অদ্ভুতুড়ে গল্প—খাইবার আগে
ট্রাকটা চলছিল অনেকক্ষণ ধরে। পিঠে পাথর বোঝাই বলে চওড়া মসৃণ রাস্তায়ও চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল রশিদ ড্রাইভারের। এমনিতে সে খুব হাসিখুশি মানুষ। ঠাট্টা-মশকরা করে অপরিচিত মানুষের সঙ্গেও দিব্যি আড্ডা জমিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু স্টিয়ারিংয়ে হাত দিলে সেই লোকই বদলে যায়। একটার পর একটা পান চিবোতে থাকে আর শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। ক্লাচ ও এক্সেলেটরে দুই পা দিয়ে, কাঁপতে থাকা গিয়ারটা বাঁ হাতের মুঠোয় চেপে ধরে সে যেন দরবেশের মতো ধ্যানে বসে। তখন চিরচেনা রশিদ ড্রাইভারকে ভীষণ ভয় পায় সানোয়ার।
অনেকক্ষণ ধরে সানোয়ারের খিদে পেয়েছে। তার ওপর বাথরুম পেয়েছে। পেটে একই সঙ্গে শূন্যতা ও পূর্ণতার অদ্ভুত বুদ্বুদ নিয়ে ভীষণ অস্বস্তিতে আছে কিশোর সানোয়ার। কিন্তু রশিদ ড্রাইভারের মুখের দিকে তাকিয়ে থামতে বলার সাহস পাচ্ছে না।
রশিদের সব মনোযোগ এখন রাস্তার দিকে। আড়চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে চোয়াল নেড়ে পান চিবোচ্ছে। চোখ দুটো রক্তজবার মতো লাল। জুলফি ও গোঁফ থেকে ধীরে ধীরে ঘাম গড়াচ্ছে। তারপরও রশিদ নির্বিকার। সানোয়ার আর থাকতে না পেরে একটা গান চালিয়ে দেয়। এশার আজানের সময় এমপি–থ্রি প্লেয়ার বন্ধ করা হয়েছে। এরপর পেরিয়ে গেছে আরও চার ঘণ্টা। এর মধ্যে রশিদ একটা কথাও বলেনি। সানোয়ারের ভয় হলো, আষাঢ়ের গরমে লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো!
রশিদ বাথরুম থেকে ঘুরে এসে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি একটানে শেষ করে বলল, ‘আহ, টিউবওয়েলের পানির মতো স্বাদের পানি আর হয় না। কিন্তু পানিতে খুব আয়রন। ওয়াশার পাল্টাইতে হবে। ম্যানেজার ভাই, কলের ওয়াশারডি পাল্টাইয়া নিয়েন।’
মেহেদী হাসানের একটা গজল শুরু হতেই রশিদ যেন চমকে উঠল। সে সানোয়ারের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কিরে ব্যাটা, খিদা পাইছে?’
এইবার সানোয়ার মুখ ফুটে বলল, ‘খিদা পাইছে, খালু। আপনি খাইবেন না?’
রশিদ বাইরে তাকিয়ে কোনো মাইলপোস্ট খুঁজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কোন জায়গা?’
সানোয়ার এদিকে কখনো আসেনি। সে মাথা নেড়ে বলল, ‘কইতে পারি না।’
রশিদ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কী কইতে পারস তাইলে? তুই গুঙ্গা? নাকি আন্ধা? খাওয়ার কথা কইতে পারস না, রাস্তাঘাটের কথা কইতে পারস না। হেলপারের কামডা কী তাইলে?’
সানোয়ার অস্ফুট গলায় বলল, ‘আমার ডর করে, খালু।’
রশিদ কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। বোধ হয় তার হেলপারি জীবনের কোনো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল। সে স্নেহভরা সুরে বলল, ‘ডর করে ক্যান ব্যাটা? আমি আছি না?’
সানোয়ার সাহস পেয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘সারা দেশের মানুষ তেঁতুলিয়া থাইকা পাথর নিয়া যায়। আর আমরা পাথর নিয়া তেঁতুলিয়ায় যাইতেছি। আপনার মনে একবারও প্রশ্ন উঠে নাই যে আমাগো ট্রাকে ঠিক কী তুইলা দিল?’
খটকা রশিদেরও লেগেছে। কিশোর হেলপারের চিন্তায় সে চমৎকৃত হয়ে বলল, ‘তুই এই সবও ভাবিস?’
সানোয়ার ধীরে ধীরে বলল, ‘ভাবি। কিন্তু সব সময় কইতে পারি না।’
রশিদের মধ্যে আড্ডার মেজাজ ফিরে আসতে শুরু করেছে। সে একটা শিস দিয়ে বলল, ‘আমার লগে থাকলে কইতেও শিখবি। খালি কাজে-কামে মনোযোগ দে...’
কথাটা শেষ করার সুযোগ পেল না রশিদ। তার চোখে একটা ভাতের হোটেল পড়েছে। সে খুশি হয়ে বলল, ‘ওই তো একটা হোটেল। ল যাইগা।’
হোটেলটা সানোয়ারেরও চোখে পড়েছে। সে ট্রাক থামানোর তীব্র ইচ্ছা উপেক্ষা করে বলল, ‘কিন্তু হোটেলটা ওইখানে ক্যান? রাস্তার পাশে এত জায়গা থুইয়া হোটেলটা অত দূরে বানাইলো ক্যান?’
রশিদ এভাবে ভেবে দেখেনি। তারা অনেকক্ষণ ধরে বিরান হাইওয়ে ধরে চলছে। সর্বশেষ বাজার পার হওয়ারও পনেরো মিনিট পার হয়ে গেছে। পথের দুই পাশে বিস্তীর্ণ ঘাসে ভরা মাঠ আমন ধান রোপনের অপেক্ষায় পড়ে আছে। ত্রিসীমানায় লোক নেই, কিন্তু হোটেল আছে—এটা এখন আর হাইওয়েতে অস্বাভাবিক দৃশ্য নয়। ট্রাকচালকদের অপেক্ষায় হোটেলগুলো সারা রাত তীর্থের কাকের মতো বসে থাকে। কিন্তু এই হোটেল রাস্তার কোল ঘেঁষে নয়। হাইওয়ে থেকে পশ্চিমে বেরিয়ে যাওয়া একটা সরু রাস্তার ওপর মাটি ভরাট করে বানানো।
রশিদ মোড়ের ওপর ট্রাক দাঁড় করিয়ে বলল, ‘এই রাস্তাটা আগে দেখছস? এত দিন এই রোডে গাড়ি চালাই, কখনো তো এই রাস্তা চোখে পড়ে নাই। এই পথে কই যায়, কে জানে?’
সানোয়ার ততক্ষণে ভাবছে, হোটেলে গিয়ে কী কী খাবে। সে বলল, ‘লন, দেইখা আসি। আমার মন কইতাছে, এরা খানা পাকায় ভালা।’
হোটেলের নাম পুষ্টি ভোজনালয়। পুরোনো বাঁশ ও টিন দিয়ে বানানো নিতান্ত সাধারণ এক ভাতের হোটেল। উঠানে একটা বাতাবিলেবুর গাছ বড় বড় ফলের ভারে নুয়ে আছে। গাছের ডালে ঝিকিমিকি রুপালি বাতি জ্বলছে। তার ওপর দিব্যি বসে আছে একটা প্রকাণ্ড লক্ষ্মীপ্যাঁচা। এতক্ষণ উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল। ট্রাকের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মাথাটি এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে আগন্তুকদের দিকে তাকাল। সানোয়ারের মনে হলো, পশ্চিমের অন্ধকারে উড়ে যাওয়ার আগে প্যাঁচাটির চোখ জোড়া একবার দপ করে জ্বলে উঠল।
বাইরে যতই আলোকিত হোক, হোটেলের ভেতরে আলো খুব সামান্য। চল্লিশ ওয়াটের পুরোনো হলুদ বাতি মিটিমিটি জ্বলছে। রশিদ খুশি হয়ে বলল, ‘এই হোটেলের মালিক ভাইরে ধন্যবাদ। ডেরাইভারের চোখের আরাম কইরা থুইছে। দুইন্যার সব হোটেলমালিকেরে যদি আল্লায় এমন বুদ্ধি দিত!’
ভেতরে রেডিওতে মৃদু শব্দে গান বাজছে, ‘দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা...।’
রশিদ বাথরুম থেকে ঘুরে এসে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি একটানে শেষ করে বলল, ‘আহ, টিউবওয়েলের পানির মতো স্বাদের পানি আর হয় না। কিন্তু পানিতে খুব আয়রন। ওয়াশার পাল্টাইতে হবে। ম্যানেজার ভাই, কলের ওয়াশারডি পাল্টাইয়া নিয়েন।’
ম্যানেজার এই ঘোর গরমের দিনেও গায়ে-মাথায় চাদর মুড়ি দিয়ে বসে ছিল। সে রশিদের কথা শুনে ‘ওহ!’–এর মতো একটা শব্দ করল। লোকটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রশিদ বিড়বিড় করে বলল, ‘কিরে সানোয়ার, কী খাইবি কইলি না?’
সানোয়ারের খেতে ইচ্ছা করছে কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি, শিদলের ভর্তা, শুকনা মরিচ পুড়িয়ে বানানো পেঁয়াজের ভর্তা আর গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত। কিন্তু ইচ্ছা করলে কী হবে? এসব খাবার হোটেলে বিক্রি হয় না। সে জিবের জল সামলে বলল, ‘গরুর মাংস আর ভাত।’
রশিদ তুড়ি মেরে বয়কে ডাক দিয়ে বলল, ‘ওইটাই সই। গরুর মাংস আর ভাত নিয়া আসো। সাথে পাতলা ডাইল।’
‘আবারও গরুর মাংস!’ ভেবে সানোয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রশিদ ড্রাইভারের সঙ্গে যতবার খেতে বসেছে সে, ওই এক তরকারি দিয়ে ভাত খেতে হয়েছে। কখনো একচুল নড়চড় হয়নি। লোকটা আর কিছু খায় না নাকি?
বয় কিছুক্ষণের মধ্যে ভাতের গামলা, দুই বাটি মাংস আর এক জামবাটি ভর্তি ডাল এনে টেবিলে রাখল। মাংসের ছিরি দেখে রশিদ মুখ কুঁচকে বলল, ‘ঠান্ডায় মাংস কেমন জইমা রইছে। গরম–গরম খাওয়াইতে পারো না?’
বয় দাঁত বের করে হাসল। সানোয়ার অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। যেমন লম্বা, তেমনি শুকনা সে। মাথাভর্তি এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল কান পেরিয়েছে। সামনের চুল নেমে এসে চোখ জোড়া ঢেকে ফেলেছে দেখে সানোয়ারের মনে হলো, এই আলো-আঁধারির মধ্যে ছেলেটা হাঁটে কীভাবে? হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় না?
রশিদ কিন্তু হাসিতে গলার পাত্র নয়। সে জগের পানি মাংসের বাটিতে ঢালার উপক্রম করে বলল, ‘এক্ষনি মাংস গরম কইরা নিয়া আসো। নাইলে এই পানি ঢাললাম। কুইক!’
বয় সানোয়ারের দিকে ফিরে বলল, ‘আপনিও গরম খাবেন কি?’
অদ্ভুত ছেলেটার কণ্ঠস্বর। যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। সন্দেহ হতেই রশিদ হোটেলের ক্যাশের দিকে তাকাল। ম্যানেজার চাদরের ঘোমটা খুলে জুলজুলে দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বয় ও ম্যানেজারের চেহারা অবিকল একই রকম। তারা যেন দুই যমজ ভাই। না, তুলনাটা জুতসই হলো না। ম্যানেজারের চেহারায় বয়সের ছাপ আছে। তারা যেন পিতা-পুত্র।
রশিদ হড়বড় করে বলল, ‘বাপে-পোলায় হোটেল খুলছেন ভালো কথা। কিন্তু পোলারে এলেমও তো দেওন লাগব, তা–ই না? গরম ভাতের হোটেলে ঠান্ডা গোশত খাইতে দেওয়া কি ঠিক?’
ম্যানেজারের অপলক দৃষ্টি একটুও ম্লান হলো না। সানোয়ারের মনে হলো, লোকটা একবারও চোখের পাতা ফেলছে না। কিছু কিছু মানুষ আছে এ রকম, যাদের চোখের পলক খুব কম পড়ে।
ম্যানেজার ইশারায় বয়কে মাংস গরম করে আনতে বলল। রশিদ থালায় ভাত বেড়ে ডাল মেখে খেতে শুরু করেছে দেখে সানোয়ারও ওস্তাদকে অনুসরণ করল। দিব্যি সুস্বাদু ডাল। ট্রাকের হেলপারি শুরু করার পর হোটেলে তিন বেলা খাওয়া তার অভ্যাস হয়ে গেছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, যেখানে ডাল ভালো রান্না হয়, সেখানকার তরকারিও সুস্বাদু হয়।
সানোয়ারের খুব খিদে পেয়েছে। শুধু ডাল দিয়েই সে গপাগপ খেতে শুরু করল। লক্ষও করল না যে রশিদ খাওয়া বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিরক্ত হয়ে রশিদ ছোট্ট করে একটা শিস দিল। সানোয়ার চমকে ওস্তাদের দিকে তাকাতেই সে হোটেলের ভেতরে ইশারা করল।
এতক্ষণ হোটেলে খদ্দের ছিল শুধু তারা দুজন। কোন ফাঁকে যেন হোটেলটি পূর্ণ হয়ে গেছে। তাদের বাঁ পাশের টেবিলে দুই কালো বোরকা পরা মহিলা একটা কমলা রঙের ফ্রক পরা মেয়েকে নিয়ে খেতে বসেছে। ডানের টেবিলে টি-শার্ট ও জিনসের প্যান্ট পরা দুই তরুণ খেতে খেতে উচ্চ স্বরে কী নিয়ে যেন তর্ক করছে। একটা টেবিলে বসেছে স্কুলড্রেস পরা দুটি শিশু। একটা ছেলে, আরেকটা মেয়ে। দুজনের বয়স ছয় বছরের বেশি হবে না। আরেক টেবিলে পাগড়ি পরা এক লম্বা দাড়িওয়ালা লোক তিনজন মাদ্রাসাপড়ুয়া তালিবুল এলেমকে নিয়ে রুটি-তরকারি খাচ্ছে। সানোয়ার অবাক হয়ে আগন্তুকদের দিকে তাকিয়ে রইল। এরা কখন এল? তাদের নজর এড়িয়ে কী করে খেতে বসল?
রশিদের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। তার মুখভর্তি ভাত, কিন্তু চিবোচ্ছে না। সানোয়ারের দিকে আড়ষ্ট হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। সানোয়ার ভীত গলায় বলল, ‘এরা কারা, খালু? কখন আইলো? টেরই পাইলাম না।’
বয় ততক্ষণে মাংসের বাটি নিয়ে ফিরে এসেছে। তাকে দেখে রশিদ কোনো জবাব দিল না। লবণদানি থেকে একরাশ লবণ ছিটিয়ে ভাত মেখে খেতে শুরু করল।
সত্যিই এরা চমৎকার রান্না করে। ঝোলের সঙ্গে মাংসের মিলমিশটা হয়েছে অমৃতসমান। রশিদ ও সানোয়ার দুজনই ক্ষুধার্ত। গোগ্রাসে খেতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিল মাঝরাতের হোটেলের অদ্ভুত খদ্দেরদের কথা। বিরামহীনভাবে দুই থালা ভাত সাঁটিয়ে একটা প্রকাণ্ড ঢেকুর তুলে রশিদ পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতেই লক্ষ করল ব্যাপারটা, হোটেলটা আবার শূন্য হয়ে গেছে। কোন ফাঁকে যেন খাওয়া শেষ করে প্রত্যেকেই বেরিয়ে গেছে। দিব্যি রাস্তার ধারের হোটেল, কিন্তু কোনো গাড়ির আওয়াজ সে পায়নি। লোকগুলো এল কোত্থেকে আর গেলই–বা কোথায়?
সানোয়ার তখনো মন দিয়ে খাচ্ছে। রশিদ গলা চড়িয়ে ম্যানেজারকে বলল, ‘ভাই, আপনের কাস্টমাররা কই গেল?’
মাটির পর মাটি পড়ে ঢেকে যেতে থাকল রশিদ ও সানোয়ারের শরীর। তাদের শ্রবণশক্তি ততক্ষণে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যেও দূরের হাইওয়ে থেকে ভেসে আসা পুলিশের গাড়ির সাইরেন তাদের কানে পড়ল।
ম্যানেজার চেয়ারে বসে ঘুমে ঢুলছিল। সে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘কোথায় আবার যাবে? যার যার কবরে ফিরে গেছে।’
রশিদ বুঝল, ম্যানেজার তার সঙ্গে মশকরা করছে। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘তাইলে আমাগো কবরডিও রেডি রাইখেন, ভাই। খাওয়ার পর এট্টু গড়ায়া নিতে পারলে ভালো লাগব।’
ম্যানেজার কিন্তু হাসল না। সে গলা চড়িয়ে বলল, ‘বশির, এদের কবর দুইটা রেডি হইছে কি?’
বয় ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল, ‘কবর খোঁড়ার কাজ চলছে। আরেকটু অপেক্ষা করতে বলেন, আব্বা।’
রশিদ বাপ-ছেলের কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। ভাত খেয়ে যতটা খুশি হয়েছিল, দুজনের আলাপ শুনে ততই ক্রুদ্ধ হলো সে। মুখ বিকৃত করে বলল, ‘কবর খোঁড়ার কাজ চলতাছে! জিন্দা মানুষরে কবর দেওয়ার আলাপ করেন; এ কেমন মশকরা?’
ম্যানেজার একটা হাই তুলে বলল, ‘আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন। আপনার সঙ্গে মশকরা করব কেন? জানেন না, এটা মৃতদের হোটেল? মরা মানুষেরাই আমাদের কাস্টমার। রাতের খাবার শেষ হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখে আসুন, সবাই নিজ নিজ কবরে ফিরে গেছে।’
রশিদ বলল, ‘যাইতাছি। ফাইজলামি করলে কিন্তু বিল পাইবেন না। মাগনা খাওয়াইতে হইব। আপনের মশকরার দণ্ড।’
সানোয়ারের হাত ধরে রশিদ হন হন করে বাইরে বেরিয়ে এল। আষাঢ় মাসের রাত। আকাশে ঘন হয়ে মেঘ জমেছে। থমথমে অন্ধকারের গুমোট কাটিয়ে বাতাস বইতে শুরু করেছে। পিচগোলা অন্ধকার ভেদ করে দূরে কোথাও ঝিলিক দিয়ে উঠছে নিঃশব্দ বজ্র। সেই অপার্থিব আলোয় হোটেলের উঠানের দিকে তাকিয়ে রশিদ ও সানোয়ারের যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে এল। হোটেলের ধূলিময় উঠানে ফোঁড়ার মতো জেগে উঠেছে নতুন-পুরোনো সারি সারি কবর। সব কটা একেবারে তাজা। কারা যেন কবর ভেদ করে উঠে এসেছিল। এইমাত্র ভেতরে ঢুকে আবারও বুজিয়ে দিয়েছে প্রবেশপথ।
সানোয়ার ততক্ষণে কাঁপতে শুরু করেছে। তার গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছে বীভৎস ভয়। রশিদের ঝুলে থাকা হাতের আঙুল খপ করে ধরে সে কান্নাজড়িত গলায় বলল, ‘তাড়াতাড়ি ট্রাক ইস্টার্ট দেন, খালু। আমার খুব ডর করতাছে।’
রশিদ হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। সানোয়ারের হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে সে ছুট লাগাল ট্রাকের দিকে। পড়িমরি করে ছুটতে গিয়ে আচমকা হোঁচট খেয়ে পড়ল এক সদ্য খোঁড়া কবরে। টাল খেয়ে ছিটকে পড়ল সানোয়ার। তারও আশ্রয় হলো এক সোঁদাগন্ধি নতুন কবরে।
এক অদ্ভুত আলস্য ভর করেছে তাদের শরীরে। বহুদিনের অপূর্ণ ঘুমে চোখের পাতা যেন জড়িয়ে আসছে। শরীরের সব পেশি শিথিল হয়ে অনন্ত ঘুমের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে দেহ। ঘোলা হয়ে আসছে চোখের দৃষ্টি। কানে বাজছে মন্ত্রপাঠের মতো একঘেয়ে মৃদু সুর। শুকিয়ে যাওয়া গলায় যেন নদীর মতো বইছে স্বাদুপানির স্রোত। কবর থেকে উঠে পালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারল না রশিদ ও সানোয়ার। যেন এটাই তাদের ঘরবাড়ি। বহুদিন ধরে এমন শান্তির আশাতেই তারা পৃথিবীর জল-মাটি-কাদায় বিচরণ করেছে।
শরীরে কী যেন সরসর করে পেঁচিয়ে ধরছে। সাপ? নাকি আগ্রাসী কোনো লতা? যা–ই হোক, মন্দ লাগছে না। চামড়ার নিচে যেন বেড়ে উঠছে স্বর্ণলতার ডাল। বুকের ভেতর দুই ফুসফুস যেন নতুন করে জন্ম নিয়েছে। প্রাণভরে শ্বাস নিতে খুব ভালো লাগছে। মিছিমিছি কবরকে এতকাল ভয় পেয়েছে তারা।
চোখ বুজে যাওয়ার আগে তারা দেখল, ম্যানেজার ও বয় মিলে তাদের শরীরে মাটি দিচ্ছে। জমির ভিজে মাটি নয়, তাদের শরীরে যেন ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ছে। মাতাল করা সুগন্ধ ভাসছে বাতাসে। ম্যানেজার বলল, ‘এই প্রথম, এই শেষ। এর পর থেকে নিজে নিজে কবর থেকে উঠতে হবে। খিদে পেলে উঠবেন। খেয়েদেয়ে আবার কবরে শুয়ে পড়বেন।’
মাটির পর মাটি পড়ে ঢেকে যেতে থাকল রশিদ ও সানোয়ারের শরীর। তাদের শ্রবণশক্তি ততক্ষণে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যেও দূরের হাইওয়ে থেকে ভেসে আসা পুলিশের গাড়ির সাইরেন তাদের কানে পড়ল। পথচলতি গাড়ির ড্রাইভাররা ভয়াবহ দুর্ঘটনা দেখে শিউরে উঠল।
হাইওয়ের ধারে খাদের ভেতর উল্টে আছে এক পাথরভর্তি ট্রাক। চালকের আসনসহ সামনের অংশ একেবারে চূর্ণ হয়ে গেছে। ভেতরে চাপা পড়ে মারা গেছে ড্রাইভার ও হেলপার।