অদ্রির অভিযান (চতুর্থ পর্ব)

অলংকরণ: সব্যসাচী চাকমা

সকাল থেকেই অদ্রিকের দিন কাটছে অন্য সবার থেকে আলাদা। প্রথম টার্মের পর কয়েক দিনের ছুটি পেয়ে অদ্রিক পাড়ি জমিয়েছে বগা লেকে। তবে এই পাড়ি জমানোর পেছনে রয়েছে তালুতের জোরাজুরি। অদ্রিক শুধু জ্ঞানপিপাসু না, বেশ ভ্রমণপিপাসু। ভ্রমণে আগ্রহ থাকলেও এই গরমে বান্দরবানের দিকে আসার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। হঠাৎ তালুত উদয় হয়ে বলল, ‘এই ভ্যাপসা গরমে বগা লেকের নরম-কোমল-ঠান্ডা পানি প্রশান্তি দেবে। সঙ্গে আছে পূর্ণিমার বোনাস!’

পাহাড়ি এলাকায় রাতের আকাশে থালা আকৃতির চাঁদ—এমন নৈসর্গিক দৃশ্য খুব কমই হয়! এ কারণে তালুতের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল অদ্রিক। তা ছাড়া দুটো স্মৃতির কারণে অদ্রিককে হাতছানি দিয়ে ডাকে পাহাড়। দুবারই শীতকালে বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় ঘুরেছিল অদ্রিক। দুটো স্মৃতিই দ্বিতীয়বার ভ্রমণকালীন। পাহাড়ের বুকে অবস্থিত জলাশয়ের ওপরে ধোঁয়ার মতো কুয়াশার স্তর পড়ে থাকার দৃশ্য তাকে অভিভূত করেছিল। আরেকটি স্মৃতি মনে পড়লে অদ্রিকের মনোজগৎ আনন্দে ভরে ওঠে। নীলগিরিতে রাতযাপন শেষে যখন ভোরে ফিরছিল, তখন শীতের কুয়াশার চাদরে ঢেকে ছিল চারপাশের পার্বত্য অঞ্চল। ওপর থেকে নিচে তাকালে দেখা যাচ্ছিল শুধু মেঘের মতো কুয়াশার চাদর। একেই বুঝি বলে অপার্থিব সৌন্দর্য! অদ্রিকের মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর বাইরের কোনো জগতে হাজির হয়েছে!

অদ্রিক আগে বান্দরবানে দুবার এলেও বগা লেক পর্যন্ত যায়নি। প্রথম এসেছিল মা–বাবার সঙ্গে। সেবার শুধু নীলাচল ও বান্দরবান শহরে ঘুরেছিল। দ্বিতীয়বার এসেছিল কাজিনদের সঙ্গে। চিম্বুক ও নীলগিরিতে গিয়েছিল। সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে চাঁদের গাড়ি বা চান্দের গাড়িতে চড়া ভিন্ন লেভেলের এক অ্যাডভেঞ্চার! মাঝেমধ্যে অনেক ওপর থেকে নিচের দৃশ্য দেখে খানিক ভয় লাগে; আবার মনের মধ্যে আনন্দের শিহরণও জাগে।

দ্বিতীয় ভ্রমণের বেশ কিছু অন্য রকম স্মৃতি আছে অদ্রিকের। একটি মজার স্মৃতিও আছে। চিম্বুক পাহাড়ের কাছাকাছি একটি বাজার থেকে খেয়েছিল লাল রঙের কলা! ছেলেবেলা থেকে দেখে এসেছে কলার খোসা হলুদ; তাই লাল খোসার অদ্ভুত পাহাড়ি কলা দেখে অদ্রিক ভীষণভাবে বিস্মিত হয়েছিল! যে নারীর কাছ থেকে লাল কলা কিনেছিল, তিনি প্রতি কলার দাম চেয়েছিলেন ২০ টাকা; এক পয়সাও কমাননি। অদ্রিক সেবারই প্রথম বুঝেছিল, পাহাড়ি এলাকার অধিবাসীরা এককথার মানুষ। ব্যাপারটি পরে আরও খেয়াল করেছে পেঁপে ও অন্যান্য স্যুভিনির কেনার সময়।

সারা রাত বাসভ্রমণ করে ভোরে বান্দরবান পৌঁছেছে অদ্রিক ও তালুত। তালুত মূলত অদ্রিকদের প্রতিবেশী। তার বাবা ও অদ্রিকের বাবা—দুজনেই ব্যবসায়ী; একটি ব্যবসায়ে দুজন অংশীদারও। সেই সূত্রে অদ্রিক ও তালুত পরস্পরের বন্ধু। স্কুলের বাইরে অদ্রিকের বন্ধু বলতে এই একজনই; অন্যদিকে স্কুলে অদ্রির সঙ্গে আছে একতরফা বন্ধুত্ব। অদ্রিক তাকে বন্ধু ভাবলেও অদ্রি তাকে পাত্তা দেয় না।

শহরের তাজিং ডং রেস্তোরাঁতে নাশতা সেরে তালুত ও অদ্রিক উঠে বসল একটি সাদা রঙের চান্দের গাড়িতে। জিপের মতো দেখতে চান্দের গাড়ির পেছনের অংশের ওপরটা ফাঁকা। পাহাড়ি রাস্তা ধরে ছুটতে থাকলে বেশ ভয় লাগে। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতা থাকায় এবার ততটা নার্ভাস হয়নি অদ্রিক। অপর দিকে তালুত অতিমাত্রায় সাহসী। তা ছাড়া জিম করায় বেশ ফিট বডির অধিকারী—পেটে সিক্স প্যাক! চান্দের গাড়ি প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে খেয়ে যখন পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে ছুটছিল, তখন সাহসী তালুত গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে ঝুলে ঝুলে দৃশ্য দেখতে থাকল। অত ওপর থেকে আশপাশে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে অদ্রিকের মাথা চক্কর দিয়ে উঠছিল; এরই এক ফাঁকে তালুত মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘কী রে অদ্রিক, প্রমাদ ভ্রমণ কেমন লাগছে?’

অদ্রিক বলল, ‘শব্দটা প্রমাদ না; হবে প্রমোদ! প্রমাদ অর্থ বিপদ আর প্রমোদ মানে আনন্দ!’

তালুত হেসে বলল, ‘তাই নাকি? তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে প্রমাদ ভ্রমণ করছিস। একটু হাসিমুখ কর! “আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি” গানের মতো মুখ করে আছিস কেন?’

অদ্রিক শক্ত মুখে বলল, ‘সাধে তো আর এমন করছি না; মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, চান্দের গাড়ি এই বুঝি চান্দের দিকে পাড়ি জমাবে!’

তালুত মজা করে বলতে থাকল, ‘ভাড়া কম, ভ্রমণে ভালো—চান্দের রেসিং কার! ভাড়া কম, ভ্রমণে ভালো—চান্দের রেসিং কার...’

‘থাম তো।’

‘কয়েক ঘণ্টা কষ্ট কর। রুমাবাজার পৌঁছালে ভালো লাগবে। সেখানেই লাঞ্চ সারব।’

রুমাবাজার পৌঁছাতে লাগল আড়াই ঘণ্টা। স্থানীয় এক গাইডের সঙ্গে কথা বলল তালুত। গাইড একটি হোটেলে খাবারের ব্যবস্থা করল। গরম ভাত-ডালের সঙ্গে ঝোল করে রান্না করা বনমোরগের মাংস। অদ্রিক ও তালুত বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে গাইডের সঙ্গে আর্মি ক্যাম্পে গেল। ক্যাম্প থেকে বগা লেক যাওয়ার অনুমতি নিতে হয়; লিখিতভাবে জমা দিতে হয় পরিচয়। তারপর আবারও চড়তে হয় চান্দের গাড়িতে।

পরবর্তী জার্নি আরও কঠিন। ঘণ্টাখানেক পরের ঘটনা। একেবারে খাড়া পাহাড় বেয়ে চান্দের গাড়ি উঠতে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল অদ্রিক। ৪৫ ডিগ্রি কোণ কাকে বলে, তা ব্যবহারিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এই খাড়া পাহাড় যথেষ্ট! চান্দের গাড়ির চালক ছেলেটি ঘন ঘন এক্সিলারেটর এবং ব্রেকে চাপ দিয়ে গাড়ি টানতে থাকল। এমন এক পরিস্থিতিতে চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো একটি বাঁক; যেখান থেকে কেউ পড়লে তাকে আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। অবশ্য এই পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। খাড়া পাহাড় বেয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে গাড়িটি উঠে যাওয়ার পরই পরম আনন্দ। কারণ, তারপরই গন্তব্যস্থল বগা লেক।

শান্ত-শীতল পানির বগা লেকের দিকে তাকিয়ে অদ্রিকের প্রাণ জুড়িয়ে গেল। তালুতও ‘বাহ, আহা’ করতে থাকল। দূর থেকেই তারা দেখতে পেল, লেকের পাড়ে রাখা একটি বড় পাথরের ওপর লেখা— ‘বগা লেক’। লেকের নিটোল পানিতে ফুটে আছে অসংখ্য শাপলা ফুল। পাশেই বিজিবি ক্যাম্প। সেখানে চলল আরেক ধাপ নাম-ঠিকানা এন্ট্রি পর্ব। তারপর তালুত বলল, ‘চল, আগে বম পাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করি। তারপর ড্রাগন লেক দেখা যাবে।’

অদ্রিক অবাক হলো। বলল, ‘ড্রাগন লেক আবার কোথায়?’

‘এই বগা লেককেই ড্রাগন লেক বলে।’

অদ্রিকের জানার আগ্রহ অনেক; কিন্তু এই তথ্য তার জানা ছিল না। তালুতের পিছু নিল সে। স্থানীয় বমদের সঙ্গে কথা বলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলল তালুত। তারপর ব্যাগ রেখে দুজন বগা লেকের পাড়ে এসে বসল। অদ্রিক বলল, ‘কী অদ্ভুত! লেকটাকে মনে হচ্ছে আকাশের আয়না, যেন নীল আকাশটাকে ধারণ করে আছে নিজের মধ্যে! তা ছাড়া চারপাশে সবুজে ঢাকা পাহাড়। জায়গাটা এত্ত সুন্দর!’

তালুত বলল, ‘তোর কি বিশ্বাস হয়, এই লেক একটা মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে সৃষ্টি হয়েছে?’

‘কী বলিস!’

‘অবশ্য ভিন্নমতও আছে। কারও কারও মতে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে পাহাড়ের চূড়ায় উল্কাপিণ্ড পড়ায় সৃষ্টি হয়েছে এই লেক।’

‘কতটুকু গভীর হবে এই লেকের পানি?’

‘তা অনেক! শুনেছি, বারোতলার সমান গভীর।’

‘এখানে এসে সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। খুব ভালো লাগছে।’

‘রাতে আরও ভালো লাগবে। আজকে পূর্ণিমা রাত। লেকের পাড়ে বসে দুজনে মিলে জ্যোৎস্নাবিলাস করব।’

‘জ্যোৎস্নাবিলাস!’

‘হ্যাঁ, বৃষ্টিবিলাসের মতো জ্যোৎস্নাবিলাস। জ্যোৎস্নার আলোতে গোসল করব।’

অদ্রিক হেসে ফেলল। তালুতের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হওয়ার বড় কারণ— ছেলেটি রসিক এবং ওর সাধারণ জ্ঞান ভালো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত নানা বিষয়ে অদ্রিকের জ্ঞান আছে; স্ট্রিং থিওরি, প্যারালাল ইউনিভার্স, ব্ল্যাকহোল, ওয়ার্মহোল ইত্যাদি সম্পর্কে সে নিজের আগ্রহে জেনেছে এবং কিছুটা প্রোগ্রামিংও শিখেছে; অন্যদিকে তালুতের জানাশোনার ক্ষেত্র একদম ভিন্ন—ভূগোল ও ইতিহাস। তাই তালুতের দেওয়া তথ্যগুলো অদ্রিকের জানার ক্ষেত্রকে বাড়িয়ে তোলে।

অদ্রিকরা ভীষণভাবে ক্লান্ত। তাই বম পাড়ার ভাড়া ঘরটিতে গা এলিয়ে শোওয়ামাত্র দুজনেই গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল। উঠল রাত সাড়ে আটটায়। বম সম্প্রদায়ের যে লোকের বাসায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, তিনিই বাসার বাইরে ভূরিভোজের আয়োজন করলেন। দুই বন্ধু পেটপুরে খেয়ে আনন্দচিত্তে এসে বসল বগা লেকের শান্ত পানির পাশে।

অদ্রিক ও তালুত প্রতিজ্ঞা করেছে, এবারের অবকাশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকবে না। তাই বগা লেকে নেটওয়ার্ক থাকা সত্ত্বেও দুজন মুঠোফোন সুইচড অফ করে রেখেছে। বাসায় জানিয়ে এসেছে, প্রয়োজন হলে অদ্রিকরাই যোগাযোগ করবে। দুই বন্ধুর মুঠোফোন বন্ধ থাকায় সন্ধ্যার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা সম্পর্কে তাদের কিছুই জানা নেই। মূলত এসব না জানার কারণেই দুজনের মন নিশ্চিন্ত ও ফুরফুরে।

মাথার ওপরে গোল থালার মতো চাঁদ। অদ্রিকদের চোখের সামনে বগা লেক। তারা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে লেকের শান্ত ও স্নিগ্ধ পানি। কিছুক্ষণ পর অদ্রিক তাকাল থালার মতো বিশাল চাঁদটির দিকে। নৈসর্গিক দৃশ্যে যখন দুজনই বিমোহিত, তখন অকস্মাৎ একটি বস্তু দেখে অদ্রিকের প্রাণ আঁতকে উঠল! খসে পড়া তারার মতো কিছু একটা ছুটে আসছে তাদের দিকে। ধীরে ধীরে আলোকবিন্দুর আকার-আকৃতি বাড়তে থাকল। কয়েক মুহূর্ত অদ্রিকের মুখ থেকে কোনো কথা বেরোল না। একসময় তার চিৎকার শোনা গেল, ‘তালুত, দেখ!’

লেক এলাকা আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠায় তালুত ইতিমধ্যেই আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তাদের দিকে ছুটে আসা আগুনের গোলাটি ক্রমেই বিশালাকায় হয়ে উঠছে! তালুত চেঁচিয়ে বলল, ‘অদ্রিক, দৌড় দে।’

অদ্রিকরা দৌড়াল বম পাড়ার দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে দেখতে পেল, বম সম্প্রদায়ের মানুষজন অস্ত্রশস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসছে। কারও জানা নেই, কী ঘটছে! দেখতে দেখতে আকাশ থেকে পড়া আগুনের গোলা যেন পাহাড়ের মতো বড় হয়ে গেল। চারদিক দিনের চেয়ে বেশি আলোকিত হয়ে উঠল; চোখ ধাঁধিয়ে দেয় এমন আলো! সঙ্গে কানে আসছে জেট ইঞ্জিনের মতো আওয়াজ এবং ধীরে ধীরে আওয়াজ বিকট হচ্ছে। অদ্রিক ও তালুত হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে কষ্টদায়ক মৃত্যুর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করল। মনে মনে স্মরণ করল স্রষ্টাকে। ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটবে এখনই।

কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত। আকস্মিকভাবে আলো ও শব্দের তীব্রতা একদমই কমে এল। চোখ খুলল অদ্রিক ও তালুত। হাজার হাজার পাহাড়বাসী ছুটে চলেছে লেকের দিকে। অদ্রিক ও তালুতও চলল সেদিকে। মিনিটখানেক লাগল লেকের কাছে পৌঁছাতে। তালুত বলল, ‘বগা লেকের ওপর মনে হয় আরেকবার উল্কাপাত ঘটল!’

অদ্রিক শুধরে দিল, ‘না, উল্কাপাত না। বস্তুটার নিয়ন্ত্রিত পতন ঘটেছে। যেভাবে ছুটে এসেছে, তাতে নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এই এলাকা ভেঙে গুঁড়িয়ে যেত; লেকের পানি উছলে চারদিক ভাসিয়ে দিত। সম্ভবত...’

‘সম্ভবত?’

‘সম্ভবত এটা কোনো স্পেসশিপ। মহাজাগতিক কোনো প্রাণী এসেছে পৃথিবীতে। দেখ, বস্তুটা লেকের পানি থেকে একটু ওপরে শূন্যে ভাসছে! নিশ্চিতভাবেই ওটা মহাকাশযান।’

আকাশ থেকে নেমে আসা বস্তুটি দেখতে মৌচাকের মতো। লেকের পানিপৃষ্ঠ থেকে খানিক ওপরে শূন্যে স্থিরভাবে ঝুলে আছে। সেটি থেকে চাঁদের আলোর মতো নরম আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে এবং মৌমাছির গুঞ্জনের মতো মৃদু শব্দ ভেসে আসছে।

তালুত বলল, ‘দাঁড়া, ফেসবুকে ঢুকলেই আসল তথ্য পাওয়া যাবে, বগা লেকে যা ঘটেছে, তা হয়তো এতক্ষণে ফেসবুকে চলে এসেছে!’

অদ্রিক ও তালুত ফেসবুকে ঢুকে হতবাক। অদ্রিকে নিয়ে নানা পোস্ট! তা ছাড়া এলিয়েন আসছে, এমন ভবিষ্যদ্বাণী অদ্রিই করেছে। তালুত বলল, ‘তুই ঠিক বলেছিস, অদ্রিক। সম্ভবত এলিয়েন চলে এসেছে পৃথিবীতে। এটা তাদের স্পেসশিপ। অদ্রি তো তোর ক্লাসমেট, একটু কল দিয়ে ওকে জানা। বগা লেকের খবর এখনো কেউ পায়নি।’

কথা না বাড়িয়ে অদ্রির মুঠোফোনে কল দিল অদ্রিক। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই অদ্রিক বলল, ‘সর্বনাশ ঘটে গেছে, অদ্রি! এখানে এলিয়েনের স্পেসশিপ নেমেছে!’

আগেও একদিন অদ্রির মুঠোফোনে অদ্রিক কল দিয়েছিল। সেবার অদ্রি ভালোভাবে কথা বলেনি। কিন্তু আজ বেশ আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায়?’

‘বান্দরবানের বগা লেকে।’

‘বগা লেক! তুমি বগা লেকে কী করো?’

‘ঘুরতে এসেছিলাম তালুতের সঙ্গে।’

‘ও আচ্ছা। আমাকে আর আমার মাকে একটা হোটেলে রেখে গেছেন পুলিশ আঙ্কেল।’

‘পুলিশ! কেন?’

‘আমাদের নিরাপত্তার জন্যই বাসা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন। পুলিশ আঙ্কেলটা ভালো। মানুষজন আমাদের বাসা ঘেরাও করেছিল!’

‘তাহলে তো ঠিকই করেছেন পুলিশ আঙ্কেল। এলিয়েন আসা নিয়ে তোমার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে! স্পেসশিপ দেখতে পাচ্ছি। তাই তোমাকে কল দিলাম।’

‘বগা লেকের কোথায় স্পেসশিপ নেমেছে?’

‘লেকের একদম মাঝখানে পানির ওপর শূন্যে ভেসে আছে স্পেসশিপ! দেখতে মৌচাকের মতো। সেখান থেকে গুনগুন আওয়াজ ভেসে আসছে। উল্কাপিণ্ডের মতো ছুটে এলেও মাটির কাছাকাছি এসে ঝুলে আছে। কোনো বিস্ফোরণও ঘটেনি। তা ছাড়া এখনো কোনো এলিয়েন বের হয়ে আসেনি।’

‘আমি টেলিভিশন দেখছি। স্ক্রলে দেখতে পাচ্ছি, বান্দরবানের খবরটা মাত্র ব্রেকিং নিউজ হিসেবে দেখাচ্ছে। টেলিভিশনে ইতিমধ্যে দেখিয়েছে, পৃথিবীর আরও নয়টি জায়গায় একই রকম বস্তু নেমেছে। উল্কাপিণ্ডের মতো ধেয়ে এসেছে পৃথিবীর দিকে; কিন্তু কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি। তোমার কি মনে হয়, এগুলো স্পেসশিপ?’

‘মনে তো হচ্ছে। আর কোথায় কোথায় নেমেছে ওগুলো?’

‘বগা লেকসহ মোট ১০ জায়গায় এমন স্পেসশিপ অবতরণ করেছে। আমি তোমাকে মেসেঞ্জারে লিস্ট পাঠাচ্ছি।’

‘এ তো দেখছি অনেকটা মনোলিথের মতো ঘটনা ঘটেছে!’

অদ্রি প্রশ্ন করল, ‘মনোলিথ আবার কী?’

অদ্রিক আগ্রহ নিয়ে জবাব দিল, ‘কিছুদিন আগে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায় অ্যালুমিনিয়ামের মতো ধাতুতে তৈরি আলমারির মতো লম্বা কিন্তু চ্যাপটা, প্রায় তিন মিটার উচ্চতার বস্তু। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটা প্রদেশ, রোম, রোমানিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাসে হঠাৎ করে পাওয়া যায় এমন বস্তুখণ্ড; আবার রাতারাতি উধাও হয়ে যায়! বিশ্বজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। বিভিন্ন দেশের সিটিজেনদের পাশাপাশি নেটিজেনদের মধ্যে তর্কযুক্ত শুরু হয়। কেউ বলেন, এটি এলিয়েনদের রেখে যাওয়া; কেউবা বলেন ভিন্ন কথা। পরে অবশ্য এই মনোলিথ রহস্যের দায় স্বীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একদল স্টান্ট শিল্পী!’

আবারও প্রশ্ন করল অদ্রি, ‘তোমার কি মনে হয় ১০ জায়গায় তেমন কারসাজি ঘটেছে?’

অদ্রিক বলল, ‘না, না, তা বলতে চাচ্ছি না। মনোলিথ মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব হলেও এসব উল্কাপিণ্ডের মতো বিশাল বস্তুখণ্ড কখনোই স্টান্টবাজি না। তা ছাড়া এটা আকাশ থেকে এসেছে এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় অভিকর্ষের প্রভাব কাটিয়ে শূন্যে ঝুলে আছে! তুমি সঙ্গে থাকলে আমরা স্পেসশিপের ভেতরে ঢুকতে পারতাম!’

‘কী বলো! তুমি কি স্পেসশিপের ভেতরে ঢুকতে চাও?’

‘চাই। তোমার বিশেষ একটা ক্ষমতা আছে। তুমি পাশে থাকলে সাহস পাই।’

‘তুমি কি আমার বিশেষ ক্ষমতার ব্যাপারটা বিশ্বাস করো?’

‘অবশ্যই করি, অদ্রি। আমি যে বিশ্বাস করি, এটাও তুমি জানো বলে আমার বিশ্বাস।’

‘তোমাকে ধন্যবাদ।’

‘অদ্রি।’

‘বলো।’

‘তোমার পুলিশ আঙ্কেলকে বলে বগা লেকে আসতে পারো না? তুমি পাশে থাকলে আমি সত্যিই স্পেসশিপে ঢুকব। এলিয়েনের সঙ্গে দেখা করব।’

অদ্রিকের সঙ্গে একটি সায়েন্স প্রজেক্টে কাজ করেছিল অদ্রি। জানা ও শেখার প্রতি তুমুল আগ্রহ ছেলেটির। ব্যাপারটি অদ্রির খুব ভালো লেগেছিল। কিছুক্ষণ চিন্তা করে অদ্রি বলল, ‘পুলিশ আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলে দেখি।’

‘ধন্যবাদ। তোমার কাছে যেহেতু তথ্য আছে, এলিয়েন পৃথিবীতে আক্রমণ করবে; এখনো এলিয়েন স্পেসশিপ থেকে বের না হলেও খুব শিগগরি হয়তো তারা আক্রমণ করবে। স্পেসশিপের ভেতরে ঢুকলে আমরা কিছু করতে পারব; হয়তো পৃথিবীকে বাঁচানোর কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারব।’

‘ঠিক বলেছ, অদ্রিক। আমি আসব বগা লেকে। যে স্থানগুলোতে স্পেসশিপ নেমেছে, তার একটি তালিকা তোমাকে ইনবক্সে পাঠিয়ে রাখছি।’

‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও। আর দেখা হচ্ছে তাহলে। বাই।

‘বাই।’

আরও পড়ুন