অদ্রির অভিযান (সপ্তম পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

অদ্রিরা বিস্মিত হয়ে দেখছে, স্টেডিয়ামের মতো বিশাল স্থানটির পরিসীমাজুড়ে থাকা দেয়ালগুলো হয়ে গেছে হলোগ্রাফিক স্ক্রিন! সেসব স্ক্রিনে ক্রমাগত অযুত-নিযুত-ট্রিযুত পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষিত হচ্ছে! এটিই স্পেসশিপের কন্ট্রোল রুম। কন্ট্রোল রুমের মাঝবরাবর শূন্যে ঝুলে আছে পৃথিবী গ্রহের বিশালাকার রেপ্লিকা। তাতে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর সব দেশ, স্থাপনা, সব রকম প্রকৃতি; সেটি যেন প্রকৃত পৃথিবীর বনসাই ভার্সন! পৃথিবীপৃষ্ঠের কোথায় কী ঘটছে, সবকিছু রেপ্লিকা পৃথিবীতে সরাসরি দেখা যাচ্ছে—কোনো বনাঞ্চলে আগুন জ্বলছে, কোনো অঞ্চলের বন্যার পানিতে মানুষের লাশ ভাসছে, কোথাও বরফ ভেঙে পড়ছে, কোথাও টর্নেডো তাণ্ডব চালাচ্ছে!

অদ্রি ক্রোধ সংবরণ করে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে জিজ্ঞেস করল, ‘এটাই কি কন্ট্রোল রুম?’ 

এলিয়েন উত্তর দিল, ‘এটা লোকাল কন্ট্রোল রুম। সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুম আমাদের গ্রহে। পৃথিবী গ্রহ থেকে ডেটা ফেচ করার জন্য লোকাল কন্ট্রোল রুমের প্রয়োজন হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করার জন্য এবং পৃথিবী গ্রহে অপারেশন ঠিকমতো চলছে কি না, তা লোকালি দেখার জন্য এই ব্যবস্থা। তবে এই যে স্পেসশিপ দেখছ, এটা আসলে সম্পূর্ণ বাস্তবতা না।’

অদ্রিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই স্পেসশিপ বাস্তব না?’

এলিয়েন উত্তর দিল, ‘ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তিতে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটিকে আমরা এমন পর্যায়ে নিয়েছি যে তার সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবতার পার্থক্য বোঝা সম্ভব হয় না। এমনকি আমাদের উচ্চতর ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি অনুভব করার জন্য আলাদা কোনো ডিভাইসের প্রয়োজন হয় না; ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই অনুভব করা যায়।’

‘তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, তোমাদের এই স্পেসশিপ ভার্চ্যুয়াল?’

‘হ্যাঁ, এই স্পেসশিপ কোনো বাস্তব বস্তু না। প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে এই ভার্চ্যুয়াল মহাকাশযান। এ কারণে কোনো বিস্ফোরণের মাধ্যমে এটাকে ধ্বংস করা সম্ভব না। কারণ, এটা বস্তুগত কিছু না।’

‘এই স্পেসশিপের ভেতরে যা দেখছি, এসবও কি ভার্চ্যুয়াল?’

‘হ্যাঁ, এসবও ভার্চ্যুয়াল। তোমরা তো দেখতেই পেলে, তোমাদের জন্য সিঁড়ি, সোফা সেট, কন্ট্রোল রুমের আবির্ভাব ঘটালাম। তোমাকে ব্যাপারটি সহজে বোঝাতে পারি এভাবে—ধরে নাও, তোমরা একটি কম্পিউটারের সফটওয়্যার অংশে ঢুকে পড়েছ। অ্যাড, ডিলিট কিংবা এডিট কমান্ড ব্যবহার করে আমি ভার্চ্যুয়াল জগতের পরিবর্তন ঘটাচ্ছি বা বিভিন্ন ভার্চ্যুয়াল বস্তুর আবির্ভাব ঘটাচ্ছি। শুধু বস্তু নয়, এই ভার্চ্যুয়াল জগতে স্থান বা সময় ইচ্ছামতো পরিবর্তন করা যায়। এখানে তোমরা আর আমিই কেবল বাস্তব; বাকি সব “প্রায় বাস্তব”। আমি বিভিন্ন “প্রায় বাস্তবতা” এক্সিকিউট করছি হাতের এই কম্পাইলারের সাহায্যে।’

অদ্রি এলিয়েনের কথাগুলো টেলিপ্যাথির মাধ্যমে মনোযোগ দিয়ে শুনল। এসব জটিল বিষয় পরে ভুলে যেতে পারে, তাই সঙ্গে সঙ্গে অদ্রিক ও তালুতকে জানাল। সব শুনে অদ্রিক বলল, ‘আবেগহীন এই এলিয়েন সত্য বলছে, তাতে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ, এটা ভার্চ্যুয়াল স্পেসশিপ। তার মানে দাঁড়ায়, এই স্পেসশিপে দাঁড়িয়ে এলিয়েনদের আটকানো যাবে না। আমাদের যেতে হবে এলিয়েনদের মূল নিয়ন্ত্রণকক্ষে, যেখান থেকে সব কটি ভার্চ্যুয়াল স্পেসশিপ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।’

তালুত উদ্‌গ্রীব হয়ে বলল, ‘অর্থাৎ আমাদের ওদের গ্রহে যেতে হবে, তাই না?’

অদ্রিক বলল, ‘ঠিক তাই।’

তালুত খুশিমনে বলল, ‘বাহ্, বেশ অ্যাডভেঞ্চার অপেক্ষা করছে মনে হচ্ছে!’

অদ্রি জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু ওদের গ্রহে যাব কীভাবে?’

অদ্রিক উত্তর দিল, ‘এলিয়েনকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে। যেহেতু ওর বদলে কেউ ডিউটিতে আসবে এবং এই এলিয়েন চলে যাবে, তার মানে ওদের পারাপারের জন্য নিশ্চয়ই ওয়ার্মহোল টাইপের কোনো পথ আছে।’

অদ্রি আবারও এলিয়েনের সঙ্গে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে যোগাযোগ করল। বলল, ‘আমরা সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুমটি দেখতে চাই। এ ধরনের প্রযুক্তি শেখা খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার।’

এলিয়েন রাজি হলো না। বলল, ‘দুঃখিত, সেই অনুমতি নেই।’

অদ্রি বুঝতে পারছে, এই ভিনগ্রহীকে জোরাজুরি করে লাভ নেই। বিষয়টি অদ্রিক ও তালুতকে জানাতে যাবে এমন সময় এলিয়েন টেলিপ্যাথির মাধ্যমে বলে উঠল, ‘এখন আমাকে “জিরোস্পেস গেট” দিয়ে যেতে হবে। অন্য একজন এখানে আসবে। তোমাদের আরও কিছু জানার থাকলে, তাকে জিজ্ঞেস করতে পারো।’ এলিয়েন কথাটুকু বলার পরপরই তাদের সামনে ফ্রেমযুক্ত আয়নার মতো দেখতে দোতলার সমান উঁচু বিশালাকৃতির একটি গেটওয়ে সৃষ্টি হলো! 

অদ্রিক ও তালুতকে অদ্রি জানাল, ‘এলিয়েন এই গেটের নাম বলল “জিরোস্পেস গেট”। এর ভেতর দিয়েই সে তাদের গ্রহে চলে যাবে।’

অদ্রিক বলল, ‘এর ভেতরে প্রবেশ করলে সম্ভবত হাইপার জাম্প টাইপের কিছু ঘটে!’

তালুত বলল, ‘এত কঠিন করে বলিস না। আমার মনে হচ্ছে, ওদের গ্রহে যেতে চাইলে এটাই একমাত্র সুযোগ। অন্য এলিয়েন আসার আগেই এই গেটের মাধ্যমে ওদের গ্রহে চলে যেতে হবে। অন্য কেউ চলে এলে নিশ্চয়ই গেটটা মিলিয়ে যাবে।’ 

অদ্রি ও অদ্রিক দুজনই একসঙ্গে বলল, ‘ঠিক।’

অদ্রি বলল, ‘পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে এর ভেতরে যেতে হবে।’

অদ্রিক বলল, ‘জানি না কপালে কী আছে, কিন্তু দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। পৃথিবীতে থাকলে সবার মৃত্যু নিশ্চিত; তবে এলিয়েনদের গ্রহে যেতে পারলে হয়তো পৃথিবীকে বাঁচানো যাবে, এমনকি আমরাও বেঁচে যেতে পারি।’

তিনজন আর কথা না বাড়িয়ে পরস্পরের হাত ধরে পা বাড়াল আয়নার অভ্যন্তরের ধোঁয়াটে বস্তুর মধ্যে। বরফশীতল ঠান্ডা যেন হাড় কাঁপিয়ে তুলল। মাথা যেন সুশৃঙ্খল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলল, অনেকটা ভাইরাল জ্বরে যেমন হয়! অদ্রি, অদ্রিক ও তালুত একে অপরের হাত ধরে থাকল যাতে কোনোভাবেই মহাশূন্যে ভেসে না যায়। তাদের চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে এল। প্রচণ্ড ঘুমে মানুষ যেমন ঢুলতে থাকে, তেমনি তিন বন্ধু ঢুলতে ঢুলতে চেতনা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলল। ঢুলু ঢুলু চোখে তারা দেখতে পেল, লাল-নীল-বেগুনি নানা রঙের আলোক ব্যান্ড যেন অসীম গতিতে সরে সরে যাচ্ছে! একপর্যায়ে আবারও হাড়কাঁপানো ঠান্ডা তাদের জাপটে ধরল। শপিং মলে এস্কেলেটরের ধাপগুলো যেমন শেষ প্রান্তে ঠেলে দেয়, তেমনি অদৃশ্য শক্তি তাদেরকে ঠেলে বের করে দিল জিরোস্পেস গেট-এর অন্য পাশে। 

অন্য পাশে পৌঁছে অদ্রিরা সামনে তাকাতেই ভয়ে শিউরে উঠল। সুনসান বিশাল সাদা কক্ষে অত্যাধুনিক অস্ত্র তাদের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে ১০-১২ জন এলিয়েন। একজন এলিয়েন জিরোস্পেস গেট-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে; সম্ভবত তারই রোস্টার ডিউটিতে যাওয়ার কথা। অদ্রি এলিয়েনদের দিকে তাকিয়ে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বরং তালুত একটু নড়তেই ড্রোনের মতো অসংখ্য বস্তু ছুটে এল অদ্রিদের দিকে এবং তিনজনের বুকে বেশ কয়েকটি করে ড্রোনসদৃশ বস্তু জোরে বাড়ি দিয়ে আটকে গেল। অদ্রিরা তৎক্ষণাৎ জ্ঞান হারাল।

জ্ঞান ফেরার পর অদ্রি চোখ মেলে চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল তারা কোন স্থানে। হাত নাড়াতে গিয়ে বুঝতে পারল, তার হাত-পা বেল্ট দিয়ে এঁটে আটকানো। যে বিছানায় তাকে শোয়ানো হয়েছে, তারই দুই পাশে দুটো বিছানায় শায়িত অদ্রিক ও তালুত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। দুজনের পিঠের ব্যাগ দুটো কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বিচিত্র যন্ত্রপাতিবেষ্টিত হলরুমটি দেখে অদ্রিদের মনে হচ্ছে, কোনো অত্যাধুনিক হাসপাতালের আইসিইউ। তিনজনের মাথায় হেলমেট পরানো, শরীরের বিভিন্ন স্থানে ইসিজির ইলেকট্রোডের মতো বস্তু আটকানো, সবকিছুর সংযোগ আলাদা তিনটি মনিটরে গিয়ে মিলেছে। মনিটরিং যন্ত্রত্রয়ে অদ্রিদের শরীরের বিভিন্ন প্যারামিটার দেখা যাচ্ছে।

অবশ্য তিন বন্ধুর বুঝতে সময় লাগল না যে কক্ষটি কারাগারের অংশ। যাদের অজ্ঞান করে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের এখানে রেখে চেতনা ফেরানো হয়। হঠাৎ কক্ষটিতে ঢুকে পড়ল তিনটি রোবট। রোবটগুলো অবশ্য এলিয়েনদের মতো উচ্চতার না; বরং অদ্রিদের সমান। কিন্তু তাদের হাতে একই রকম ভয়ংকর অত্যাধুনিক অস্ত্র। তিন রোবট এসে বেডের সুইচ টিপে তিন বন্ধুকে বাঁধনমুক্ত করল। তারপর সুইচের সাহায্যেই বেডগুলো উল্লম্ব করে ফেলল। এর ফলে অদ্রি, অদ্রিক ও তালুত দাঁড়ানো অবস্থায় চলে গেল। রোবট তিনটি তাদের ঠেলে সামনে যেতে নির্দেশ করল।

তালুত বলল, ‘এরা আমাদের নিয়ে কী করছে?’

অদ্রিক বলল, ‘কিছুই তো বুঝতে পারছি না। মনে হয়, জেলখানায় ভরবে।’

অদ্রি বলল, ‘ওরা সম্ভবত আমাদের মেরে ফেলবে।’

অদ্রির কথায় আঁতকে উঠল অদ্রিক ও তালুত। অদ্রিক বলল, ‘মেরে ফেলবে কেন? তুমি জানলে কীভাবে?’

অদ্রি কক্ষটির বাঁ কর্নারের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলল, ‘ওই দেখো।’

অদ্রিক ও তালুত তাকিয়ে দেখল, রুমটির বাঁ কর্নারে রাখা আছে বিচিত্র প্রজাতির কয়েকটি গাছ। গাছগুলোর মাধ্যমেই অদ্রি জানতে পেরেছে এই তথ্য। বর্তমানে ট্রি-নেটওয়ার্কে অদ্রিদের নিয়েই চলছে মূল আলোচনা। সেখান থেকে আপডেট পাচ্ছে অদ্রি।

তালুত বলল, ‘এই গ্রহেও গাছ আছে?’

অদ্রিক বলল, ‘এলিয়েনরা যেহেতু আমাদের গ্রহকে তাদের বসবাসের উপযুক্ত ভেবেছে, তাই আমি আগেই ধারণা করেছিলাম যে এলিয়েনদের গ্রহেও গাছ আছে। শুধু তাই না, আমরা ধারণা, এই গ্রহের জলবায়ু, ভূমিরূপ, অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান পৃথিবী গ্রহের মতো।’

রোবটদের সঙ্গে হাঁটার সময় তালুত ও অদ্রিক কথা বলতে থাকলেও অদ্রি একদম চুপ করে থাকল। তার মন সংযুক্ত ট্রি-নেটওয়ার্কে। রোবটরা অদ্রিদের নিয়ে হাজির হলো অন্য আরেকটি হলরুমে। বড় হলরুমের মাঝবরাবর একটি টেবিলের অপর পাশে বসে আছে জনৈক ক্ষমতাবান এলিয়েন! সেই এলিয়েনের পেছনে তার দুই দিকে অস্ত্রসহ দাঁড়িয়ে আছে দুই এলিয়েন। এ ছাড়া অস্ত্র ছাড়া দাঁড়িয়ে আছে এক এলিয়েন। তাদের সামনে বেশ দূরে তিনটি চেয়ার রাখা।

প্রহরী রোবটরা অদ্রিদের ঘাড় ধরে বসিয়ে দিল তিন চেয়ারে। অদ্রিরা চেয়ারে বসতেই সেন্সর নিয়ন্ত্রিত বেল্ট তাদের আটকে ফেলল চেয়ারের সঙ্গে। সামনে খানিক দূরে বসে থাকা হর্তাকর্তা গোছের এলিয়েন মুখ দিয়ে কিছু বলে উঠল। কিছুই বুঝতে পারল না অদ্রিরা; তবে বুঝতে সময়ও লাগল না। কারণ, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিরস্ত্র এলিয়েন সুন্দরভাবে বাংলায় কথাগুলো বলল—মহামান্য বিচারক বললেন, ‘তোমাদের এখানে আনা হয়েছে বিচারের জন্য।’

অদ্রি প্রশ্ন করল, ‘আমরা কী অপরাধ করেছি?’

দোভাষী এলিয়েন অদ্রির প্রশ্নটি বিচারক এলিয়েনকে তাদের ভাষায় বুঝিয়ে দিল। বিচারক এলিয়েন প্রত্যুত্তর দিল। দোভাষী এলিয়েন বিচারকের উত্তর শুনে অদ্রিদের বলল, ‘তোমরা বিনা অনুমতিতে বেআইনিভাবে এই গ্রহে প্রবেশ করেছ।’

অদ্রি বিরক্তমুখে বলল, ‘আপনারাও তো বেআইনিভাবে আমাদের গ্রহে প্রবেশ করেছেন। শুধু তা-ই না; আপনারা আমাদের গ্রহে মানুষ হত্যা করছেন! নানা রকম অন্যায় করছেন। এসব অন্যায় করার অনুমতি আপনাদের কে দিয়েছে?’

দোভাষী এলিয়েনের সহায়তায় বিচারক জানাল, ‘সেটার বিচার করবে তোমাদের গ্রহের প্রধানেরা। কিন্তু আমাদের গ্রহে তোমরা বেআইনিভাবে প্রবেশ করেছ—এটি বিচারের দায়িত্ব আমাদের। আর আমরা আমাদের দায়িত্বে অবহেলা করি না। তোমরা যে অপরাধ করেছ, তার সাজা মৃত্যু।’

এমন বক্তব্যে অদ্রিক খেপে উঠল। অদ্রি এলিয়েনদের সঙ্গে ‘আপনি’ সম্বোধন করে কথা বললেও ক্ষিপ্ত হয়ে অদ্রিক তাদের ‘তুমি’ সম্বোধনে বলল, ‘তোমরা তো মহা অন্যায়বাজ। গ্রহে প্রবেশ করার জন্য তোমরা আমাদের বড়জোর জেলে ভরে রাখতে পারো। এ জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া তো অবিচার।’

তালুত হাত মুঠি করে একেবারে তুই-তোকারি শুরু করল, ‘তা ছাড়া আমরা অপরাধী কি না—এ ব্যাপারটাও তো আপেক্ষিক। তোরা আমাদের অপরাধী বলছিস; অথচ আমরা করছি ন্যায়সংগত কাজ। আমাদের গ্রহ আক্রান্ত। পৃথিবী গ্রহের মানুষদের বাঁচানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে কথা বলার জন্যই আমরা এই গ্রহে এসেছি। আর তোরা আমাদের অন্যায়ভাবে মারতে চাচ্ছিস!’

বিচারক এলিয়েন বলল, ‘শোনো মানুষ, আপেক্ষিকতা কোনো কিছুর সাপেক্ষে হয়। আমরা অন্য কোনো গ্রহের ন্যায়-অন্যায়ের সাপেক্ষে আমাদের ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণ করি না। তোমরা অন্যায়ভাবে আমাদের গ্রহে প্রবেশ করেছ, এটি আমাদের আইন অনুযায়ী গুরুতর অপরাধ এবং এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সুতরাং, আমি তোমাদের তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দিচ্ছি।’

দোভাষী এলিয়েন মহামান্য বিচারকের কথাগুলো অদ্রিদের শোনানোমাত্র বিচারক এলিয়েন তার হাতের কলমসদৃশ স্টাইলাস দিয়ে সামনে রাখা ট্যাবসদৃশ যন্ত্রের মনিটরে কিছু লিখে স্বাক্ষর করল এবং তারপর স্টাইলাসটি ভেঙে ফেলল।

তিনজনকে সত্যিই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে—এই অন্যায় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অদ্রিক। তালুত শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেয়ার থেকে ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু বেল্ট দিয়ে শক্ত করে বাধা থাকায় কিছু করতে পারল না। অন্যদিকে, অদ্রি এতক্ষণ চুপ ছিল। বিচারকের রায় লেখার পর বলল, ‘এটা ভীষণ অন্যায়জনক রায়। এই রায় কখন কার্যকর করা হবে?’

বিচারক দোভাষীর মাধ্যমে জানাল, ‘এখনই তোমাদের নিয়ে যাওয়া হবে ডেথ চেম্বারে।’

অদ্রি সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘পৃথিবী গ্রহে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে একটি ইচ্ছা পূরণ করা হয়।’

‘আমাদের এই গ্রহেও শেষ ইচ্ছা পূরণ করা হয়। কী ইচ্ছা তোমাদের?’

তালুত কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে অদ্রি বলল, ‘আমরা এই অপূর্ব গ্রহটাকে একবার দেখতে চাই।’

‘ঠিক আছে, তোমাদের গ্রহের প্রকৃতি ও পরিবেশ দেখানোর জন্য এই অট্টালিকার বাইরে থেকে আধঘণ্টা ঘুরিয়ে আনার অনুমতি দিচ্ছি।’ বিচারক এ কথা বলামাত্র অদ্রিদের বেঁধে রাখা বেল্ট খুলে গেল এবং তাদের ঘাড় জাপটে ধরল সেই তিন প্রহরী রোবট।

রোবটগুলো বিচারকক্ষ থেকে তিনজনকে বের করে নিয়ে এল। বিচারকক্ষের বাইরে আসতেই তালুত ও অদ্রিক বিরক্তি প্রকাশ শুরু করল। অদ্রি বলল, ‘দুজনই মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনো।’

অদ্রিক ও তালুত চুপ হয়ে গেল। রোবটদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে অদ্রি বলল, ‘তোমরা খেয়াল করেছ কি না, বিচারকক্ষেও গাছ ছিল। এমনকি পুরো অট্টালিকাজুড়ে গাছ আছে। আমি ট্রি-নেটওয়ার্ক থেকে একটি নির্দেশনা পেয়েছি। সেই অনুযায়ী আমাদের কাজ করতে হবে।’

দুজন একসঙ্গে বলল, ‘অবশ্যই।’

অদ্রি বলল, ‘গাছদের মাধ্যমে জেনেছি, যে করিডর ধরে আমরা হাঁটছি, সেটি প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা। এই করিডরের শেষ মাথায় বাঁ দিকেই ডেথ চেম্বার।’

অদ্রিক বলে উঠল, ‘তাহলে আমরা বাঁচব কীভাবে?’

তালুত বলল, ‘এই যন্ত্রগুলো কি আমাদের ডেথ চেম্বারে নিয়ে যাচ্ছে?’

অদ্রি জানাল, ‘গাছদের পরামর্শেই আমি শেষ ইচ্ছা হিসেবে ওদের গ্রহ দেখাতে বলেছি। আসলে করিডরের বাঁ পাশে ডেথ চেম্বার আর ডান পাশে কিছুদূর গিয়ে আবার ডান দিকে গেলে এলিভেটর। গ্রহ দেখাতে রোবটগুলো আমাদের এখন বিল্ডিংয়ের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা আছি বিল্ডিংয়ের ৫৫০ তলায়।’

অদ্রিক বলল, ‘তাহলে বাঁচার উপায়?’

অদ্রি বলল, ‘মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনো। এলিভেটরের আগেই একটা ইমার্জেন্সি এক্সিট আছে। যে দরজা দিয়ে ইমার্জেন্সি এক্সিট আটকানো, তাতে আছে একটি পুশবার। সেই পুশবারে ধাক্কা দিলেই তা খুলে যাবে এবং আমাদের দরজার বাইরে ঝাঁপ দিতে হবে।’

তালুত ও অদ্রিক মহাবিস্মিত চোখে তাকাল অদ্রির দিকে। অদ্রিক বলল, ‘কী বলো, ৫৫০ তলা থেকে পড়লে তো মৃত্যু নিশ্চিত!’

অদ্রি বলল, ‘না, না, তা নয়। ইমার্জেন্সি এক্সিটের দরজার ওপাশে আছে একটি জিরোস্পেস গেট। সেখানে ঢুকে পড়লেই আমরা এই গ্রহের অন্য একটি স্থানে চলে যাব। এই অফিসের সব ইমার্জেন্সি গেটের ওপাশে একটা করে জিরোস্পেস গেট আছে। সেগুলোর ডেস্টিনেশন অ্যাড্রেস এক। আমি তথ্যগুলো পেয়েছি ট্রি-নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। বাঁচার এই একটিমাত্র উপায় আমাদের হাতে আছে। আমি মূলত বাইরে যেতে চেয়েছি, ওই ইমার্জেন্সি এক্সিট দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু...’

তালুত বলল, ‘কিন্তু কী?’

অদ্রি বলল, ‘এই গর্দভ রোবটগুলোর হাত থেকে পালিয়ে আমাদের ইমার্জেন্সি এক্সিট দিয়ে বের হতে হবে।’

তালুত বলল, ‘সেটা আমার দায়িত্ব।’

অদ্রিদের কথোপকথনের দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তিন রোবটের। তারা অস্ত্র হাতে তিনজনকে নিয়ে চলেছে এলিভেটরের দিকে। রোবটগুলোর মুখে কোনো শব্দ নেই। এমনকি করিডরের শেষ প্রান্তে যখন ডানে মোড় নিতে হবে, তখন রোবটরা বল প্রয়োগে অদ্রিদের ঘাড় ধরে ঘুরিয়ে সেদিকে হাঁটার দিকনির্দেশনা দিল!

এলিভেটরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে অদ্রি, অদ্রিক, তালুত এবং তিন প্রহরী রোবট। আকস্মিকভাবে তালুত কারাতের একটি বিশেষ কৌশলে পেছনে এক লাইনে দাঁড়ানো তিন রোবটের পায়ের নিচ দিয়ে সজোরে নিজের পা চালিয়ে নিল। তাল সামলাতে না পেরে রোবট তিনটি পড়ে গেল এবং তাদের হাতের অস্ত্র ছিটকে পড়ল। অদ্রিরা অস্ত্রগুলো নিয়ে দৌড়ে চলে গেল ইমার্জেন্সি এক্সিটের কাছে। অদ্রি পুশবারে বাড়ি দিয়ে দরজা খুলতেই সামনে দেখতে পেল জিরোস্পেস গেট। গেটের ভেতর ঝাঁপ দিল তিন বন্ধু। জিরোস্পেস গেটের অপর পাশে পৌঁছাতে এবার খুবই কম সময় লাগল। অন্য পাশে পৌঁছেই অদ্রিরা সামনে দেখতে পেল, বিকট-দর্শন অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে এক এলিয়েন!

চলবে...

আরও পড়ুন