অদ্রির অভিযান (তৃতীয় পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

অদ্রি বাসায় পৌঁছানোর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকে হতবাক। ছেলেগুলো করেছে কী! ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক—প্ল্যাটফর্ম তিনটিতে যে পোস্টগুলো দিয়েছে, সেগুলো রীতিমতো হট কেকের মতো বিতরণ করছেন নেটিজেনরা (ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সিটিজেনরা)। প্রচলিত ভাষায়, পোস্টগুলো ভাইরাল! ট্রি-নেটওয়ার্কের কথামালার দিকে এতক্ষণ মনোযোগ না দেওয়ায় অদ্রি এ খবর আগে পায়নি; অথচ ট্রি-নেটওয়ার্কের হট টপিকও ভাইরাল পোস্টগুলো নিয়ে। আর ভাইরাল হবেই–বা না কেন? তিনজন রংঢং করে যে কনটেন্টগুলো তৈরি করেছে, তা দেখে মানুষ মজা পাচ্ছে!

টিকটকার টিঙ্কু এলিয়েনের পোশাক পরে ছোটদের ট্রাইসাইকেল নিয়ে ক্যামেরার সামনে শুধু চক্কর দিয়েছে আর লিপসিং করেছে প্রচলিত একটি গানের সঙ্গে, ‘ও সখিনা গেছস কি না ভুইলা আমারে, আমি অহন রিশকা চালাই ঢাহা শহরে...’। শেষমেশ কীভাবে যেন দুটো কথাও জুড়ে দিয়েছে, ‘সাবধান, হুঁশিয়ার! এলিয়েন আসিতেছে, এলিয়েন আসিতেছে!’

অন্যদিকে, ইউটিউবার বঙ্কু যে কনটেন্ট তৈরি করেছে, সেটি ফেসবুকের ইনবক্সে ভীষণভাবে চালাচালি হচ্ছে। অদ্রির ইনবক্সেও কয়েকজন কনটেন্টটি পাঠিয়েছে। বঙ্কু নিজে একটি কবিতা লিখে নিজেই আবৃত্তি করেছে! কনটেন্টে ব্যাকগ্রাউন্ড অডিও হিসেবে বঙ্কুর কণ্ঠের আবৃত্তি শোনা যাচ্ছে; তবে ইমেজ হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা স্পেসশিপ, বিকটদর্শন এলিয়েনের চেহারা! কবিতার লাইনগুলো এমন:

‘পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছে স্পেসশিপ,
ধেয়ে আসছে এলিয়েন!
মেরে ফেলবে মানুষ, খেয়ে ফেলবে গাছ ও ফিশ!
নিজের এক্সপায়ারি ডেট জানেন?
এলিয়েন আসছে দ্বিমত নাই,
বাঁচার কি কোনো পথ নাই?’

ফেসবুকার ছোটকুও ঝড় তুলেছে ফেসবুকে। ছেলেটি ছোট ছোট কবিতা লিখেই বর্তমানে বড়সড় কবি। তার স্ট্যাটাস যথারীতি ছোট, কিন্তু ফলোয়ার বেশি হওয়ায় তার কনটেন্টই সবচেয়ে বেশি মানুষ শেয়ার দিয়েছেন, রিঅ্যাক্ট হিসেবে ‘কেয়ার’ দিয়েছেন! ছোটকুর চার লাইনের কবিতা:

আর মাত্র তিন দিন,
খেয়েদেয়ে বেঁচে নিন।
জানাচ্ছি কষ্ট ও আগ্রহে,
এলিয়েন আসছে এই গ্রহে!

ঘটনা এখানে শেষ নয়; বরং শুরু! পোস্টগুলো ভাইরাল হওয়ার পরই টিঙ্কু-বঙ্কু-ছোটকুকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় নানা ‘ট্রল’ পোস্ট হওয়া শুরু হলো। তাদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হলো যে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে এলিয়েন আসার খবরটি হাস্যকর টপিকে পরিণত হলো! টিঙ্কু-বঙ্কু-ছোটকুকে কোনো কোনো ট্রল পোস্টে সম্বোধন করা হলো ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ নামে; আবার কোনো কোনোটিতে সম্বোধন করা হলো ‘থ্রি ইডিয়টস’ বলে। কেউ কেউ তো ‘থ্রি গাধা’ লিখতেও বাকি রাখেননি।

টিঙ্কু-বঙ্কু-ছোটকু যে আসলেই তিন গাধা, সেটি রাত নয়টার দিকে টের পেল অদ্রি! তিনজন নিজেদের গাধামি মিশিয়ে একসঙ্গে তৈরি করেছে নতুন ভিডিও কনটেন্ট। সেটি পোস্ট হওয়ামাত্র ভাইরাল হলো রকেটগতিতে। ভিডিওতে তারা বলেছে, ‘আমরা তিনজন ভদ্রঘরের মেধাবী সন্তান। দয়া করে আমাদের নিয়ে ট্রল করবেন না। যা বলার, অদ্রি নামের মেয়েটিকে বলুন। অদ্রি আমাদের বলেছে, গাছ নাকি তাকে জানিয়েছে, পৃথিবী গ্রহে আক্রমণ চালাবে এলিয়েন। অদ্রি খবরটি সবাইকে জানাতে বললে আমরা লক্ষ্মী ছেলের মতো কাজটি করি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, কত বড় ভুল করেছি! চিলে কান নিয়ে গেছে শুনেই চিলের পেছনে দৌড়ানো যেমন ঠিক নয়; তেমনি এলিয়েনের আসার কথা শুনেই যাচাই না করে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া ঠিক হয়নি। আমরা সরি। তিনজনই সরি।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় তিনজনের ক্ষমা চাওয়ার ভিডিও পোস্ট হওয়ার পর শুরু হলো অদ্রিকে নিয়ে ট্রল! পোস্টগুলো দেখে অদ্রি ভীষণ অবাক—তার সম্পর্কে এত তথ্য, তার নানা ছবি কোথায় পেল ছেলেপুলে! অবশ্য এসব ছবি ও তথ্যের অনেকাংশ সে নিজের হাতেই বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করেছে। ট্রল পোস্ট বানানো ছেলেপুলেগুলোর ক্রিয়েটিভিটিতে অদ্রি মুগ্ধ!

অদ্রি বুঝতে পারেনি যে ট্রল নিয়ে আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসাহাসি শুরু হওয়ায় কিছুক্ষণ পর অদ্রির মা মিলির কাছে দূরসম্পর্কের আত্মীয়রা ফোন করা শুরু করলেন! নানা কথা বলে মিলিকে অস্থির করে তুললেন। এসব হাসি-তামাশা-চটকদার কথা অন্যদিকে মোড় নিল যখন টেলিভিশনের সমস্ত চ্যানেলে একটি ব্রেকিং নিউজ সম্প্রচারিত হতে থাকল!

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংস্থার বিজ্ঞানীরা কিছুক্ষণ আগে দেখতে পেয়েছেন, একগুচ্ছ উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। উল্কাপিণ্ডের সংখ্যা ১০। এসব উল্কার আঘাতে জানমালের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হবে। উল্কাপিণ্ডগুলো হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলো বা আগে কেন তাদের দেখতে পাওয়া যায়নি, এমনকি তাদের গতি অপেক্ষাকৃত মন্থর হওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। এ কারণে মিটিংয়ে বসেছেন পৃথিবীর বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী।

ব্রেকিং নিউজটি প্রচার হাওয়ামাত্র পৃথিবীজুড়ে অদ্রির নাম উচ্চারিত হতে থাকল। এক বিস্ময় বালিকা এলিয়েন আসার আগাম বার্তা জানিয়েছে, খবরটি উল্কাপিণ্ডের সংবাদের পাশাপাশি সব স্থানে আলোচিত হতে থাকল। এর মাঝে আকস্মিকভাবে মিলি দেখতে পেলেন, দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় তাদের বাসা দেখানো হচ্ছে! বাসার নিচে শত শত মানুষ ভিড় করেছে।

উৎসুক জনতাকে ভীষণ ভয় পান মিলি। নিজের কষ্টের জীবনে কোনো উপকারী জনতার দেখা পাননি; অথচ দেখেছেন অনেক উৎসুক জনতা যারা শুধু পরিস্থিতি অবলোকন করে আনন্দ পান! জীবনে কঠিন সব বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ায় মিলির বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে, পৃথিবীতে দুই রকম মানুষ আছে—ভালো মানুষ এবং উৎসুক জনতা।

অদ্রিকে ডাকলেন মিলি। টেলিভিশনের পর্দায় নিজেদের বাসার ছবি দেখে অদ্রি বিস্মিত। পরিস্থিতি এত দূর গড়াবে, এটি সে বুঝতে পারেনি। চোখ-কান খোলা রাখা উচিত ছিল; এমনকি ট্রি-নেটওয়ার্কের কথামালা অনেকক্ষণ খেয়াল করে শুনছে না অদ্রি। একটি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে, তাদের বাসার সামনে ভিড় করা জনগণের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন জনৈক সাংবাদিক। লোজজন অদ্রির কথা বিশ্বাস করেছেন। তারা উল্কাপাতের ব্যাপারটি এলিয়েনদের কাণ্ড বলে ধারণা করছেন। এ কারণে সবাই অদ্রিকে দেখতে চান; তার মুখে কথা শুনতে চান।

এমন সময় হঠাৎ কলিবেল বেজে ওঠায় মিলি ও অদ্রি দুজনেই আঁতকে উঠল। মিলি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত থাকতে বললেন। তারপর দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘কে?’

দরজার ওপাশ থেকে দরাজ কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ভয় পাবেন না, দরজা খুলুন। আমরা পুলিশের লোক। আমি গোয়েন্দা মেহেরাজ। আপনাদের নিতে এসেছি।’

মিলি পিপহোলে চোখ দিয়ে দরজার বাইরে ভালোমতো দেখলেন। তারপর বললেন, ‘আপনারা কী চান?’

ওপাশ থেকে উত্তর এল, ‘আমরা আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসেছি। আপনাদের জীবন এই মুহূর্তে বিপন্ন। বিশেষ করে এই বাসায় অদ্রি নামের যে মেয়ে আছে, তার জীবন বিপদাপন্ন। তাই আপনাদের পুলিশি হেফাজতে নেওয়া জরুরি।’

মিলি আর কী বলবেন, বুঝতে পারলেন না। পিপহোল দিয়ে ওপাশে দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যদের দেখা যাচ্ছে। তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুললেন। দরজা খুলতেই পুলিশের চারজন লোক রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। চারজনের মধ্যে দুজনের হাতে রাইফেল আর দুজনের কোমরে পিস্তল। লম্বা, শ্যামলা, সুঠাম দেহের অধিকারী পুলিশ কর্মকর্তা বাসার চারপাশে একবার চোখ বোলালেন। তারপর মিলিকে পাশ কাটিয়ে অদ্রির দিকে তাকিয়ে দরাজ কণ্ঠে বললেন, ‘অদ্রি মা, আমি গোয়েন্দা এ সি মেহেরাজ। তুমি আমাকে মেহেরাজ আঙ্কেল বলতে পারো। তোমাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।’

মিলি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আমি আমার মেয়েকে একা ছাড়ব না।’

গোয়েন্দা এ সি মেহেরাজ বললেন, ‘তাহলে আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে।’

গোয়েন্দা দলের সঙ্গে মিলি ও অদ্রি বাসার সামনের রাস্তায় নামতেই সাংবাদিক ও লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। নিচে পুলিশের আরও অনেক সদস্য ছিলেন। তাঁরা দুপাশের জনস্রোত আটকে পথ করে দিলেন। অদ্রি ও মিলি উঠলেন গোয়েন্দা মেহেরাজের গাড়িতে। অদ্রি তাকিয়ে দেখল, সব টেলিভিশন ক্যামেরা তাদের দিকে তাক করা। সাংবাদিক আঙ্কেলরা নানা প্রশ্ন করছেন, কিন্তু সেগুলোর উত্তর দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অদ্রি গোয়েন্দা আঙ্কেলের অফিসে পৌঁছানোর পর দেখতে পেল তার রুমে বসে আছে পরিচিত চারজন! বাদল ভাই, টিঙ্কু, বঙ্কু ও ছোটকু। সবার চেহারাই বিমর্ষ দেখাচ্ছে। অদ্রিদের দিকে তারা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। তাদের মাঝারি মাত্রার চড়থাপ্পড় দেওয়া হয়েছে; সঙ্গে হালকা মাত্রায় মারধর ছিল।

অফিসকক্ষে নিজের চেয়ারে বসলেন গোয়েন্দা এ সি মেহেরাজ। অদ্রি তার মাকে নিয়ে বসল টেবিলের অন্যপাশে। মেহেরাজ আঙ্কেল পিয়নকে ডেকে চা-বিস্কুট আনতে বললেন; তারপর অদ্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অদ্রি মা, আমাকে বলো তো, কে তোমাকে বলল পৃথিবীতে এলিয়েন আসছে?’

অদ্রি বলল, ‘গাছপালার কথা আমি বুঝতে পারি, আঙ্কেল। তারাই জানিয়েছে, পৃথিবীতে এলিয়েন আসছে।’

‘আমাকে তুমি সত্যটা বলতে পারো, মা।’

এই প্রথমবারের মতো গোয়েন্দা আঙ্কেলের ওপর অদ্রির রাগ হলো। অদ্রি সত্যিই বলছে; অথচ তাকে আকার-ইঙ্গিতে বলা হচ্ছে যে সে মিথ্যা বলছে! অদ্রি আঙ্কেলের কথার কোনো জবাব না দিয়ে তার পেছনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল। তখনই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল! বাইরে থাকা কৃষ্ণচূড়াগাছটি অদ্রির সঙ্গে যোগাযোগ করল। কৃষ্ণচূড়াগাছের কথায় মনোযোগ দিল অদ্রি। গোয়েন্দা কাশেমের কথা গাছটি জানতে পেরেছে এবং ভীষণভাবে ব্যথিত হয়েছে। তাই অদ্রিকে একটি তথ্য জানাল কৃষ্ণচূড়াগাছ।

অদ্রি গোয়েন্দা আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আঙ্কেল, আপনার পেছনের ওই কৃষ্ণচূড়াগাছ আপনার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছে এবং আমাকে জানাল যে তার একটা ডাল এখনই ভেঙে পড়বে।’

গোয়েন্দা এসি মেহেরাজের রুমে আরও একজন পুলিশ কর্মকর্তা এসে বসেছেন। তিনি হেসে বলেন, ‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? বললাম আর গাছের ডাল ভেঙে পড়ল!’

পুলিশ কর্মকর্তার কথা শেষ হওয়ামাত্র ঘটল ঘটনাটি! বিশাল কৃষ্ণচূড়াগাছ থেকে বড় একটি ডাল বিকট শব্দে ভেঙে পড়ল। গাছটির নিচেই রাখা ছিল ঊর্ধ্বতন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার গাড়ি। ফলে মুহূর্তেই গাছ ঘিরে হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি হলো। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ি উদ্ধারে নেমে পড়ল ২০ থেকে ৩০ জন পুলিশ সদস্য।

জানালা দিয়ে খানিকক্ষণ এসব দৃশ্য দেখে গোয়েন্দা এ সি মেহেরাজ চোখ ফেরালেন সামনে বসা পুলিশ কর্মকর্তার দিকে। বললেন, ‘ওই চারজনকে ছেড়ে দাও।’

বাদল এবং তার সহযোগীদের নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা রুম থেকে বের হলে গেলেন। তারা বের হওয়ার পর রুমে চা-বিস্কুট-কেক এল। গোয়েন্দা মেহেরাজ বললেন, ‘নাও অদ্রি, শুরু করো। আপনিও নিন আপা। অল্প নাশতা। কারণ, আপনাদের জন্য হোটেল “সেরা ভবন”-এ রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটু পর সেখানে নিয়ে যাব। নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েক দিন সেখানে থাকতে হবে।’

কথাগুলো বলে মিলি বা অদ্রিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গোয়েন্দা এ সি মেহেরাজ রুমের টিভি চালানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। টেলিভিশন চালু করার পর দেখা গেল, একটি চ্যানেলে আকাশের দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। উল্কাপাতে যেমন আলোকরেখা ছুটতে দেখা যায়, তেমনি অনেক আলোকরেখা পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। পৃথিবীর সব টেলিভিশন চ্যানেলে একই খবর—বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, উল্কাপাতে পৃথিবীর প্রকৃতি ও জীবনের বড় ধরনের ক্ষতি হবে! নেপথ্যকণ্ঠের সঙ্গে নানা রকম ভিডিও ক্লিপ দেখানো হচ্ছে—বাংলাদেশে এখন রাত হলেও পৃথিবীর কোনো স্থানে বিকেল, আবার কোনো স্থানে সকাল। ভিডিও ক্লিপগুলোয় দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে আতঙ্কিত মানুষ ছোটাছুটি করছে, এ ছাড়া সম্প্রচারিত হচ্ছে পৃথিবীর দিকে উল্কা ধেয়ে আসার দৃশ্য, কখনোবা দেখানো হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর অনলাইনে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ফুটেজ।

একটি চ্যানেলে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংস্থার প্রধানকে কথা বলতে দেখা গেল। তিনি জানান, উল্কার গতি এমন মন্থর হয় না; বিষয়টি তাঁকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। চ্যানেলটিতে তারপরই দেখানো হলো অদ্রির ছবি ও নাম। বাংলাদেশের অদ্রিকে টিভি চ্যানেলটি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ‘বিশ্বের বিস্ময় বালিকা’ হিসেবে! এলিয়েন আসছে পৃথিবীতে—অদ্রির এ কথা আমলে নিয়েছে অনেক দেশ; অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত সেসব দেশের সশস্ত্র বাহিনী। চ্যানেলটিতে কয়েকটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতির নানা ফুটেজ দেখানো হলো।

গোয়েন্দা এ সি মেহেরাজ টেলিভিশন বন্ধ করে দিলেন। অদ্রির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অদ্রি মা, টিভি অন করলাম মূলত পরিস্থিতির আপডেট তোমাকে জানানোর জন্য এবং নিজেও জানার জন্য। কাল সকাল থেকেই তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য হোটেল “সেরা ভবন”-এ বিভিন্ন দেশের গবেষক এবং সংবাদকর্মী আসা শুরু করবেন। কারণ, পৃথিবীকে এই মহাবিপদ থেকে বাঁচাতে তোমার সহযোগিতা প্রয়োজন।’

এমন সময় মিলির মুঠোফোনে কল এল। অপরিচিত ও অন্য দেশের নম্বর হওয়ায় তিনি লাউডস্পিকারে দিলেন। ওপাশ থেকে চীনা ভাষায় কেউ একজন কী সব কথা বললেন, কিছুই বোঝা গেল না। মিলি কলটি কেটে দেওয়ামাত্র আরেকটি কল এল। এবারের ভদ্রলোক কথা বললেন ইংরেজি ভাষায়। যা বললেন, তা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘হ্যালো, আমি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থা থেকে বলছি। আপনি কি অদ্রির মা বলছেন?’

‘জি, বলছি।’

‘আপনার মেয়ের সঙ্গে আমাদের কথা বলা প্রয়োজন। ভীষণ জরুরি। পৃথিবীর মহাবিপদ। তাকে ফোনটা দিন।’

মিলি চুপ করে রইলেন। মেহেরাজ আঙ্কেল অদ্রিকে ইশারা দিয়ে কথা বলতে বললেন। অদ্রি কথা বলে উঠল, ‘হ্যালো।’

‘হ্যালো অদ্রি, তুমি যা বলেছ, তা–ই ঘটছে পৃথিবীতে! আমাদের গ্রহে এলিয়েন নামছে। পৃথিবীকে বাঁচাতে তোমার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।’

‘এ ব্যাপারে আমি কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি?’

‘পৃথিবী গ্রহে তুমিই একমাত্র মানুষ, যে জানতে পেরেছে এ তথ্য। তার মানে, তুমিই একমাত্র মানুষ, যার মাধ্যমে কোনো না কোনো উপায়ে এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব।’

‘কিন্তু বিজ্ঞানীরা তো বলছেন এটা উল্কাপাত।’

‘আসলে এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেছেন। একদল বলছেন—উল্কাপাত; আরেক দল বলছেন—এলিয়েনের হামলা। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান হিসেবে আমার দায়িত্ব মহাজাগতিক প্রাণীর আক্রমণ থেকে পৃথিবী গ্রহের মানুষের বাঁচানো। তাই তোমার সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন।’

‘কীভাবে আমি সহযোগিতা করব বলুন?’

‘ইতিমধ্যে তোমার কাছে আমাদের দুজন উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি পাঠিয়েছি। তোমাদের দেশের প্রধানকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। যথাসময়ে তাঁরা তোমার সঙ্গে দেখা করবেন। তুমি তাঁদের সব রকম সহযোগিতা করবে, এটাই আমার আশা।’

‘ঠিক আছে, ধন্যবাদ।’

কথা শেষ হওয়ার পর গোয়েন্দা এ সি মেহেরাজ মিলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চলুন, আপনাদের হোটেলে পৌঁছে দিই। খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়ুন। কারণ, কাল সকাল থেকেই আপনারা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। আন্তর্জাতিক আটটি সংস্থা ইতিমধ্যে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাদের প্রতিনিধিরা কাল ভোরের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন এ দেশে। হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরেই অদ্রির সঙ্গে আলোচনায় বসবেন।’

মিলি বললেন, ‘তাহলে চলুন ভাই, দেরি না করাই ভালো। আর আমার মুঠোফোনটা বন্ধ রাখছি। তা না হলে রাতবিরাতে হয়তো কল আসবে। আপনি যেকোনো প্রয়োজনে অদ্রির মুঠোফোনে কল দিলেই আমাদের পাবেন।’

‘ঠিক আছে, অদ্রি মায়ের মোবাইল নম্বর তো আমি নিয়েই রেখেছি। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’

গোয়েন্দা এ সি মেহেরাজ অদ্রিদের রাত ১১টার দিকে “সেরা ভবন” হোটেলে পৌঁছে দিলেন। অন্যদিকে, অদ্রির ক্লাসমেট অদ্রিকের সারা দিন গেছে অন্যভাবে এবং এই রাতে সে অদ্ভুত এক সত্যের মুখোমুখি! কী করবে বুঝতে পারছে না বিজ্ঞানমনস্ক ছেলেটি।

চলবে...

আরও পড়ুন