মিলিটারির ভয়ে বিল পেরিয়ে আমরা এখন মেথরপাড়ায়। নাগেশ্বর কাকার বাড়িতে। নাগেশ্বর কাকা ছিলেন পিটিআইয়ের জমাদার। লোকেরা তাঁদের মেথর বলত। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল ফুলরানী। তাঁদের তিনটা ছেলেমেয়ে ছিল, রাজা, রানি আর মায়া। রাজা ছিল আমার সমান, রানি তার চেয়ে ছোট, আর মায়ার বয়স ছিল দুই। তাদের সবার চুল ছিল বড় বড়। তাদের চোখ ছিল গোল গোল, ভাসা–ভাসা, চোখে যেন সব সময় কাজল দেওয়াই থাকত। কী সুন্দর যে ছিল তারা।
কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে মিশতে চাইত না।
নাগেশ্বর আর ফুলরানী পিটিআইয়ের বাথরুমগুলো পরিষ্কার করতেন। ক্লাসরুমগুলো ঝাড়ু দিতেন। তাঁদের প্রায়ই টাকা শেষ হয়ে যেত, তাঁরা আমাদের বাসার সামনে এসে বসে থাকতেন।
আব্বাকে দেখলেই বলতেন, এই স্যার বাবু, এই স্যার বাবু, দশ টাকা কর্জ দে না বাবু।
আম্মা বলতেন আব্বাকে, খবরদার টাকা দিবা না। টাকা নিয়েই সোজা মদ খেতে যাবে।
আমরা মদ জিনিসটা কী, জানি না। তবে জানি ভয়ংকর খারাপ কিছু। কারণ, মাঝেমধ্যেই মেথরপাড়া থেকে জমাদারেরা আসত, আমাদের বাসার ওই পাড়ে, দেয়ালের ওই পাড়ে একটা গাছে ঢাকা একতলা ভবনের সামনে তারা জড়ো হতো, আর খুব চিল্লাচিল্লি করত। এমনভাবে গালিগালাজ করত, ভয়ে আমরা কোথায় লুকাব, বুঝতাম না। ভয় হতো, দেয়াল পার হয়ে এসে তারা আমাদের বাসায় ঢুকে যাবে; আর আমাদের মারধর করবে। তারা নিজেরাও মারামারি করত। চিৎকার–চেঁচামেচি করত। কান্নাকাটি করত। এগুলো সব হতো সন্ধ্যার পর। কুকুর ডাকত। আর মুক্তাগাছায় তো বিদ্যুৎ ছিল না। হারিকেনের আলো অন্ধকার তাড়াতে পারত না। কত যে ভয় লাগত। মনে হতো, সবখানে ভূতপ্রেত বসে আছে। সন্ধ্যার পর ওই যে পিটিআইয়ের মাঠের বেলগাছটা, সেখানে ভূতেরা লাফাচ্ছে। আর যখন পিটিআইতে কোনো লম্বা ছুটি থাকত, ট্রেইনি শিক্ষকেরা হোস্টেল ছেড়ে বাড়ি চলে যেতেন, তখন তো সব ফাঁকা। মনে হতো, তিনতলা–চারতলার ছাদে ভূতেরা লাফালাফি করছে। রাতের বেলায় পুরো বিল্ডিংয়ে নানা রকমের শব্দ হতো।
আমরা বিছানায় শুয়ে বলাবলি করতাম…
এই কিসের শব্দ হলো, আমি ফিসফিসিয়ে বললাম!
রিটন ভাই বললেন, ছাদের মধ্যে ভূতেরা নাচানাচি করছে।
মিতাপু বলল, এত জোরে শব্দ হবে কেন। নাচানাচি করলে নূপুরের শব্দ হবে।
রিটন ভাই বললেন, এগুলো খারাপ ভূত। ভালো ভূতেরা নূপুর পায়ে নাচে। খারাপ ভূতেরা ছাদের মধ্যে লাফালাফি করে।
আমি ভয়ে মনে হয় পেশাব করে ফেলব। আম্মা আম্মা...
রিটন ভাই বললেন, আবার আম্মাকে ডাকিস কেন?
ভয় লাগে।
আম্মা হয়তো তখন এশার নামাজ পড়ছেন। জায়নামাজটা গোটাতে গোটাতে বললেন, কী হলো?
আম্মা, ছাদে কি ভূত লাফাচ্ছে? আমি বললাম।
না।
তাহলে শব্দ হচ্ছে কেন?
আম্মা বললেন, ছাত্ররা নেই। হোস্টেল ফাঁকা। ওরা অনেকেই জানালা বন্ধ করে যায় নাই। বাতাসে জানালার পাল্লা নড়ছে। বাড়ি খাচ্ছে।
সেই ভূতপ্রেতের রাজ্যে আবার সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যেই নাগেশ্বরদের লোকেরা আমাদের বাড়ির খুব কাছে এমন মাতলামো করত।
আমরা খুব ভয় পেতাম।
এখন আমরা সবাই নাগেশ্বর কাকুর বাড়িতে। ফুলরানী কাকি আমাদের পেয়ে খুশিতে আত্মহারা।
রাজা, রানি আর মায়া আমাদের পাশে এসে ঘুরঘুর করছে।
আব্বাকে তারা একটা টুল এনে দিল বসার জন্য।
নাগেশ্বর বললেন, স্যার বাবু, আপনাকে এখন কই বসতি দিবে?
ফুলরানী বললেন, সোনার চানেরা এসেছে, তাদরগুলানকে কই বসতি দিবে? মা এসেছে, তাকে কই বসতি দিবে?
আম্মা বললেন, আরে বিপদে পড়ে এসেছি। মিলিটারি আসছে। এর মধ্যে আবার তোরা কী শুরু করলি? থাম তো।
ওদের খড়ের চালাঘর। তবে খুব পরিষ্কার। একটা ঘরের ওপরে একটা কামরাঙাগাছ। তাতে হলুদ পাতা। পাতা ঝরে ঝরে পড়ছে আঙিনায়।
নাগেশ্বর বললেন, মিলিটারি হামাদের ক্ষতি করতে না পারবে বাবু।
নাগেশ্বর উঠলেন। বললেন, তিনি তাঁদের পাড়ার ওই পাশে সাঁওতাল আর ওরাওঁদের পাড়ায় যাবেন। ওদের তির–ধনুক আছে। তারা সবাই তির–ধনুক নিয়ে চলে আসুক।
মিলিটারিকে তারা ঢুকতে দেবে না।
আম্মা বললেন, সর্বনাশ হয়েছে। আমি তো আমার বাসার দরজায় তালা দেই নাই। ঘরদোর সব খোলা। এখন যদি কেউ বাড়ি ঢুকে জিনিসপত্র সব নিয়ে চলে যায়!
আব্বা বললেন, রাখো তো রিটনের মা। জিনিসপত্র দিয়ে কী করবে? আগে জীবন। জান বাঁচানো ফরজ। বাঁচলে জিনিসপত্র আবার হবে। মারা গেলে জিনিসপত্র দিয়ে কী করবা?
আম্মা বললেন, না, আমি যাব। বাসায় গিয়ে তালা দিয়ে আসব।
ফুলরানী বললেন, তাহলে আমিও মার সঙ্গে যাবে।
আব্বা বললেন, না, যেয়ো না।
আম্মা বললেন, তুমি ছেলেপুলেগুলোকে দেখো। আমি আসছি।
আম্মা ওই বিলের মধ্য দিয়ে কাদাভরা সরু পথ ধরে আবার চললেন আমাদের কোয়ার্টারের দিকে। সঙ্গে চললেন ফুলরানী।
আমরা কাঁদতে লাগলাম। আম্মা যাবেন না। আম্মা যাবেন না।
কিন্তু আম্মা তখন হনহন করে হাঁটছেন।
পেছনে ফুলরানী ছুটছেন।
তাদের পিছু নিল একটা কুকুর।
আম্মা বিল পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
আমরা কী খাব? নাগেশ্বর জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
আমি দেখলাম, ওরা উঠানে একটা মাদুরে বরই শুকাতে দিয়েছে। লাল লাল বরই। শুকিয়ে বেশ মার্বেলের আকার নিয়েছে।
আমি বললাম, বরই খাব।
মিতুপা বললেন, এই, এখন কিছু খেতে হবে না।
তারপর কানে কানে বললেন, এদের এখানে কিছু খাওয়া যাবে না।
আমি বললাম, কেন।
চুপ হাদারাম। চুপ করে থাক।
আব্বা বললেন, দাও, একটু বরই দাও। খেয়ে দেখি।
আমাদের আব্বা ছিলেন পরহেজগার। নিয়মমতো নামাজ পড়তেন। নাগেশ্বর একটা থালায় করে বরই এনে দিলেন। আব্বা সবার আগে বরই তুলে মুখে পুরলেন।
নাগেশ্বর বললেন, ফুলরানী তো বেগম মার সঙ্গে চলে গেল। না হলে ভাত রাঁধতে পারত।
আব্বা বললেন, আরে বিপদের মধ্যে আবার ভাত কিসের।
আমিও আব্বার দেখাদেখি বরই তুলে মুখে দিলাম। রিটন ভাই দিলেন।
মিতাপুও তখন বরই মুখে পুরলেন। শক্ত শুকনো বরই। চিবিয়ে চিবিয়ে চুষে চুষে নরম করতে হয়। তারপর কে কতক্ষণ বিচি মুখে রাখতে পারে, তার প্রতিযোগিতা হয় শুরু।
আমি সবার আগে বিচি ফেলে দিয়ে আরেকটা বরই মুখে দিই। আমি হেরে যাই।
মিতাপু মুখের মধ্যে একটা বিচি এক ঘণ্টাও রাখতে পারেন। তিনি সব সময় এই খেলায় জয়লাভ করেন।
আম্মা চলে গেছেন কোয়ার্টারের দিকে। আসছেন না।
এদিকে দেখা গেল, সাঁওতাল আর ওরাওঁদের পাড়া থেকে তির–ধনুক, বল্লম, লাঠিসোঁটা নিয়ে একদল লোক নাগেশ্বরদের বাড়ির পাশ দিয়ে বিল পেরিয়ে যাচ্ছে। তারা মিলিটারিদের আক্রমণ করবে।
রিটন ভাই বললেন, পাগল নাকি। মিলিটারিদের হাতে বন্দুক আছে।
আমি কাঁদতে লাগলাম...এখন কী হবে?
রিটন ভাই বললেন, যুদ্ধ হবে।
আমি বললাম, আম্মা কই? আমি আম্মার কাছে যাব।
রিটন ভাই বললেন, যা।
আমি বললাম, আমার আম্মাকে এনে দাও।
সাঁওতালরাও বিল পাড়ি দিয়ে চলে গেল।
আম্মা আসছেন না।
এই সময় গুলির শব্দ শোনা গেল। গুড়ুম। গুড়ুম।
আব্বা বললেন, এই ছেলেপুলে! মাটিতে শুয়ে পড়ো।
আমরা সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লাম। গুলির শব্দে কাক উড়তে লাগল। গরুগুলো দড়ি ছিঁড়ে ছোটাছুটি শুরু করল।
আব্বাও মাটিতে শুয়ে পড়েছেন। তিনি বললেন, তোদের মা তো আসছে না। বললাম, যেয়ো না। কথা শুনল না।
আমরা কাঁদছি। আম্মা আসছেন না। আবারও গুলির শব্দ।
একটু পরে দিগন্তে দেখা গেল দুজনের ছায়া। রঙিন। আম্মা আর ফুলরানী ফিরছেন।
আমরা আল্লাহকে ডাকছি। আবারও গুলির শব্দ।
আম্মার না জানি গুলি লাগে।
আম্মা এসে বসে পড়লেন মাটিতে। ফুলরানী যা বললেন, তার মানে দাঁড়াল, আরেকটু হলেই বাড়ি লুট হয়ে যেত। তারা দুজন দোতলায় উঠে তালা খুঁজে দরজায় তালা দিয়ে নামছেন, সেই সময় দেখেন, একটা লোক দোতলায় উঠছে। আম্মা তাকে বললেন, তুমি উপরে উঠছ কেন? সে বলল, যদি তোমাদের কোনো দরকার লাগে।
আম্মা তাকে বলেছেন, চলো, আমাদের সঙ্গে নিচে চলো। খবরদার ওপরে উঠবে না।
লোকটা নিচে চলে গেছে।
আম্মাকে পেয়ে আমরা খুব খুশি। আমি আম্মার কোলে গিয়ে বসে পড়লাম।
একটু পরে সাঁওতালরা আবার হইহই করতে করতে ছুটে এল। তারা চিৎকার করছে, জয় বাংলা।
ব্যাপার কী?
মুক্তাগাছা রেলস্টেশনে একটা ট্রেন এসেছিল।
ট্রেনটা রেলস্টেশনে থেমেছিল। ট্রেনে ছিল পাকিস্তানি মিলিটারি।
তখন সবাই ভয় পেয়ে পালাচ্ছিল।
এর মধ্যে কলেজের ছেলেরা, জয় বাংলার লোক, থানা থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে যারা মুক্তি বাহিনী গঠন করেছে, তারা জড়ো হয়। স্টেশনের দিকে এগিয়ে যায়। ট্রেন লক্ষ্য করে গুলি করে। পাকিস্তানি মিলিটারিও পাল্টা গুলি ছোড়ে।
তারপর সাঁওতালরাও চলে যায় স্টেশনের কাছে। তারা তির ছুড়তে থাকে।
তখন মিলিটারিরা গুলি করতে করতে তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠে পড়ে। ট্রেন ছেড়ে দেয়। ট্রেনের পেছন পেছন সাঁওতালরা ধাওয়া করে। কিন্তু ট্রেন তাদের চোখের আড়ালে চলে যায়।
মিলিটারি পালিয়ে গেছে। আর আসবে না।
সাঁওতালরা সবাই জয় বাংলা বলে চিৎকার করতে করতে তাদের পাড়ায় ফিরে গেল।
আম্মা আসার সময় হাতে করে রেডিওটা নিয়ে এসেছেন। আমরা রেডিও শোনার চেষ্টা করি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনা যায়। এবার শুনবেন বজ্রকণ্ঠ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রচারিত হচ্ছে:
‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমাদের লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের প্রতি আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’
আব্বা বললেন, সাঁওতালরা তো দেখি বঙ্গবন্ধুর হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। তির–ধনুক নিয়ে মিলিটারির ট্রেন আক্রমণ করতে গেছে।
আমরা আবার আমাদের পিটিআইয়ের কোয়ার্টারে ফিরে আসি
কিন্তু ভয় ভয় লাগে। আব্বা আর পিটিআইয়ের একজন ইনস্ট্রাকটর মোস্তাফিজ সাহেব বিকেলবেলায় মাঠে হাঁটেন, আর গল্প করেন। আমি তাঁদের সঙ্গে হাঁটি।
মোস্তাফিজ সাহেব বললেন, শুনেছেন তো, মিলিটারিরা স্টেশনে নেমেই স্টেশনমাস্টারকে গুলি করে মেরেছে?
আব্বা বললেন, হ্যাঁ। তা–ই তো শুনতে পাচ্ছি।
মোস্তাফিজ সাহেব বললেন, কোনো কারণ ছিল না। এই স্টেশনে রেড সিগন্যাল ছিল। সে জন্য ট্রেন থেমেছিল। মিলিটারির ট্রেন কেন এত ছোট স্টেশনে থামানো হলো। এই রাগে মিলিটারিরা স্টেশনমাস্টারকে গুলি করে মেরেছে।
আব্বা বললেন, নিশ্চয়ই রেড সিগন্যালের কোনো কারণ ছিল।
মোস্তাফিজ সাহেব বললেন, উল্টো দিক থেকে ট্রেন আসছিল। সেটাকে ক্রসিং দেওয়ার জন্য এটাকে রেড সিগন্যাল দিতে হয়েছিল।
আব্বা বললেন, তা না দিলে তো দুই ট্রেনে কলিশন হয়ে যেত।
মোস্তাফিজ সাহেব বললেন, ওরা চেয়েছিল, ওদের ট্রেন যাবে। উল্টো দিকের ট্রেনটাকে আগের স্টেশনে আটকে রাখা হবে।
আব্বা বললেন, সে দোষ তো তাহলে মুক্তাগাছা রেলস্টেশনের মাস্টারের নয়।
মিলিটারিকে সেটা কে বোঝাবে?
মোস্তাফিজ সাহেব বললেন, মিলিটারির দিকে গুলি ছুড়েছে। তির–ধনুক মেরেছে। ওরা কি আর ছাড়বে? আবার আসবে।
আব্বা বলেন, আবার আসবে মানে? ওরা তো ভয়েই পালাল।
নিশ্চয়ই ওরা কোথাও যাচ্ছে। তাদের প্রতি হুকুম হয়েছে কোথাও যাওয়ার জন্য। তাই তারা মুক্তাগাছায় বেশি সময় থাকতে পারেনি। কিন্তু গুলি যখন খেয়েছে, তারা তো প্রতিশোধ নিতে আসবেই।
আমি আব্বা আর মোস্তাফিজ স্যারের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে লাগলাম। মিলিটারি আবারও আসবে? কী হবে?
আমি আব্বাকে বললাম, আব্বা চলেন, আমরা মুক্তাগাছা থেকে চলে যাই?
আব্বা বললেন, কই যাবা?
আমি বললাম, চলেন, দাদাবাড়ি যাই।
আব্বা বললেন, দাদাবাড়ি অনেক দূর। রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ। কোথায় না কোথায় মিলিটারি চেকপোস্ট বসিয়েছে। দেখি। পরিস্থিতি একটু ভালো হোক।
পরিস্থিতি ভালো হলো না।
খবর এল, মিলিটারি আসছে মুক্তাগাছায়। তারা পুরা মুক্তাগাছা জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে দেবে।
গভীর রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। আম্মা বললেন, বাবা, ওঠ। পালাতে হবে।
আমাদের বলে দেওয়ার দরকার পড়ল না যে আবার মিলিটারি আসবে।
আমরা জিনিসপত্র বেঁধেছেঁদে নিয়ে সঙ্গে আরও লোকজন নিয়ে রাতের অন্ধকারে পিটিআইয়ের কোয়ার্টার ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম বিলের ওপারে। সেই রাতে আকাশে চাঁদ ছিল। আমরা হাঁটছি। চাঁদও আমাদের সঙ্গে হাঁটছে।
অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পা ব্যথা হয়ে আসছে। তবু হাঁটার বিরাম নেই। আলপথ, মাটির রাস্তা ধরে আমরা হাঁটছি। আব্বার হাতে টর্চলাইট। সেটা দিয়ে রাস্তা দেখে দেখে আমরা চলেছি।
আমাদের পেছনে একটাই বিপদ। মিলিটারি।
সেই অন্ধকার রাতে চলতে চলতে আমাদের মোটেও সাপের ভয় লাগছিল না। ভূতের কথা মনেও পড়ছিল না।
কারণ আমাদের পেছনে আছে মিলিটারি।
তারা সাপের চেয়েও বিষাক্ত।
তারা ভূতের চেয়েও ভয়ংকর।
আমি হাঁটছি। আমার বয়স সাড়ে পাঁচ বছর। আমার বোন হাঁটছেন। আমার ভাই হাঁটছেন। আম্মা হাঁটছেন। আব্বা হাঁটছেন। আমাদের সঙ্গে আছে আনসার মিয়া। তাঁর হাতে আব্বার সাইকেল। সেই সাইকেলের সামনে–পেছনে নানা বোঝা বাঁধা।
আরেকজন লোক নেওয়া হয়েছে সঙ্গে। তার কাঁধে বাঁক। আমরা বলি, বাউংকা। একটা লাঠির দুই পাশে দড়ি দিয়ে ডালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেই ডালায় জিনিসপাতি। তিনি হাঁটছেন সেটা কাঁধে নিয়ে।
আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে চটের ব্যাগ। তাতেও জিনিসপাতি।
ভোররাতের দিকে আমরা অনেক দূর চলে গেলাম। তখন পেছন থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসতে লাগল।
মুক্তাগাছা বন্দরে মিলিটারি এসে গেছে।
মাইলের পর মাইল হাঁটছি। ব্যথায় আমার পা টনটন করছে। হাতের ব্যাগটায় মনে হচ্ছে হাত ছিঁড়ে যাবে। রিটন ভাই একটা বুদ্ধি বের করলেন। একটা লাঠি এনে বললেন, আয়, ব্যাগগুলো লাঠিতে ঝুলিয়ে দিই। তারপর দুই ভাই লাঠিটা ধরে নিয়ে যাই।
এতে লাভ হলো। হাতে ব্যথা কম লাগছে।
রাতের বেলায় হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় দেখলাম শিয়াল। অবাক হয়ে আমাদের দেখছে। শিয়ালের চোখ জ্বলছে।
বিভিন্ন গ্রামের ভেতর দিয়ে যখন যাই, কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে এগিয়ে আসে।
সকালবেলায় আমরা একটা গ্রামে পৌঁছালাম। এটা আম্মার ফুফুর বাড়ি। গ্রামের নাম কাজলা।
আম্মার ফুফু মানে আমার নানি। অনেক বয়স তঁার। তাঁর দাঁত নেই। তাঁর শাড়িতে তামাকের গন্ধ। তিনি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ওরে আমার নাতিভাই রে। কত কষ্ট করছে রে। আয় ভাই, দুধভাত খা।
আমরা টিউবওয়েলের পানিতে হাত–পা ধুয়ে রান্নাঘরে বসলাম পিঁড়িতে। আমাদের কাঁসার বাটিতে দুধ আর ভাত দেওয়া হলো। গুড় মেখে দুধভাত লাল করে আমরা খেতে লাগলাম।
দুপুর নাগাদ খবর এল, মিলিটারি পুরো মুক্তাগাছা বাজার পুড়িয়ে দিয়েছে। নেমেই নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। বহু মানুষ মরে পড়ে আছে। পিটিআইটাকেই তারা ক্যাম্প বানিয়েছে।
আব্বা বললেন, ওগো শুনছ। আজকে যদি মুক্তাগাছা থাকতাম, তাহলে নির্ঘাত মারা পড়তাম।
আম্মা বললেন, আল্লাহ বাঁচায় রাখুক। রাখে আল্লাহ মারে কে।