পুরোনো টাওয়ার (পঞ্চম পর্ব)

অলংকরণ: তুলি

নয়

‘শহরের বাইরে ছোট্ট একটা বাসা নিয়েছি আমরা,’ জানাল বব। ‘সস্তা ভাড়ার। প্রতিবেশীরাও খুব একটা সুবিধার নয়। কিন্তু কী আর করা, মানিয়ে নিতে হবে।’

মনে মনে বন্ধুর প্রশংসা করল গোয়েন্দারা। ফালতু অহংকারের বালাই নেই ছেলেটার। যখন যেমন তখন তেমন, পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে মোটেও পিছপা নয়। ‘কিন্তু এর মধ্যে বাবার কোনো চাকরি না হলে, আমাকেই ফুলটাইম কাজে নেমে পড়তে হবে।’

‘কী বলছ? তাহলে তো স্কুল ছাড়তে হবে তোমাকে!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন।

‘উপায় নেই। ছাড়তে তো চাই না, জানোই তো একটা স্কলারশিপের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু...’ মুখ নিচু করল বব।

এবার যেন উপলব্ধি করল গোয়েন্দারা, কী পরিস্থিতিতে স্কুল ছাড়তে হচ্ছে ববের। কতটা কষ্ট হবে ওর! অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখত সে। ক্লাসের সেরা দশজন ছাত্রের একজন। সব সময় চেয়েছে, স্কুলের পাঠ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। স্কুলের টিচাররাও ওর ব্যাপারে উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। বলেন, একদিন খুব ভালো ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে বব। এখন দেখা যাচ্ছে, বাবার এই দুর্ভাগ্যের কারণে ওর সব স্বপ্ন ব্যর্থ হতে চলেছে।

ববের কাঁধে হাত রাখল কিশোর। ‘মাথা তোলো তো,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল সে। ‘কেসটার শেষ না দেখে ছাড়ছি না আমরা!’

‘তোমরা সবাই খুব ভালো,’ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেল ওর গলায়। ‘তোমাদের এই সহযোগিতার কথা সহজে ভুলছি না অমি।’ হাসার চেষ্টা করল সে। তবে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই তার। হেঁটে চলে যাওয়ার সময় ওর সেই স্বতঃস্ফূর্ত, লঘু ভাবটা আর খুঁজে পেল না গোয়েন্দারা।

‘তো, এখন কী করব আমরা, কিশোর?’ রবিনের প্রশ্ন।

‘প্রথমেই ওই গয়নাগুলোর পরিপূর্ণ বিবরণ জোগাড় করতে হবে। ওগুলো কোথাও বিক্রির চেষ্টা করতে পারে চোরটা। চলো, পুরোনো গয়নার দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখি, কিছু পাই কি না।’

‘গুড আইডিয়া। যদিও পুলিশ হয়তো এতক্ষণে কাজটা সেরে ফেলেছে।’

হাসল কিশোর। তারপর আবার গম্ভীর হয়ে গেল। ‘বিলসন কি গয়নাগুলোর লিস্ট দেবেন বলে মনে হয় তোমার?’

‘ওঁর কাছে চাওয়ার দরকারটা কী? রাশেদ আঙ্কেলের কাছেই তো থাকার কথা তথ্যটা।’

‘তাহলে চলো এখনই গিয়ে দেখি।’

বাড়ি ফিরে দেখল, ওদের জন্য অপেক্ষা করছেন রাশেদ পাশা। ‘তোমাদের জন্য একটা সংবাদ আছে,’ বললেন তিনি। ‘অ্যাকসিডেন্ট করা গাড়িটা চোরাই বলে তোমরা যে ধারণা করেছিলে, সেটাই ঠিক। এইমাত্র ফোন করেছিল ফ্লেচার। ইঞ্জিন নাম্বার ধরে আসল মালিক নাকি শনাক্ত করেছে ওটা। গাড়িটা কটনউডের এক ভদ্রলোকের।’

‘দারুণ। এতে আরেকটা আঘাত পড়বে চোরের মাথায়।’ বলল রবিন।

কিন্তু পরমুহূর্তে ওদের আনন্দে ভাটা পড়ল, যখন রাশেদ পাশার কাছে গয়নার লিস্টের কথা বলল ওরা।

‘আমার কাছে যতটুকু তথ্য আছে, তা দিতে তো কোনো আপত্তি নেই আমার,’ বললেন রাশেদ পাশা, ‘কিন্তু ওতে কতটুকু কী কাজ হবে সেটাই কথা। কারণ, জানিই তো তথ্যটা কেন চাইছ তোমরা।’

‘কেন?’

‘পুরোনো গয়নার দোকানগুলোয় ঢুঁ মেরে দেখবে কোথাও ওগুলোর খোঁজ পাওয়া যায় কি না।’

‘হুঁ!’ ভোঁতা গলায় বলল কিশোর।

মুচকি হাসলেন মি. পাশা। ‘কেসটা নেওয়ার ঘণ্টাখানেকের ভেতর গয়নার পূর্ণ তালিকা নিয়ে, শহরের সব গয়নার দোকানে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। শুধু তা–ই নয়, আশপাশের শহরগুলোর সব জুয়েলারি ফার্ম আর পুরোনো গয়নার দোকানেও পাঠিয়েছি ওই তালিকা। সেই সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশকেও জানিয়ে রেখেছি। এই যে ডুপ্লিকেট একটা তালিকা, চাইলে নিতে পারো। তবে দোকানে দোকানে ঘুরলে অযথাই সময় নষ্ট করবে। পুলিশ তো বটেই, সব ব্যবসায়ীও এখন ওই গয়নার খোঁজ করছে।’

যন্ত্রের মতো হাত বাড়িয়ে তালিকাটা নিল কিশোর। ‘আর কী না ভেবেছিলাম, কী দারুণ একটা আইডিয়াই না বের করেছি!’

‘দারুণ আইডিয়া তো বটেই। তবে আগেও এটা ব্যবহার হয়েছে, এই যা। বেশির ভাগ রত্ন চুরির সমাধানই এই পদ্ধতিতে করা হয়েছে। অর্থাৎ চোর ওগুলো বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।’

‘বুঝলাম,’ গোমড়ামুখে বলল রবিন। ‘প্ল্যানটা মাঠে মারা গেল, আর কী। চলো তো, কিশোর। অন্য কিছু ভেবে বের করি।’

‘পুরস্কারের আশায়?’ মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন মি. পাশা।

‘হ্যাঁ। আর সেটা পাবই আমরা!’

‘আশা করি, পাও। কিন্তু আমার কাছে আর সাহায্য চাইতে পারবে না। যতটুকু করেছি, ব্যস। মনে রেখো, কেসটা কিন্তু আমারও। কাজেই এখন থেকে তোমরা আর আমি, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ!’

‘ঠিক আছে!’

‘এগিয়ে যাও!’ হাসতে হাসতে নিজের ডেস্কে ফিরে গেলেন মি. পাশা।

দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে বিভিন্ন জুয়েলারি আর এজেন্সির একগাদা রিপোর্ট এসেছে তাঁর হাতে। যেসব জায়গায় তিনি চুরি যাওয়া গয়না আর সিকিউরিটিগুলো সম্পর্কে খবর চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু রিপোর্টগুলোর সব কটার বক্তব্য একই। টাওয়ার ম্যানশন থেকে চুরি যাওয়া কোনো রত্ন বা বন্ডের কোনো খোঁজ নেই।

কিশোরের চাচার স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে এসে পেছনের বারান্দার সিঁড়িতে বসল ছেলেরা।

‘এবার কী করব?’ জানতে চাইল রবিন।

‘জানি না। কীভাবে আমাদের ঘোল খাইয়ে দিল চাচা, দেখলে?’

‘হুঁ, তাই তো দেখলাম। কিন্তু ভালোই হয়েছে তাতে। অনেক পরিশ্রম থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’

‘ঠিকই, ঘুরপাক খেয়ে মরতে হতো আমাদের,’ কিশোরের স্বীকারোক্তি। মাথার চুলে আঙুল চালাল সে। ‘মনে হচ্ছে, কেসটায় খানিকটা এগিয়ে রয়েছে চাচা— অন্তত শহরের ভেতরে তো বটেই।’

‘কী বলতে চাইছ?’ রবিনের প্রশ্ন।

শহরের বদলে অন্যখানে নজর দিতে। চোরটার পেছনে লেগেছিলাম আমরা, কারণ মুসার গাড়ি চুরি করেছিল সে। চলো, সেখান থেকেই আবার শুরু করি।’

‘তার মানে?’

‘মুসার গাড়ি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে লাল-পরচুলা পরা লোকটা ওই জঙ্গলে আবার ফিরেও আসতে পারে, সে ক্ষেত্রে...’

‘তার মানে বলতে চাও, লোকটা নিজের অজান্তে কোনো সূত্র ফেলে যেতে পারে, তাই তো?’

‘একেবারে ঠিক।’

আবারও উত্সাহে চনমনিয়ে উঠল দুই গোয়েন্দা। হাঁক দিয়ে মেরি চাচিকে জানিয়ে দিল, কোথায় যাচ্ছে ওরা। তারপর ছুটল মোটরসাইকেল নিয়ে। পিকনিক সাইটে এসে আগের মতোই পার্কিং করে, রওনা হলো সেই জনশূন্য জায়গাটায়। মুসার জেলোপি লুকানো ছিল যেখানে।

সবকিছু যেমন দেখে গিয়েছিল, তেমন আছে বলেই মনে হলো। তারপরও সাবধানে মাটি পরীক্ষা করতে লাগল কিশোর আর রবিন, পায়ের ছাপ পাওয়া যায় কি না দেখতে। তেমন কিছু পেল না বটে, তবে নির্দিষ্ট দূরত্বে একটা করে গোল দাগের দিকে ইশারা করল রবিন। ইঞ্চি ছয়েক চওড়া।

গোল দাগগুলো পরীক্ষা করল কিশোর আর রবিন।

‘ঠিক একজন বড় মানুষের পায়ের মাপের,’ বলল রবিন। ‘আগে কিন্তু লক্ষ করিনি এগুলো।’

‘আমার চোখেও পড়েনি,’ বলল কিশোর। ‘কী মনে হয়, চোরটা কি জুতোর সঙ্গে প্যাড বেঁধে নিয়েছিল ছাপ লুকানোর জন্য?’

‘চলো, কোথায় গিয়েছে, দেখি।’

গোল দাগগুলো অনুসরণ করে জঙ্গলের দিকে এগোতে লাগল ছেলেরা। খুব বেশি দূর যেতে হলো না। হঠাৎই উত্তেজনার ছাপ ফুটল ওদের চোখে–মুখে।

‘আরেকটা সূত্র!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘আর সূত্রটা দারুণ!’

‘মনে হয়,’ খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে কিশোরের। ‘এগুলো দেখালে চাচা আমাদের খাতির করে দলে ভিড়িয়ে নেবে!’

‘এক মিনিট,’ বলল রবিন। ‘আমরা না এখন প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ? আমাদের দুজনের না রহস্যটার সমাধান করে পুরস্কার জিতে নেওয়ার কথা?’

মাটি থেকে দোমড়ানো একটা ফেল্ট হ্যাট আর একটা পুরোনো জ্যাকেট তুলল কিশোর। ‘এগুলো চোরের হলে, আমার ধারণা, টাকাটা ইতিমধ্যে আমাদের প্রাপ্য হয়ে গেছে!’

জ্যাকেটের পকেট হাতড়াল সে। খালি। ‘এটার মধ্যে কোনো সূত্র নেই,’ বলল সে।

‘এই হ্যাটটার গায়ে অবশ্য লেবেল আঁটা আছে—লস অ্যাঞ্জেলেস স্টোর,’ রবিন বলল।

‘জ্যাকেটেরও তাই,’ যোগ করল কিশোর। ‘একই দোকানের। একটা ব্যাপার শিওর। জিনিসগুলো চোরের হলে, কখনোই এগুলো ইচ্ছে করে ফেলে যায়নি সে। ও জানে, লেবেলগুলো ওর বিপদ ডেকে আনতে পারে।’

‘নিশ্চয়ই ভয়ে ফেলে গেছে,’ অনুমান করল রবিন। ‘যখন দেখেছে, মুসার জেলোপির খোঁজ পেয়ে গেছি আমরা, তখন তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে ভুলে ফেলে রেখে গেছে।’

‘এখন আমাদের যেটা দেখতে হবে,’ বলল কিশোর, ‘ওই লাল উইগের কোনো চুল লেগে আছে কি না হ্যাটে।’

‘ঠিক,’ হাসল রবিন। হ্যাটটাকে নিয়ে এমন একটা জায়গায় দাঁড়াল সে, যেখানে গাছের ফাঁক গলে সূর্যের আলো সরাসরি এসে পড়ছে টুপিটার গায়ে। খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ভেতরটা। কানা উল্টে দেখাও বাদ দিল না। ‘ইয়াহু! পেয়ে গেছি!’ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল।

লাল চুল দুটোর দিকে তাকাল কিশোর। হুবহু কুড়িয়ে পাওয়া সেই লাল উইগের চুলের মতো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন। ‘এখন মনে হচ্ছে আঙ্কেলকে আর না বলে উপায় নেই, উইগটা তার কাছে।’

‘ঠিকই।’

মূল্যবান সূত্রগুলো শক্ত করে ধরে, বাড়ির দিকে ছুটল কিশোর আর রবিন। ওরা যখন পৌঁছাল, তখনো নিজের স্টাডিরুমেই আছেন মি. পাশা। ওদের এত তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে স্পষ্ট বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। সংশয় দেখা দিল দৃষ্টিতে।

‘অ্যাঁ! আরও সূত্র নাকি!’ উত্তেজনা প্রকাশ পেল তাঁর কণ্ঠে।

‘হ্যাঁ!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ওদের অভিযানের কথা খুলে বলে জ্যাকেট আর হ্যাটটা নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। ‘তোমার কাছে জমা দিতে এনেছি এগুলো।’

‘কিন্তু আমার তো ধারণা ছিল তোমরা দুজন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে কাজ করছিলে।’

‘সত্যি বলতে কী চাচা,’ স্বীকার করল কিশোর, ‘সূত্রগুলো কীভাবে কাজে লাগাব বুঝতে পারছি না আমরা। লস অ্যাঞ্জেলেস সিটির দিকে ইঙ্গিত করছে এটা।’

লেবেল আর চুলগুলো দেখাল কিশোর। সামনে ঝুঁকে এলেন মি. পাশা।

‘তা ছাড়া আরেকটা ব্যাপার,’ বলে চলল কিশোর, ‘আমাদের ধারণা, পোশাকগুলো চোরের কি না, তা প্রমাণ করার একমাত্র উপায় হলো, সেই লাল উইগটার সঙ্গে এই চুলগুলো মিলিয়ে দেখা। কিন্তু উইগটা তো আমাদের কাছে নেই।’

মুচকি হেসে ফাইল কেবিনেট থেকে উইগটা বের করে আনলেন মি. পাশা। ‘চিফ ফ্লেচার রেখে গেছে এটা।’

উইগের চুলের সঙ্গে হ্যাটের পাওয়া চুল দুটো হুবহু মিলে গেল!

‘নিঃসন্দেহে তোমরা দুজনে দারুণ কাজ দেখিয়েছ,’ ছেলেদের প্রশংসা করলেন মি. পাশা। হাসলেন তিনি। ‘কাজেই তোমাদের ছোট্ট একটা গোপন কথা বলা যেতে পারে। চিফ ফ্লেচার আমাকে দেখতে বলেছে উইগ থেকে কিছু পাওয়া যায় কি না। ও নাকি কোনো প্রস্তুতকারকের নাম পায়নি ওটায়।’

‘নাম আছে নাকি?’ রবিনের প্রশ্ন।

দশ

আলো ঝিলিক দিল মি. পাশার চোখে। ‘মনে হয়, ফ্লেচারের সহকারী লোকটা ভালো করে পরীক্ষা করেনি। সে যা–ই হোক, ভেতরে আরেকটা লাইনিং আবিষ্কার করেছি আমি, যেটাতে প্রস্তুতকারকের নাম আছে। লস অ্যাঞ্জেলেস সিটির এক লোক। ভাবছিলাম, লস অ্যাঞ্জেলেস সিটিতে গিয়ে দেখা করব ওর সঙ্গে। এখন তোমরা আরেকটা সূত্র দেওয়ায়, যাওয়ার উদ্দেশ্য ডাবল হয়ে গেল।’

খুশিতে ঝলমল করে উঠল কিশোর আর রবিনের চোখ–মুখ। কিন্তু পরক্ষণেই আবার কালো হয়ে গেল।

‘কী সমস্যা?’ জানতে চাইলেন মি. পাশা।

‘আপনি তো একাই কেসটা সমাধান করে ফেলতে যাচ্ছেন।’ ম্লান গলায় বলল রবিন।

‘করলে অসুবিধা কী?’ মিটিমিটি হাসছে রাশেদ পাশার চোখ। ‘এখন শোনো, যে লোক উইগটা কিনেছিল, সে হয়তো তার নাম বলেনি। কিংবা হয়তো বহুদিন আগে কিনেছিল, নাম বলে থাকলেও বিক্রেতার সেটা মনেই নেই। একই কথা খাটে জ্যাকেটের বেলায়ও।’

আবার উজ্জ্বল হয়ে গেল ছেলেদের মুখ। ‘তাহলে তো, কেসটার সমাধান এখনো বহুদূর।’

‘হতে পারে। তবে সন্দেহ নেই, এগুলো খুব ভালো সূত্র,’ বললেন মি. পাশা। ‘অনেক সময় দেখা যায়, যে দোকান থেকে জিনিস কেনে সন্দেহভাজন লোকটা, তার আশপাশেই কোথাও বাস করে। যদিও সম্ভাবনাটা সামান্যই। তবে কোনো কিছুকেই উপেক্ষা করা যাবে না।

জিনিসগুলো নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস যাব আমি। দেখব কিছু করা যায় কি না। অনেক কিছু হতে পারে, আবার কিছুই না-ও হতে পারে। শূন্য হাতে যদি ফেরত আসি, হতাশ হইয়ো না যেন। আবার বিশেষ কোনো তথ্য নিয়ে ফিরতে দেখলেও অবাক হইয়ো না।’

উইগ, হ্যাট আর জ্যাকেটটা ডেস্কের পাশে থাকা খোলা একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন তিনি। তদন্তের কাজে হঠাৎ হঠাৎ বিনা নোটিশে বিভিন্ন জায়গায় ছুট দিতে হয় মি. পাশাকে। তাই সব সময় তিনি ব্যাগ গুছিয়ে রেডি করে রাখেন।

‘এখন রওনা হয়ে কোনো লাভ নেই,’ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। ‘তবে সকালে উঠে প্রথমেই ওখানে রওনা হব। এর ভেতর তোমরা দুজন চোখ–কান খোলা রাখবে, দেখবে আর কোনো সূত্র পাও কি না। কেসটা কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি।’

ডেস্কের ওপর রাখা কিছু কাগজ তুলে নিলেন মি. পাশা। ওদের দিকে আর তাকালেন না। আলোচনা শেষ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে এল ছেলেরা।

ওই রাতে বিছানায় গেল ওরা মহা উত্তেজনা নিয়ে। ঘুম আসছে না।

‘বহুত সেয়ানা চোর।’ বিড়বিড় করল রবিন।

‘অপরাধীরা যত সেয়ানা হয়, তাদের পরিণতিও তত খারাপ হয়।’ কিশোর বলল। ‘এই চোরটার যদি কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকে, ধরতে খুব বেশি সময় লাগবে না চাচার। আমি চাচাকে বলতে শুনেছি, চালাক অপরাধী বলে কিছু নেই। সত্যিকারের চালাক হলে সে কখনো অপরাধী হতো না।’

‘ঠিক। কথাটা যে সত্য, তা আমিও মানি। আসলে বলতে চাইছি, আমরা যার পেছনে লেগেছি সে কোনো আনাড়ি চোর নয়। ব্যাটা বহুত পিছলা ধড়িবাজ।’

‘ওই পিছলাতে আর কাজ হবে না এখন। চাচার হাতে যখন কয়েকটা সূত্র এসে গেছে, ব্যাটার আর নিস্তার নেই তার হাত থেকে।’

‘আর আমরা আছি, সেটাও ভুলো না,’ হাই তুলল রবিন। ঘুমিয়ে পড়ল ছেলেরা।

পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে গিয়ে শুনল কিশোর আর রবিন, ভোরের প্লেনে লস অ্যাঞ্জেলেস রওনা দিয়েছেন মি. পাশা। ‘ভালোয় ভালোয় ফিরে এলেই বাঁচি,’ মেরি চাচি বললেন। ‘মাঝে মাঝেই তো দেখি, বিপদ-আপদে পড়ে।’

মেরি চাচি বলে চললেন, মি. পাশা কথা দিয়ে গেছেন, রাতের খাবারের আগে ফিরতে না পারলে ফোন করে জানাবেন। হঠাৎই প্রলোভন জাগানো হাসি হেসে যোগ করলেন তিনি, ‘বলে গেছে, যদি লস অ্যাঞ্জেলেসে তাকে থেকে যেতে হয়, তাহলে কিসের নাকি একটা সারপ্রাইজ আছে তোদের জন্য!’

ব্যস, এটুকুই। আর কিছু বলতে পারলেন না চাচি, কিংবা কোনো কারণে বললেন না। তবে কোথায় যেন একটা রহস্য রহস্য ভাব—মনে হলো কিশোরের।

যা-ই হোক স্কুলে গেল ছেলেরা। কিন্তু একবিন্দু মন বসল না পড়ালেখায়। খালি ভাবছে, মি. পাশা কী করছেন লস অ্যাঞ্জেলেসে, আর সারপ্রাইজটাই বা কী হবে?

বব পিটারসন স্কুলে এসেছে এদিন। তবে ক্লাস শেষে জানাল ও, একেবারে নাকি চলে যাচ্ছে এখান থেকে।

‘পড়ে আর কী হবে।’ বলল সে। ‘বাবা আর স্কুলের খরচ জোগাতে পারবে না আমার। তা ছাড়া পরিবারের দেখভাল করার দায়িত্বও এখন আমার ওপরই পড়েছে। কাল থেকে সুপারমার্কেটে কাজ শুরু করব আমি।’

‘তুমি না কলেজে পড়তে চেয়েছিলে!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ‘তার কী হবে!’

‘উপায় তো নেই,’ ভারী গলায় বলল বব। ‘এ পর্যন্ত যে পড়তে পেরেছি, সে–ই ঢের। ওই সব কলেজ–টলেজে পড়ার চিন্তা করে আর কী হবে আমাদের মতো গরিবদের, কর্মজগতে ঢুকতে হবে এখন। এক দিক দিয়ে ভালোই হলো, গোড়া থেকেই সুপারমার্কেটের কাজগুলো শিখে ফেলতে পারব। কী কাজ নিয়েছি জানো? মালপত্র তদারকির।’ একটু থেমে হাসল। ‘হয়তো বছর পঞ্চাশেকের ভেতর একটা স্টোরের মালিকও হয়ে যেতে পারি!’

‘তুমি যেটা করবে, তাতেই ভালো করবে,’ সান্ত্বনা দিল রবিন। ‘কিন্তু খারাপ লাগছে, কলেজে পড়ার যে প্ল্যান করেছিলে তুমি, সেগুলো আর হচ্ছে না। এখনই আশা ছেড়ো না, বব। কী হবে, তা তো আর কেউ বলতে পারে না। হয়তো টাওয়ার ম্যানশনের ডাকাতটা ধরাও পড়ে যেতে পারে।’

আগের দিন পাওয়া সূত্রগুলোর কথা ববকে বলতে চেয়েছিল কিশোর আর রবিন। কিন্তু একই কথা মনে হলো দুজনের। যদি কোনো ভুলভাল হয়ে যায়, তাতে খামোখা মিথ্যে আশা জোগানো হবে ওকে। কাজেই শুভেচ্ছা জানিয়ে ওরা বিদায় নিল ওর কাছ থেকে। হাসিখুশি থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বব। কিন্তু চলে যাওয়ার সময় মুখের হাসিটা বড় করুণ দেখাল ওর।

‘ইশ্‌, খুব খারাপ লাগছে ওর জন্য,’ বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে রবিনকে বলল কিশোর। ‘স্কুলে ভালো করার জন্য অনেক পরিশ্রম করত, আর কলেজে পড়া নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল।’

‘টাওয়ার ডাকাতির রহস্য ভেদ করতেই হবে আমাদের। এটাই এখন একমাত্র কাজ!’ ঘোষণা করে দিল রবিন।

বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চলার গতি বেড়ে গেল কিশোরের। ওদের চাচা কি চোরটাকে চেনার মতো কোনো তথ্য নিয়ে ফিরেছেন লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে? নাকি এখনো ওখানেই আছেন? আর সারপ্রাইজটাই বা কী?

প্রথমেই গ্যারেজে এসে থামল কিশোর আর রবিন। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল, শুধু মেরি চাচির গাড়িটাই আছে। মি. পাশা তাঁর সেডান চালিয়ে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন, এখনো সেটা ফেরেনি।

‘আঙ্কেল এখনো আসেনি!’ উত্তেজনায় ফেটে পড়ল রবিন। ‘এখন জানতে পারব, সারপ্রাইজটা কী।’ রান্নাঘরের দিকে ছুটে যেতে যেতে ডেকে উঠল সে, ‘আন্টি!’

‘এই যে আমি দোতলায়,’ পাল্টা ডাক শোনা গেল মেরি চাচির।

সামনের সিঁড়ি দিয়ে, একেক লাফে দুই ধাপ টপকে ওপরতলায় ছুটল ছেলেরা। ওদের বেডরুমের দরজায় দেখা হয়ে গেল মেরি চাচির সঙ্গে। মুখে চওড়া হাসি নিয়ে, কিশোরের বিছানায় পড়ে থাকা একটা গোছানো সুটকেসের দিকে ইশারা করলেন তিনি। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ছেলেরা।

পোশাকের পকেটে হাত ঢোকালেন তিনি, যেন জাদুর মতো হাতে বেরিয়ে এল একজোড়া প্লেনের টিকিট আর কিছু ডলার। ছেলেদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে টিকিট আর ডলারের তোড়ার অর্ধেকটা ধরিয়ে দিয়ে একবার কিশোরের দিকে, একবার রবিনের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘তোমার আঙ্কেল বলেছে, লস অ্যাঞ্জেলেসে গিয়ে যেন তোমরা কেসটার ব্যাপারে সাহায্য করো তাকে।’

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত মুখে কথা ফুটল না কিশোর আর রবিনের। পরক্ষণেই লাফিয়ে উঠল। শুরু হলো হট্টগোল। খুশির চোটে কিশোর তো গিয়ে চাচিকে জড়িয়েই ধরল।

‘কী দারুণ, কী দারুণ! অবিশ্বাস্য!’ চিত্কার করে উঠল রবিন। ‘চমক বটে একটা!’

আহ্লাদে আটখানা হয়ে চাচির মুখের দিকে তাকাল কিশোর। ‘নিশ্চয় দিনভর ছোটাছুটি করে কেটেছে তোমার—প্লেনের টিকিট জোগাড়, টাকা তোলা। ইশ্, তুমিও যদি যেতে!’

হাসলেন মেরি চাচি। ‘তোদের সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেস যদি যেতেই হয়, বেড়ানোর জন্য যাব। থানা-পুলিশ আর চোর-ডাকাতের পেছনে ছোটাছুটি করে আনন্দ মাটি করার জন্য নয়! যাকগে, চলো, নিচে চলো। খাবার বেড়ে রেখেছি, ঝটপট খেয়ে নে। তারপর এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসব।’

ঘণ্টা দুয়েকের ভেতর লস অ্যাঞ্জেলেসগামী এরোপ্লেনে চেপে বসল ছেলেরা। লস অ্যাঞ্জেলেস এয়ারপোর্টে নামতেই মি. পাশার দেখা পেল। ওদের নিয়ে এলেন তাঁর হোটেলে। নিজের পাশের রুমটাই নিয়ে রেখেছেন ওদের জন্য। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি রহস্যটা সম্পর্কে।

‘ইন্টারেস্টিং মোড় নিয়েছে কেসটা,’ এতক্ষণে মুখ খুললেন তিনি। ‘অনেক কিছু যাচাই করার ব্যাপার আছে। সে কারণেই মনে হলো, তোমাদের সাহায্য লাগতে পারে আমার।’

‘এযাবৎ যা যা হলো বলো না আমাদের,’ উত্সুকভাবে অনুরোধ করল কিশোর।

মি. পাশা জানালেন, ‘শহরে পা দিয়েই লাল পরচুলা প্রস্তুতকারী কোম্পানিটির অফিসে গিয়েছিলাম। ম্যানেজারের কাছে আমার কার্ড পাঠালে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় আমাকে। ‘লাল পরচুলাটা যখন ম্যানেজারের সামনে রাখলাম, সে বলল, “আমাদের কোনো কাস্টমার কি কোনো ঝামেলায় জড়িয়েছে, মি. পাশা?”’

“‘এখনো নয়। তবে এই চুলের খরিদ্দারের সন্ধান পেলে বোঝা যাবে, ঝামেলায় জড়িয়েছে কি না,’’ বললাম আমি।’

‘পরচুলাটা তুলে নিল ম্যানেজার। ভালো করে দেখে কপাল কুঁচকাল। তারপর বলল, “শুধু বিশেষ কিছু নাটকের লোকজনের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা। আশা করি, ওইসব অভিনেতার কেউ কোনো ঝামেলা করেনি।”’

‘“ওটা কে কিনেছিল বলতে পারবেন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।’

‘“আমরা শুধু অর্ডারের উইগ বানাই,” বলল ম্যানেজার। ডেস্কের পাশের একটা বোতাম টিপে একটা বেয়ারাকে ডাকল। বলল, ‘‘ট্রুবারকে আসতে বলো।” তারপর আমাকে বলল, “জিনিসটা বের করা কঠিন হবে, উইগটা পুরোনো। বছর দুয়েক আগের ফ্যাশন এটা।”’

‘“তারপরও যদি...” আমি বললাম। এই সময় ঘরে ঢুকল, ‘চশমা পরা এক বৃদ্ধ।’

‘“এই যে ট্রুবার এসে গেছে,” বলল ম্যানেজার। “আমাদের এক্সপার্ট। উইগ সম্পর্কে জানে না, এমন কিছু নেই।” তারপর বুড়ো লোকটার দিকে ঘুরে, উইগটা দিল ওর হাতে। “মনে আছে নাকি এটার কথা, ট্রুবার?”

‘সন্দিগ্ধ চোখে পরচুলাটা দেখল বুড়ো। তারপর ছাদের দিকে তাকাল। “লাল উইগ...লাল উইগ...” বিড়বিড় করল।’

‘“বছর দুয়েক আগের না?” কথা জোগানোর চেষ্টা করল ম্যানেজার।’

‘“দেড় বছর হবে। মনে হচ্ছে, কমেডি চরিত্রে ব্যবহারের মতো। দাঁড়ান, মনে করে দেখি। এ ধরনের উইগ পরে অভিনয় করে এমন লোকের সংখ্যা গত এক–দেড় বছরে খুব বেশি ছিল না আমাদের। কে হতে পারে, কে হতে পারে...” ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করল বুড়ো। আচমকা চুটকি বাজিয়ে থমকে দাঁড়াল সে।’

(চলবে...)

আরও পড়ুন