পুরোনো টাওয়ার (অষ্টম পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ষোলো

‘খোঁজার ব্যাপারটা আমি তোমাদের ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি,’ মুচকি হেসে বললেন মি. পাশা। ‘সে ক্ষেত্রে মি. বিলসনের সম্পত্তি তার হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বটা তোমাদেরই থাকবে। বুঝতে পারছি, এখন থেকে কেসটা আমাকে ছাড়াই চালিয়ে নিতে পারবে তোমরা।’

‘তুমি না থাকলে খুব বেশি দূর এগোনো হতো না আমাদের,’ বলল কিশোর।

‘আর তোমাদের সাহায্য ছাড়াও খুব একটা কিছু করতে পারতাম না আমি। কাজেই সমান সমান,’ চওড়া হেসে বললেন মি. পাশা। ‘তো, গুডলাক, আরকি!’

স্টাডিরুম থেকে বেরোনোর সময় বলল কিশোর, ‘থ্যাঙ্কস, চাচা। এখন পুরানো টাওয়ারে খোঁজার কথা শুনে বিলসনরা আমাদের ধমক দিয়ে না তাড়ালেই বাঁচি।’

‘ওদের শুধু বোলো যে,’ পরামর্শ দিলেন রাশেদ পাশা, ‘গয়না আর বন্ড কোথায় লুকানো রয়েছে, তার একটা ভালো সূত্র আছে তোমাদের হাতে। ব্যস, তাহলেই খুঁজতে দেবে।’

হাসল রবিন। ‘এহ কিশোর, দিন শেষ হওয়ার আগেই পঞ্চাশ হাজার ডলারের পুরস্কার পেয়ে যাচ্ছি আমরা, কি বল!’

কে কার আগে যাবে, ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বের হলো ছেলেরা। আশা করছে, কিছুক্ষণের ভেতর টাওয়ারে ধনভাণ্ডার রহস্যের সমাধান করে ফেলবে।

*

বেলা চারটের দিকে টাওয়ার ম্যানশনে পৌঁছাল ছেলেরা। ঘন্টি শুনে দরজা খুললেন স্বয়ং জন বিলসন। লম্বা, কুঁজো ভদ্রলোক পুরু লেন্সের চশমার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছেন ওদের। হাতে এক পাতা ডাকটিকিট।

‘কী চাই?’ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কাজে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত হয়েছেন তিনি।

‘আমাদের তো চিনেছেন, নাকি?’ বিনয়ের সঙ্গে বলল কিশোর। ‘আমরা মি. পাশার দুই ভাস্তে।’

‘গোয়েন্দা রাশেদ পাশা? আচ্ছা। তা কী দরকার তোমাদের?’

‘কিছু মনে না করলে, পুরানো টাওয়ারটা একটু খুঁজে দেখতে চাই। ডাকাতির ব্যাপারে একটা সূত্র পেয়েছি আমরা।’

‘কিসের সূত্র?’

‘আমাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে, যাতে ধারণা দেওয়া হয়েছে যে গয়না আর বন্ডগুলো পুরানো টাওয়ারে লুকিয়ে রেখেছে চোর।’

‘তাই নাকি! তথ্যপ্রমাণ আছে তোমাদের কাছে, অ্যাঁ?’ ভালো করে ছেলেদের দিকে দেখলেন বৃদ্ধ জমিদার। ‘নিশ্চয়ই ওই বদমাশ পিটারসন, ওই খবর দিয়েছে তোমাদের। জিনিসগুলো লুকিয়ে রেখে, এখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য বলে দিয়েছে কোথায় আছে।’

ঘটনা যে এ রকমও হতে পারে, ভেবে দেখেনি কিশোর বা রবিন। ফ্যালফ্যাল করে মি. বিলসনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা। শেষ পর্যন্ত মুখ খুলল রবিন।

‘মি. পিটারসনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এটার,’ বলল সে। ‘আসল চোরটা ধরা পড়েছে। ও-ই জানিয়েছে যে চোরাই মালগুলো পুরানো টাওয়ারে লুকানো আছে। এখন আপনি খোঁজার অনুমতি দিলে আমরা ওগুলো বের করে দিতে পারি।’

‘আসল চোরটা কে?’

‘এই মুহূর্তে আপনাকে বলতে পারছি না, স্যার। আগে সম্পদগুলোর হদিস পাওয়া যাক। তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলব আপনাকে।’

চোখ থেকে চশমা নামিয়ে রুমাল দিয়ে মুছলেন মি. বিলসন। কয়েক মুহূর্ত সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলেদের দিকে। তারপর হাঁক দিলেন:

‘কোরিয়া!’

মিটমিটে আলোয় ঢাকা হলওয়ের ওপাশ থেকে উঁচু মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল।

‘কিছু বলছ?’

‘একবার একটু এসো তো এদিকে।’

স্কার্টে লাগানো পুঁতির ঝমঝম আওয়াজ তুলে আবির্ভূত হলেন কোরিয়া বিলসন। ফ্যাকাসে গায়ের রং, সোনালি চুল। হালকা–পাতলা গড়নের ভদ্রমহিলা। বছর কুড়ি আগের ছাটের ঝলমলে পোশাক পরনে। তাতে রংধনুর সব রং যেন মেতে উঠেছে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে।

‘আবার কী হলো? তোমার জন্য দেখছি একদম স্বস্তিতে কাজে বসার উপায় নেই, জন?’

‘পুরানো টাওয়ারটা দেখতে চায় এই ছেলেগুলো।’

‘কী কারণে, শুনি? কী আছে ওখানে?’

ভয় হলো কিশোর আর রবিনের, মহিলা মনে হয় রাজি হবে না দেখতে দিতে। নরম গলায় বলল কিশোর, ‘আমার চাচা, ডিটেকটিভ রাশেদ পাশার হয়ে কিছু তদন্তের কাজ করছি আমরা...’

‘ওদের ধারণা, চুরি যাওয়া গয়না আর বন্ডগুলো খুঁজে বের করতে পারবে ওরা টাওয়ারে,’ কিশোরের কথাটা শেষ করে দিলেন জন বিলসন।

‘ও, ওরা খুঁজে বের করবে? ওরা?’ হিমশীতল গলায় মহিলা বললেন। ‘তা, গয়না আর বন্ডগুলো টাওয়ারে গেল কীভাবে?’

‘আমাদের কাছে সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, চুরির পর ওগুলো টাওয়ারে লুকিয়ে রাখা হয়েছে,’ কিশোর বলল তাঁকে।

পরিষ্কার সন্দেহ নিয়ে ছেলেদের দিকে তাকালেন মিসেস বিলসন। ‘তো, চোরেরা এতই ছাগল যে আর জায়গা পায়নি, যে বাড়ি থেকে চুরি করেছে সেখানেই চোরাইমাল লুকিয়ে রাখবে!’ উপসংহারে এলেন তিনি।

‘আমরা শুধু সাহায্য করার চেষ্টা করছি আপনাদের,’ বলল রবিন।

‘দেখো তাহলে, কি পাও,’ নাক–মুখ কোঁচকালেন ভদ্রমহিলা। ‘তবে হ্যাঁ, ওই টাওয়ারটা টুকরো টুকরো করে ফেললেও কিছুই পাবে না তোমরা, বলে রাখছি। যত্তসব ফালতু কাজ।’

জন বিলসনের পেছন পেছন ম্লান হলঘর আর করিডর ধরে এগিয়ে চলল ওরা পুরানো টাওয়ারটার দিকে। বৃদ্ধ জানালেন, বোনের মতো তাঁরও ধারণা ওদের খোঁজাখুঁজি একেবারেই বিফলে যাবে।

‘তারপরও একটু চেষ্টা করে দেখি না, মি. বিলসন,’ বলল কিশোর।

‘আমাকে আবার আসতে বোলো না যেন, আমার হাঁটুতে ব্যথা। আজ বিকেলেই কয়েকটা নতুন ডাকটিকিট পেয়েছি। ওগুলো গুছিয়ে রাখার সময়ই তোমরা এসে বাধা দিলে। কাজটা শেষ করতে হবে আমাকে।’

ওদের নিয়ে ধুলায় ঢাকা একটা করিডরে হাজির হলেন বৃদ্ধ। দেখাই যাচ্ছে, বহুদিন ব্যবহার করা হয় না এটা। আসবাবপত্র নেই, একেবারে খালি। শেষ মাথায় একটা ভারী দরজা। তালা দেওয়া। মি. বিলসন ওটা খুলে দিতে, বর্গাকার একটা ঘর চোখে পড়ল ছেলেদের। প্রায় মাঝামাঝি থেকে উঠে গেছে এক সারি কাঠের সিঁড়ি, ব্যাপক কারুকাজ করা হাতল। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছাদের দিকে উঠে গেছে ধাপগুলো। পাঁচতলার সমান হবে। প্রতিটি তলায় একটা করে ঘর।

‘এটাই তোমাদের জায়গা,’ ঘোষণা করলেন মি. বিলসন। ‘সবখানে খুঁজে দেখো— যদিও কিছুই পাবে না সেটা নিশ্চিত।’

এটুকু মন্তব্য করেই ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। লেংচে লেংচে চলে গেলেন করিডর ধরে। হাড্ডিসর্বস্ব হাতে তখনো ডাকটিকিটের পাতা ধরা।

পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা। ‘হতাশ করে দেওয়া কথাবার্তা, কী বলো?’ শুকনো মুখে বলল রবিন।

সতেরো

‘জিনিসগুলো ফেরত দেওয়াই উচিত না ওকে,’ রাগ দেখিয়ে বলল কিশোর। তারপর কাঁধ ঝাঁকাল। ‘চলো, টাওয়ারে উঠে খুঁজতে শুরু করি।’

যত্নের সঙ্গে ধাপগুলো পরীক্ষা করল কিশোর আর রবিন। কোনো পায়ের ছাপ আছে কি না দেখল। কিন্তু কিছুই দেখা গেল না।

‘ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে,’ বলল কিশোর। ‘ইদানীং ডোবার এখানে এসে থাকলে, ওর পায়ের ছাপ তো থাকার কথা। কিন্তু ধুলা দেখে তো মনে হচ্ছে, অন্তত এক বছরের মধ্যে কারও পা পড়েনি এখানে।’

‘হয়তো যতটা ভাবছ, তার চেয়ে বেশি ধুলা পড়ে এখানে,’ বলল রবিন। ‘কিংবা জোর বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে।’

পুরানো টাওয়ারের দোতলা পরীক্ষা করে দেখা গেল, লুটের মাল লুকানোর মতো কোনো জায়গায়ই নেই সেখানে। একমাত্র সিঁড়ির তলাটা বাদে। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না।

পরের তলায় উঠে, সিঁড়ির বাঁ দিকের ঘরটায় ঢুকল ওরা। এই মাত্র যেটা থেকে এল, সেটার মতোই ফাঁকা শ্মশান এ ঘরটাও। আগের মতোই পুরু ধুলা চারদিকে, মাকড়সার জাল আর নোংরা ঝুল-কালিতে প্রায় বুজে আছে জানালাগুলো। সমগ্র জায়গাটার পরিবেশে কালের ক্ষয়ীষ্ণু ছাপ। যেন বহু বছরেও পা পড়েনি কোনো জনমানবের।

‘এখানে কিচ্ছু নেই,’ দ্রুত একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল কিশোর। ‘ওপরে যেতে হবে।’

পরের তলায় উঠে এল ওরা। এবারও ঘর আর সিঁড়ির নিচটা পরীক্ষা করে পরাজয় মেনে নিতে হলো ওদের।

তার ওপরের তলাটাও প্রথমটা আর দ্বিতীয়টার হুবহু সংস্করণ। নিরানন্দ, খাঁ খাঁ শূন্যতা। ধুলায় ধূসরিত। সামান্য জায়গাও নেই কোনো কিছু লুকানোর। এমন কোনো চিহ্নও নেই যা দিয়ে বোঝা যায়, বহু বছরের ভেতরে এদিকে পা পড়েছে কারও।

‘খুব একটা ভরসা তো লাগছে না, রবিন। কি জানি, হয়তো টাওয়ারের মাথায় উঠে গিয়েছিল ডোবার।’

বিফল হয়ে খুঁজতে খুঁজতে ছাদ অবধি চলে এল ছেলেরা। একটা ট্র্যাপডোর দেখতে পেল, যেটা নিচের দিকে খোলে। ওটা দিয়ে ঢুকলেই টাওয়ারের মাথা। ছিটকিনি সরিয়ে পাল্লা ধরে টান দিল কিশোর। কিন্তু নড়ল না ওটা।

‘আমিও হাত লাগাই দেখি,’ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল রবিন।

দুজন মিলে গায়ের জোরে টানতে লাগল পুরানো টাওয়ারের অবাধ্য ট্র্যাপডোরটা ধরে। আচমকা হাঁ হয়ে খুলে এল পাল্লা। তাল হারিয়ে ফেলল ছেলেরা। সিঁড়ি বেয়ে উল্টে পড়তে শুরু করল কিশোর।

আর রবিন, গগনবিদারী এক চিত্কার দিয়ে, রেলিং টপকে ছিটকে পড়ল শূন্যে!

খপ করে সিঁড়ির হাতলের একটা কাঠের শিক ধরে ফেলল কিশোর। কোনোমতে ধাপ গড়িয়ে নিচে পড়া থেকে বাঁচাল নিজেকে। রবিনকে শূন্যে পড়ে যেতে দেখেছে সে। আশঙ্কা করল, এই বুঝি পাঁচতলা থেকে নিচে আছড়ে পড়ার, গা-গুলানো আওয়াজ কানে আসবে।

‘রবিন!’ সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বিড়বিড় করল সে। ‘হায় হায়, এ কী হলো, রবিন!’

কিন্তু আওয়াজটা না শোনাতে অবাক লাগল কিশোরের। হাতলের ওপর দিয়ে উঁকি দিল সে। অজ্ঞান হয়ে টাওয়ারের তলায় পড়ে নেই রবিন। তার বদলে, নিচতলার দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে থাকা দুটো শিক ধরে ঝুলছে কোনোমতে।

স্বস্তির এক মস্ত নিশ্বাস ফেলে নিচতলায় ছুটে গেল কিশোর। হাত ধরে টেনে তুলে আনল রবিনকে, বসিয়ে দিল সিঁড়ির ধাপে। ধপ করে কিশোরও বসে পড়ল তার পাশে। পতনের ধাক্কা সামলাতে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে রবিন।

অবশেষে কথা বের হলো রবিনের গলা দিয়ে। ‘থ্যাঙ্কস। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, আমার গোয়েন্দা জীবনের মনে হয় এখানেই ইতি!’

স্কুলের জিম টিচারকেও ধন্যবাদ দেওয়া উচিত তোমার। তার বদৌলতেই তো অমন শিক ধরে ঝোলার কসরত শিখতে পেরেছ,’ বলল কিশোর। ‘নিশ্চয়ই শিক দুটো ধরেছিলে তুমি ক্যামেরার ফ্ল্যাশের গতিতে।’

মুখ তুলে ওপরে তাকিয়ে আছে ছেলেরা। খুশি আর দুশ্চিন্তার মাঝামাঝি একটা ভাব খেলা করে গেল ওদের চোখে–মুখে।

‘মিস্টারের বিলসন যদি শোনেন,’ বলল কিশোর, ‘আমরা তাঁর ট্র্যাপডোর ভেঙে ফেলেছি, মোটেও খুশি হবেন না।’

‘তা তো হবেনই না। এসো, দেখি মেরামত করা যায় কি না।’

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল ছেলেরা। কতটুকু ক্ষতি হয়েছে পরীক্ষা করল। দেখা গেল, কাঠ পচে যাওয়ায় কবজা খুলে চলে এসেছে। চৌকাঠে নতুন এক টুকরা কাঠ লাগালেই পাল্লাটা আবার বসিয়ে দেওয়া যাবে যথাস্থানে।

‘নিচে যাওয়ার আগে এসো, ছাদটা একবার ঘুরে দেখি,’ বলল রবিন। ‘আমরা ধারণা করেছিলাম, চোরাইমালগুলো হয়তো ছাদে রাখা আছে। মনে আছে?’

কিশোর আর রবিন দরজা গলে, রেলিংয়েঘেরা একটা সংকীর্ণ কার্নিশে বেরিয়ে এল। চারপাশ থেকে পেঁচিয়ে রেখেছে চৌকো টাওয়ারটাকে। কিছুই নেই ওখানে।

‘এত কষ্টের একমাত্র পুরস্কার এই যে এখান থেকে রকি বিচ শহরটাকে সুন্দর দেখা যাচ্ছে,’ ম্লান হেসে বলল কিশোর।

ওদের নিচে বিছিয়ে রয়েছে ব্যস্ত শহর। পুবে, রকি উপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ঝিকমিকি করছে।

‘চাচাকে মনে হয় বোকা বানিয়েছে ডোবার,’ আস্তে আস্তে বলল কিশোর। ‘বহু বছর এই টাওয়ারে আসেনি কেউ।’

মন খারাপ করে শহরের ওপর চোখ বুলিয়ে আনল ছেলেরা। বিলি ম্যানশনের সীমানায় এসে থামল ওদের দৃষ্টি। প্রাসাদের অসংখ্য ছাদের সব কটি ওদের বহু নিচে। আর ঠিক ওদের বরাবর, ওপাশে উঠে গেছে নতুন টাওয়ারের প্রকাণ্ড কাঠামো।

‘কী মনে হয়, ডোবার ওই নতুন টাওয়ারটার কথাই বলেনি তো?’ আচমকা উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন।

‘চাচা নির্দিষ্ট করে পুরোনোটার কথা বলে দিয়েছে।’

‘কিন্তু তাঁর তো ভুলও হতে পারে। নতুনটাকেও তো পুরোনোই দেখাচ্ছে। চল, মি. বিলসনকে বলে দেখি, নতুনটায়ও খুঁজতে দেন কি না।’

‘চেষ্টা করে অবশ্য দেখা যায়। ভয় হচ্ছে, ট্র্যাপডোরের কথা শুনলেই না আবার ‘‘না’’ করে বসেন।’

ফাঁক গলে নিচে নেমে এল ছেলেরা। পাল্লাটা তুলে জায়গামতো বসিয়ে ছিটিকিনি আটকাল। কিশোরের ছোট নোটবুকটা গুঁজে দিল ভাঙা পাশে। যদিও পাল্লাটা আটকে থাকল, কিন্তু কিশোর আর রবিন বুঝতে পারছে, সামান্য বাতাসেই খসে আসবে ওটা।

দুদ্দাড় করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ছেলেরা। করিডর ধরে চলে এল ভবনের মূল অংশে।

একটা দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করলেন কোরিয়া বিলসন। ‘চোরাইমালগুলো কোথায়?’

‘খুঁজে পাইনি,’ স্বীকার করল কিশোর।

নাক দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ করলেন মহিলা। ‘কী, বলেছিলাম না তোমাদের! ফালতু সময় নষ্ট!’

‘এখন মনে হচ্ছে,’ চট করে বলল রবিন, ‘মালগুলো হয়তো নতুন টাওয়ারে লুকানো আছে।’

‘নতুন টাওয়ারে, অ্যাঁ!’ গর্জে উঠলেন মিস বিলসন। ‘যতসব আজগুবি কথা! তার মানে এখন গিয়ে নতুন টাওয়ারে খুটুরখাটুর করতে চাইবে।’

‘ইয়ে, আপনাদের যদি ঝামেলা না হয়, আরকি।’

‘হবে না মানে!’ খনখনে গলায় চিৎকার করে উঠলেন মহিলা। ‘অহেতুক শয়তানি আমার বাড়িঘর তছনছ করবে ছেলে দুটো, সেটা আমি মোটেও বরদাশত করব না। তোমরা এখন বিদেয় হও। আর ওসব আলতু-ফালতু চিন্তা দূর করো মাথা থেকে।’

মহিলার চিৎকার কানে গেল জন বিলসনের। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন লেংচাতে লেংচাতে।

‘আবার কী হলো?’ কড়া গলায় জানতে চাইলেন তিনি। তাঁর বোন তাঁকে জানাতেই বিজয়ীর হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল বৃদ্ধের মুখ। ‘অ্যাঁ! তাহলে কিছুই খুঁজে পাওনি তোমরা! ভেবেছিলে পিটারসনকে বাঁচাতে পারবে। কই, পারলে না তো!’

‘এখনো পারিনি,’ জবাব দিল কিশোর।

‘ছেলেগুলোর স্পর্ধা দেখেছ,’ মাঝখানে বললেন মিস বিলসন, ‘নতুন টাওয়ারেও খুঁজতে যেতে চায়!’

চোখ কটমট করে ছেলেদের দিকে তাকালেন জন বিলসন। ‘কক্ষনো না!’ হিসিয়ে উঠলেন। ‘আমাদের ছাগল পেয়েছ তোমরা?’ মুঠি পাকানো হাত নাড়লেন ওদের মুখের সামনে।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর আর রবিন। আর উপায় নেই, কেননা মালগুলো নতুন টাওয়ারে থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে ওদের, তা জানাতেই হচ্ছে।

‘মি. বিলসন,’ গলা খাকারি দিয়ে শুরু করল কিশোর। ‘আপনার চুরি যাওয়া মালগুলোর তথ্যটা এসেছে যে লোক ওটা চুরি করেছে, তার কাছ থেকে। আর লোকটা মি. পিটারসন নয়।’

‘কী! তার মানে কাজটা অন্য কারও? সে কি ধরা পড়েছে?’

‘আটক করা হয়েছিল তাকে, কিন্তু এখন আর বেঁচে নেই।’

‘মারা গেছে? ঘটনাটা কী?’ উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন জন বিলসন।

‘লোকটার নাম রেড ডোবার। কুখ্যাত এক ক্রিমিনাল। চাচা ওর পিছু লাগলে রেলের হ্যান্ডকা নিয়ে পালাতে চাইছিল। ওটা বিধ্বস্ত হলে মারাত্মক আহত হয় সে,’ বলল  কিশোর।

‘তাহলে যে তথ্যের কথা বলছ, সেটা পেলে কোথায়?’ মি. বিলসনের প্রশ্ন।

পুরো ঘটনাটা বর্ণনা করে সবশেষে বলল কিশোর, ‘ভাবছি, ডোবারের কোনো ভুল হয়েছিল। আসলে জিনিসগুলো লুকিয়েছিল সে নতুন টাওয়ারে।’

‘তো এই ডোবার ব্যাটা ডাকাতির কথা স্বীকার করেছে, অ্যাঁ?’

‘সবকিছু স্বীকার করেছে। একসময় এদিকেই কাজ করত সে। রকি বিচ এলাকাটা তার ভালমতো চেনা ছিল। চুরিটা করার আগে কয়েক দিন ঘোরাফেরা করেছিল শহরে।’

‘বেশ,’ ধীরেসুস্থে বললেন বিলসন, ‘ও যদি মালগুলো পুরানো টাওয়ারে লুকোনোর কথা বলে থাকে, আর সেগুলো যদি সেখানে না পাওয়া যায়, তাহলে তো অবশ্যই নতুন টাওয়ারে থাকবে, তোমরা যেমনটা বললে।’

‘আমাদের খুঁজে দেখতে দেবেন?’ ব্যগ্র হয়ে বলল রবিন।

‘হ্যাঁ। আর আমিও সাহায্য করব। গয়না আর বন্ডগুলো বের করতে তোমাদের মতো আমিও উদ্‌গ্রীব হয়ে আছি। চলো, যাই।’

ছেলেদের প্রাসাদের অন্য প্রান্তের একটা দরজার দিকে নিয়ে চললেন মি. বিলসন। ওটার ওপাশেই নতুন টাওয়ার। এবার যথেষ্ট খোশ মেজাজে আছেন বদমেজাজি বৃদ্ধ। কিশোর দেখল, এ-ই সুযোগ, তাঁকে ভাঙা ট্র্যাপডোরটার কথা বলার। বলে ফেলল কিশোর। পয়সা সাধল মেরামতের জন্য।

‘আরে, ওটা কোনো ব্যাপার নয়,’ দরাজ গলায় বললেন বৃদ্ধ। ‘আমিই ঠিক করিয়ে নেব। সত্যি বলতে কি, আমাদের পিটারসন—ওহ্ হো, ভুলেই গিয়েছিলাম। যাকগে, ছুতোর মিস্ত্রি ডেকে আনব।’

আর কিছু না বলে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন তিনি। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর আর রবিন। সামান্য বকাঝকাও করলেন না ওদের!

দরজাটা খুলে ভেতরের করিডরে পা রাখলেন প্রাসাদের মালিক। পিছু নিল কিশোর আর রবিন, উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে দুজন।

আঠারো

নতুন টাওয়ারের ঘরগুলো আসবাবপত্রে সাজানো হয়েছিল টাওয়ারটা নির্মাণের সময়ই। কিন্তু কদাচিৎ, দৈবক্রমে কোনো মেহমান এসে পড়লে ওই ঘরগুলোয় থাকতে দেওয়া হয়, জানালেন মি. বিলসন। প্রথম ঘরটাতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পেল না কিশোর, রবিন আর মি. বিলসন। দেয়াল আলমারি, দেরাজ, টেবিলের ড্রয়ার, আসবাবপত্রের তলায়—কোথাও কিছু নেই। এমনকি কার্পেট আর ম্যাট্রেসের তলাগুলো পর্যন্ত উল্টে দেখা হলো। অবশেষে যখন পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলো যে এ ঘরে কিছু লুকানো নেই, তখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ঘরের দিকে চলল ওরা। আরও একবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো ওদের তদন্তকর্ম।

বদমেজাজি জন বিলসনও আবার তাঁর স্ব-মূর্তি ধারণ করেছেন। ছেলেদের কাহিনি শুনে খানিকটা নরম হয়েছিলেন বটে, কিন্তু টাওয়ারের সব ঘর খুঁজেও যখন কিছুই পাওয়া গেল না, বিরক্তিতে ফেটে পড়লেন তিনি।

‘সব ধাপ্পাবাজি!’ ঘোঁত ঘোঁত করে উঠলেন। ‘ঠিকই বলেছিল কোরিয়া। আমি একটা গাধা! আর সবকিছুর মূলে—ওই পিটারসন ব্যাটা!’

‘কিছুই বুঝলাম না!’ ধৈর্যচ্যুতি ঘটল রবিনেরও। ‘ডোবার নিজেই বলেছিল টাওয়ারে নাকি জিনিসগুলো লুকিয়েছিল সে।’

‘সত্যিই যদি ওই লোক টাওয়ার দুটোর কোনো একটাতে গয়না আর বন্ড লুকিয়ে থাকে,’ খানিকটা নরম হয়ে বললেন বিলসন, ‘তাহলে নিশ্চয়ই কেউ এসে নিয়ে গেছে সেগুলো—হয়তো আর কেউ ছিল ওর সঙ্গে। তা না হলে চুরির পরপরই হয়তো পিটারসনের চোখে পড়ে যায় ওগুলো। চুপচাপ কাউকে কিছু না বলে নিয়ে গেছে সে।’

‘আমি নিশ্চিত, অমন কাজ করবে না মি. পিটারসন,’ প্রতিবাদ করল রবিন।

‘তাহলে নয় শ ডলার কোথায় পেল ও? বোঝাও আমাকে। পিটারসন তো আর বলবে না!’

মূল প্রাসাদে ফেরার পথে, নিজের অনুমানের কথাটাই আবার বললেন তিনি। লুটের মাল যেহেতু পাওয়া গেল না, তাতে তার সন্দেহ আরও বেড়েছে, কোনো না কোনোভাবে পিটারসনই জড়িত এর সঙ্গে।

‘দেখো গে ডোবারের সঙ্গেই জোট বেঁধেছিল কি না!’ সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন।

আবারও বলল ছেলেরা, ক্রিমিনালদের সঙ্গে মাখামাখির মতো লোকই নয় সাবেক কেয়ারটেকার। তারপরও নিজেরাই হতভম্ব হয়ে পড়েছে ছেলেরা। হতাশ হয়েছে। সেই সঙ্গে উদ্বিগ্নও। ওদের অনুসন্ধান যেন মি. পিটারসনের দিকেই ইঙ্গিত করছে আরও গভীরভাবে।

মূল ভবনের হলঘরে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল কোরিয়া বিলসনের সঙ্গে। সার্চ-পার্টিকে খালি হাতে ফিরতে দেখে দূর থেকেই উল্লাসে কক কক করে উঠলেন মহিলা। ‘বলেছিলাম না তোমাকে?’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘জন বিলসন, তোমাকে গাধা বানিয়ে দিল ছেলে দুটো!’

কিশোর আর রবিনকে সদর দরজায় দিয়ে গেলেন তিনি। আর মি. বিলসন, বিমূঢ় হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ঢুকে গেলেন তাঁর স্টাডি রুমে।

‘একেবারে লেজেগোবরে করে ফেললাম আমরা, কিশোর,’ বলল রবিন। মোটরসাইকেলের দিকে হাঁটছে দুজন। ‘নিজেকে একেবারে নিঃশেষ মনে হচ্ছে।’

‘আমারও।’

হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ফিরে এল ওরা। হতাশার সংবাদটা দিতে হবে ওদের চাচাকে। লুকানো মালগুলো দুটো টাওয়ারের একটাতেও পাওয়া যায়নি শুনে থ হয়ে গেলেন রাশেদ পাশা। ‘জায়গাগুলো ভালোভাবে দেখেছ, শিওর?’

‘প্রতিটি ইঞ্চি। চোরাইমালের কোনো চিহ্নও নেই। আর পুরানো টাওয়ারের ধুলা দেখেই তো বলে দেওয়া যায়, বহু যুগ কারও পা পড়েনি ওখানে,’ জবাব দিল কিশোর।

‘তাজ্জব ব্যাপার,’ বিড়বিড় করলেন রাশেদ পাশা। ‘আমি শিওর, মিছে কথা বলেনি ডোবার। আমাকে ঠকিয়ে ওর বিন্দুমাত্র ফায়দা নেই। “পুরানো টাওয়ারে লুকিয়ে রেখেছি”—ঠিক এই কথাটাই বলেছিল সে। আর পুরানো টাওয়ার বলতে বিলি ম্যানশন ছাড়া আর কী বোঝাবে ও? আর টাওয়ারের সঙ্গে “পুরানো” শব্দটাই বা কেন ব্যবহার করবে? যেহেতু রকি বিচ ওর চেনা শহর, কাজেই ওর জানা থাকার কথা, নতুন আর পুরানো—দুটো টাওয়ার আছে টাওয়ার ম্যানশনে।’

‘হয়তো সত্যিই ভালো করে দেখিনি আমরা,’ বলল রবিন। ‘কোন একটা মেঝের নিচে থাকতে পারে মালগুলো। কিংবা আলগা কোনো দেয়ালের পেছনে। ওসব জায়গা তো আর দেখিনি আমরা।’

‘হুঁ, এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা,’ সায় দিলেন মি. পাশা। ‘আমি এখনো বুঝতে পারছি না যে চোরাইমালগুলো ওখানে নেই কেন? দেখি, বিলসনের সঙ্গে কথা বলে দুটো টাওয়ারেই আরেকবার তল্লাশির অনুমতি চাইব। কিশোর, তোর চাচির সঙ্গে দেখা কর, কিছু আনাবে বোধ হয়।’

চলবে...

আরও পড়ুন