অপারেশন মুক্তাগাছা (দ্বিতীয় পর্ব)

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

...১৯৭০

ঘুম ভাঙল বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দে।

রাতের বেলা ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা দুই ভাই একটা বিছানায় শুয়ে আছি। পাশে আরেকটা বিছানায় মিতাপু। পাশের ঘরে আব্বা আর আম্মা। অন্ধকারে শোঁ শোঁ শব্দ। ভয়ানক শব্দ। আমরা যে বিল্ডিংয়ে থাকি, সেটা তিনতলা। আমরা থাকি দোতলায়। পুরো বিল্ডিংটা একটা হোস্টেল। হোস্টেলে যারা থাকেন, আম্মা তাদের বলেন ‘ছাত্র’। আসলে তারা শিক্ষক কিংবা শিক্ষক হতে চান। পিটিআই মানে প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়া হয় এখানে। প্রচণ্ড বাতাসে একেকটা দরজা–জানালার কবাট বাড়ি খাচ্ছে বাতাসে। শব্দ হচ্ছে ভীষণ। আর সেই সঙ্গে বিজলি চমকাচ্ছে। বাজ পড়ছে। কামানের গর্জনের মতো শব্দ হচ্ছে। অন্ধকার ঘর হঠাৎ হঠাৎ আলোয় ভরে যাচ্ছে। রিটন ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। তিনিও ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। পাশের বিছানা থেকে মিতাপু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তবু ভয় যায় না। আমার মনে হচ্ছে এই ঝড়ে আমাদের বিল্ডিং ভেঙে যাবে।

আমরা তিন ভাইবোন পাশের ঘরে চলে এলাম। আম্মা–আব্বারও ঘুম ভেঙে গেছে। আমরা পাঁচজন এক বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে আছি। আম্মার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছি আমি। আম্মার আঁচল দিয়ে চোখমুখ–মাথাকান ঢেকে রেখেছি। তবু ভয় যায় না। জানালায় ঝাপটা মারছে বাতাস। চারদিকে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে। বাজের কড়াৎ কড়াৎ শব্দে কান ফেটে যাবে নাকি? আজই বুঝি দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে।

আমি বলি, আম্মা।

আম্মা বলেন, কী বাবা!

আম্মা, এই বিল্ডিং ভেঙে যাবে। চলেন নিচে যাই।

নিচে কই যাব?

সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের গোয়ালঘরে যাই।

বিল্ডিংয়ের পাশে সুপার সাহেবের গরু রাখার গোয়ালঘর। ওপরে খড়ের চাল। নিচে বাঁশের বেড়া। সেখানে তার তিনটা গরু, দুইটা বাছুর থাকে। গরুগুলোর দেখাশোনা করে আবদুল আলী। গরু চরায়। ঘাস কাটে।

আমার এমন ভয় লাগছে, মনে হচ্ছে, এই দোতলা থেকে নেমে ওই গোয়ালঘরে আশ্রয় নিলে বেঁচে যাব!

আম্মা বললেন, ঝড়ের সময় বিল্ডিংই ভালো। এটা ভাঙবে না। ওই গোয়ালঘর তো ঝড়ে ভেঙে যাবে। বাতাসে উড়ে যাবে।

ভয়ের চোটেই কখন যে আম্মার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছি, টের পাইনি। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ঝড় থেমে গেছে। আকাশ পরিষ্কার। তবে চারদিকের গাছপালা সব ভেজা। মাঠের ঘাস ভেজা। আমার আর মিতাপুর নিজেদের লাগানো ফুলগাছগুলো সব হেলে আছে মাটির সঙ্গে। এখানে–ওখানে দু–চারটা গাছ উপড়ে পড়ে আছে। পড়ে আছে ভাঙা ডাল। সবচেয়ে বেশি ভেঙেছে কৃষ্ণচূড়ার ডাল।

আমার আর মিতাপুর একটা বাগান আছে। নিচে একটা জায়গায় একটা একটা করে ইট পুঁতে আমরা একটা বৃত্ত তৈরি করেছি। তার ভেতরে আমরা ফুলগাছ লাগাই।

একটা ফুলের নাম বিস্কুট ফুল।

কবির স্যার অবশ্য বলেন, এই ফুলের নাম নয়নতারা।

একটা ফুলের নাম মোরগ ফুল।

একটা ফুলের নাম নাইন ও’ক্লক ফুল।

পিটিআইয়ের মালি মাহতাব আলী চাচার কাছ থেকে আমরা কসমস ফুলের বীজ এনেছিলাম। সেই বীজ ছিটিয়ে পানি দিয়েছিলাম। গাছগুলো কেবল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। আহা, সেসব এখন ঝড়বৃষ্টির আঘাতে মাটিতে নুয়ে পড়ে আছে। আমি আর মিতাপু স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে গায়ে সোয়েটার চাপিয়ে সেই গাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। গাছগুলোর কথা ভেবে ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার।

আমি বসলাম। মিতাপুও বসলেন। আমরা গাছগুলোকে আলতো হাতে ধরে সোজা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। রিটন ভাই ডাকল, মিঠুন, মিতা। এদিকে আয়।

গাছের মায়া ছেড়ে ভাইয়ার দিকে ছুটলাম আমরা। বিল্ডিংয়ের আরেক ধারে গিয়ে দেখি, গোয়ালঘরটা নাই। কয়েকটা খুঁটি কেবল দাঁড়িয়ে আছে। আবদুল আলী ছোটাছুটি করছে। গরু–বাছুরগুলো কোনদিকে চলে গেছে কে জানে। অথচ রাতের বেলা ভয় পেয়ে এই গোয়ালঘরে এসেই আশ্রয় নিতে চেয়েছিলাম আমি!

সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের মেয়ে বিলকিস। ক্লাস ফোরে পড়ে। তার ভাই বাদল। বাদল ছেলেটার মনে হয় একটা কিছু সমস্যা আছে। কথা বলে কম। কী বলে, ভালো করে বোঝা যায় না। সে আমার চেয়ে একটু বড়। কিন্তু এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। তার একটা রিকশা গাড়ি আছে। আমি সেটা চালাই। বাদল চালাতে পারে না। সে বসে থাকে। আমি তার রিকশা ঠেলে দিই। আম্মা বলেন, এই বোকা, তুই কেন ওর রিকশা ঠেলিস?

আমি আম্মাকে বলি, আম্মা, ও তো পারে না।

তাই বলে তুই খাটবি নাকি!

বড়রা অনেক কিছু বোঝেন না। আমি তো খাটি না। আমি ওর সঙ্গে খেলি।

বাদল আর বিলকিস স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে হাত ধরাধরি করে এদিকে এল। ওরা আমাকে আর মিতাপুকে বলল, এই, আমাদের গরুগুলো হারিয়ে গেছে। তোমরা কি দেখেছ?

আমি বললাম, না দেখিনি।

বাদল বলল, না দেখিনি।

বিলকিস বলল, চলো আমরা গরু খুঁজতে যাই।

রিটন ভাই বললেন, যা বাতাস ছিল কাল রাতে, গরুগুলোকে মনে হয় উড়িয়ে নিয়ে গেছে।

বাদল বলল, উড়িয়ে নিয়ে গেছে।

পাঁচজন মিলে গরু খুঁজতে বের হলাম আমরা। পিটিআইয়ের দুইটা পাকা বিল্ডিংয়ের চারপাশ ঘুরে ঘুরে গরু খুঁজছি। কিন্তু গরুগুলোকে পাওয়া গেল না। এবার জঙ্গলগুলোর ভেতরে খোঁজা দরকার। কিন্তু জঙ্গলে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। প্রচুর সাপ জঙ্গলে।

হঠাৎ হাম্বা রব শোনা গেল। আওয়াজটা আসছে বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকেই। আমরা ক্লাসরুমের দিকে শব্দের উৎস সন্ধানে ছুটতে লাগলাম। দেখা গেল, ক্লাস ফোর আর ফাইভের সামনে বারান্দায় কয়েকটা গরু। এই রাতের অন্ধকারে হোস্টেলের দিক থেকে ছুটে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে গরুগুলো এখানে কীভাবে এল, আমরা বলতে পারলাম না।

আব্বা রেডিও শুনতে লাগলেন। ব্যাটারি ঠিকভাবে কাজ করছে না।

রিটন ভাই বললেন, আব্বা, টাকা দেন। ব্যাটারি কিনে আনি।

আম্মা বললেন, ব্যাটারি কেনার টাকা নাই।

রিটন ভাই বললেন, আজকে তো কেবল ৪ তারিখ। বেতনের টাকা আছে না?

আব্বা টাকা দিলেন।

আমরা দুজন, আমি আর রিটন ভাই, বের হলাম রেডিওর জন্য ব্যাটারি কিনতে হবে বলে। আমাদের ছোটার রাস্তা চিরপুরাতন। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলে একটা শর্টকাট পায়ে চলার পথ। বৃষ্টিভেজা সেই পথ ধরে আমরা ছুটছি বন্দরের দোকানের দিকে।

ব্যাটারি আনার পর আব্বার রেডিও একটু ভালো করে শোনা যেতে লাগল। আব্বা বললেন, সাংঘাতিক ব্যাপার। সাইক্লোনে লাখ লাখ লোক মারা গেছে। জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। মানুষ সমুদ্রে ভেসে গেছে।

কী ভয়ঙ্কর! ঝড়ে–জলোচ্ছ্বাসে কত ক্ষতি হয়েছে মানুষের! লাখ লাখ মানুষ নাকি মারা গেছে। এটা ছিল ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে। আমি ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে।

কিন্তু বিলকিস কাঁদছে একটা বাছুরের জন্য। তার কান্না দেখে বাদল মাঝেমধ্যে চিৎকার করে হা হা হেসে উঠছে।

বিলকিসের কান্না দেখে আমিও কাঁদছি। মিতাপুও কাঁদছেন। তাদের লাল বাছুরটা মারা গেছে। পিটিআই হোস্টেলের পাকঘরের পেছনে বাছুরটার লাশ পড়ে আছে।

রিটন ভাই বললেন, বিলকিস, কেঁদো না। তোমাদের লাল বাছুরটাকে কবর দেওয়া হবে না। এটাকে মমি করা হবে।

রিটন ভাইয়ের জ্ঞানের পরিধির কোনো সীমা ছিল না। সত্যি সত্যি তা–ই করা হলো। লাল বাছুরটার চামড়ার ভেতরে খড় পুরে বানানো হলো একটা নকল বাছুর। কারণ বাছুর ছাড়া গাভী দুধ দেয় না। ওই নকল বাছুরটাকে গাভীর সামনে রাখলে গাভী বাছুরটাকে জিভ দিয়ে চেটে আদর করে। তখন তার পেছনে বসে আবদুল আলী দুধ দুইয়ে নেয়।

আমার আরেকটা ক্ষতি হয়েছে ১৯৭০-এর সাইক্লোনে।

আমি একটা রেলগাড়ির সিগন্যাল পোস্ট বানিয়েছিলাম। একটা কাঠের লম্বা লাঠির ওপরে একটা ছয় ইঞ্চি স্কেলের সমান কাঠের টুকরা পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছিলাম। জিনিসটা দেখতে ইংরেজির ওয়ানের মতো। ওপরের ওই ছয় ইঞ্চি কাঠের টুকরাটার এক মাথায় সুতা বেঁধে বড়টা বরাবর নিচে নামিয়ে রেখেছিলাম। তারপর এটা সোজা বেঁধে রেখেছিলাম বারান্দার একটা পাইপের সঙ্গে খাড়া করে।

রেলগাড়ির আওয়াজ পেলেই আমি দৌড়ে এসে সুতা ঢিল করতাম। ট্রেনের সিগনাল ডাউন হতো। ট্রেন চলে গেলে সুতা ধরে টান মেরে সিগনাল আপ করতাম। ঝড়ের রাতে আমার ওই সিগনাল পড়ে ভেঙে গেল।

আম্মা বললেন, আমরা ভোট দিতে যাব দাদার বাড়িতে। সেখানে আমাদের ভোট আছে। মুক্তাগাছায় আমাদের ভোট নাই। আমরা ট্রেনে চড়ে চললাম দাদাবাড়ির উদ্দেশে। মহিমাগঞ্জে স্টেশনে নেমে আবার বাসে উঠতে হলো। তারপর গরুগাড়ি। গরুগাড়ির ভেতরে তোশক বিছানো। গাড়িতে ছই। তার ভেতরে আমরা বসা। রিটন ভাই গাড়িয়াল চাচার সঙ্গে সামনে বসলেন। রিটন ভাই নিজেও গরুর গাড়ি চালাবেন। হাতে একটা পান্টি। তিনি ‘হ্যাট হ্যাট, এই গরু ডাইনে যা, এই গরু বাঁয়ে যা’ বলতে লাগলেন। গাড়িয়াল চাচার পেছনে আব্বা। তারপর আমি আর মিতাপু। তার পেছনে আম্মা। আম্মা ছইয়ের মধ্যে বসে পেছনের দৃশ্য দেখতে লাগলেন।

গরুগাড়ি চড়া মোটেও আরামের কিছু নয়। মাঝেমধ্যেই গাড়ি পড়ে গর্তে। আর আমাদের মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি লাগে। না হলে ছইয়ের বাঁশের বাতার সঙ্গে বাড়ি খায় আমাদের মাথা। আম্মা বলেন, শক্ত করে ধরে থাকো। ধরে যে থাকব, ধরার মতো তো কিছু নাই।

দাদাবাড়ির গ্রামের নাম সাতানা। রাত হয়ে এল। বাড়ির কাছে একটা কুখ্যাত জায়গা আছে। একটা তেঁতুলগাছ এত বড় যে রাস্তাটা ওখানে দিনের বেলাতেও অন্ধকার থাকে। ভয়ে এবার ছইয়ের ভেতরে চলে এলেন রিটন ভাই।

এই গাছে নাকি তিনটা ভূত আর ছয়টা পেতনি থাকে।

রিটন ভাইয়ের হাতে টর্চলাইট। তিনি টর্চলাইটের আলো ছইয়ের ভেতরেই জ্বালিয়ে রাখলেন।

আম্মা বললেন, এই রিটন, ব্যাটারি নষ্ট করছ কেন?

রিটন ভাই বললেন, আলো থাকলে তেনারা আসেন না।

আম্মা বললেন, তেনারা কে?

রিটন ভাই বললেন, তেনাদের নাম রাতের বেলা এই তেঁতুলগাছের নিচে আমি নিতে পারব না।

মিতাপু বললেন, টর্চের আলোকে ওনারা ভয় পান না। ওনারা আগুনের আলোকে ভয় পান।

রিটন ভাই কাতর কণ্ঠে বললেন, হামিদ চাচা, ও হামিদ চাচা, আপনার কাছে না বিড়ি আছে। একটা বিড়ি ধরান। তেঁতুলতলাটা পার হই।

গাড়িয়াল হামিদ চাচা বিড়ি ধরানোর চেষ্টা করছেন। প্রচণ্ড বাতাসে তার দেশলাই কাজ করছে না।

সবাই চুপ করে আছে। আমাদের শ্বাস–প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দূরে শেয়াল ডাকছে। কুকুরও ডেকে উঠল ঘেউ ঘেউ।

হামিদ চাচা বলছেন, দুরো বাহে, দেশলাই কাম করিচ্ছে না ক্যা?

এই সময় নারীকণ্ঠে আর্তনাদ শোনা গেল। আমাদের গাড়ির ছইয়ের ওই পারে কে যেন প্রচণ্ড শব্দ করে আর্তনাদ করে উঠল। ভয়ে আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মিতাপুও আমার গায়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে ডুকরে উঠলেন রিটন ভাই।

গাছের মধ্যেও কতগুলো বাদুড়–হরিয়াল বোধ হয় নড়ানড়ি করল। গাছ থেকে নানা ধরনের শব্দ ভেসে আসছে। ভূতেরা নিশ্চয়ই গাছ থেকে নেমে আসছে। এখনই আমাদের গরুগাড়ির সামনে এসে দাঁড়াবে। গরু দুটোও ভয় পেয়ে রাস্তা ছেড়ে আরেক দিকে যেতে চাইল। হামিদ চাচা গরুর দড়ি ধরে সামলাতে পারছেন না।

আব্বা বললেন, ও হামিদ, মেয়ে মানুষের কান্নার আওয়াজ আসে কোত্থেকে?

হামিদ চাচা বললেন, আরে একটা লোক এডিও (রেডিও) হাতত নিয়া যায়। এডিওত নাটক হতিছে। নাটকের মায়ামানুষ কান্দে। দুঃখু পাইছে। নাটকের মায়ামানুষ খালি দুঃখু পায়।

আব্বা হেসে উঠলেন। আম্মা বললেন, এই তোরা সোজা হয়ে বস। রেডিও শুনে সব ভয়ে পেয়ে শেষ। কী বীর বাহাদুর একেকটা!

এদিকে হামিদ চাচা বললেন, ক্যা বাহে, তোমার কাছে আগুন হবি নাকি।

রেডিওওয়ালা লোকটা নিজেই বিড়ি খাচ্ছিল। তার বিড়ির আগুনে নিজের বিড়ি ধরালেন হামিদ চাচা। রিটন ভাই বললেন, আগুন আছে, আর কোনো ভয় নাই। আমরা নিরাপদে তেঁতুলতলা পার হলাম।

হারিকেন হাতে দাদি আর বড় আম্মা আর আমাদের জ্যাঠাতো ভাইবোনেরা সবাই এগিয়ে এসেছেন আমাদেরকে বরণ করে নেওয়ার জন্য। গাড়ি বাড়ির খুলিতে থামল। হামিদ চাচা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সামনের দিকটা ধরে থেকে গরুগুলোকে ছেড়ে দিলেন। গরু দুটো নিজের গরজে গেল তাদের চাড়ির দিকে। তারপর গাড়ির সামনের দিকটা নামিয়ে মাটিতে রাখলেন। আমরা গাড়ি থেকে নেমে এলাম। দাদি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার গা থেকে তামাকের গন্ধ আসছে। দাদির ঘরভর্তি তামাক। তার গায়ে তাই তামাকের গন্ধ লেগেই থাকে। কাঠের খড়ম পায়ে এগিয়ে এলেন দাদা।

মিঠুন কোন্টে? মিঠুন? দাদা আমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করেন। আমি গিয়ে দাদার কোলে উঠে পড়লাম। দাদিকে আর দাদাকে কদমবুসি করলেন আম্মা।

ভোটের দিন। তিনটা গরুর গাড়ির ছইয়ে সামনে–পেছনে শাড়ি প্যাঁচানো হচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা ভোট দিতে যাবেন দুই মাইল দূরের স্কুলের ভোটকেন্দ্রে। আম্মার সঙ্গে গরুর গাড়িতে আমি আর মিতাপু উঠে বসলাম। রিটন ভাই আমাদের জ্যাঠাতো ভাই মামুন ভাইয়ের সাইকেলের সামনের রডে উঠে আগেভাগে চলে গেলেন।

দাদা বললেন, বউমা, ভোট দিবা কী মার্কায়?

আম্মা, বড় আম্মা সবাই বললেন, নাওত দিমো।

দাদা বললেন, হারিকেনত দিলে ভালো হতো না?

আম্মা বললেন, না আব্বাজান। মিথ্যা কথা তো বলতে পারব না। আমরা নৌকা মার্কাতেই ভোট দিব। ছয় দফার মার্কা নৌকা।

দাদা বললেন, যুগ পাল্টায়া গেছে বউমা। তোমাদেরকে তো আর নিষেধ করতে পারি না।

স্কুলের মাঠের চারদিকে পোস্টার। বেশির ভাগই নৌকার। একটা দুইটা হারিকেনের। রিটন ভাই একটা নৌকা মার্কার ব্যাজ বুকের কাছে সোয়েটারের ওপরে সেফটিপিন দিয়ে লাগিয়েছেন।

আমি বললাম, একটা আমাকে দেন।

রিটন ভাই বললেন, নৌকা মার্কার ব্যাজ নাই। হারিকেনের আছে। নিবি?

আমি বললাম, না, নিব না।

স্কুল মাঠে অগ্রহায়ণের রোদ ঝকঝক করছে। ওই দেখো, ধানকাটা হয়ে গেছে। কাটা ধানের খেতে ধানের গোড়ালি দেখা যাচ্ছে। তাতে গরু–ছাগল চড়ছে। ওই ওদিকে বিল। বিলের পাশে হিজল গাছ। কত কত বক যে গাছে বসে আছে! বিলের পানিতেও বক এক পা তুলে মাছ শিকারের আশায় তপস্যা করছে।

আমার মন খারাপ। রিটন ভাই নৌকার ব্যাজ পেয়েছেন। আমি কিছুই পেলাম না। কেন যে গরুগাড়িতে উঠলাম!

তারিখটা ছিল ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের ৭। আব্বা, বড় আব্বা, মামুন ভাই সারা রাত রেডিওর ধারে বসে রইলেন। নৌকা কয়টা আসন পেল। হারিকেন কয়টা পেল। আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরের দিন সকালে পিঠা উৎসব শুরু হলো। আম্মা, বড় আম্মা, কাজের মহিলারা ঢেঁকি ভানছেন। নতুন ধান থেকে আটা হচ্ছে। ঢেঁকি ভানার শব্দ হচ্ছে ঢ্যাম কুড়কুড়। একজন মহিলা গান ধরলেন:

ও ধান ভানি রে

ঢেঁকিত পাড় দিয়া

ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া।

আটা বানানো হলে একটা হাঁড়িতে পানি বসিয়ে ভাপা পিঠা বানানো শুরু হলো। আরেকটা হাঁড়িতে পুলি পিঠা সেদ্ধ হতে লাগল। বড় আব্বা এলেন উঠানে চুলার কাছে। বললেন, আরেকটা চুলাত ত্যালপিঠাও বানাও।

দাদা বললেন, না না, ত্যালের দাম বেশি। ত্যালপিঠার দরকার নাই।

মামুন ভাই বললেন, দাদা, তুমি একটু মডার্ন হও তো। কবে তুমি পাকিস্তান আন্দোলন করছিলা। হারিকেন মার্কাত ভোট দিছিলা। সেই দিন কি আর আছে। এইটা হলো নৌকা মার্কার যুগ। সারা বাংলাত সবখানে নৌকা। আসো, আজ থাকা তুমিও নৌকা।

দাদা বললেন, না রে নাতি। সেইটা হয় না।

এই বাড়িতে দাদার হুকুম ছাড়া কিছু হয় না। আমরা তেলপিঠা খাব। দাদাকে রাজি করাতে হবে।

বড় আম্মা (মানে আমার জ্যাঠাইমা) বললেন, মিঠুন, বাপো, তুমি যাও। তোমার দাদার পাকা চুল তুল্যা দিয়া কও, দাদা ত্যালপিঠা খামো। তাইলেই তোমার দাদার মন গলবে।

আমি গেলাম দাদার কাছে। আমি নাকি দেখতে দাদার মতন। সবাই বলে। গোল মুখ। গোল নাক। দাদার পাকা দাড়ি। কাঁচাপাকা চুল। দাদা উঠানে বসে আছেন একটা বেঞ্চে। রোদ পোহাচ্ছেন।

আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, আচ্ছা দাদা, আপনার চুলের বয়স তো আপনার দাড়ির থেকে বেশি। তাইলে দাড়ি পেকে গেল, চুল কেন পাকল না?

দাদা বললেন, চুল পাকছে নাকি? দাও তো বাহে দাও তো নাতি, পাকা চুল তুলা দাও। একটা পাকা চুল তুললে পাঁচ পয়সা পাবা।

আমি দাদার পাকা চুল তুলছি। আরামে চোখ বন্ধ করে আছেন দাদা। আমি বললাম, দাদা, তেলপিঠা খেতে মন চায়।

দাদা বললেন, আচ্ছা তোমার দাদিক ডাকো।

আমি দৌড়ে গেলাম দাদির কাছে। দাদি দাদি, দাদা ডাকে। আসেন।

দাদি এলে দাদা বললেন, নাতি আমার তেলপিঠা খাবার চায়। অক তেলপিঠা করে দেও।

পুরা বাড়ি খুশিতে নেচে উঠল।

(চলবে...)

আরও পড়ুন