অদ্রির অভিযান (দ্বিতীয় পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

‘মনে করো, জাল থেকে মুক্তি পেলে মাছ যেমন আনন্দ পাবে, ইন্টারনেটের জাল থেকে মুক্তি পেয়ে তোমরা এই মুহূর্তে সেই পরিমাণ আনন্দিত!’ বাদল কথাটুকু বলে অদ্রিদের দিকে তাকালেন। অদ্রি হাসি থামাতে পারল না; তবে শব্দ করে হাসল না। কোনো এক অদ্ভুত কারণে বাদলের সমস্ত কর্মকাণ্ড ও কথামালাই অদ্রির মধ্যে হাসির উদ্রেক করে। অদ্রির চোখে তার বাদল ভাইয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান।

বাদল একটি মেডিটেশন সেন্টার খুলেছেন অদ্রিদের এলাকায়। মিলি তাঁর মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন সেই মেডিটেশন সেন্টারে। মিলির ধারণা, মেডিটেশনের ফলে অদ্রির ভেতরের শব্দতরঙ্গের অস্থিরতা কিছুটা হলেও দূর হবে। কিন্তু অদ্রি বুঝতে পারে, এই প্রক্রিয়ায় সেটি দূর করা সম্ভব নয়; এমনকি দূর করার প্রয়োজনীয়তাও নেই। তবে মেডিটেশনের কারণে অদ্রির উপকারই হয়। ট্রি-নেটওয়ার্কের যে কথাটি সে শুনতে চায়, শুধু সেই কথা শোনার জন্য ধৈর্য ও মনোযোগের ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। মেডিটেশন সেশন তার মনের মধ্যে সুস্থিরতা আনে।

বাদল এবার বললেন, ‘সোজা হয়ে বসো। চোখ বন্ধ করো।’

সবাই বসেই আছে। এই কথায় টান টান হয়ে বসল। অদ্রি চোখ বন্ধ করে দুইবার কাশি দিল। অ্যাডভান্সড কাশি। কারণ, পরের ইনস্ট্রাকশন এটিই। বাদল বললেন, ‘এখন দুবার কাশো।’

অন্যরা দুবার কাশল। একসঙ্গে না হওয়ায় রুমে কাশাকাশির অবস্থা তৈরি হলো। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সবাই বাদলের কথা অনুসরণ করতে থাকল। তিনি খুব ধীরলয়ে বলে চললেন মেডিটেশনের কথামালা, ‘মনে করো, কাশির মাধ্যমে তোমার ভেতরের সমস্ত দুষ্ট এনার্জি বের হয়ে গেছে। এখন শরীরজুড়ে আছে শুধু ভদ্র এনার্জি। ভদ্র এনার্জি দিয়ে এবার হাসো। কল্পনা করো, সেই হাসি উড়ে যাচ্ছে। তার পাখির মতো পাখা আছে। পাখার আওয়াজে তোমার কানের পর্দা প্রকম্পিত হচ্ছে। তোমার মনে হচ্ছে, কেউ কটন বাড দিয়ে তোমার কান চুলকে দিচ্ছে। তুমি সুড়সুড়ি অনুভব করছ। তাই পেটের ভেতরে হাসির জন্ম হচ্ছে। টর্নেডোর মতো সেই হাসি তোমার গলা, মুখগহ্বর হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু হাসির মাধ্যমে এত এনার্জি তুমি চিরতরে হারাতে চাও না। তাই মুখের সামনে বয়াম ধরো। তারপর প্রাণখুলে হাসো। হাসি শেষে বয়ামের মুখটি লাগাতে ভুলো না।’

সবাই বিকট শব্দে হাসা শুরু করল। কেউ কেউ হাসি শেষ করে সেটি হাতের অদৃশ্য বয়ামে ভরে বয়ামের মুখ এঁটে লাগিয়ে দিল। অদ্রিও একই কাজ করল।

মেডিটেশন শেষে একে একে সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। অদ্রি দাঁড়িয়ে থাকল। তার উদ্দেশ্য একটাই—পৃথিবীর মহাবিপদের বিষয়টি পৃথিবীবাসীকে জানানোর জন্য বাদল ভাইয়ার সহযোগিতা নেওয়া। ওনাকে দেখে হাসি পেলেও অদ্রি এ-ও জানে যে অনেক মানুষের সঙ্গে তাঁর কানেকশন।

অদ্রিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও বাদল কথা না বাড়িয়ে রুমের এক পাশে বিছিয়ে রাখা ম্যাটে ঝুপ করে বসে পড়লেন। তারপর এমনভাবে বসে রইলেন, মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছেন। ভাগ্যিস, ইঁদুরটা দৌড় দিয়েছিল! দূর থেকে লেজুড়ে ইঁদুর দেখে এক বিকট চিৎকার দিল অদ্রি। বাদলের মেডিটেশন ভাঙল হাইপারটেনশনের মাধ্যমে। তিনি ভ্রু কুঁচকে বিরক্তমুখে অদ্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা কী হলো!’

‘একটু গলা সাধলাম।’

‘মানে?’

‘ঠিকমতো গলার ব্যায়াম হচ্ছে না অনেকদিন, তাই দেখলাম ঠিক আছে কি না।’

‘অদ্রি, তুমি আবার দুষ্টুমিপূর্ণ কথা বলছ!’

বাদল ভীষণ সিরিয়াস টাইপের মানুষ। যা বলেন, সিরিয়াসলি বলেন। যা করেন, সিরিয়াসলি করেন। শুধু অন্যদের কাছে কেন যেন সেসব হাস্যকর মনে হয়! দেখতে মাঝারি লম্বা, মুখ গোলগাল, সব সময় গম্ভীর, এমনকি হাসির কথা বললেও বাদলের মুখে কখনো হাসি দেখা যায় না। তিনি জীবনকে ভাবেন সিরিয়াস পরীক্ষাক্ষেত্র, হাসি-তামাশার স্থান নয়। অদ্রি কথা না বাড়িয়ে আসল প্রসঙ্গ ধরল, ‘ভাইয়া, আপনাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। কারণ, পৃথিবী মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছে!’

বাদল আতঙ্কে লাফ দিয়ে উঠলেন, যেন ইঁদুর তাঁর পায়ের মাঝ দিয়ে গেল! বললেন, ‘কিসের বিপদ আবার?’

‘এলিয়েন আসছে পৃথিবীর দিকে!’

‘কী সব আজগুবি কথা বলছ, অদ্রি! এসব কে বলল তোমাকে?’

অদ্রি জবাব দিল, ‘আপনি তো জানেন ভাইয়া, গাছপালার সঙ্গে আমার কথা হয়। গাছই আমাকে জানিয়েছে। অন্য গ্রহের উদ্ভিদ পৃথিবী গ্রহের উদ্ভিদকে জানিয়েছে আর আমার বাসার সামনের আমগাছটি জানিয়েছে আমাকে। কয়েক দিনের মধ্যেই এলিয়েনের দল আক্রমণ চালাবে পৃথিবীতে।’

অদ্রির কথায় আবারও আঁতকে উঠলেন বাদল। বললেন, ‘তুমি যেভাবে গাছপালার কথা বলো, তাতে ইদানীং শাকসবজি খেতেও আমার ভয় লাগে! মনে হয়, আমি শাকসবজিতে কামড় দেওয়ার আগে শাকসবজিই আমাকে কামড়ে দেবে! আমজনতার কাছে আমগাছের গল্প শোনাও, কিন্তু আমার কাছে দয়া করে এসব গল্প কোরো না। কারণ, আমি হাফ ভেজিটেরিয়ান।’

‘হাফ ভেজিটেরিয়ান!’

‘হ্যাঁ, বাকি হাফ ফিশ-মিট ইটার।’

অদ্রি হাসবে না কাঁদবে, বুঝতে পারছে না। কারণ, বেশির ভাগ মানুষই তো তা-ই। অদ্রি বলল, ‘ভাইয়া, আমি এত কিছু বুঝি না, আমাকে আপনার সাহায্য করতে হবে।’

বাদল সিরিয়াস ভঙ্গিমায় বললেন, ‘আমি সাহায্য করব কীভাবে! এলিয়েন এলে আসবে; তারা পৃথিবী গ্রহ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যাবে।’

বিস্মিত কণ্ঠে অদ্রি বলল, ‘এসব কী বলছেন, ভাইয়া! আমি কিন্তু বিন্তি আপুকে বলে দেব, আপনি এসব উল্টাপাল্টা বলেছেন।’

বিন্তির কথা বললেই বাদলের আচরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। কোনো এক বিচিত্র কারণে বিন্তিকে তিনি ভয়ও পান। বাদল আমতা-আমতা করে বললেন, ‘কী সাহায্য লাগবে? এলিয়েনদের মেডিটেশন আমার জানা নেই।’

অদ্রি বুঝতে পারল, বাদল ভাইকে বাগে পাওয়া গেছে। বলল, ‘জি না ভাইয়া, এলিয়েনদের মেডিটেশন শেখাতে হবে না। আপনার দায়িত্ব হবে সবাইকে জানানো যে পৃথিবী মহাবিপদে পড়তে যাচ্ছে! শিগগিরই এলিয়েন আক্রমণ করবে।’

‘সবাইকে আমি চিনি নাকি! আমি কীভাবে জানাব?’

‘আপনিই পারবেন, ভাইয়া। কারণ, আপনার সঙ্গে অনেকের পরিচয় আছে। তাঁদের মাধ্যমে এই খবর সবার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবেন। বিভিন্ন দেশের মানুষ জেনে গেলে সেসব দেশ সৈন্য-গোলাবারুদ নিয়ে প্রস্তুত থাকবে। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে পৃথিবীতে গণবিলুপ্তি ঘটবে!’

‘গণবিলুপ্তি! সেটা আবার কী?’

‘গণবিলুপ্তির সহজ মানে, আমি-আপনি সবাই মারা পড়ব।’

‘কী বলো!’

‘যা শুনেছেন, তা-ই বলেছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, প্রায় সাড়ে চুয়াল্লিশ কোটি বছর আগে প্রথম গণবিলুপ্তিতে সামুদ্রিক প্রায় সব প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’

বাদল চোখ বড় বড় করে ভীতভাবে অদ্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কই না তো, জানি না।’

অদ্রি থামল না। বেচারাকে আরও ঘাবড়ে দিয়ে বলল, ‘উনচল্লিশ কোটি বছর আগে দ্বিতীয় গণবিলুপ্তির পরিণতি আরও ভয়াবহ। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ প্রাণী নাই হয়ে গেছে!’

বাদলকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি মেনে নিতে পারছেন না। এভাবে প্রাণিকুল নাই হয়ে যাওয়া কীভাবে মেনে নেবেন? অদ্রি বলে চলল, ‘প্রায় পঁচিশ কোটি বছর আগে ঘটা তৃতীয় গণবিলুপ্তি আরও ডেঞ্জারাস। ছিয়ানব্বই শতাংশ জীব ডেড!’

বাদলের চোখ যেন কপালে চড়ে বসতে চাইছে। অন্যদিকে অদ্রি থামার পাত্রী না। বলল, ‘সাড়ে বিশ কোটি বছর আগে ঘটেছে চতুর্থ গণবিলুপ্তি। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে আর গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর অর্ধেক প্রাণী মৃত!’

বাদলকে দেখে মনে হচ্ছে ফ্লোর ম্যাটে সটান হয়ে পড়ে যাবেন। তবু থামল না অদ্রি। বলে চলল, ‘পঞ্চম গণবিলুপ্তির কথা আমরা প্রায়ই শুনি। মাত্র সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডাইনোসরের বিলুপ্তি ঘটে! এবার এলিয়েন আসার মাধ্যমে শুরু হয়ে গেছে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির প্রক্রিয়া। এখনই কিছু না করলে দেখা যাবে শুধু প্রাণী নয়, গাছপালাও শেষ। আমি আপনি কেউ বাঁচব না।’

বাদল কোনোভাবে কোঁৎ করে মুখ দিয়ে মুদৃস্বরে তিনটি শব্দ বের করলেন, ‘আমি মরব কেন?’

আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে অদ্রি বলল, ‘আমার খবরটা প্রচারের ব্যবস্থা করলে আপনি মরবেন না। কিন্তু ব্যবস্থা না করলে কে জানে, হয়তো বিন্তি আপুর হাতেই মারা পড়বেন!’

বাদল কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন। আসলে খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘পৃথিবীতে এলিয়েন ধেয়ে আসার খবর তুমি জেনেছ গাছপালার কাছ থেকে, এটা মানুষকে বললে মানুষ রীতিমতো হাসাহাসি শুরু করবে। আমি হাসির পাত্রে পরিণত হব!’

অদ্রি বাদলকে আর খ্যাপাল না, কিন্তু মনে মনে ভাবল, যে ব্যক্তি এমনিতেই হাসির পাত্র, তার আর নতুন করে হাসির পাত্র হওয়ার প্রয়োজন আছে নাকি! তবে মুখে অদ্রি বলল, ‘হাসির পাত্র হলে আমি হব। কারণ, গাছের কাছ থেকে খবরটা পেয়েছি আমি। এটা নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’

‘সত্যি বলছ তো? গাছে তুলে মই কেড়ে নেবে না তো?’

‘গাছে তুলব কেন আপনাকে? গাছে তুলে মই কাড়া কী, আমার জানা নেই। এসব উদ্ভট বাক্য আমার সামনে ব্যবহার করবেন না। কাজের কথায় আসি। কাদের মাধ্যমে খবরটা ছড়াতে হবে, বুঝতে পেরেছেন?’

‘গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়া’ বাগধারাটির অর্থ অদ্রির জানা; সে একটু ভাব নিল বাদল ভাইয়ার সঙ্গে। অদ্রির কড়া মেজাজের ভাবে কাজ হলো। বাদল লক্ষ্মী বালকের মতো মাথা নেড়ে জানালেন যে তিনি বুঝতে পেরেছেন। বললেন, ‘আমি এখনই কল দিচ্ছি টিকটকার টিঙ্কু, ইউটিউবার বঙ্কু আর ফেসবুকার ছোটকুকে। এই তিনজনের পাহাড়সমান ফলোয়ার। এঁরা তিনজন পোস্ট দেওয়ামাত্র তা ভাইরাল-ব্যাকটিরিয়াল হয়ে যাবে!’ এটুকু বলে বাদল টলতে টলতে গেলেন অদূরে টেবিলের ওপর রাখা মোবাইল সেট নিতে। কল করলেন তিন মহান ব্যক্তিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে বাদল ভাইয়ার তিন মহারথী এসে হাজির। সম্পূর্ণ ঘটনা তিনজনকে খুলে বলল অদ্রি। ঘটনা শুনে তাঁরা প্রথমে খানিকক্ষণ থ মেরে থাকলেন; তারপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আকস্মিকভাবে মেডিটেশন সেন্টার থেকে বের হয়ে গেলেন! অদ্রি বুঝতে পারল, তাঁরা মহাবিপদের বিষয়টা নিয়েই ভাবছেন; তাই আর কিছু বলল না। মেডিটেশন সেন্টার থেকে অদ্রি বাসায় পৌঁছানোর সময়টুকুতে তিনজনের বদৌলতে ঘটে গেল নানা ঘটনা; সেসব ঘটনার সূত্র ধরে ঘটতে থাকল একটার পর একটা ঘটনা!

চলবে...

আরও পড়ুন