তেলপিঠা ভাজা হচ্ছে। আমার খুশির কোনো সীমা নেই। দাদাবাড়ির উঠানে আমি আপনমনে লাফ দিচ্ছি, ঝাঁপ দিচ্ছি। পাটখড়ি দিয়ে বন্দুক বানিয়েছি। সেই বন্দুক আবার তিনকোনা। ত্রিভুজের মতো দেখতে। একপাশে দুটি পাটখড়ি দিয়ে বেণির মতো বানানো। তার দুই মাথায় দুটি পাটখড়ি দিয়ে তৈরি করতে হয় ত্রিভুজটা। কিন্তু যেকোনো একটি কাঠিতে আগুন লাগিয়ে দিলে বেণির প্যাঁচটা খুলে গিয়ে বাকি কাঠিগুলো লাফিয়ে ওঠে। আঙিনায় আমি আর রিটন ভাই সেই খেলা খেলছি। উঠানে মুরগি চরছে। হাঁসের বাচ্চারা ঘুরঘুর করছে মুরগি মায়ের পেছনে।
মিতাপু বললেন, মিঠুন, বল তো, হাঁসের বাচ্চার কেন মুরগি মা?
আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানি না। আমি বলি, কেন!
মিতাপু বলেন, মিঠুন, তুই একটা হাবা। তুই কিছুই জানিস না।
আমি বলি, তুমি জানো, তুমি বলো।
মিতাপু বলেন, আমি এখন তোকে এই গল্প করতে পারব না। এখন আমি রুটি বানাব। মিতাপুর একটা ছোট পিঁড়ি আছে আর একটা বেলনা আছে। সেটা দিয়ে তিনি ছোট ছোট রুটি বানাবেন। সেই রুটি নিয়ে যাবেন রান্নাঘরে। আম্মা–বড় আম্মার সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে তাওয়ায় সেই ছোট ছোট রুটি সেঁকাও হবে।
আমি বলি, আচ্ছা রুটি বানাতে বানাতে বলো।
মিতাপু বলেন, আচ্ছা চল, পরাটার গাছের পাতা তুলে আনি।
আমরা রান্নাঘরের পেছনে যাই। মাটির পিড়ালিতে ছোট ছোট গাছ জন্মেছে। তার ছোট ছোট পাতা। সেই পাতাগুলো তুলে আনি আমরা। তারপর পাটখড়ির ছোট্ট টুকরাকে বেলনা বানিয়ে পাতাগুলোকে চাপ দিই। পাতাগুলোর গা তেলতেলে দেখায়। এটাই হলো আমাদের পরাটা। আর এই গাছগুলোকে আমরা বলি, পরাটার গাছ। এর পাতাকে বলি পরাটার পাতা।
পরাটার গাছে পরাটা ধরত। মধুফুলের গাছে ধরত মধু। আমরা গাছের ছোট সাদাফুল তুলে ফুলের গোড়া চুষে মধু খেতাম। আর আমরা চুনের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে বানাতাম সর্ষের তেল। এসব দিয়ে আমাদের রান্নাবাটি খেলা চলত।
রান্নাবাটি খেলতে খেলতে মিতাপু বললেন, মুরগি ডিমে তা দেয়। আঠারো–বিশ দিন ডিমে তা দিলে বাচ্চা ফোটে। মুরগির মায়ের ডিমের সঙ্গে বড় আম্মা হাঁসের ডিমও দিয়ে দেন। মুরগি মা–ই তা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মুরগির বাচ্চা। হাঁসের বাচ্চা। মুরগির বাচ্চাও মা মুরগিকে নিজের মা ভাবে। হাঁসের বাচ্চাও মা মুরগিকে নিজের মা ভাবে। মুরগি মা–ও হাঁসের ছানা মুরগির ছানা সবাইকে নিজের বাচ্চাই ভাবে।
আমি বললাম, মিতাপু, হাঁসের ডিম কেন হাঁস মা তা দেয় না?
মিতাপু বলেন, বড় আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বড় আম্মা বলেছেন, আরে বাহে, হাঁস তা দিতে বসলে অনেক দিন আর ডিম পাড়ে না। কিন্তু মুরগি মা তা দিয়ে তাড়াতাড়ি আবার ডিম পাড়তে আরম্ভ করে। সেই জন্য।
আমি কিছুই বুঝলাম না। মিতাপুকে সেটা বলা যাবে না। মিতাপু এমনিতেই আমাকে হাবা মিঠুন বলে খ্যাপানোর চেষ্টা করেন।
দাদার বাড়ি সাতানায় ইলেকট্রিসিটি ছিল না। ছিল না মুক্তাগাছাতেও। বিকেলবেলা হারিকেনগুলো পরিষ্কার করা হতো। চিমনি পরিষ্কার করে ঝকঝকে করে রাখা হতো। হারিকেনে ভরা হতো কেরোসিন তেল। কেরোসিনের গন্ধে চনমন করত পুরো বাড়ির বাতাস।
রাতের বেলা। আমরা যাচ্ছি কুয়াতলায়। হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়তে হবে। কুয়াতলাটা বাঁশঝাড়ের নিচে।
আমি, মিতাপু আর আম্মা যাচ্ছি। আম্মার হাতে একটা হারিকেন। হারিকেন নড়ছে, নড়ছে আমাদের ছায়াও। কুয়ার পাড়ে কুয়ার বালতি বাঁধা একটা বাঁশের আড়ের মাথায়। হাত থেকে বালতির দড়ি যাতে ছুটে না যায়, সেটা একটা কারণ। আরেকটা কারণ, বাঁশের মাথার এক পাশে বড় ওজন বাঁধা আছে। লম্বা মাথার দিকে দড়ি বেঁধে আরেক মাথায় বালতি বেঁধে দেওয়া হয়েছে। দড়ি টেনে বালতি নিচে নামাতে হয়। পানি ভরে বালতি তোলার সময় বাঁশের মাথা আকাশে উঠে যায়। তাতে পানি টেনে তোলার কষ্ট কমে যায়।
আম্মা হারিকেন মাটিতে রেখে বালতি দিয়ে পানি তুলছেন।
এই সময় ওই ওপাশে বেড়ার ওই পাশটায় কী যেন নড়ছে। একটা ঢিল এসে পড়ল কুয়ার পাড়ে।
কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। দূরে শেয়াল ডাকছে। বাঁশঝাড়ে বাতাসের ঝাপটা লাগল। দূরে রান্নাঘরের খড়ের চালে দুটো কী যেন জ্বলছে। আমি বললাম, মিতাপু, কী জ্বলে?
মিতাপু বললেন, বিড়ালের চোখ।
এই সময় কে যেন নাঁকি গলায় বলে উঠল, এঁই তোঁরাঁ তেঁলপিঠাঁ খেঁয়েঁছিঁস, আঁমাঁকেঁ দিঁস নাঁইঁ। এঁবার তোঁদেঁর আঁমি ধঁরব।
‘আম্মা!’ বলে চিৎকার করে উঠে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। একবার ডানে একবার বামে তাকিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন মিতাপু।
আম্মা বললেন, এই রিটন ফাজিল কোথাকার, বাচ্চা দুটাকে ভয় দেখাচ্ছিস কেন। ভয় পেলে ওদের জ্বর এসে যাবে।
রিটন ভাই হাসতে লাগলেন। তার পাশে আমাদের জেঠাত ভাই মিল্টন। তারা কুয়ার পাড়ের বেড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের ভয় দেখানোর জন্য।
আমরা দাদাবাড়িতে থেকে ফিরে এলাম মুক্তাগাছায়।
১৯৭১ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস। আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি।
ক্লাস কমই হচ্ছে। মিছিল হচ্ছে বেশি।
একদিন বিকেলবেলা রিটন ভাই বললেন, মিঠুন, কালকে ফজরের ওয়াক্তে উঠতে হবে ঘুম থেকে।
আমি বললাম, উঠব। রোজই তো ভোরবেলা উঠি ঘুম থেকে। আম্মা ডেকে দেন। বলেন, ওঠ ওঠ। যা, পাখিরা গান করছে। শুনে আয়।
আমি মিতাপুর হাত ধরে ভোরবেলা বাইরে বেরোতাম। দোতলা থেকে নেমে চলে যেতাম শিমুলগাছ আর জামগাছের তলায়। সত্যি, কত পাখি যে কত বিচিত্র সুরে ডাকত।
কিন্তু গান তো করছে না।
আমি মিতাপুকে বলতাম, মিতাপু, গান কখন হবে? পাখিরা গান গাইবে কখন?
মিতাপু হাসতেন। বলতেন, আরে হাবু, এই যে পাখিরা ডাকছে, এইটাই ওদের গান। ওরা কি লালঝুঁটি কাকাতুয়া বলে গান করবে নাকি! ওদের ভাষা ওদের মতো। ওদের সুরও ওদের মতো। ওই শোন বলছে, বউ কথা কও। বউ কথা কও...
সেই দিনটা ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১। ভোরবেলা পাখিরা ওঠার আগেও আমরা ঘুম থেকে উঠেছি। আব্বা নামাজ পড়ে নিলেন। এরপর বললেন, রিটন, মিতা মিঠুন, তোমরা যাবে আমার সঙ্গে? শহীদ মিনারে?
আমরা বললাম, আব্বা, সেই জন্যই তো আমরা এত ভোরে ঘুম থেকে উঠে জেগে বসে আছি।
মিতাপু বললেন, আমি তো রাতের বেলাতেই ফুলের মালা গেঁথে রেখেছি।
সত্যিই তাই, আমি আর মিতাপু কাল রাতে পিটিআইয়ের বাগানে গিয়ে লম্বা জবাগুলো নিয়ে এসেছি। এই লম্বা জবাগুলোও মধুতে ভরা। এর পেছনের বৃন্তটা খুলে ফেলে মুখে নিয়ে চুষলেই মধুতে মুখ ভরে ওঠে। আমরা প্রায়ই পিটিআইয়ের দেয়ালঘেরা বাগানে ঢুকে এই ফুল নিয়ে এসে মধু খাই। কালকে আমরা সন্ধ্যার সময় এই ফুল এনেছি মালা গাঁথার জন্য। মিতাপু সুইসুতা দিয়ে দুইটা মালা গেঁথেছেন।
আমরা দোতলা থেকে নেমে নিচে এলাম। পিটিআইয়ের ছাত্র, যারা আসলে শিক্ষক, তারাও এলেন। একজন আবার গামছা দিয়ে একটা হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন।
বেশ বড়সড় একটা দল হলো আমাদের। সবার সামনে আব্বা। তিনি ফজরের নামাজ পড়ে এসেছেন। তার মাথায় টুপি। আমাদের হাতে ফুল। আমরাও সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
যার কাঁধে হারমোনিয়াম, তার নাম আবদুল হামিদ। হামিদ স্যার বলে আমরা তাকে ডাকি। তিনি গান ধরলেন, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি।
আমরাও তার সঙ্গে গান গাইতে গাইতে খালি পায়ে হাঁটতে লাগলাম। কুয়াশাঢাকা মাঠ পেরিয়ে গেট দিয়ে বাইরে চলে এলাম। স্টেশন পাশে রেখে আমরা যাচ্ছি পাশের কলেজে। কলেজের মাঠে শহীদ মিনার আছে। আমরা গিয়ে যখন পৌঁছালাম, তখন আরও আরও মিছিল এসেছে। কলেজের ছাত্ররা এসেছে।
কলেজের ছাত্ররা ফুল দিয়ে শপথ করতে লাগল, আমরা দেশমাতৃকাকে মুক্ত করে ছাড়ব। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।
তারা স্লোগান ধরল:
শহীদ স্মৃতি শহীদ স্মৃতি
অমর হোক অমর হোক।
আমরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ফিরে আসছি। দৌড়ে আসছি আমি, মিতাপু, আর রিটন ভাই। আমরা বড় রাস্তা দিয়ে আসব না। কলেজের দেয়ালের নিচের ফোকর দিয়ে পার হব আমরা। বিলের ধার দিয়ে পিটিআইয়ের বাউন্ডারিতে এসে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ব। তাহলে আর বেশি হাঁটতে হবে না। শর্টকাট করব।
পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে। সে ছিল গাছের আড়ে।
ঢোলকলমির ঝাড়ের পাশ দিয়ে হাঁটছি। ফড়িংয়ের হাট বসেছে। এত ফড়িং।
তিনটা আমগাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে। এইখানে পায়ে চলা পথটা সরু হয়ে গেছে। আমরা সামনে দেখি, পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে তমিজ মিয়া।
রিটন ভাই বললেন, এই রে, এখন কী হবে?
মিতাপু বললেন, চলেন, আমরা ঘুরে আবার কলেজের মাঠে যাই। বড় রাস্তা দিয়ে যাব।
রিটন ভাই বললেন, মাথা খারাপ!
কিন্তু এইখানে রাস্তা খুবই সরু। দুই পাশে জঙ্গল। মধ্যখানে এক চিলতে পথ। সেই পথের মধ্যখানে দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছেন তমিজ মিয়া।
তিনি বললেন, এই ছোলপোল, তোমরা কুটি গেছলা? (এই ছেলেপুলে তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?)
রিটন ভাই বললেন, আমরা কোথায় গিয়েছিলাম, আপনাকে কেন বলব?
মিতাপু ছিলেন মুখে মুখে তর্ক করার ওস্তাদ। তিনি বললেন, আমরা কি আপনার খাই নাকি আপনার পরি?
তমিজ মিয়া খেপে গেলেন, বললেন, বেতমিজ!
এমন জোরে চিৎকার করলেন যে আমি কেঁদেই ফেললাম। তিনি আমার হাত ধরে ফেললেন। বললেন, কুটি গেছলা?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, শহীদ মিনার?
ছি ছি ছি। মুসলমানের বেটাবেটি শহীদ মিনার যায়। আস্তাগফেরুল্লা।
রিটন ভাই বললেন, আপনি যে পেশাব করে পানি নেন না, সেটা আমরা দেখে ফেলেছি।
তমিজ মিয়া বললেন, এই এগলা কী কথা?
আপনি রাস্তা ছাড়েন। তা না হলে আমরা দেয়ালে দেয়ালে লিখে রাখব বড় বড় করে, তমিজ মিয়া পেশাব করে পানি নেয় না।
তমিজ মিয়া বললেন, তোমরা জানলা ক্যাংকা করা?
আপনি জঙ্গলের ধারে বসে ছ্যাড় ছ্যাড় করে পানি ছাড়লেন, আমরা দূর থেকে দেখেছি। ওখানে পানিও ছিল না। আপনি ঢিলও নেননি।
রিটন ভাই গড়গড় করে বলে চললেন।
তমিজ মিয়া দৌড়ে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেলেন। আমাদের পথ পরিষ্কার। আমরা বাসায় ফিরে এলাম।
আম্মা বললেন, রিটনের আব্বা, আমাদের একটা রেডিও কেনা লাগে।
আব্বা বললেন, রেডিও দিয়ে কী করবা? গান শুনবা?
না। খবর শুনব। ঢাকায় কী হচ্ছে, জানা দরকার। শেখ সাহেবের সাথে ইয়াহিয়া খানের মিটিং হচ্ছে। কী হলো না হলো, জানা দরকার কি না!
আব্বা বললেন, ঠিকই বলছ। খবর শুনতে হবে। রেডিও একটা লাগে।
আব্বা বললেন, রিটন, মিঠুন যাবা নাকি আমার সাথে?
রিটন ভাই বললেন, কই যাব আব্বা?
আব্বা বললেন, চলো বাহে, বন্দরে যাই।
রিটন ভাই বললেন, যাব।
আমি বললাম, আমিও যাব।
আব্বা বললেন, চলো, সাইকেলে যাই।
আব্বার একটা সাইকেল আছে। সাইকেলের নাম হারকিউলিস। আমি আব্বার সামনে রডে বসলাম। আব্বা সাইকেল চালাতে শুরু করলেন। রিটন ভাই চলন্ত সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারে দৌড়ে এসে বসলেন। সাইকেল নড়ে উঠল।
আমরা বন্দরের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। বন্দরের প্রতিটা দোকানে কালো পতাকা উড়ছে। ব্যাপার কী।
আমরা প্রথমে নামলাম খলিফা চাচার দোকানে। তিনি খুবই ব্যস্ত। কালো পতাকা সেলাই করছেন।
আব্বা সাইকেলের বেল বাজালেন।
খলিফা চাচা আব্বাকে সালাম জানালেন।
আব্বা বললেন, খলিফা সাহেব, আজকে কালো পতাকা বানাচ্ছেন কেন? আর সবাই কালো পতাকাই বা ওড়াচ্ছে কেন?
খলিফা চাচা বললেন, আমি মূর্খ মানুষ, আমি তার কী জানি। ছাত্ররা বলল, কালো পতাকা বানান। আমি বানাতিছি। ভালো বিক্রি হতিছে। আমার আয় রোজগার ভালো হতিছে বারে। এই পর্যন্ত। আলহামদুলিল্লাহ।
দরজির দোকানে দুজন তরুণ উপস্থিত। মনে হয়, তারা কলেজের ছাত্র। একজন বললেন, স্যার, জানেন না। আজকা ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস। আজকা আমরা কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়াতে দিব না। তার বদলে আমরা ওড়াচ্ছি কালো পতাকা।
আব্বা বললেন, বুঝেছি।
আব্বা বললেন, খলিফা সাহেব, আমাকেও একটা কালো পতাকা দেন। সাইকেলের সামনে লাগাই।
খলিফা সাহেব একটা ছোট কালো পতাকা দিলেন। আব্বা তাকে দিলেন আটআনা।
সেই পতাকাটা একটা কঞ্চিতে লাগিয়ে সাইকেলের সামনে বেঁধে দেওয়া হলো।
এরপর আব্বা আবারও সাইকেল চালানো শুরু করলেন।
রিটন ভাই পেছনে ক্যারিয়ারে বসা। আমি রডে। রিটন ভাই স্লোগান ধরলেন:
তোমার আমার ঠিকানা
আমি সামনের রডে বসে জবাব দিতে লাগলাম: পদ্মা মেঘনা যমুনা।
শেখ মুজিবের পথ ধরো
বাংলাদেশ স্বাধীন করো
বাঁশের লাঠি তৈরি করো
বাংলাদেশ স্বাধীন করো
ভুট্টোর পেটে লাথি মারো
বাংলাদেশ স্বাধীন করো
জয় বাংলা
জয় বাংলা
আমরা একটা রেডিওর মেকানিকের দোকানে থামলাম।
আব্বাকে দেখেই তারা সালাম দিল, আসসালামু আলাইকুম, স্যার।
আব্বা সালামের জবাব দিলেন। বললেন, আপনার কাছে কোনো পুরানা রেডিও ট্রানজিস্টর কিছু আছে নাকি!
রেডিওর মেকানিকের মুখে বসন্তের দাগ। তার কাঁচা–পাকা চুল। একটা দাঁত মনে হচ্ছে সোনা দিয়ে বাঁধা। তার নাম আলতাফ আলী।
তিনি বললেন, আছে একটা। খুব ভালো। জাপানি রেডিও। কিন্তু দাম তো পড়বে বেশি।
আব্বা বললেন, কত?
৫০০ টাকা।
আব্বা বললেন, ৫০০ টাকা দিয়ে কেন পুরানা রেডিও কিনব। নতুনই কিনতে পারব। কত হলে দিবেন, তা–ই বলেন।
আসেন ভিতরে আসেন। আগে রেডিও বাজাই। শোনেন...
একটা এক ফুট চওড়া, ইঞ্চি দশেক উঁচু, ছয় ইঞ্চি পুরু বাক্স। পেছনে কালো। সামনে সাদা। সাদার মধ্যে গোল গোল বিন্দু বিন্দু ফুটো। এটা দিয়ে বোধ হয় সাউন্ড বের হয়।
দুটো গোল ভলিউম। সেটা ঘোরাতে লাগলেন মেকানিক সাহেব। ঘর্ঘর আওয়াজ হলো। তারপর গান শুরু হলো: ‘কারার ওই লৌহ কবাট, কারার ওই লৌহ কবাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট...’
আব্বা বললেন, কয় ব্যান্ডের রেডিও?
দুই ব্যান্ডের?
কয় ব্যাটারি?
চার ব্যাটারি।
বিবিসি শোনা যায়?
একদম পরিষ্কার।
আকাশবাণী শোনা যায়?
জি, যায়।
আচ্ছা, দুই শ টাকা দিচ্ছি। দেন। শুনে দেখি। ভালো লাগলে আর দশ বিশ টাকা দিয়ে যাব। ভালো না লাগলে দুই দিনের মধ্যে ফেরত দিব।
মেকানিক বলল, আপনি আর ৫০ টাকা দেন। তারপর শুনে দেখেন...
আব্বা ২৫০ টাকা দিলেন।
মেকানিক বললেন, আমাকে মোট ৪২০ টাকা দেওয়া লাগবি। আপনার বাকি থাকল ১৭০ টাকা।
আব্বা বললেন, বাংলা স্বাধীন হলে রেডিওর কি আর এত দাম থাকবে?
আর এত দাম থাকবে?
আমরা রেডিও নিয়ে হাঁটছি। রিটন ভাই রেডিও দুই হাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটছেন।
আব্বা বললেন, তোমাদের আম্মাকে বলতে হবে রেডিওর একটা কভার বানিয়ে দিতে।
আমরা নগেন বাবুর মিষ্টির দোকানের সামনে হাজির হলাম।
রিটন ভাই বললেন, আব্বা, রেডিও কিনলাম। আব্বা, নগেন বাবুর মিষ্টির দোকান।
আব্বা বললেন, মিতাকে যে আনা হলো না।
রিটন ভাই বললেন, মিতার জন্য কিনে নিয়ে যাই।
আচ্ছা। বসো।
আমরা মিষ্টির দোকানে বসলাম।
আব্বার ডায়াবেটিস। আব্বা মিষ্টি খাবেন না।
আব্বা বললেন, তোমাদের বড় মিষ্টি আগে দাও দুইটা।
ইয়া বড় মিষ্টি। একটার দাম তিন টাকা। একটা থালা ভরে যায় এক মিষ্টিতে। আমরা দুজন খাচ্ছি।
আব্বা চেয়ে চেয়ে দেখছেন।
এরপর আব্বা বললেন, রসমঞ্জুরি দাও।
আমরা বললাম, আব্বা আর পারব না।
আব্বা বললেন, পানি খেয়ে মুখটা ক্লিয়ার করো। তারপর খাও।
এবার এল রসমঞ্জুরি।
আমরা খাচ্ছি। আব্বা তাকিয়ে আছেন।
যেন আব্বার পেটে গিয়ে মিষ্টি পড়ছে। আব্বার ছিল ডায়াবেটিস। তার মিষ্টি খাওয়া ছিল বারণ। আমরা মিষ্টি খাচ্ছি, এ দৃশ্য দেখে আব্বার মিষ্টি খাওয়া হয়ে যেত।
আমাদের খাওয়া শেষ। এবার বাসার জন্য মিষ্টি কেনা হবে। বাঁশের খাঁচায় পত্রিকার কাগজ পেতে তার মধ্যে মিষ্টি দেয়া হলো। আমরা সেটা নিয়ে আবার সাইকেলে উঠলাম। আমার হাতে মিষ্টি। রিটন ভাইয়ের হাতে রেডিও।
তিনি সাইকেলের পেছনে বসে রেডিও চালিয়ে দিলেন। গান হচ্ছে, নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা!
এই গান আমারও মুখস্থ। আমাদের রেডিও নাই। কিন্তু যেখানে যেখানে রেডিও আছে, সেখানেই এই গান বাজে। না শুনে থাকার উপায় নেই।
নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা।
এই সবুজের শ্যামল মায়ায় দৃষ্টি পড়েছে ঢাকা॥
শনশন বাতাসের গুঞ্জন হলো চঞ্চল করে এই মন।
আহা…ও ও হো…আহা হা হা ও হো…
ডাক দিয়ে যায় কার দুটি চোখ স্বপ্ন কাজল মাখা।।
ঝুরুঝুরু বকুলের গন্ধে এই মৌমাছি দোলে একি ছন্দে।
আহা…ও হো হো…আহা ...
আমাদের সাইকেলের সামনে কালো পতাকা দুলছে...
আমিও গাই। রিটন ভাইও গান। আব্বা বলেন, আরেব্বাস, তোমাদের এই গান মুখস্থ নাকি!
বাসায় আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। রেডিও এসেছে। মিষ্টি এসেছে। মিতাপু দৌড়ে এলেন। আমরা রেডিওতে গান শুনতে লাগলাম। একটু পর খবর হলো। আব্বা বললেন, রাতের বেলা বিবিসি শুনতে হবে।
দুই দিন পর রেডিওতে শোনা গেল মারাত্মক খবর।
ঢাকায় ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে। মিলিটারি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। মানুষ মারা গেছে।
শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে গেছে।
তারও আগে গুজব। শেখ সাহেবকে ধরতে পারেনি। তার কণ্ঠস্বর শোনা গেছে জাহাজে। তিনি বলেছেন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন...
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে।
দুপুরবেলা হঠাৎ হইচই। মিলিটারি আসতিছে মিলিটারি...
আম্মা বললেন, মিলিটারি আসতেছে। পালাতে