অদ্রির অভিযান (ষষ্ঠ পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

লেকের পেছন দিকে অপেক্ষারত একটি ছাউনিওয়ালা ডিঙিনৌকায় তিন বন্ধু উঠে বসল। অদ্রিরা ছাউনির ভেতরে গিয়ে বসল। নৌকার মাঝি বম সম্প্রদায়ের এক কিশোর। ছেলেটি বৈঠা বেয়ে নৌকা দ্রুত নিতে থাকল স্পেসশিপের দিকে। যতই তারা স্পেসশিপের দিকে এগোতে থাকল, ততই জেট ইঞ্জিনের মতো গুনগুন শব্দটির তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা বাড়তে থাকল।

হঠাৎ লেকপাড় থেকে মাইকে এক সেনাসদস্যের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘নৌকা নিয়ে ফিরে আসুন। ওই বস্তুর কাছাকাছি যাবেন না। জীবনের ঝুঁকি আছে। আবারও বলছি, নৌকা নিয়ে ফিরে আসুন। ফিরে আসুন নৌকা নিয়ে।’ মাইকের আওয়াজ শুনে কিশোর মাঝি আরও জোরেতালে নৌকা টানতে থাকল। বগা লেকের তীরে থাকা মানুষজন হইহই শুরু করল। জনতার আওয়াজে মাইকের আওয়াজ ম্লান হয়ে গেল।

খানিকক্ষণের মধ্যেই স্পেসশিপের কাছে পৌঁছল নৌকা। বগা লেকের পানি থেকে কয়েক ফুট ওপরে শূন্যে ঝুলে আছে স্পেসশিপ। দেখে মনে হচ্ছে প্রকাণ্ড এক মৌচাক! মৌচাকের মতো মহাকাশযানটির স্থানে স্থানে বড় গর্ত। মহাকাশযানের কাছে তার জেট ইঞ্জিনের মতো শব্দ এত বিকট শোনা যাচ্ছে যে লেকের পাড়ে থাকা জনস্রোতের চিৎকার আর কানে আসছে না। তবে অদ্রির মস্তিষ্কের ভেতরে ট্রি-নেটওয়ার্কের শব্দতরঙ্গ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে! চারপাশে থাকা গাছপালা অদ্রিদের লক্ষ করছে।

নৌকাতে ছাউনি থাকায় সুবিধা হয়েছে। তালুত ছাউনিতে উঠে শূন্যে ঝুলে থাকা স্পেসশিপের একটি গর্তে দুই হাতের তালু চেপে ধরে দেয়ালে ওঠার মতো করে তাতে উঠে পড়ল। কুঠুরির মতো প্রবেশদ্বারে উঠে তালুত সহযোগিতার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। অদ্রিক ছাউনির ওপর দাঁড়িয়ে তালুতের সহযোগিতায় কুঠুরিতে উঠল। তারপর অদ্রি ছাউনির ওপর দাঁড়ালে দুজন তাকে টেনে উঠাল। তিন বন্ধু হাত নেড়ে মাঝিকে বিদায় জানাল।

কুঠুরির মতো প্রবেশদ্বারের ভেতরের দিকে তাকিয়ে অদ্রিরা দেখতে পেল, সুড়ঙ্গের মতো পথটি চলে গেছে অনেক দূর। সুড়ঙ্গের দেয়াল ফটো লুমিনিসেন্সে সক্ষম পদার্থ দিয়ে তৈরি, এ কারণে সুড়ঙ্গটি হালকা নীলাভ রঙে জ্বলজ্বল করছে। সাহসী তালুত অগ্রগামীর ভূমিকা নিল; পিছু নিল অদ্রিক ও অদ্রি। এঁকেবেঁকে চলা সুড়ঙ্গ ধরে খানিকক্ষণ এগোনোর পর তারা অনুভব করল, তাদের শরীর কলয়েড বা আধা তরলজাতীয় পদার্থে তৈরি ফিনফিনে পাতলা পর্দা ভেদ করে চলে এল! পর্দাটি ভেদ করতে তেমন জোর খাটাতে হয়নি। তিনজনই একে অপরের দিকে তাকাল; কিন্তু মুখে কিছু বলল না। 

বেশ কিছুক্ষণ এগোনোর পর তালুত বলল, ‘অনেকটা পথই তো হাঁটলাম। এটা কত বড়, ঠিক বুঝতে পারছি না! বাইরে থেকে স্পেসশিপটাকে যত বড় মনে হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পথ হাঁটা হয়ে গেছে!’ তালুতের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল অদ্রিক ও অদ্রি; কিন্তু তারা মুখে কিছু বলল না। 

আরও কিছুক্ষণ সুড়ঙ্গপথ ধরে হাঁটার পর একটি কুঠুরির দেখা পেল তিনজন। কুঠুরির চারপাশে আরও আটটি সুড়ঙ্গপথ! তিন বন্ধু বিস্ময়ে মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। অদ্রিক বলল, ‘অবাক করা ব্যাপার! এটা কি শুধুই সুড়ঙ্গ আর কুঠুরি?’

অদ্রি বলল, ‘আমার মনে হয়, আমরা যেকোনো একটি সুড়ঙ্গপথ ধরে এগোতে পারি।’

অদ্রিরা আটটি সুড়ঙ্গপথের একটি ধরে এগোতে থাকল। সুড়ঙ্গের হালকা নীল আলোতে টানা প্রায় ২০ মিনিট হাঁটার পর তারা আরেকটি ঘরে এসে পৌঁছাল। সেই ঘর থেকে চারপাশে চলে গেছে আরও আটটি পথ! তালুত বলল, ‘এ কেমন গোলকধাঁধা! তা ছাড়া আমরা যে পরিমাণ পথ পার করলাম, তাতে তো এতক্ষণে স্পেসশিপটার এক পাশ থেকে আরেক পাশে দশবার যাওয়া-আসা করা সম্ভব!’

অদ্রিক বলল, ‘আমি এটার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না!’

অদ্রি বলল, ‘আজকে আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব।’

আটটির মধ্যে একটি সুড়ঙ্গপথ ধরে অদ্রিরা আবার হাঁটা ধরল। এবারে কিছুক্ষণ হাঁটার পর অদূরে সুড়ঙ্গের মুখে হালকা হলুদ আলো দেখতে পেল। সামনে হলুদ আলোয় ভিন্ন কিছু আছে, এই চিন্তা থেকে তিনজন সাবধানতা অবলম্বন করে এগোতে থাকল। অদ্রিক ও তালুত তাদের পিঠের ব্যাগের মধ্যে দা নিয়ে এসেছে। স্থানীয় বমদের কাছ থেকে তারা দা সংগ্রহ করেছে। দুই বন্ধু ব্যাগ থেকে দা বের করে হাতে নিল। তা ছাড়া তালুত যে শুধু জিম করে তা নয়, মার্শাল আট তার জানা। তাই তালুত সামনে এবং বাকি দুজন পেছনে থেকে এগিয়ে যেতে থাকল।

সুড়ঙ্গের শেষাংশে পৌঁছে তিন বন্ধুর চোখ ছানাবড়া! চোখের সামনে স্টেডিয়ামের মতো বিশাল স্থান; তবে সেটি ভূমি থেকে প্রায় ২০ ফুট নিচে। চারপাশে অসংখ্য সুড়ঙ্গপথের শেষমাথা এসে মিলেছে; সেসব স্থান থেকে নীলাভ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তাই বিস্তৃত গোলাকার পৃষ্ঠের পরিসীমা অপার্থিব লাগছে!

অদ্রিরা সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছে ফাঁকা স্থানে এক এলিয়েনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে! ভিনগ্রহীর মুখাবয়ব ব্যাঙের মুখের মতো; কিন্তু তার শরীরের বাকি অংশের গঠন অনেকটা মানুষের মতো। এলিয়েনের গায়ে অস্বচ্ছ পলিথিন টাইপের কোনো পদার্থের কাপড়; তবে মুখ, হাত দেখে বোঝা যাচ্ছে, এলিয়েনের ত্বক সবুজ রঙের।

ভিনগ্রহী তাকাল আগন্তুক তিন মানুষের দিকে। হঠাৎ অদ্রি অনুভব করল বিস্ময়কর একটি ব্যাপার! অদ্রি যেভাবে ট্রি-নেটওয়ার্কের কথামালা শুনতে পায়, ঠিক একইভাবে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে তার সঙ্গে কথা বলছে এলিয়েন! টেলিপ্যাথি প্রক্রিয়ায় যে ভাষা ব্যবহৃত হয়, তা পরিচিত ভাষাগুলোর মতো না; তবে টেলিপ্যাথি ক্ষমতার অধিকারীরা সেই ভাষা বুঝতে পারে। যন্ত্র যেমন অ্যাসেম্বলি ল্যাঙ্গুয়েজ তথা মেশিন ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে পারে, তেমনি মস্তিষ্কের বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিবাহিত এই ভাববিনিময় কেবল টেলিপ্যাথির ক্ষমতাধারীরা বুঝতে পারে।

টেলিপ্যাথির মাধ্যমে এলিয়েন বলল, ‘তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো। তোমার টেলিপ্যাথি ফিচার আছে, অন্য দুজনের তা নেই।’

টেলিপ্যাথির মাধ্যমে অদ্রি বলল, ‘পৃথিবী গ্রহে তোমাকে স্বাগত জানচ্ছি। তোমার সঙ্গে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কথা বলতে চাই। আমরা নিচে নামব কীভাবে?’

এলিয়েন উত্তর দিল, ‘তোমাদের জন্য সিঁড়ির ব্যবস্থা করছি।’ এটি বলার খানিক পরই অদ্রিদের সুড়ঙ্গমুখে অসংখ্য সূক্ষ্ম কণা টর্নেডোর মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে একত্র হয়ে একটি সিঁড়িতে রূপ নিল! হঠাৎ সিঁড়ির আবির্ভাবে তালুত ও অদ্রিক মহাবিস্মিত। তাদেরকে অদ্রি টেলিপ্যাথির মাধ্যমে এলিয়েনের সঙ্গে আলাপচারিতার ব্যাপারে জানাল।

তালুত জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু এভাবে সিঁড়ি তৈরি হলো কেমন করে?’

অদ্রির জানা নেই বলে সে না-সূচক মাথা নাড়ল।

অদ্রিক জিজ্ঞেস করল, ‘এলিয়েন কি মুখে কথা বলতে পারে না?’

অদ্রি উত্তর দিল, ‘মুখের ভাষা বুঝব না বলেই হয়তো টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কথা বলেছে। কারণ, টেলিপ্যাথির ভাষা এক ও অভিন্ন। চলো, আগে নিচে এলিয়েনের কাছে যাই। পৃথিবীতে তাদের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে বলি।’

অদ্রির পিছু নিল অদ্রিক ও তালুত। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল তিন বন্ধু। এলিয়েনের কাছ থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়াল তিন পৃথিবীবাসী। ভিনগ্রহী উচ্চতায় অদ্রিদের দ্বিগুণ। তাকে দেখে অদ্রিকের মাথায় নানা চিন্তা খেলা করছে। এলিয়েনের গায়ের সবুজ রং দেখে তার মনে হচ্ছে, এই এলিয়েন প্রজাতির দেহে হয়তো উদ্ভিদের মতো ক্লোরোফিল আছে; হয়তো তারা গাছের মতো নিজের খাবার নিজের শরীরেই উৎপাদন করতে পারে। আবার এলিয়েনের মুখের দিকে দৃষ্টি যেতেই অদ্রিকের মনে হলো, নিজের খাবার নিজের শরীরে উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকলে তাদের তো মুখ থাকত না!

অদ্রিক ও তালুত সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই দা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছে। তালুত ভেবেছিল, মার্শাল আর্টের ক্যারিশমায় এলিয়েনকে কাবু করে দেবে। কিন্তু ভিনগ্রহীর উচ্চতার সামনে তাদেরকে শিশুর মতো দেখাচ্ছে। তা ছাড়া এলিয়েনের হাতের মুঠোয় অস্ত্রের মতো কিছু একটা আছে; তবে সেটি কী, তা তালুত বুঝতে পারছে না। অন্যদিকে অদ্রির মনে হচ্ছে, গাছের ট্রি-নেটওয়ার্কের মতো এলিয়েনরা কোনো এলিয়েন-নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। সব সময় তারা আপডেটেড থাকে সেই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

অদ্রির সঙ্গে আবারও টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কথা বলে উঠল এলিয়েন, ‘তোমাদের বসার ব্যবস্থা করছি।’ এটুকু বলে হাতের যন্ত্রটিতে ভিনগ্রহী কিছু ইনপুট দিল। স্টেডিয়ামের মতো স্থানটিতে বিভিন্ন বস্তু বিভাজিত হয়ে ধূলিঝড়ের মতো পরিবেশ সৃষ্টি হলো; ধুলার মতো ক্ষুদ্রাকার কিন্তু রংবেরঙের অসংখ্য কণা টনের্ডোর মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে কিছু সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকল। অদ্রিরা বিস্মিত হয়ে দেখল, কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে একটি বিশালাকায় ড্রয়িংরুমের পরিবেশ সৃষ্টি হলো!  

নৈসর্গিক ড্রয়িংরুমে তৈরি হয়েছে কয়েক সেট সুদৃশ্য সোফা, চারপাশে সৃষ্টি হয়েছে বিচিত্র ধরনের অসংখ্য গাছপালা, গাছগুলোর মাঝখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীর সরু স্রোতোধারা, দূরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি পাহাড়, প্রতিটি পাহাড়ের মাথায় রিং আকারে পেঁচিয়ে আছে মেঘমালা, পাহাড়গুলো থেকে নেমে এসেছে চিকন ধারার ঝরনা!

এমন দৃশ্য দেখে অদ্রিক বলে উঠল, ‘ওয়াও’!

অদ্রিক ও তালুতকে অদ্রি জানাল, এলিয়েনের সঙ্গে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে সে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। কথা শেষ হলে আপডেট জানাবে। ইতিমধ্যে অদ্রির সঙ্গে আবারও যোগাযোগ করল এলিয়েন। অদ্রি খেয়াল করল, টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কথা বলার সময় এলিয়েনের মুখের সবুজ রং খানিকটা হালকা হয়ে যায়। এলিয়েন জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা এখানে এসেছ কেন?’ 

অদ্রি জানাল, ‘আমরা এসেছি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কথা বলতে। তোমরা আসার পর থেকে পৃথিবীতে নানা বিপর্যয় শুরু হয়েছে। এগুলো কি তোমরাই করছ?’

এলিয়েন উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আমরা করছি।’

অদ্রি মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুলল এবং টেলিপ্যাথির মাধ্যমে বলল, ‘কেন করছ?’

এলিয়েন ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিল, ‘এই গ্রহের সব রকম প্যারামিটার অ্যানালাইসিস করে দেখেছি, গ্রহটি আমাদের থাকার জন্য উপযুক্ত।’

অদ্রি ভীষণভাবে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তাই বলে এভাবে তোমরা মানুষ মারতে পারো না।’

এলিয়েন বলল, ‘অন্য কোনো অপশন কাজে আসবে না বলেই আমরা এই মিশনে নেমেছি।’

অদ্রি জিজ্ঞেস করল, ‘অন্য অপশন কী ছিল?’

এলিয়েন জবাব দিল, ‘মানুষকে এই গ্রহ থেকে অন্য কোনো উপগ্রহ, গ্রহ বা গ্রহাণুপুঞ্জে স্থানান্তর করা যেত।’

অদ্রি কঠিন স্বরে জানাল, ‘সেই অপশনের কথা তো তোমরা পৃথিবীবাসীকে জানাওনি; বরং এসেই মানুষ হত্যা করতে শুরু করেছ।’

এলিয়েন যথারীতি বিন্দাসভাবে উত্তর দিল, ‘কারণ, ওসব অপশন মানুষ মেনে নেবে না। আমরা পৃথিবীর সব মানুষের অনুভূতিবিষয়ক সব প্যারামিটার অ্যানালাইসিস করে দেখেছি। তাদেরকে এই গ্রহের বদলে অন্য কোনো স্থানে নেওয়ার প্রস্তাব দিলে তারা প্রত্যেকেই তা প্রতিহত করার চেষ্টা করবে।’

‘কোথায় পেলে এসব প্যারামিটার?’

‘পৃথিবীর সব রকম ডেটাবেজ হ্যাক করে সেই সুপ্রা মেটা ডেটা অ্যানালাইসিস করেছি। মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ঐতিহাসিক নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে—মানুষ মা, মাতৃভাষা, মাতৃভূমি এমনকি মাতৃগ্রহের প্রতি ভীষণ রকম দুর্বল। এগুলো রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও তারা পিছপা হয় না।’

‘তাই বলে তোমরা এভাবে মানুষ মারছ! তোমাদের তো বুদ্ধিমত্তা কম না। বুদ্ধিমান হয়েও এত বড় অন্যায় কেন করছ?’

‘তুমি প্রথম থেকেই ভুল করছ। এটা আমাদের অন্যায় না।’

‘কী বলছ! এটা অন্যায় না?’

‘অন্যায়; তবে তার জন্য আমরা দায়ী নই।’

‘তোমরা দায়ী নও মানে?’

‘আমরা চাইলে পৃথিবীতে কোনো বিষাক্ত গ্যাস কিংবা জীবাণু ছড়িয়ে দিয়ে সব মানুষ মেরে ফেলতে পারতাম, কিন্তু তা করিনি। আমরা শুধু প্রকৃতির বিভিন্ন ফ্যাক্টর পরিবর্তন করেছি, মানুষকে সরাসরি আঘাত করিনি। তাই আমাদের সরাসরি দায়ী করা যায় না।’

‘প্রকৃতির ফ্যাক্টর পরিবর্তন করেছ—এর অর্থ বুঝিয়ে বলো।’

‘যেমন ধরো, সি-গাল পাখি হায়েনার মতো হিংস্র হয়ে ওঠে একটি ফ্যাক্টরের প্রভাবে। নির্দিষ্ট তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতার উচ্চমাত্রার শব্দ পরিবেশে তৈরি হলে সি-গাল পাখি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে যায় এবং অতিমাত্রায় হিংস্র হয়ে যায়। সেই মাত্রার শব্দ মানুষ কান দিয়ে শুনতে পায় না। পৃথিবীর কয়েকটি স্থানে সি-গাল পাখি মানুষ মেরেছে। মানুষ মারার জন্য পাখিগুলোই দায়ী; আমরা শুধু নির্দিষ্ট তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতার উচ্চমাত্রার শব্দ তৈরি করে পাখিগুলোকে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত করেছি।’

অদ্রি খেপে গিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘বাহ্, তোমার যুক্তি শুনে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে!’

এলিয়েন যথারীতি গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, ‘সে ক্ষেত্রেও তোমার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী থাকব না।’

এলিয়েনকে এতটা বিন্দাস দেখে অদ্রি ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ‘তুমি তো তোমাদের কুকর্মের কথা এমনভাবে বলছ, যেন এটা কোনো খেলা! তোমাদের কি কোনো অনুভূতি নেই?’

এলিয়েন নিরুত্তাপভাবে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে জানাল, ‘দুঃখিত, আমার অনুভূতি নেই। তবে বড় কথা, এ ক্ষেত্রে আমরা কোনো কুকর্ম করছি না। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কৃত্রিমভাবে বাতাসের উপাদানগুলোর তাপমাত্রা-চাপ-ঘনত্ব ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটাচ্ছি মাত্র। ফলে যে হারিকেন বা টাইফুন, টর্নেডো, ধূলিঝড় ঘটছে কিংবা মেরু অঞ্চলের বরফ গলে স্থলভাগ তলিয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর জন্য আমরা দায়ী নই।’

অদ্রি এলিয়েনের সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে তাদের কথোপকথনের বিস্তারিত অদ্রিক ও তালুতকে সংক্ষেপে জানাল। অদ্রিক বলল, ‘বুঝতে পারছি, গাধাটার সঙ্গে এসব বিষয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, যা করার নিজেদের করতে হবে। ওর কাছে কন্ট্রোল রুম সম্পর্কে জানতে চাও।’

অদ্রি জিজ্ঞেস করল, ‘কোন কন্ট্রোল রুম?’

অদ্রিক বলল, ‘এই স্পেসশিপে নিশ্চয়ই কোনো কন্ট্রোল রুম আছে, যেখানে তারা সব ডেটা অ্যানালাইসিস করছে, যেখান থেকে কুকর্মগুলো চালাচ্ছে; এমনকি কোনো মূল কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আমাদের প্রথমে স্পেসশিপের কন্ট্রোল রুমে যেতে হবে। সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখো।’

অদ্রি এলিয়েনকে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে জানাল, ‘আমরা তিনজনই ছাত্র; মূলত তোমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। এই স্পেসশিপের কন্ট্রোল রুম কি তুমি আমাদের দেখাতে পারো?’

ভাবলেশহীনভাবে এলিয়েন বলল, ‘অবশ্যই।’ তারপর হাতের যন্ত্রটিতে কিছু ইনপুট দিল। আশপাশের সব বস্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রভাবে বিভাজিত হয়ে ঘূর্ণনের মাধ্যমে ধোঁয়াশা তৈরি করল। ধোঁয়াশা কাটলে অদ্রিরা দেখতে পেল, তারা একটি কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে আছে! চারপাশের দেয়ালজুড়ে মিলিয়ন-বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডেটা অ্যানালাইসিস হচ্ছে।

চলবে...

আরও পড়ুন