আমাদের অদ্ভুত ফ্যামিলি
বললে হয়তো বিশ্বাস করবা না, কিন্তু আমাদের বাসায় আমি ছাড়া কোনো নরমাল মানুষ নাই। একদম ১০০ পার্সেন্ট সত্যি কথা। এই বাসার সবাই অদ্ভুত। মাঝেমধ্যে তো আমাদের বাসার নিচের কুকুরটাকেও নরমাল মনে হয় না। এই কুকুর জিলাপি খায়। বাংলাদেশে এ রকম কোনো কুকুর আর আছে কি না, কে জানে।
আমাদের বাসার মানুষ যে অদ্ভুত, এটা তোমাদের কীভাবে বোঝাই? ধরো আমার আম্মা—সারা দিন থাকে অফিসে। বাসায় এসে কোথায় রেস্ট নেবে, নাহ। ঢুকেই একসঙ্গে একগাদা কথা বলতে শুরু করে, ‘কিরে, দরজার সামনে স্যান্ডেল ওলটানো ক্যান, বিপদ হয় জানিস না?’ আমাদের সঙ্গে যে সারা দিন তার দেখা নাই, তা কি একবারও আম্মা ভাবে? ভাবে না। বরং দরজা আটকেই সে পুরো ঘরের দিকে ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে তাকায়। মনে হয় মানুষ না, রোবটের মতো পুরো ঘরটা স্ক্যান করছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো ঘরটা স্ক্যান করে ফেলে আম্মা। তারপর…ডায়ালগ শুরু: ‘আয়হায় হায় হায়, কী করে রাখসে ঘরটা। সর্বনাশ! কিরে, ডাইনিংয়ে ফ্যান চলে ক্যান? শুধু শুধু ফ্যান চলতেসে, না জানি কত ঘণ্টা চলসে ফ্যানটা! বন্ধ কর ফ্যান!’
আমি তাড়াতাড়ি ফ্যানের সুইচ অফ করি। কিন্তু আম্মার ডায়ালগ থামে না—
‘ঘরটা বালু বালু লাগতেসে! জুতা নিয়ে ঘরে হাঁটসে নিশ্চিত! আয়হায় হায় হায়! সকালে ঘরটা পরিষ্কার করে গেলাম, এরা কিচ্ছু রাখে নাই!’
আম্মা ডাইনিংয়ের চেয়ারে ব্যাগটা রেখে ছোটে ঝাড়ু আনতে। সাধারণত এই সময়েই তার চোখ পড়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে।
‘ভাত খেয়ে টেবিলটা একটু মুছতে পারিস না? পিঁপড়া ধরে গেসে! ইশ! কী অবস্থা করসে টেবিলটার! তোরা কি টেবিলে ভাত ফেলে খাস? প্লেটে খাইলে এত ভাত পড়ে কী করে?’
আম্মা টেবিল মোছার ন্যাকড়া পানিতে ভিজিয়ে টেবিল মোছা শুরু করে।
‘দেখসো, করসেটা কী? নিচেও ভাত ফেলসে! আয়হায় হায় হায়, এরা কবে শিখবে? এদের যন্ত্রণায় আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল! এরা মাটিতে ভাত ফেলে! কী করব আমি এদের নিয়ে?’ এই সময়ে আম্মা ঝাড়ু নিয়ে টেবিলের নিচে অযথাই ঝাড়ু দেয়।
‘আমার আর ভাল্লাগে না! সারা দিন খাটাখাটনি করে ঘরে এসেও এক ফোঁটা শান্তি নাই। আমার কপালে আছে খালি যন্ত্রণা।’
অনেক সময় মাটিতে বসে টেবিলের নিচে ঝাড়ু দেয় আম্মা। প্রায়ই তাড়াহুড়া করে ওঠার সময় ধাম করে টেবিলের কোনায় মাথাটা বাড়ি খায় তার।
‘ওমা! ইশ! কী জোরে বাড়ি খাইসি রে! আল্লাহ, মাথাটা শেষ আমার।’
‘আম্মা, ব্যথা পাইসো?’ তাড়াতাড়ি বলি আমি।
‘যা, সর আমার সামনে থেকে!’ চেয়ারে বসে খেঁকিয়ে উঠবে আম্মা। টেবিলে রাখা গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পানি খাবে। খটাস করে গ্লাসটা রাখবে টেবিলে। অফিস থেকে এসেই ঝাড়ুটারু দিয়ে দরদর করে ঘামছে আম্মা। ওড়না দিয়ে কপাল মুছে হঠাৎ আমার দিকে কড়া দৃষ্টি দিয়ে বলবে—
‘অফিস থেকে এসে মা গরমে বসে আছে, একবারও তোর কিছু মনে হলো না? গরমে ঘেমে আমি গোসল হয়ে গেলাম, তুই দাঁড়িয়ে পেয়ারা খাচ্ছিস?’
আমি মাত্রই পেয়ারায় একটা কামড় বসিয়েছি। পেয়ারা চিবানো বন্ধ করলাম। আম্মা তিন গুণ জোরে চেঁচিয়ে বলবে,
‘ফ্যান ছাড় শয়তান!’ তাড়াতাড়ি ফ্যানের সুইচ অন করি আমি।
ফ্যানটা ফুলস্পিডে ঘুরতেই ঝাড়ু দিয়ে জড়ো করে রাখা ধুলাগুলো এদিক ছড়িয়ে যাবে। সেটা টের পেয়েই আম্মা রীতিমতো গর্জে উঠবে—
‘দেখসো, ফুল স্পিডে ফ্যানটা ছাড়সে। যেন আবার আমাকে কষ্ট করে ঝাড়ু দিতে হয়। শয়তানের শয়তান!’
‘তুমিই তো বললা ফ্যান ছাড়তে!’ অবাক হয়ে বললাম আমি।
‘যা সর আমার সামনে থেকে।’
গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে যাব আমি। ঠিক এক ঘণ্টা পর আম্মাই গোসলটোসল করে এসে নরম গলায় বলবে—
‘কিরে, খিদে লাগে নাই? নুডলস রান্না করছি। খেয়ে চুপচাপ পড়তে বসবি।’
মানে, কী বলব। আমি মেলাতেই পারি না। মাসের ৩০ দিনের মধ্যে অন্তত ১৫ দিন এ রকম ঘটনা ঘটে।
কোন এক ভিডিও দেখে আব্বা নতুন নিয়ম করেছে—নয়টার মধ্যে সবাই রাতের খাবার খেয়ে ফেলবে। এটা নাকি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। খাবার খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ঘুমাতে যেতে হবে।
আমার আব্বা আসে আরেকটু পর। আব্বা আবার আম্মার ঠিক উল্টো। ঘরে ঢুকেই দেয় চিৎকার, ‘কই রে, বাবুরা কই?’
‘চিৎকার কোরো না। ওরা পড়তে বসেছে।’ কড়া গলায় বলে ওঠে আম্মা। ‘তোমার আশকারা পেয়ে এরা সিলিংয়ে উঠে যাচ্ছে।’
‘ভালো তো।’ জুতা খুলতে খুলতে বলে আব্বা। ‘সিলিংয়ে ওঠা ভালো। সিলিংয়ের ঝুল জমেছে, ওদের দিয়েই পরিষ্কার করা যাবে।’
‘ফালতু কথা আমার সামনে একদম বলবা না। আর খবরদার, হাতমুখ না ধুয়ে টিভির সামনে বসবা না বলে দিলাম।’
‘ঠিক আছে। ঠিক আছে।’ বলেই আব্বা টিভির সামনে বসে খবর দেখা শুরু করবে। ঠিক পাঁচ মিনিট পর (আমি স্টপওয়াচ ধরে দেখেছি) আম্মা এসে কড়া গলায় বলবে, ‘আয়হায় হায় হায়, তোমাকে না বললাম, এসেই টিভি না দেখতে? এটা কী অভ্যাস? আশ্চর্য! আমি কোথায় যাব এই লোককে নিয়ে?’
‘আরে, আমি টিভি দেখছি না তো।’ বোঝানোর চেষ্টা করে বলবে আব্বা।
‘টিভি অন করে মোবাইলে ভিডিও দেখতেসো?’
‘এই একটু দেখলাম আরকি, আর দেখব না।’ বলেই আব্বা টিভিটা অফ করে দেবে।
‘ওমা, টিভি অফ করলা ক্যান? আমি এখন সিরিয়াল দেখব না? অন করে যাও।’
‘ধুর, বাসায় এসে একটা দিন শান্তি পাই না।’ বিরক্ত হয়ে বলবে আব্বা। তারপর মোবাইলে ভিডিও দেখতে দেখতে বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে ডাইনিংয়ের চেয়ারের সঙ্গে হোঁচট খাবে। ফোনটা টেবিলে রেখে বাথরুমে গিয়ে আব্বা গুনগুন করে কী যেন একটা গান গায়। আমি আজ পর্যন্ত ধরতে পারি নাই গানটা কী। এটা কি বাংলা গান না হিন্দি, সেটাও বুঝি না। আন্দাজ করতে পারি যে এটা একটা গান। গানের মাঝখানে আব্বা চিৎকার করে ভেতর থেকে বলবে, ‘এই দেখো, তাড়াহুড়ায় গামছাটা আনতে ভুলে গেছি। এ বাবু, গামছাটা দিয়ে যা তো।’
আর আমার ভাইয়ার কথা কী বলব? বাসার সবচেয়ে অদ্ভুত মানুষ হচ্ছে ভাইয়া। ভার্সিটিতে পড়ে। কিন্তু আমি ওকে আমি কখনো পড়ত দেখি না। ফোন নিয়ে কী সব ভিডিও বানিয়ে ফেসবুক আর ইউটিউবে আপলোড করে। সেই ভিডিও দেখে তিনজন—আমার আব্বা-আম্মা আর ভাইয়া। আমাকে অনেকবার দেখার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমি এই সব দেখি না। এ জন্য মাঝেমধ্যেই ভাইয়া আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রাখে। কিন্তু যখন আম্মার সঙ্গে ঝগড়া হয়, তখন মেসেঞ্জারে আমাকে মেসেজ দিয়ে বলে, ‘আম্মাকে বলে দে, আমি ভাত খাব না। আমাকে যেন না ডাকে।’
এখন তোমরাই বলো, আমি ছাড়া এ বাসায় কোনো নরমাল মানুষ আছে?
২
কোন এক ভিডিও দেখে আব্বা নতুন নিয়ম করেছে—নয়টার মধ্যে সবাই রাতের খাবার খেয়ে ফেলবে। এটা নাকি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। খাবার খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ঘুমাতে যেতে হবে। এর কোনো নড়চড় হবে না। সমস্যা হলো, আব্বা নিজেই বাসায় আসতে আসতে নয়টা বাজিয়ে দেয়। তারপর আমি পড়তে থাকি। আর বাকি তিনজন টিভি, কম্পিউটার ও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকে। আমি যে একটা মানুষ এ বাসায় আছি, কারও মাথায়ই থাকে না। এগারোটা–বারোটা বেজে গেলে যখন তাদের ফোনের চার্জ কিংবা টিভির সিরিয়াল শেষ হয়ে যায়, তখন মনে পড়ে, ভাত খাওয়ার কথা। আব্বা বলে, ‘সেকি, এত বেজে গেছে? নাহ, ডিসিপ্লিন বলে এ বাসায় কিছু নাই।’
আব্বা ‘হায় হায়’ বলার সঙ্গে সঙ্গে টিনের চালে বিকট শব্দে পড়ল টবটা। আমাদের বিল্ডিংয়ের পেছনেই টিনের শেড। দারোয়ান চাচার ঘর ওটা। টবটা ওখানেই পড়েছে।
‘আয়হায় হায় হায়…এখনো ভাত রান্না বাকি…আজকেও দেরি হয়ে গেল। সকালে আবার আমার অফিস! কী যে হবে!’
আম্মা ছোটে ভাত রান্না করতে। আব্বা ফ্রিজ থেকে শসা, টমেটো, গাজর কেটে সালাদ বানানো শুরু করে। ইউটিউব দেখে এসব নতুন শিখেছে সে। শুক্র-শনিবারে নানা রকম রেসিপি রান্না করে। সেগুলো আমরা কেউ খেতে পারি না। একদিন আমাদের বুয়া খুব আগ্রহে আব্বার রান্না করা চিকেন স্টু বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। এর পর থেকে বুয়া আর কাজে আসে না। আমার ধারণা, সে এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
রাতের খাবার খেতে খেতে আমাদের দেরি হয়ে যায়। খাওয়া শেষে আমি ঘরে চলে আসি। হালকা ভলিউমে গান ছেড়ে অঙ্ক করতে বসি। আমি যেন সারা রাত মোবাইল না ধরি, সে জন্য আম্মা আমার মোবাইল নিয়ে যায়। আব্বার কড়া নির্দেশ, স্ক্রিনটাইম কমাতে হবে। বেশিক্ষণ মোবাইল স্ক্রল করলে নাকি ব্রেন ফ্রিজ হয়ে যায়। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছি, ‘আব্বা, তুমি এ তথ্যটা কোথায় পেয়েছ?’
‘কেন? একটা রিলসে দেখলাম।’ আব্বার সরল উত্তর।
আমার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আব্বা-আম্মা নিজেরা কিন্তু বিকট ভলিউমে ভিডিও দেখবে। তোমরা নিশ্চয়ই অনেক সময় ভাবো, ফেসবুকের ভিডিওগুলোর নিচে অপ্রাসঙ্গিক কমেন্টগুলো কারা করে? এই যে উত্তর। কমেন্ট করে আমার আব্বা আর আম্মার মতো মানুষ। আমার আম্মা মুকেশ আম্বানির ইনস্টাগ্রামের পোস্টে গিয়ে ভুলভাল ইংরেজিতে লিখে এসেছে—‘কত মানুষ না খেয়ে আছে আর আপনারা ছেলের বিয়েতে এত টাকা এভাবে খরচ করলেন? এটাই কি মানবতা?’
কিন্তু আজকে হঠাৎ আমার ডাক পড়ল। আমি ঘর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আব্বা বলল, ‘বারান্দায় চল।’
আব্বার পেছন পেছন বারান্দায় গেলাম আমি। আমাদের বারান্দাটা বেশ বড়। বারান্দায় গ্রিলের একটা অংশে ছোট একটা দরজার মতো করা আছে। সামনে স্টিল দিয়ে গাছের টব রাখার একটা স্ট্যান্ড করা আছে। সেখানে টবে বেশ কিছু গাছ। আব্বা দরজাটা খুলে রেখেছে। তার উদ্দেশ্য এখনো বুঝতে পারছি না।
‘আব্বা, করো কী!’ অবাক হয়ে বললাম আমি।
‘টবে মিষ্টিকুমড়ার চাষ করব।’ টবের মাটি নাড়াচাড়া করতে করতে বলল আব্বা। ‘একটা মিষ্টিকুমড়ার দাম চল্লিশ টাকা। চিন্তা করা যায়?’
আব্বার কথা শুনে মনে হলো, এখন বীজ লাগালে কাল সকালেই গাছ থেকে মিষ্টিকুমড়া হয়ে যাবে।
‘এই টবে মিষ্টিকুমড়া হবে?’
‘অবশ্যই হবে। জহির তো বারান্দার টবে মিষ্টিকুমড়া চাষ করে এখন স্বাবলম্বী।’
‘জহিরটা কে?’
‘কৃষিভিত্তিক ভিডিও বানায় ইউটিউবে। ২৫ কে ফলোয়ার। তোরা তো এসব জ্ঞানী লোককে চিনবি না।’
‘কাজটা কাল সকালে করলে হয় না? এখন রাত একটা বাজে। আমার মনে হয় এটা মিষ্টিকুমড়া চাষের জন্য আদর্শ সময় না।’
‘আরে বোকা মেয়ে, যে কাজ এখন করা যায়, এটা কালকের জন্য ফেলে রাখার দরকার নেই। ধর।’
বড়সড় একটা টব আমার হাতে ধরিয়ে দিল আব্বা।
‘নিতেই পারতেসি না!’ বিরক্ত হয়ে বললাম আমি।
‘কী বললি?’ ঘুরে তাকাল আব্বা।
‘না, টবটা আরকি, বেশ ভারী!’
বারান্দার এক কোনা থেকে মাটির একটা ব্যাগ টেনে আনল আব্বা। টবে মাটি ফেলতে ফেলতে বলল, ‘মাত্রই ভিডিওটা দেখলাম তো, সঙ্গে সঙ্গে করে না ফেললে পরে ভুলে যাব।’ হাঁপাচ্ছে আব্বা। ‘আর…ধর…সব জিনিসপত্র তো আছেই। বীজ মনে কর…আগেই…কিনে রেখেছিলাম…নারে, কাজটা কঠিন আছে তো!’
‘আম্মাকে ডাকি?’
‘তোর আম্মা তো কী একটা আজগুবি ভিডিও দেখছে। কোন এক মেয়ে…লাইভে কম দামি জামা…বেশি দামে বিক্রি করছে। সেটা…এক্সপোজ করেছে আরেক মেয়ে…এখন ওই মেয়েটা…মানে যে কম দামি জামা বেশি দামে বিক্রি করে সে…’
‘আব্বা, প্লিজ। আমি আর শুনতে চাচ্ছি না। কী করতে হবে বলো।’
‘দাঁড়া না, এত অস্থির হচ্ছিস কেন? তোদের এই জেন–আলফাদের ধৈর্য এত কম…ধৈর্য ছিল আমাদের। তিন কিলোমিটার হেঁটে যেতাম স্কুলে। জীবন এত সোজা?’
রাত দেড়টার সময় আব্বা ভিডিও দেখে দেখে মিষ্টিকুমড়ার বীজতলা তৈরি করছে। ভিডিওতে বরিশালের ভাষায় এক লোক স্যারের কাছে পড়া বলার মতো শুরু করে বলছে, ‘ভিউয়ার্স, এরপর আপনাদের যা করতে অইবে, তা দেখার জন্য পরিপূর্ণ ভিডিও অবলোকন করুন।’ আর আমি ঘুমে ঢুলছি। পৃথিবীর কোনো কিছু অবলোকন করার ইচ্ছা আমার নেই। বারান্দায় বাতাস নেই। গরমে আব্বাও ক্লান্ত হয়ে গেছে। তারও শখ মিটে গেছে বোধ হয়। মাটি ভরা টবে বীজ বুনে সেটাকে স্ট্যান্ডে রাখার জন্য ঠেলছে অব্বা। মাঝপথে গিয়ে টবটা বোধ হয় আটকে গেল। বিরক্ত হয়ে জোরে ধাক্কা দিল আব্বা। আর তখনই কীভাবে যেন টবটা আটতলা থেকে নিচে পড়ে গেল।
আব্বা ‘হায় হায়’ বলার সঙ্গে সঙ্গে টিনের চালে বিকট শব্দে পড়ল টবটা। আমাদের বিল্ডিংয়ের পেছনেই টিনের শেড। দারোয়ান চাচার ঘর ওটা। টবটা ওখানেই পড়েছে। কিন্তু এত শব্দ হওয়ার তো কথা না। আমি আর আব্বা নিচে উঁকি দিলাম। আশপাশের বাসাগুলোতে আলো জ্বলছে। আম্মাও বারান্দায় ছুটে এসেছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
‘আমার মিষ্টিকুমড়ার…’
‘আব্বা থামো তো।’ বললাম আমি। ‘টব পড়ে গেছে নিচে। টিনের ওপর পড়েছে।’
ঠিক তখন, নিচ থেকে কারা যেন চিৎকার করে বলল, ‘মারা গেছে! মানুষ মারা গেছে! সবাই নামেন, মানুষ মারা গেছে!’
‘আয়হায় হায় হায়! কী সর্বনাশ!’ ফিসফিস করে বলল আম্মা! ‘তোমার টব কার না কার মাথায় পড়েছে। মরে গেছে লোকটা! এটা কী করলা তুমি? আল্লাহ, এই লোকটা আমাকে আর কত বিপদে যে ফেলবে…’ আম্মা কাঁদতে শুরু করল।
‘কিন্তু এখানে লোক এল কোত্থেকে?’ চিন্তিত হয়ে বলল আব্বা।
‘তোমরা এখান থেকে সরে যাও। এখানে দাঁড়ানো ঠিক হবে না।’ পেছন থেকে এসে বলল ভাইয়া।
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।’ আম্মা সমর্থন দিল ভাইয়াকে।
‘কী যে তোমরা বলো!’ বললাম আমি। ‘আগে তো নিচে গিয়ে দেখবে কী হয়েছে। ভাইয়া, তুমি চলো তো আমার সঙ্গে।’
‘দুই তলা থেকেই পইড়া ধরা খাইছি, এটা শুনলে মানুষ কী কইব? আমি তো সমাজে মুখ দেখাইতে পারমু না। আমারে নিয়া হাসাহাসি হবে। আবার এই ভাইয়ে করছে ভিডিও। আমি তো ভাইরাল হইয়া যামু। চুরি করতে সমস্যা হইব পরে।’
‘এক চড় দিয়ে তোকে বারান্দা থেকে ফেলে দেব।’ আম্মা মুখ বাঁকিয়ে বলল। ‘চুপচাপ ঘরে যা। সাহস দেখাতে আসছে। যা, সর এখান থেকে।’
নিচের হইচই আরও বাড়ল। কেউ বোধ হয় টর্চের আলো ফেলছে নিচ থেকে। আব্বা উঁকি দিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’
‘চোর পড়ছে মনে হয়। চুরি করতে উঠছিল, টিনের ওপরে পড়ছে।’
‘ধরেন ওকে। পুলিশ ডাকেন। এই, ট্রিপল নাইনে কল দে...।’
‘আমি নিচে গেলাম’ বলে ফোন আর গিম্বল হাতে ছুটল ভাইয়া। আব্বা-আম্মাও গেল পেছন পেছন। আমি আর থেকে কী করব? আমিও বেরোলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখলাম আরও অনেকেই নামছে। সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা—চোর ধরা পড়েছে! নিচে নেমে দেখলাম, চোরকে ধরাধরি করে নামানো হয়েছে। মাথা ফাটেনি, কিন্তু ভালো ব্যথা পেয়েছে লোকটা। পা ভেঙেছে মনে হয়। নড়াচড়া করতে পারছে না। এর মধ্যেই কয়েকজন এসে তাকে কিল–ঘুষি দেওয়ার চেষ্টা করছে। আম্মা সবাইকে থামাল। ‘খবরদার, গায়ে হাত দেবেন না কেউ। পুলিশ এসে যা করার করবে।’
এর মধ্যে ভাইয়া ভিডিও করতে শুরু করেছে তার চ্যানেলের জন্য—‘হ্যালো গাইজ, তোমাদের জন্য একটা এক্সাইটিং নিউজ নিয়ে এসেছি। আমাদের বাসায়…একেবারে আমাদের নিজের বাসায় একটা চোর ধরা পড়েছে, লাইভ দেখতে পাচ্ছ চোরটাকে…এই সেই চোর…’ বলে সে লোকটার মুখের সামনে ক্যামেরা ধরল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ধরা পড়লেন কীভাবে?’
চোরটা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পাইপ বাইয়া উঠতাছিলাম। দুই তলা পর্যন্ত উঠছি। আতকা কী জানি একটা আইসা ঘাড়ের ওপরে পড়ল। তাল হারাইয়া নিচে পইড়া গেলাম।’
‘টব পড়েছে।’ আব্বা গর্বের সঙ্গে বলল। ‘আমার বাসার টব। মিষ্টিকুমড়া গাছের টব।’
আশপাশ থেকে লোকজন খুব বাহবা দিতে লাগল। ‘আরে ভাই, আপনার টবের কারণে আমরা চুরির হাত থেকে বাঁচলাম। কত বড় উপকার করলেন ভাই…’
আম্মা হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো ভাই?’
‘হ, বাঁইচা আছি। তবে অপমান লাগতেছে।’
‘তা তো একটু লাগবেই।’
‘দুই তলা থেকেই পইড়া ধরা খাইছি, এটা শুনলে মানুষ কী কইব? আমি তো সমাজে মুখ দেখাইতে পারমু না। আমারে নিয়া হাসাহাসি হবে। আবার এই ভাইয়ে করছে ভিডিও। আমি তো ভাইরাল হইয়া যামু। চুরি করতে সমস্যা হইব পরে।’
‘আপনি এর পরও চুরি ছাড়বেন না?’
‘এই কাম ক্যামনে ছাড়ি?’ শুনে লোকজন আবার মারতে উঠল লোকটাকে। আমি ভয়ে শেষ। চোর হলেও তাকে তো মারার অধিকার নেই আমাদের। আব্বা-আম্মাই সবাইকে থামাল। এর মধ্যেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। চোর দেখতে যারা এসেছিল, তারা সবাই যে যার মতো ছুটল তাদের বিল্ডিংয়ে নিচে। আমিও আমাদের গ্যারেজে ঢুকলাম। সঙ্গে আম্মা আর ভাইয়া। আব্বা কই? সবাই যখন আব্বাকে খুঁজছি, তখন এক আঙ্কেল জানাল, ‘তোমার আব্বা তো বাইরে। দেখো গিয়ে কী করছে।’
আমি গিয়ে দেখি, কোত্থেকে একটা ছাতা জোগাড় করে আব্বা ওই চোরটার মাথার ওপর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর কেউ কিন্তু নেই, আব্বাই দাঁড়িয়ে আছে। আব্বার অনেক কাজ আমার বিরক্ত লাগে, তবে এটা খুব ভালো লাগল। মুখে যা-ই বলুক, লোকটাকে চোর না, মানুষ হিসেবেই দেখছে আব্বা। আমি গেটের রড ধরে আব্বার দিকে তাকিয়ে ডাকলাম, ‘আব্বাআআআ!’ আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পারলে একটা ছাতা নিয়ে আয়।’
‘কেন?’
‘ওই যে, আমার মিষ্টিকুমড়ার বীজগুলা…’
বললাম না, আমি ছাড়া আমাদের বাসায় একটাও নরমাল মানুষ নেই। এখন কি তোমাদের একটু বিশ্বাস হচ্ছে?