পুরোনো টাওয়ার (ষষ্ঠ পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এগারো

‘“পেয়ে গেছি,” বলল বুড়ো। “নিশ্চয় উইগটা মোপানি কিনেছিল। হ্যাঁ, মোপানি-ই হবে! ডেনিম মোপানি। ক্রেমলিন কোম্পানির সঙ্গে শেক্‌সপিয়ারের যাত্রাপালায় অভিনয় করে সে। উইগের ব্যাপারে দারুণ খুঁতখুঁতে। যেমন চায়, ঠিক তেমনটি হওয়া চাই। এটা যে ওরই, তা আমার মনে থাকার কারণ হলো, মাসখানেক আগে এসে ঠিক এটার মতো আরেকটার অর্ডার দিয়ে গেছে সে।”’

‘“কেন অর্ডার দিয়েছিল?” জানতে চাইলাম আমি।’ রাশেদ পাশা বললেন।

‘কাঁধ ঝাঁকাল ট্রুবার। “তা তো আর বলতে পারব না। অনেক অভিনেতাই দুই সেট উইগ রাখে। ক্রিসেন্ট থিয়েটারে অভিনয় করছে মোপানি এখন। তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন না।”’

‘“আমি যাচ্ছি দেখা করতে,” বললাম ওদের। তো, এখন ওটাই করতে হবে আমাদের, বুঝলি কিশোর? রাতের খাবারের পরই কাজে নামব।’

‘এই অভিনেতাটি তো আর চোর নয়, তাই না চাচা?’ বিস্মিত প্রশ্ন কিশোরের। ‘এত তাড়াতাড়ি রকি বিচে যাতায়াত করবে কী করে? তা ছাড়া, রোজ রাতে ওর অভিনয় করতে হয় না নিশ্চয় এখানে?’

মি. পাশা স্বীকার করলেন, তাঁরও অবাক লাগছে। মুসার জেলোপিটা যেদিন চুরি হয়, সেদিনের সেই পরচুলা পরা লোকটা যে মোপানি নয়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত তিনি। কারণ ওই সময় ওই ক্রেমলিন কোম্পানির তিন সপ্তাহের যাত্রাপালা চলছিল লস অ্যাঞ্জেলেসে। যেকোনো হিসেবেই অভিনেতার চোর হওয়ার ব্যাপারটাকে অসম্ভব মনে হয়।

পর্দা ওঠার আধঘণ্টা আগে মোপানির ড্রেসিংরুমে হাজির হলো কিশোর, রবিন আর মি. পাশা। ক্রিসেন্ট থিয়েটারের এক সন্দিগ্ধ দারোয়ানের হাতে নিজের কার্ড ধরিয়ে দিলেন মি. পাশা। শেষ অবধি অবশ্য তাঁকে আর ছেলেদের ঢুকতে দেওয়া হলো ব্যাকস্টেজে। আলো ঝলমল করিডর ধরে নিয়ে যাওয়া হলো হ্যারল্ড মোপানির ড্রেসিংরুমে। বেশ শৌখিন, আরামদায়ক একটা জায়গা। দেয়ালে দেয়ালে ছবি, গলিপথের উল্টো ধারের জানালায় একটা ফুলের টব, আর মেঝেতে পুরু কার্পেট।

দুই পাশের উজ্জ্বল ইলেকট্রিক আলোর মাঝখানে, আয়নার সামনে বসে আছে মোটাসোটা, ছোট্ট একজন মানুষ। মাথায় মস্ত টাক। গভীর মনোযোগে মেকআপের ক্রিম ডলছে মুখে। আয়নায় অতিথিদের দেখতে পেয়ে, পেছনে না ঘুরেই স্বাভাবিক সুরে বসতে বলল। ঘরের একমাত্র চেয়ারটা দখল করলেন মি. পাশা। ছেলেরা বসে পড়ল কার্পেটে।

‘আপনার কথা অনেক শুনেছি, মি. পাশা,’ বিস্ময়কর রকম ভারী গলায় বলল লোকটা। এই ছোটখাটো লোকটার গলায় অমন গুরুগম্ভীর আওয়াজ অদ্ভুত শোনাল। ‘আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। তা, কী ধরনের সাক্ষাৎকার এটা, এমনিই—না কোনো পেশাগত কাজে?’

‘পেশাগত।’

‘বলে ফেলুন,’ সংক্ষিপ্ত বাক্য মোপানির। চোয়ালে মেকআপ ঘষা অব্যাহত রয়েছে।

‘এই উইগটা দেখেছেন কখনো?’ মেকআপ টেবিলের ওপর পরচুলাটা রাখলেন মি. পাশা।

আয়নার দিক থেকে ফিরে তাকাল মোপানি। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের এক অভিব্যক্তি খেলে গেল ওর চর্বিজমা গোল মুখে। ‘মনে হচ্ছে আগেও দেখেছি এটা!’ বলল সে। ‘বুড়ো ট্রুবার দেশের সেরা পরচুলা প্রস্তুতকারী এটা আমাকে বানিয়ে দিয়েছিল বছর দেড়েক আগে। তা, পেলেন কোথায় এটা? ভাবতেও পারিনি এই লাল পরচুলাটাকে আবার দেখতে পাব।’

‘কেন?’

‘চুরি গিয়েছিল। একরাতে আমি যখন স্টেজে, তখন কোত্থেকে এক ছিঁচকে চোর এসে সাফ করে দিয়ে গেল আমার ড্রেসিংরুম। কাণ্ডটা দেখুন না। আমি ব্যস্ত মঞ্চে আমার কাজে। আর এ দিকে ব্যাটা চোর সোজা ঢুকে পড়ল এখানে। ঘড়ি নিল, টাকা নিল, ড্রেসিং টেবিলের ওপর একটা হীরার আংটি ছিল, তা-ও নিল। খুব ভালো কথা, কিন্তু ব্যাটা বজ্জাত উইগগুলো নিতেও ছাড়ল না। এটা তো বটেই, আশপাশ থেকে আরও গোটা দুই উইগ তুলে নিয়ে চম্পট দিল। কেউ ওকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেনি। নিশ্চয়ই জানালা গলে ঢুকেছিল।’

ছোট ছোট বাক্যে, হড়হড় করে বলে গেল মোপানি। বোঝা গেল, সত্যি কথাই বলছে সে।

‘সব কটা লাল রঙের উইগ,’ জানাল সে। ‘বাদবাকি উইগগুলো নিয়ে ভাবনা ছিল না আমার। কারণ ওগুলো সব আগের নাটকের। কিন্তু এটার কাজ তখনো চলছিল। আমার জন্যই বিশেষভাবে বানিয়ে দিয়েছিল ট্রুবার। বাধ্য হয়ে আরেকটা বানিয়ে দিতে বলতে হলো ওকে। সে যাকগে—কোথায় পেয়েছেন ওটা?’

‘ইয়ে, একটা তদন্তে গিয়ে আমার ছেলেরা কুড়িয়ে পেয়েছে। অপরাধী লোকটা ফেলে গিয়েছিল। এটার সূত্র ধরে ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা।

আর কিছু জিজ্ঞেস করল না মোপানি। ‘তা, এই পর্যন্তই বলতে পারি আমি,’ জানাল সে। ‘ওই চোরটার কোনো সন্ধান পায়নি পুলিশ।’

‘হয়তো অন্যভাবে ওকে ধরতে পারব আমি। আপনার চুরি হওয়া জিনিসগুলোর একটা লিস্ট দিন আমাকে। ওটা ধরে হয়তো ওর খোঁজ বের করা যাবে।’

‘এক্ষুনি দিচ্ছি,’ বলে ড্রয়ার খুলে এক তা কাগজ টেনে বের করল মোপানি। ‘এই লিস্টটাই আমি পুলিশকে দিয়েছিলাম চুরির খবর জানাতে গিয়ে। ঘড়ি আর বাকি সব কিছুর কথাই লিখেছি, উইগগুলোর কথা বাদে। ভেবেছিলাম, ওগুলো ফেরত পেলেও আর পরার মতো অবস্থায় থাকবে না।

লিস্টটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলেন মি. পাশা। হাতঘড়ি দেখল মোপানি। আয়নায় মুখ দেখল। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠল। ‘হায় হায়! পাঁচ মিনিটের ভেতর পর্দা উঠবে, আর এদিকে অর্ধেক মেকআপও শেষ হয়নি আমার। আপনারা কিছু মনে না করলে এখন একটু নিজের কাজ করি আমি।’

এক খাবলা রং নিয়ে ভয়ংকরভাবে ডলতে শুরু করল নিজের গালে। আজ রাতে যে চরিত্রের রূপায়ণ করতে যাচ্ছে, তার সাজসজ্জা। মি. পাশা আর ছেলেরা বেরিয়ে এল।

‘তেমন কোনো লাভ হলো না,’ রাস্তায় উঠে বলল কিশোর।

‘মি. মোপানির চোরাই গয়নাগুলো বাদে,’ মনে করিয়ে দিলেন ওর চাচা। ‘পুরোনো গয়নার দোকানে যদি খোঁজ মেলে ওগুলোর, তাতে চোরটার খোঁজ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তা, ছেলেরা, তোমরা কি নাটক দেখতে চাও মঞ্চে?’

‘চাই, চাচা! চাই, আঙ্কেল!’ সমস্বরে বলল দুজনে। তারপর যোগ করল রবিন, ‘কাল তাহলে আমরা জ্যাকেট আর হ্যাটের সূত্র ধরে চোরটার নাম–ঠিকানা বের করার চেষ্টা করছি?’

‘হ্যাঁ,’ রাশেদ পাশার জবাব।

একসঙ্গে মজা করে দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকের মঞ্চায়ন দেখল ওরা। সেই সঙ্গে বিশেষ চরিত্রে মি. মোপানির অনবদ্য কৌতুক আর অঙ্গভঙ্গি দেখে হেসে নিল প্রাণ খুলে।

পরদিন সকালে রাশেদ পাশা আর কিশোর-রবিন গেল যে দোকান থেকে চোরটা জ্যাকেট আর হ্যাট কিনেছিল, সেই দোকানে। ওখান থেকে জানা গেল, স্টাইলটা তিন বছরের পুরোনো। বলার কোনো উপায়ই নাকি নেই, কে, কবে কিনেছিল ওগুলো।

‘এই জিনিস দুটো,’ পুরুষের সুট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে থাকা লোকটা পরামর্শ দিল, ‘ইদানীংকালেও কেনা হয়ে থাকতে পারে, সেকেন্ডহ্যান্ড কাপড়ের দোকান থেকে।’ তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল গোয়েন্দারা।

‘এবারের অভিযানে ব্যর্থতাই খালি সার,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।

রবিনের কাঁধে হাত রাখলেন মি. পাশা। ‘শোনো, একজন ভালো গোয়েন্দা কক্ষনো হতাশার দীর্ঘশ্বাসও ফেলে না, অধৈর্যও হয় না,’ বললেন তিনি, ‘বিখ্যাত এমন অনেক কেস আছে, যেগুলো সমাধান করতে বছরের পর বছর লেগেছে, বুঝলে!’

জানালেন, পরের পদক্ষেপ হবে যত্নের সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি পুলিশের কেস ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করা। যেহেতু আগে লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি পুলিশেরই একজন ডিটেকটিভ ছিলেন, কাজেই যখন খুশি রেকর্ডগুলো দেখার অনুমতি আছে তাঁর।

কিশোর আর রবিন গেল তাঁর সঙ্গে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। কাজ শুরু হলো। প্রথমেই নিয়ে আসা হলো লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের সেই সব ক্রিমিনালের ফাইল, যারা ছদ্মবেশ ধরার জন্য পরিচিত। এদের ভেতর থেকে আবার যারা হালকা-পাতলা আর মাঝারি উচ্চতার, তাদের ফাইল আলাদা করা হলো।

পরের কাজ, ওই সব লোকদের কে কোথায় আছে, ফোন করে খোঁজ নেওয়া। দেখা গেল, চুরিগুলো হওয়ার সময় সবাই তারা রকি বিচ থেকে বেশ দূরে কোথাও অবস্থান করছিল। শুধু একজন বাদে।

‘মনে হচ্ছে, এ-ই আমাদের লোক!’ উত্তেজনায় ফেটে পড়ল কিশোর। ‘কিন্তু এখন সে কোথায়?’

জানা গেল, সন্দেহভাজন লোকটা প্যারোলে ছাড়া পেয়ে এখন জেলের বাইরে। ডোবার পিঞ্চম্যান নাম, কিন্তু সবাই ওকে ‘রেড ডোবার’ নামে চেনে। কারণ ধরা পড়ে জেলে যাওয়ার আগে ওর মাথায় একটা লাল পরচুলা পরা ছিল।

‘ও তো দেখছি লস অ্যাঞ্জেলেসেই থাকে। আর এর মাঝে হয়তো ফিরেও এসেছে বাড়িতে,’ বলল রবিন। ‘চলো, গিয়ে দেখে আসি।’

‘এক মিনিট,’ হাত তুললেন মি. পাশা। ‘কিশোর, তোর চাচি বাড়িতে একা। আর এত সময় ধরে ওকে একা থাকতে দেওয়াটা ঠিক হবে না। তা ছাড়া এসব তদন্ত কাজে তিনজন গোয়েন্দা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ালে, সহজেই অপরাধীদের চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ডোবার লোকটা আমাদের লোক হোক বা না হোক, লোকটা বিপজ্জনক হতে পারে। তার চেয়ে তোরা বরং রাতের প্লেন ধরে বাড়িতেই ফিরে যা। চোরটাকে ধরামাত্র ফোন করে জানাব তোদের।’

‘ঠিক আছে, চাচা,’ কিশোর বলল। যদিও মনে মনে একটু হতাশই হলো চলে যেতে হবে বলে।

বাড়ি ফিরে শুনল আরেক কাহিনি। কেসটার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন মেরি চাচিও, কিন্তু ভিন্নভাবে।

‘পিটারসনদের কাছে ফোন করেছিলাম আমি ওদের একটু চাঙা করতে,’ বললেন তিনি। ‘তোদের লস অ্যাঞ্জেলেসে যাওয়ার কথা বললাম, শুনে দারুণ খুশি মনে হলো। সোমবার আমি কাবাব আর কেক বানিয়ে দেব, দিয়ে আসিস। শরীর ভালো না মিসেস পিটারসনের। রান্নাবান্না খুব একটা করতে পারেন না।’

‘তোমার তুলনা নেই, চাচি!’ প্রশংসা করল কিশোর। ‘অবশ্যই দিয়ে আসব।’

রবিন জানাল ওর নাকি ক্রিকেট ম্যাচ আছে। ‘পরের বার যাব আমি,’ কথা দিল সে।

সোমবার, ক্লাসের ফাঁকে করিডরে ট্রেসির সঙ্গে দেখা হলো কিশোরের। ‘এই যে!’ বলল ট্রেসি। ‘তা এবার কোন সমস্যা ঘুরছে গোয়েন্দা সাহেবের মাথায়? দেখে তো মনে হচ্ছে, হাত ফসকে পালিয়েছে তোমার অপরাধী!’

হাসল শুধু কিশোর।

তারপর ট্রেসিকে জানাল, অনেক আশা নিয়ে ও ফোন করেছিল বাড়িতে। ভেবেছিল, ওর চাচা হয়তো এর মাঝে সুসংবাদ দিয়েছেন যে বিলি ম্যানশনের আসল চোরটা ধরা পড়েছে। চুরির অপবাদ ঘুচেছে মি. পিটারসনের। ‘কিন্তু কিসের কী, ট্রেসি। চাচা ফোনই করেনি। এখন ভাবছি, কোনো বিপদেই পড়ল কি না।’

বারো

‘বুঝতে পারছি,’ বলল ট্রেসি। ‘কী হতে পারে বলে ভাবছ তুমি?’

‘অপরাধী নিয়ে কারবার যেহেতু, কখন কী হয়, কিছুই বলা যায় না।’

‘তাই বলে তো আর এটা বলবে না যে আঙ্কেল কোনো ট্র্যাপে পড়েছেন?’ ট্রেসি বলল।

‘না, মনে হয় না তেমন কিছু হবে। এমনও হতে পারে, যে লোকটাকে খুঁজছে, তাকে এখনো পায়নি চাচা, তাই বাড়ি আসছে না।’

‘যাহোক, আশা করি চোরটা নিশ্চয়ই ধরা পড়বে,’ বলল ট্রেসি। ‘তবে, কিশোর, মি. পিটারসন এ কাজ করেছেন, সেটা কিন্তু কেউই বিশ্বাস করে না!’

‘সম্ভবত শুধু মি. বিলসন বাদে। আসল চোর ধরা না পড়া পর্যন্ত বেকারই থাকতে হবে মি. পিটারসনকে।’

‘দেখি, শিগগিরই একবার দেখা করে আসব পিটারসনদের সঙ্গে। থাকছে কোথায় ওরা?’

ট্রেসিকে কিশোর ঠিকানা দিতে চোখ কপালে উঠে গেল মেয়েটার। ‘আরে! এটা তো শহরের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা! ইশ্, বুঝতেই পারিনি যে এতটা খারাপ অবস্থা ওদের!’

‘এতটাই খারাপ। তবে আরও খারাপ হবে, যদি শিগগিরই কোনো কাজ জোটাতে না পারেন মি. পিটারসন। ববের একার উপার্জনে পুরো পরিবারটা চলতে পারবে না। আচ্ছা, ট্রেসি, স্কুল ছুটির পর পিটারসনদের ওখানে যাবে নাকি আমার সঙ্গে? কাবাব আর কেক পাঠাচ্ছেন চাচি।’

‘অবশ্যই যাব,’ রাজি হলো ট্রেসি। অঙ্ক ক্লাসের সামনে এসে আলাদা হয়ে গেল দুজনে।

ক্লাস ছুটির ঘণ্টা বাজতেই একসঙ্গে বিল্ডিং থেকে বের হলো কিশোর আর ট্রেসি। প্রথমে বইখাতা রাখার জন্য ট্রেসিদের বাড়িতে থামল ওরা।

‘কিছু ফলমূল নিয়ে যাই ওদের জন্য,’ বলল ট্রেসি। কিছু কমলা, কলা আর আঙুর কিনল সে দোকান থেকে।

নিজেদের বাড়িতে পা দিয়েই চাচির কাছে জানতে চাইল কিশোর, চাচার কোনো খবর আছে কি না। ‘না, এখনো জানি না,’ জানালেন মেরিচাচি।

চাচাকে নিয়ে যে ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছে, সে কথাটা আর চাচিকে জানাল না কিশোর। কথা না বাড়িয়ে কাবাবের প্যাকেটটা বগলে চেপে ধরে কেকের বাক্সটা তুলে নিল দুই হাতে। রাস্তায় এসেই নিজের উদ্বেগের কথাটা আবারও বলল ট্রেসিকে।

‘এখনো কোনো খবর না পাওয়াটা কেমন অদ্ভুতই লাগছে,’ স্বীকার করল ট্রেসি। ‘তবে পুরোনো প্রবাদটা ভুলো না, “সব সংবাদই সুসংবাদ নয়।”’

‘খারাপ সংবাদও হতে পারে, এটা বলতে চাইছ তো? তাহলে ব্যবস্থা নিতে পারব; তবে খবর পাওয়াটা আসল কথা,’ বলল কিশোর। ‘তবে তোমার সামনে আর মুখ কালো করে রাখব না, যাও, কথা দিলাম।’

‘অনেক ধন্যবাদ,’ হাসিমুখে ট্রেসি বলল।

হাত তুলে একটা চলন্ত বাস থামাল কিশোর। পিটারসনদের এলাকার দিকে যাবে ওটা। ট্রেসিকে নিয়ে উঠে পড়ল বাসে। অনেক লম্বা রাস্তা। রকি বিচ ছাড়িয়ে যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই শ্রী হারাচ্ছে রাস্তাঘাটের।

‘কী একটা ব্যাপার ঘটে গেল!’ সহসাই ফুঁসে উঠল ট্রেসি। ‘পিটারসনরা কত সুন্দর জীবন যাপন করত! আর এখন কিনা এই বস্তিতে থাকতে হচ্ছে! চোরটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধরা দরকার!’

চোখ দুটো জ্বলছে ওর। ট্রেসির অগ্নিমূর্তি দেখে হাসি পেল কিশোরের। ‘মনে হচ্ছে, ব্যাটাকে হাতের কাছে পেলে তুমি...’

‘চটকে ফেলতাম!’ কিশোরের কথাটা শেষ করে দিল ট্রেসি।

পিটারসনরা যেখানে উঠেছে, সেই রাস্তায় পা দিতে মন খারাপ হয়ে গেল ওদের। বেহাল অবস্থা। জীর্ণশীর্ণ সব খুপরি ঘর, ভগ্নপ্রায় দশা। ময়লা, ছেঁড়া কাপড় পরা বাচ্চারা খেলে বেরাচ্ছে পথের ধারে।

রাস্তার শেষ মাথায় ছোট্ট একটা কুঁড়ে। আর যাহোক, আশপাশের তুলনায় খানিকটা বাসযোগ্য মনে হচ্ছে কুঁড়েটাকে। কাঠের বেড়াটা মেরামত করা হয়েছে, উঠানটাও ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করা।

‘এখানেই থাকে ওরা,’ বলল কিশোর।

সামান্য হাসি ফুটল ট্রেসির মুখে। ‘পুরো রাস্তায় এটাই একমাত্র পরিচ্ছন্ন জায়গা।’

দরজায় টোকা দিল কিশোর। খুলে দিল নিরা। কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে তার বোন ডলি। কারা এসেছে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের চোখমুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল।

‘কিশোর! ট্রেসি!’ চেঁচিয়ে উঠল ওরা। ‘এসো এসো!’

সহৃদয় গম্ভীর্যের সঙ্গে স্বাগত জানালেন ওদের মিসেস পিটারসন। খানিকটা শুকিয়ে গেছেন ঠিকই, গায়ের রংও ময়লা হয়েছে আগের চেয়ে, কিন্তু বিলি ম্যানশনে থাকতে যেমন ব্যক্তিত্ব নিয়ে ছিলেন, এখনো তা–ই আছেন।

‘খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারব না,’ বলল ট্রেসি। ‘কিশোর আর আমি মিলে ঠিক করলাম, একটু দেখে যাই আপনাদের। আর এই যে, সামান্য কিছু জিনিস এনেছি আপনাদের জন্য।’

মাংস, কেক আর ফলের ব্যাগ রাখল ওরা। যমজ দুই বোন বারবার তাকাচ্ছে খাবারগুলোর দিকে। পানিতে ভরে উঠল মিসেস পিটারসনের চোখ। ‘এত ভালো লোক তোমরা সবাই,’ বললেন তিনি। ‘কিশোর, তোমার চাচিকে বোলো, ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই আমার।’

হাসিমুখে শুনছে কিশোর।

বলে চলেছেন মিসেস পিটারসন, ‘ট্রেসি, তোমাদের আনা খাবারগুলো মজা করে খাব আমরা। অনেক ধন্যবাদ।’

নিরা বলল, ‘চমৎকার উপহার এগুলো। জানো, বব সুপারমার্কেটে কাজ করতে গিয়ে দুই দিনের মাথায় আরেকটা ভালো চাকরি পেয়ে গেছে!’

‘তাই নাকি!’ খুব খুশি হলো কিশোর। ‘তাহলে, আমাদের বন্ধু যে কত স্মার্ট ছেলে, বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনি ম্যানেজারের, কী বলো?’

হাসল যমজ দুই বোন। কিন্তু ব্যথাভরা কণ্ঠে বললেন মিসেস পিটারসন, ‘ওদের বাবা একটা চাকরি পেলে খুব ভালো হতো। এখানকার কেউ তো আর ওকে কাজ দিচ্ছে না, তাই চাকরির জন্য অন্য শহরে যেতে চাইছে সে।’

‘আপনাদের এখানে রেখে?’

‘মনে তো হয়। জানি না কী করব।’

‘ভীষণ অন্যায় এটা!’ ফুঁসে উঠল নিরা। ‘যে ডাকাতির ব্যাপারে বাবা কিছুই জানে না, তারই দায় ঘাড়ে নিয়ে কষ্ট পেতে হচ্ছে আমাদের!’

একটু ইতস্তত করে কিশোরকে বললেন মিসেস পিটারসন, ‘ইয়ে, মি. পাশা কি কিছু করতে পেরেছেন, জানো নাকি?’

‘ঠিক জানি না আমি,’ সত্যি কথাই বলল সে। ‘এখনো কোনো সংবাদ দেয়নি। কয়েকটা সূত্র ধরে লস অ্যাঞ্জেলেসে গেছে চাচা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাইনি আমরা।’

‘উনি যে পিটারসনকে বাঁচাতে পারবেন, সেই আশাই–বা করি কীভাবে,’ ম্লান গলায় বললেন ভদ্রমহিলা। ‘পুরো ঘটনাটাই তো ভীষণ রহস্যজনক।’

‘আমি অত ভাবনাচিন্তা করি না,’ বলল ডলি। ‘রহস্যটার সমাধান হলে তো ভালোই। না হলেও আমরা না খেয়ে মরব না। তা সে যাহোক। আর বাবা জানে, আমাদের বিশ্বাস আছে তার ওপর।’

‘ঠিকই বলেছ। আমারও মনে হয় অত দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। যা বলার, তা তো সব বলাই হয়ে গেছে। নতুন কিছু আর বলার নেই।’

ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে, ও প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াল না কেউ। যাওয়ার জন্য উঠল কিশোর আর ট্রেসি। রাতের খাবার খেয়ে যেতে অনুরোধ করলেন ওদের মিসেস পিটারসন আর তাঁর দুই মেয়ে। রাজি হলো না ট্রেসি। ওর নাকি তাড়া আছে। চলে আসার সময় কিশোরকে একপাশে ডেকে নিলেন মিসেস পিটারসন।

‘আমাকে একটা কথা দাও, বাবা,’ বললেন তিনি। ‘তোমার চাচা ফিরে আসামাত্রই জানাবে আমাকে, মানে যদি কোনো সংবাদ থাকে আরকি।’

‘অবশ্যই জানাব, আন্টি,’ কিশোর বলল। ‘আপনার আর মেয়েদের কাছে এই অনিশ্চয়তা যে কতটা কষ্টের, তা বুঝতে পারছি।’

‘কষ্টের তো বটেই। কিন্তু যতক্ষণ রাশেদ পাশা আর তিন গোয়েন্দা কাজ করছে, আমি নিশ্চিত, সত্যিটা বের হবেই।’

ফেরার পথে একেবারে চুপচাপ হয়ে থাকল কিশোর আর ট্রেসি। বিলি ম্যানশনের রহস্যটা পিটারসন পরিবারের জীবনযাত্রায় যে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে দুজনই বিহ্বল হয়ে পড়েছে। কিশোরদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক গলি পরেই ট্রেসিদের বাসা। ওকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল কিশোর।

‘কাল দেখা হচ্ছে,’ বলল কিশোর।

‘হ্যাঁ, কিশোর। আর আশা করি এর মধ্যে আঙ্কেলের খবর পেয়ে যাবে তোমরা।’

দ্রুতপায়ে বাড়ির পথ ধরল কিশোর। ব্যগ্র হয়ে ঘরে ঢুকতে, দেখা হলো রবিনের সঙ্গে।

‘ফোন এসেছে?’

মাথা নাড়ল রবিন। ‘আন্টি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে, আঙ্কেলের কি কিছু হলোই নাকি ভেবে!’

আরও একটা পুরো দিন পার হয়ে গেল। তারপরও যখন মি. পাশার কোনো সংবাদ এল না, হোটেলের নম্বরে ফোন করলেন মেরিচাচি। জানা গেল, আগের দিনই হোটেল ছেড়ে চলে গেছেন মি. পাশা।

এক রহস্যের ভেতর নতুন আরেক রহস্য যোগ হলো মি. পাশার অন্তর্ধানে। হতাশা আর দুশিন্তায় পড়ালেখায় একেবারেই মন বসাতে পারল না কিশোর আর রবিন।

অবশেষে, পরদিন ভোরে মুখে চওড়া হাসি নিয়ে ওদের ঘুম ভাঙালেন মেরিচাচি। ‘তোদের চাচা চলে এসেছে!’ উৎফুল্ল স্বরে বললেন তিনি। ‘ঠিকই আছে সে। কিন্তু অনেক ধকল গেছে। ঘুমোচ্ছে এখন। বলেছে, ঘুম থেকে উঠে সব বলবে তোদের।’

উত্তেজনায় ফেটে পড়ার দশা হলো কিশোর আর রবিনের। চাচার কথা শোনার জন্য তর আর সইছে না। কিন্তু আপাতত কৌতূহলটা চাপা দিয়ে রাখা ছাড়া গতি নেই।

‘নিশ্চয়ই ভীষণ কাহিল অবস্থা চাচার,’ মেরিচাচি নাশতার আয়োজন করতে নিচে চলে গেলে বলল রবিন। ‘কোথায় যে ছিলেন, সেটাই ভাবছি।’

‘মনে হয় রাত জেগে কাজ করেছে। কেসের কাজ শুরু করলে তো ঘুমের কথা আর মাথায় থাকে না চাচার। কী মনে হয় তোমার, কিছু খবরটবর পেয়েছেন?’

‘আশা তো করছি, কিশোর। ‘ওহ, এখনই যদি জেগে উঠে সব বলতেন আঙ্কেল। না শুনে স্কুলে যেতেও ইচ্ছে করছে না।’

দেরি করে গেলে সমস্যা হবে জেনেও নানা ছুতোয় স্কুলে বেরোতে দেরি করতে লাগল ওরা। তাতেও লাভ হলো না। ওদের বেরোনোর আগে আর ঘুম ভাঙল না মি. পাশার।

ক্লাস শেষ হতে না হতেই, পড়িমরি করে বাড়ির দিকে ছুটল ওরা। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার রেকর্ড তৈরি করল।

লিভিংরুমে ছিলেন মি. পাশা। ওদের হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকতে দেখে চওড়া হাসি ফুটল তাঁর মুখে। লম্বা ঘুম দিয়ে ওঠায় অনেক ফ্রেশ লাগছে তাঁকে। আর উৎফুল্ল মেজাজ দেখে বোঝা যাচ্ছে, অভিযানটা পুরোপুরি বিফলে যায়নি।

‘এই যে ছেলেরা, কী খবর! তোমাদের চাচি আর তোমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দেওয়াতে দুঃখিত।’

‘কাজ হয়েছে কোনো?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘হয়েছে, আবার হয়নিও বলতে পারো। রেড ডোবার যে বোর্ডিংয়ে থাকে, সেখানে গিয়েছিলাম আমি। ভালো হয়ে যাওয়া প্যারোলের আসামি মনে হলেও, ঠিক করলাম ওকে চোখে চোখে রাখব। বন্ধুত্ব পাতানোর চেষ্টা করব।’

‘কীভাবে করলে কাজটা?’

‘ওর ঠিক পাশের রুমটাই ভাড়া নিলাম আর ভাব করলাম, আমিও একজন জেলখাটা অপরাধী!’

‘দারুণ!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘তারপর?’

(চলবে...)

আরও পড়ুন