পুরোনো টাওয়ার (নবম পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মেরি চাচির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কথাটা শুনে নিয়ে আবার মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটল কিশোর আর রবিন। রকি বিচের বাণিজ্যিক এলাকায় এসে দেখল, ইতিমধ্যে ডোবারের স্বীকারোক্তির কথা ছড়িয়ে গেছে সবখানে। স্থানীয় রেডিওতে বিকেলের সংবাদে প্রচারিত হয়েছে খবরটা। লোকজন সব আলোচনায় ব্যস্ত।

ডগলাস ফ্রেডকে দেখা গেল রাস্তায়। চোখমুখের ভঙ্গিটা এমন যে কেউ তার সামনে কেসের বিষয়ে কিছু বললেই তাকে আস্ত চিবিয়ে খাবে। কিশোর-রবিনকে দেখামাত্র তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।

‘আচ্ছা,’ রুগ্ণ কণ্ঠে বলল সে, ‘শুনলাম, জিনিসগুলো উদ্ধার করেছ তোমরা?’

‘পারলে তো ভালোই হতো,’ মুখ কালো করে বলল কিশোর।

‘অ্যাঁ!’ চেঁচিয়ে উঠল ডিটেকটিভ, পলকে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। ‘পাওনি তোমরা? তবে যে রেডিওতে শুনলাম, ডোবার নাকি তোমাদের চাচাকে বলে গেছে কোথায় লুকিয়েছিল ওগুলো?’

‘বলেছিল ঠিকই। সে যা-ই হোক, খবরটা ছড়াল কী করে?’

‘ডোবারের দরজা তো আর সব সময় বন্ধ ছিল না। একজন নার্স রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনে ফেলেছিল। ও-ই সবাইকে বলেছে। তো, লুটের মাল খুঁজে পাওনি তোমরা, না? হা হা হা! খুব ভালো খবর!’ আনন্দে ফেটে পড়ল ডিটেকটিভ। ‘ডোবার যে পুরানো টাওয়ারে রাখার কথা বলেছিল তোমাদের, তাতে কাজ হয়নি?’

‘বুঝতেই তো পারছেন, ওখানে ছিল না ওগুলো!’ মেজাজ খিঁচড়ে গেল রবিনের। ‘নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে ডোবারের!’

‘ডোবারের ভুল হয়েছে!’ উৎফুল্ল গলায় বলল ফ্রেড। ‘নাকি মজা করেছে তোমাদের চাচা তোমাদের সাথে?’ জবাবের অপেক্ষা না করে হাসতে হাসতে চলে গেল হবু গোয়েন্দা।

বাড়ি ফিরে জানতে পারল ছেলেরা, জন বিলসনের সঙ্গে কথা হয়েছে মি. পাশার। বিলসনকে বুঝিয়ে–শুনিয়ে রাজি করেছেন, টাওয়ার দুটোতে আরও ভালো করে অনুসন্ধান চালানো দরকার।

‘ছেলেরা,’ বললেন তিনি, ‘রাতের খাবারের পরই সোজা চলে যাব আমরা। মনে হচ্ছে, আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।’

সাড়ে সাতটার দিকে ছেলেদের নিয়ে টাওয়ার ম্যানশনে হাজির হলেন মি. পাশা। দরজা খুলে দিলেন জন বিলসন।

‘যদিও খুঁজতে দিচ্ছি আপনাদের,’ ওদের নিয়ে পুরানো টাওয়ারের দিকে যাওয়ার পথে বললেন বৃদ্ধ, ‘তবু আমার বিশ্বাস কিছুই পাওয়া যাবে না ওখানে। কেসের ব্যাপারে আমার আলাপ হয়েছে চিফ ফ্লেচারের সঙ্গে। তার ধারণা, ঘটনার পেছনে পিটারসনের হাত আছে। আর আমি তো নিশ্চিত এ ব্যাপারে।’

‘তাহলে ডোবারের স্বীকারোক্তির ব্যাপারটা কী?’ জিজ্ঞেস করলেন তাঁকে মি. পাশা।

‘চিফ ফ্লেচার বলেছেন, ওটা ভুল পথে চালানোর জন্যও হতে পারে। পিটারসনকে বাঁচাতেই কাজটা করেছে ডোবার। একসঙ্গে কাজ করেছে ওরা।’

‘বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা পিটারসনের জন্য খারাপ হচ্ছে,’ স্বীকার করলেন মি. পাশা। ‘তারপরও টাওয়ারগুলোয় খুব ভালো করে তল্লাশি চালাতে চাই আমি। ডোবারের স্বীকারোক্তির সময় ছিলাম আমি ওখানে। ও মিথ্যা কথা বলেছে বলে মনে হলো না আমার।’

‘হতে পারে। হয়তো আপনার কথাই ঠিক। তারপরও বলে রাখছি আপনাকে, পুরো ব্যাপারটাই ডোবারের ধাপ্পাবাজি।’

‘সেটা তখনই বিশ্বাস করব, যখন টাওয়ার দুটোর ভেতরে বা বাইরে কোথাও কিছু পাওয়া যাবে না,’ বললেন মি. পাশা। দুই ঠোঁট পরস্পরের সঙ্গে চেপে বসেছে তাঁর।

‘বেশ, আসুন যাওয়া যাক,’ জন বিলসন বললেন। দরজা খুলে ঢুকে গেলেন পুরানো টাওয়ারের ভেতরে।

উৎসুকভাবে কাজে লেগে গেল চারজন। পুরানো টাওয়ারটার ওপর থেকে খুঁজতে খুঁজতে নিচের দিকে নামতে লাগল তারা। কোনো সম্ভাবনা বাদ রাখল না। প্রতিটি দেয়াল ঠুকে ঠুকে দেখা হলো কোথাও ফাঁপা আওয়াজ পাওয়া যায় কি না, যার পেছনে গোপন কুঠুরি থাকতে পারে। মেঝেগুলো ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা হলো, সম্প্রতি কোনো কিছু নড়ানোর চিহ্ন আছে কি না কাঠের গায়ে। কিন্তু সেসবের ভেতরেও নেই হারানো গয়না আর বন্ডগুলো। অবশেষে আবার নিচতলায় ফিরে এল সবাই।

‘এখানে কিছু নেই, নতুনটায় যেতে হবে,’ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য মি. পাশার।

‘আবার শুরু করার আগে কিছু খেয়ে, খানিকটা জিরিয়ে নিতে হবে আমার,’ ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন বিলসন। সবাইকে নিয়ে ডাইনিংরুমে ঢুকলেন তিনি। দুধ আর স্যান্ডউইচ রাখা আছে সেখানে। ‘যার যার মতো নিয়ে নিন,’ আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। সবাই বসে পড়লে তিনি নিজে খেলেন শুধু এক গ্লাস দুধ আর কয়েক টুকরা বিস্কুট।

খাওয়া আর বিশ্রামের পর আবার চাঙা হয়ে উঠল সবাই। এবার ওদের মনোযোগ গিয়ে পড়ল নতুন টাওয়ারের দিকে। এবারও অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে খোঁজ করা হলো। দেয়াল আর পার্টিশনগুলো ঠুকে দেখা হলো। মেঝেতে শব্দ করা হলো। প্রতিটি আসবাবপত্র নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করা হলো। গোয়েন্দাদের তল্লাশিতে বাদ পড়ল না এক ইঞ্চি জায়গাও।

অনুসন্ধান প্রায় শেষের দিকে, অথচ লুটের মালগুলো তখনো লাপাত্তা। মি. পাশা মন্তব্য করলেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে, ডোবার কখনো জিনিসগুলো রাখেইনি এখানে। তা ছাড়া যদি রেখেও থাকত, কেউ যে পরে এসে নিয়ে গেছে, তারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘তার মানে, মি. পিটারসন যে এখানে আসেননি, এটাই তার প্রমাণ?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘হ্যাঁ।’

‘হয়তো তা-ই,’ একমত হলেন মি. বিলসন। ‘কিন্তু তার মানে এই নয় যে চোরের সঙ্গে যোগসাজস ছিল না ওর!’

‘এখুনি অনুসন্ধান বন্ধ করতে চাই না আমি,’ দৃঢ় কণ্ঠে জানালেন মি. পাশা। ‘মালগুলো হয়তো পুরানো টাওয়ারের বাইরে কোথাও রাখা হয়েছে।’

বুঝিয়ে বললেন তিনি, রাতের বেলা বাগান পরীক্ষা কঠিন হবে। ‘আপনি অনুমতি দিলে, মি. বিলসন, কাল ভোরে এসে ছেলেদের নিয়ে কাজ শুরু করতে চাই আমি। অনিচ্ছায় হলেও সম্মতি দিলেন প্রাসাদমালিক। তখন ছেলেদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন মি. পাশা। ‘স্কুল টাইমের আগেই প্রমাণ বের করে ফেলতে হবে আমাদের।’

ছেলেরা বলল তাঁকে, হোমওয়ার্ক করার সুযোগ পায়নি ওরা। তাই তিনি যদি প্রিন্সিপালের কাছে একটা নোট লিখে দেন, তাতে শাস্তি থেকে বেঁচে যায় ওরা। মুচকি হাসলেন মি. পাশা। বাড়ি এসেই একটা চিঠি লিখে দিলেন। তারপর ‘গুডনাইট’ জানিয়ে শুয়ে পড়লেন।

কিশোর আর রবিনের মনে হলো, চোখটা সবে বুজেছে, এই সময় ওদের চাচা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি শুরু করেছেন। ‘অনুসন্ধানে যেতে চাইলে এখুনি উঠে পড়তে হবে,’ বললেন তিনি।

ঘুমঘুম চোখে তাকাল ছেলেরা, পরক্ষণেই লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়ল। গোসল করতেই পুরো সজাগ হয়ে গেল। দ্রুত কাপড় পরে নিল। কিচেনে ঢুকে দেখল নাশতা বানিয়ে ফেলেছেন মেরি চাচি। দূর পাহাড়ের মাথায় সূর্য কেবল উঁকি দিতে শুরু করেছে।

‘আজকে সব গরম গরম খাবার,’ বললেন মেরি চাচি। ‘বাইরে অনেক ঠান্ডা।’

খাবারের মেন্যুতে আছে আপেলের হালুয়া, ওটমিল, ডিমপোচ, টোস্ট আর কোকো। দেরি যাতে না হয়, তার জন্য প্রায় নিঃশব্দে খাওয়া সারল ওরা। বিশ মিনিটের ভেতর রওনা হলো কিশোর, রবিন আর মি. পাশা।

‘গাড়িতে কোদাল দেখতে পাচ্ছি, চাচা,’ বলল কিশোর। ‘মাটি খুঁড়তে হবে নাকি আমাদের?’

‘হ্যাঁ, লুকানো জিনিসগুলো মাটির ওপরে পাওয়া না গেলে মাটির নিচেই খুঁজব।’

বিলি ম্যানশনে পৌঁছেই কাজে নেমে পড়ল ওরা। বিলসনদের আর বিরক্ত করল না। জানে যে এই সময় ঘুমিয়ে আছে ওরা। দুই টাওয়ার লাগোয়া সব জায়গা তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। পাথরের চাঁই উল্টেপাল্টে দেখা হলো, চালাঘরের নিচে টর্চ জ্বেলে দেখা হলো। গাঁথুনির প্রতিটি পাথর পরীক্ষা করা হলো, কোনোটা নড়ানো হয়েছে কি না। কিচ্ছু পাওয়া গেল না।

‘মনে হয় খোঁড়াখুঁড়ি করতেই হবে,’ অবশেষে বলল কিশোর।

খোঁড়ার জন্য পুরানো টাওয়ারের নিচের দিকে একটা ঝোপ বেছে নিল। নতুন গজানো চারাও রয়েছে ওখানে। একটা কোদাল নিয়ে কোপ দিল। শক্ত কিছু একটাতে লাগল কোদালটা। উত্তেজিত হয়ে জায়গাটার চারপাশের মাটি সরাতে লাগল কিশোর। আধা মিনিটের মাথায় চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে।

‘একটা বাক্স! পুঁতে রাখা হয়েছে এখানে!’

উনিশ

বিপুল উত্সাহে কোদাল দিয়ে কোপাতে লাগল কিশোর। ফুট দুয়েক লম্বা, ছয় ইঞ্চি চওড়া আর এক ফুট গভীর একটা গর্ত খুঁড়ল।

‘গুপ্তধন!’ চিত্কার দিয়ে ছুটে এল রবিন।

মি. পাশাও ছুটে এসেছেন পেছন পেছন। হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন কিশোরের আবিষ্কারের দিকে। গর্ত থেকে বাক্সটা বের করে আনল কিশোর। তালা নেই। কালবিলম্ব না করে ডালা তুলতে শুরু করল ওটার।

দম আটকে রেখেছে সবাই। সত্যিই তাহলে বিলসনদের চুরি যাওয়া গয়না আর বন্ডগুলো খুঁজে পেল ওরা! ডালা তুলল কিশোর।

হতভম্ব হয়ে বাক্সের জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে তিনজন। জীবনে কখনো এত অবাক হয়নি ওরা। অবশেষে কথা বলল রবিন।

‘কতগুলো ফুলগাছের কন্দ!’

হতাশার প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যেতে হাসতে লাগলেন মি. পাশা আর দুই গোয়েন্দা। ওরা যা আশা করেছিল তার সঙ্গে এতটাই অমিল বস্তুগুলোর যে না হেসে উপায় নেই।

‘একটা ব্যাপার শিওর,’ বলল কিশোর, ‘এই বাক্সটা রেড ডোবার পুঁতে রাখেনি। কিন্তু কার কাজ এটা?’

‘আমি বলতে পারি,’ হঠাৎ পেছন থেকে বলল একটা কণ্ঠ। ঘুরে তাকাতেই জন বিলসনকে দেখতে পেল ওরা, চটি পায়ে বার্থরোব গায়ে এগিয়ে আসছেন ওদের দিকে।

‘গুড মর্নিং, মি. বিলসন,’ সমস্বরে বলল ছেলেরা। মি. পাশা যোগ করলেন, ‘কাজে নেমে পড়েছি আমরা, বুঝলেন। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল আমাদের, লুকানো সম্পদগুলো মনে হয় পেয়েই গেছি।’

উজ্জ্বল একটা অভিব্যক্তি খেলা করে গেল জন বিলসনের চোখেমুখে। ‘আমার জিনিসগুলো পাননি ঠিক আছে,’ বললেন তিনি, ‘কিন্তু ভালো একটা সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছেন চোরটার। এই বাক্সটা পিটারসনই রেখেছে। কোরিয়ার গয়না আর আমার বন্ডগুলো নিয়েও নিশ্চয়ই এই কাজই করেছে! কোথাও না কোথাও পুঁতে রেখেছে। তবে আমি নিশ্চিত, এখানে কোথাও নেই ওগুলো।’

কিশোর টের পাচ্ছে, আজ মেজাজমর্জি খুব একটা সুবিধের নয় মি. বিলসনের। চোরাই সম্পদের আলোচনা বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল কিশোর। ‘মি. বিলসন, মি. পিটারসন ফুলগাছের কন্দ এখানে পুঁতে রেখেছিলেন কেন?’

নাক দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করলেন প্রাসাদমালিক। ‘বিরল ফুলের জন্য পাগল লোকটা। ইউরোপে গিয়েছিল এই কন্দগুলো জোগাড় করতে। ওগুলো কয়েক মাস রেখে দেওয়ার কথা ঠান্ডা আর অন্ধকার জায়গায়। তাই ও পুঁতে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কাজকারবারই সব উল্টোপাল্টা লোকটার। জানো, কিসের বায়না ধরেছিল সে আমার কাছে? একটা গ্রিনহাউস বানিয়ে দেওয়ার। বিরল প্রজাতির সব ফুলের চাষ করবে!’

‘মজার হবি বলেই তো মনে হচ্ছে,’ বলল রবিন।

‘মজার না, কচু!’ ফোঁস করে উঠলেন মি. বিলসন। ‘একটা গ্রিনহাউস বানাতে কত খরচ তুমি জান! তা ছাড়া বিরল প্রজাতির ফুলের চাষে বহু সময় নষ্ট হয়। বুনোগাছ থেকে মস্ত ডেইজি ফোটানো কিংবা কাউস্লিপকে অর্কিডে রূপান্তর করা—এসব হাবিজাবি কাজে মেতে থাকলে চলে ওর? আরও অনেক জরুরি কাজ ছিল।’

শিস দিল কিশোর। ‘ওগুলো করলে তো জিনিয়াসই বলা যায় মি. পিটারসনকে!’

‘জিনিয়াস—ফাজলেমি করছ!’ বললেন মি. বিলসন। ‘আচ্ছা, তোমরা খোঁড়াখুঁড়ি করতে থাক। রহস্যটার একটা সুরাহা চাই আমি।’

মি. পাশার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যেহেতু ছেলেদের তুলনায় ভালো, কাজেই ঠিক করা হলো টাওয়ার দুটোর আশপাশের জমিতে তল্লাশি চালাবেন তিনি নিজে। কোথাও মাটি একটু অন্য রকম লাগলেই সেখানে খুঁড়ে দেখবে কিশোর আর রবিন। ফুলের কন্দভরা বাক্সটা আবার যত্নের সঙ্গে জায়গামতো রেখে মাটিচাপা দেওয়া হলো।

খানিক বাদেই পুরানো টাওয়ারের উল্টো পাশ থেকে হেঁকে উঠলেন মি. পাশা, ‘এই যে এখানে একটা জায়গা দেখছি খোঁড়ার মতো।’ ছেলেদের কোদাল নিয়ে হাজির হতে বললেন তিনি, ‘মনে হচ্ছে, কোনো কুকুর-টুকুরের খোঁড়া এটা, হাড়জাতীয় কিছু থাকতে পারে। তারপরও, কিছুই বাদ দেওয়া উচিত হবে না আমাদের।’

এবার খুঁড়তে গিয়ে রবিনের কোদালে লাগল কিছু একটা। ওদের চাচার অনুমানই সত্য হলো। কুকুরের পুঁতে রাখা হাড়।

নতুন টাওয়ারে কাজ শুরু করল তিনজনে। এতক্ষণ ধরে নীরবে ওদের কাজ দেখছিলেন জন বিলসন। আড়চোখে দেখল ছেলেরা, বৃদ্ধের চোখেমুখে একধরনের সন্তুষ্টির চিহ্ন ফুটে উঠেছে।

কবজিতে বাঁধা ঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে আনলেন মি. পাশা। ‘ঠিক আছে, ছেলেরা, এটাই আমাদের শেষ চেষ্টা।’ ফুট কয়েক দূরের একটা জায়গার দিকে ইশারা করলেন তিনি। ‘এরপর গোসল করে স্কুলে যেতে হবে তোমাদের।’

এত ব্যর্থতার পরও দমে না গিয়ে, আশা নিয়ে খুঁড়তে শুরু করল কিশোর আর রবিন। খানিক বাদেই ছোট আরেকটা বাক্স আবিষ্কার করে ফেলল ওরা।

‘এটা তো দেখছি দারুণ ভারি!’ গর্ত থেকে বাক্সটা বের করে আনল কিশোর।

‘তাহলে হয়তো এটাতে চোরাই মালগুলো আছে!’ উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন।

মি. বিলসনের ভেতরেও দারুণ আগ্রহ দেখা গেল। হাঁটুগেড়ে বসে তিনি নিজে ঢাকনাটা তুললেন ওটার। ছোট ছোট কয়েকটা থলে দেখা গেল ভেতরে।

‘গয়নাগুলো!’ চিত্কার দিল রবিন।

‘আর ওই চ্যাপ্টা থলেটার ভেতর বন্ডগুলো থাকতে পারে!’ উদ্‌গ্রীব হয়ে বলল কিশোর।

গোলাকার থলেগুলোর একটা তুলে নিয়ে দ্রুত হাতে ওপরের ফিতে খুললেন মি. বিলসন। প্রচণ্ড বিরক্তিতে বেঁকে গেল তাঁর মুখ। ‘কতগুলো বিচি!’ হুংকার দিয়ে উঠলেন।

ইতিমধ্যে চ্যাপ্টা থলেটা তুলে নিয়েছেন মি. পাশা। প্রায় মি. বিলসনের মতোই হতাশ হলেন তিনিও। ‘ফুলের ক্যাটালগ!’ ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লেন। ‘বিদেশি ভাষায় লেখা মনে হচ্ছে।’

‘সব সময় পৃথিবীর সবখান থেকে এসব আনাত পিটারসন,’ মন্তব্য করলেন বিলি ম্যানশনের মালিক। ‘ওগুলোকে নষ্ট করে ফেলতে বলেছিলাম আমি। জরুরি কাজের সময় খালি আজেবাজে জিনিসের পিছে সময় নষ্ট করত। আমার ভয়ে মনে হয় পুঁতে রেখেছে ওগুলো।’

বড় করে শ্বাস টানলেন বৃদ্ধ। তারপর আবার বলে চললেন, ‘যাকগে, এখানেই সবকিছুর ইতি। কিছুই প্রমাণ করতে পারলেন না আপনারা। এদিকে আমার বাড়ি আর বাগান তো ঠিকই তছনছ করে দিলেন।’

কথাটা যে সত্যি, মানতেই হলো কিশোরদের। তবে বৃদ্ধকে এ-ও জানাল যে দুটো কারণে ওদের মনোবল অটুট আছে। প্রথমত, মি. পিটারসনকে দায় থেকে মুক্ত করা। দ্বিতীয়ত, চোরাই সম্পদগুলো উদ্ধার করা। কোদালগুলো গাড়িতে রেখে এলো ওরা। তখন মি. বিলসন ওদের ভেতরে গিয়ে সাফসুতরো হয়ে কিছু খেয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।

‘আরেকবার নাশতা করতে তো সমস্যা নেই তোমাদের,’ ছেলেদের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন তিনি।

‘নাহ, মি. বিলসন লোকটাকে মাঝেসাঝে ভালই মনে হয়,’ ভাবল কিশোর।

আমন্ত্রণ রাখল ওরা। ভেতরে গিয়ে মজা করে কেক আর মধু খেল। তারপর মি. পাশা ওদের নামিয়ে দিয়ে গেলেন রকি বিচ হাইস্কুলে।

কিশোর আর রবিন গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই ওদের নাম ধরে ডাক শুনতে পেল। পেছন ফিরে দেখল, ফারিহা আর ট্রেসি এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।

‘এই যে কিশোর!’

‘কী খবর!’

‘আজ সকালের কাহিনি শুনেছ কিছু তোমরা?’ ট্রেসি জিজ্ঞেস করল।

‘কেন, স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে নাকি?’ উত্সুক হলো রবিন।

‘সেটা হলে তো ভালোই হতো,’ বলে গম্ভীর হয়ে গেল ট্রেসি। ‘মি. পিটারসন আজ ভোরে আবার অ্যারেস্ট হয়েছেন!’

‘বলো কী!’ বজ্রাহতের মতো ট্রেসির দিকে তাকিয়ে রইল দুই গোয়েন্দা। ‘কেন?’ জানতে চাইল কিশোর।

ফারিহার মুখে শোনা গেল ঘটনাটা। ও আর মুসা নাকি রেডিওতে সকালের খবরে শুনেছে দুঃসংবাদটা। বিস্তারিত ঘটনা জানার জন্য স্কুলে আসার পথে পিটারসনদের বাসা হয়ে এসেছে ওরা।

‘যত দূর বোঝা গেল, চিফ ফ্লেচারের মনে হয়েছে যে মি. পিটারসনের আঁতাত ছিল ডোবারের সঙ্গে, যার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিয়েছেন তোমাদের চাচা। তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আহা রে, বেচারা মিসেস পিটারসন! কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।’

‘আর ঠিক যখন আরেকটা চাকরি খুঁজে পেলেন তিনি, তখনই ঘটল এই ঘটনা,’ আফসোস করল ট্রেসি। ‘ইশ, তোমার কিছু করতে পারল না?’

‘কেসটার সমাধান করতে যতটা সম্ভব খাটাখাটনি করছি আমরা,’ জবাব দিল কিশোর। তারপর আগের দিন সন্ধ্যা আর সেদিন সকালের অভিযানের কথা জানাল মেয়েদের। স্কুলের ঘণ্টা পড়তে আলাদা হয়ে গেল ছেলেমেয়েরা।

এইমাত্র যা শুনল, তাতে গভীর উদ্বেগে পড়ে গেছে কিশোর আর রবিন। টিফিনের সময় জিল, জিরেমি, বিড আর মুসার সঙ্গে দেখা হতে খবরটা জানাল ওদের।

‘ববের বড় দুঃসময় যাচ্ছে,’ বলল জিরেমি।

‘পুরো পরিবারটারই দুঃসময়,’ বলল মুসা।

পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করল ছেলেরা। মাথা খাটিয়ে পিটারসনদের সাহায্য করার একটা উপায় বের কারার চেষ্টা করল। লুকানো গয়না আর বন্ডগুলো খুঁজে বের করতেই হবে, তাহলেই কেবল মি. পিটারসনের ওপর থেকে সন্দেহের কালো ছায়াটা দূর হবে।

‘তার মানে, করার মতো একটা কাজই আছে,’ কিশোর বলল। ‘যেভাবেই হোক লুটের মালগুলো খুঁজে বের করতে হবে আমাদের!’

স্কুল ছুটির পর জিমটিচারের চাপে খানিকক্ষণ বেসবল খেলতে হলো কিশোর আর রবিনকে। তারপর বাড়ি ফিরে এল। খেলাধুলা করার মতো মন–মানসিকতা এই মুহূর্তে নেই ওদের। দিনটাও কেমন গোমড়ামুখো, চারপাশ কালো হয়ে আছে। বৃষ্টি নামবে বোধ হয়। মন খারাপ ভাব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে ছেলেদের।

অস্থিরতা পেয়ে বসেছে কিশোরের। অবশেষে থাকতে না পেরে বলল, ‘চল, হেঁটে আসি।’

‘হুঁ, মগজের গিঁট খুলতে পারে তাতে,’ সায় দিল রবিন।

মেরি চাচিকে জানাল, রাতের খাবারের আগেই ফিরে আসবে ওরা। তারপর বেরিয়ে পড়ল। হাঁটতেই থাকল, হাঁটতেই থাকল কিশোর আর রবিন। ফেরার সময়, অনেকটা চুম্বকের টানে যেন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলল বিলি ম্যানশনের দিকে।

‘এই জায়গাটা আমাকে ভূতের মতো পেয়ে বসেছে,’ বলল রবিন। ম্যানশনের ড্রাইভওয়ে ধরে হাঁটছে ওরা।

আচমকা রবিনের বাহুতে হাত রাখল কিশোর। ‘এইমাত্র একটা কথা মাথায় এল। এমনও হতে পারে, ডোবারের মৃত্যুশয্যার স্বীকারোক্তিটা হয়তো উল্টোপাল্টা ছিল। অন্য কোনো জায়গায় করা ডাকাতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিল। তা ছাড়া প্রতিটি রহস্যের ক্ষেত্রে একটা সময় এসে, আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে নির্দোষ লোকটাই সন্দেহভাজন হয়ে দেখা দেয়। বিলসনরা যে ধাপ্পা দিচ্ছে না, তার প্রমাণ কী? বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে ওরা নিজেরাই সিন্দুক থেকে গয়না আর বন্ড চুরির গল্প ফেঁদে বসতে পারে। মনে নেই, চাচা ওখানে বিলসন ছাড়া আর কারও আঙুলের ছাপ খুঁজে পায়নি?’

‘কিশোর, ভালো একটা পয়েন্ট বলেছ। মাঝেমধ্যে ভীষণ ছোটলোকের মতো আচরণ করে ওই লোক আর তাঁর বোন। আমার তো মনে হচ্ছে, ইনসিওরেন্স কোম্পানিকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যেও ওরা ঘটনাটা সাজিয়ে থাকতে পারে,’ বলল রবিন।

‘ঠিক বলেছ,’ সায় দিল কিশোর। ‘এই মুহূর্তে, এসো, এভাবেই ভাবা যাক। ধরে নিই, ওরা আমাদের সন্দেহভাজন। তাহলে আমাদের ওপর নজরও রাখা হতে পারে।’

চট করে রাস্তা থেকে সরে পাশের ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ল ওরা। সতর্কতার সঙ্গে এগোতে লাগল বিলি ম্যানশনের দিকে। দোতলার তিনটে রুম বাদে পুরো এলাকাটা অন্ধকারে ঢাকা।

‘তোমার পরিকল্পনাটা কী, কিশোর?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল রবিন। ‘এমন কিছু একটা আবিষ্কার করা, যাতে বোঝা যায় বিলসনরা চুরির গল্পটা সাজিয়েছে কি না, তাই তো?’

‘হ্যাঁ। চোখ-কান খোলা রাখলে হয়তো কোনো সূত্র পেয়েও যেতে পারি।’

নিঃশব্দে এগিয়ে চলল ছেলেরা। প্রাসাদের যে প্রান্তে পুরানো টাওয়ারটা, সে পাশ ঘুরে এগোচ্ছে ওরা। হঠাৎ ওদের কাছাকাছি নুড়ি বাঁধানো পথে কারও হাঁটার শব্দ শোনা গেল। চোখের পলকে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ছেলেরা। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। দেখার জন্য অপেক্ষা করছে ওরা, লোকটা কে। বিলসনদের কেউ, নাকি অন্য কেউ?

কিন্তু দেখার আগেই আবার পেছন দিকে চলে গেল পায়ের শব্দ। ছেলেরাও বেরিয়ে এল লুকানো জায়গা থেকে। ঠিক তখনই তীব্র আলোর রশ্মি এসে পড়ল ওদের ওপর।

আলোটা আসছে টাওয়ারের সবচেয়ে ওপরের তলাটা থেকে!

‘জলদি শুয়ে পড়ো!’ ফিসফিস করল কিশোর। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সে।

সঙ্গে সঙ্গে কিশোরের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল রবিনও।

চলবে...

আরও পড়ুন