রকিব হাসানের ‘ক্যাম্পাসে ভূত’ (চতুর্থ পর্ব)

অলংকরণ: ধ্রুব এষ

বাড়ি ফিরে কিশোর দেখল, ওর দেরি দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন মেরি চাচি। তাড়াতাড়ি টেবিলে খাবার বেড়ে দিলেন। খাওয়া সবে শেষ করেছে কিশোর, এই সময় বাজল টেলিফোন। প্রফেসর রিড জনসন।

‘একটা কথা মনে পড়ল,’ টেলিফোনে বললেন তিনি, ‘সে জন্যই ফোন করলাম। লরার বাসা যে অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটায়, তার কাছে পুরোনো একটা কেবিন আছে। ওই কেবিনে বসে বসে মাঝেমধ্যে কবিতা লিখতেন লরা।’

‘কবিতা?’ বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

হাসলেন জনসন। ‘শুনলে পাগলামিই মনে হবে, জানি। কিন্তু বাইরে থেকে কট্টর স্বভাবের মনে হলেও ভেতরে একটা রোমান্টিক মন ছিল লরার, যেটার কথা আমি ছাড়া ফ্যাকাল্টির আর কেউ জানে না। তাঁর সব বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম ক্যাম্পাসের ভেতরে বসে করলেও কবিতা লেখার বেলায় তিনি বাইরে চলে যেতেন, তুমি চলে যাওয়ার পর মনে হয়েছে আমার। কবিতার কথা মাথায় আসতেই কেবিনটার কথা মনে পড়ল। আমি যতদূর জানি, ওটাতে কখনো তল্লাশি চালানো হয়নি। আমি ভাবছি, দেখতে যাব। তুমি আসবে নাকি? তাহলে একসঙ্গে যেতে পারি।’

সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল কিশোর। প্রফেসর জানান, ২০ মিনিটের মধ্যে বাড়ি থেকে তুলে নেবেন ওকে।

কিছুক্ষণ পর, বনের ভেতরে প্রফেসর জনসনের সঙ্গে পুরোনো কেবিনটার দিকে এগিয়ে চলল কিশোর। অন্ধকার হয়ে গেছে। একটা ফ্যাকাশে সোনালি চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। দেখে মনে হচ্ছে, ভুতুড়ে আলখেল্লার আড়ালে থেকে যেন কাঁপছে চাঁদটা।

‘কেবিনটা কার?’ কিশোর জিগ্যেস করল।

‘কারোর না। খালি, পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে—আমি স্টোনভিলে আসার পর থেকেই দেখছি। এখানে আসার সময় সঙ্গে করে একটা ডেক চেয়ার আর পোর্টেবল ল্যাম্প নিয়ে আসতেন লরা। সাধারণত গরমের বিকেলগুলোতেই আসতেন তিনি। এখানে বসে বই পড়তেন। লিখতেন।’

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিশোর। অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে। প্রফেসরের হাত খামচে ধরল। ফিসফিস করে বলল, ‘দেখুন!’

গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা আবছা ছায়ামূর্তি। সামান্য দূরে। গায়ে একটা আলখেল্লা। মাথায় হুড। লরার ভূতটা যে পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়, ঠিক সে রকম।

ফ্যাকাল্টি ক্লাবে পাওয়া মেসেজটার কথা মনে পড়ল কিশোরের। তাতে লেখা ছিল: আমার বিশ্বাস, প্রেতজগতের কোনো প্রেতাত্মা ভর করতে চাইছে ছেলেটার ওপর। ভেবে গায়ে কাঁটা দিল কিশোরের। হাতের লোম খাড়া হয়ে গেল।

মনে হলো, ওদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে ছায়ামূর্তিটা। তাড়াতাড়ি গাছের আড়ালে চলে গেল। তবে যাওয়ার আগে মুখ ফিরিয়ে তাকাল একবার ওদের দিকে। ওটার কুৎসিত ক্ষতবিক্ষত ফ্যাকাশে সাদা ভুতুড়ে মুখটা ভালোমতোই দেখতে পেল কিশোর।

চোখের পলকে বনের অন্ধকার ছায়ায় হারিয়ে গেল ছায়ামূর্তিটা।

‘চলুন!’ প্রফেসরের হাত ধরে টানল কিশোর। ‘ওটার পিছু নিই!’

সামনে এগোল কিশোর। পেছনে জনসন। তাড়াহুড়ো করে এগোতে গিয়ে ঝোপের লতায় পা বেঁধে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন প্রফেসর। ফিরে এসে হাত ধরে তাঁকে টেনে তুলল কিশোর। তাতে সময় নষ্ট হলো।

ফিরে তাকিয়ে হাতের টর্চটা জ্বালল কিশোর। গাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। বনের ভেতরে টর্চের আলো ফেলে, এদিক-ওদিক সরিয়ে, ভালোমতো খুঁজল। কিন্তু গাছের ফাঁকে কোথাও আর দেখা গেল না ছায়ামূর্তিটাকে। সে যখন প্রফেসরকে তুলতে ব্যস্ত, সে সময় পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে ভূতটা।

হতাশ কণ্ঠে বিড়বিড় করল কিশোর, ‘আর পিছু নিয়ে লাভ নেই!’ প্রফেসরের দিকে ফিরে বলল, ‘চলুন, যেখানে যাচ্ছিলাম। কেবিনটা দেখি।’

স্যাঁতসেঁতে, শূন্য কেবিন। দুটো জানালার একটায় কাচ নেই। আরেকটায় যাও-বা আছে, তাও ভাঙা। ছাতের একটা বড় ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। ঘরে আসবাব বলতে রয়েছে একটা নড়বড়ে চেয়ার, আর এক কোণে একটা স্টোভ।

হঠাৎ ঘরের এক কোণে একটা বাক্স চোখে পড়ল কিশোরের। টিনের তৈরি দুধ রাখার পুরোনো বাক্স। এগিয়ে গিয়ে ডালাটা উঁচু করল ও। ভেতরে টর্চের আলো ফেলতেই উত্তেজিত চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে। ভেতরে কতগুলো কাগজ।

কাগজগুলো তুলে নিয়ে দেখতে শুরু করল কিশোর। একটা কাগজেই শুধু কবিতা লেখা রয়েছে। হাতে লেখা। বাকি কাগজগুলো টাইপ করা। নিচে লরা ওয়াইল্ডারের নাম লেখা সই। দ্রুত লেখাটা পড়ে ফেলে মুখ তুলে প্রফেসরের দিকে তাকাল কিশোর। বলল, ‘এটা একটা দলিল। লরা ওয়াইল্ডার তাঁর সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি প্রিয় বোনঝি টিনা হার্বার্টকে দিয়ে গেছেন!’

‘দেখি!’ কিশোরের হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে টর্চের আলোয় পড়ে মৃদু শিস দিয়ে উঠলেন জনসন। ‘হঠাৎ করেই বড়লোক হয়ে গেল টিনা!’

‘হ্যাঁ! সে রকমই মনে হচ্ছে, তাই না?’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ‘দলিলগুলো আমার চাচার কাছে নিয়ে যাই, কী বলেন? চাচার একজন উকিল বন্ধু আছেন। তাঁকে দেখালে ভালো হয়।’

ঘোরের মধ্যে যেন মাথা ঝাঁকালেন প্রফেসর। ‘একের পর এক এইসব অদ্ভুত ঘটনা! আশ্চর্যই লাগছে! নিয়ে যাও। সেটাই ভালো হবে।’

কাগজগুলো বাড়ি নিয়ে এল কিশোর। চাচাকে দেখাল। উল্টেপাল্টে দেখে রাশেদ পাশা বললেন, ‘এভাবে দেখে তো কিছু বোঝা যাবে না। উকিলকে দেখিয়ে শিওর হতে হবে।’

‘হ্যাঁ, সে জন্যই তো আনলাম।’

ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে দুজনে, এ সময় ঘরে ঢুকল মুসা ও রবিন। চোখ বড় বড় করে কিশোরের কাছে সব ঘটনা শুনল দুজনে। বনের ভেতর দেখা ভূতটার কথা শুনে আঁতকে উঠল মুসা।

‘বলো কী?’ রবিন বলল। ‘ভূতটা তাহলে সত্যিই ঘুরে বেড়ায় বনের ভেতরে?’

‘যেভাবে ভূতের বর্ণনা দিলে,’ কিশোরকে বলল মুসা, ‘আজ রাতে শিওর দুঃস্বপ্ন দেখব আমি।’

একটা বুদ্ধি এল কিশোরের মাথায়। বলল, ‘কাল তোমাদের দুজনকে একটা কাজ করতে হবে। করবে?’

‘কী?’ জানতে চাইল রবিন।

‘আমার হয়ে খানিকটা গোয়েন্দাগিরি।’

রাজি হয়ে গেল দুজনেই। কী করতে হবে, খুলে বলল তখন কিশোর। টিনা হার্বার্টের পিছু নিতে। অনুসরণ করে দেখতে হবে—ও কোথায় যায়, কী করে। তারপর চাচাকে দিয়ে স্টোনভিল হোটেলের হাউস ডিটেকটিভকে ফোন করাল। ডিটেকটিভ ওর চাচার বন্ধু। মুসা ও রবিনকে সাহাঘ্য করতে তাঁকে বলে দিলেন রাশেদ পাশা।

আরও পড়ুন