আহসান হাবীবের রহস্যোপন্যাস ‘তানিমের ভয়’ (দ্বিতীয় পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ফেরার পথে পথের ধারের একটা রেস্টুরেন্টে মজার শিঙাড়া খেলো। আর খেলো সাত লেয়ারের চা। জিনিসটা মোটেও সুখকর মনে হলো না তানিমের কাছে। যাহোক, বাইরে খেয়েদেয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটা। গিজারের গরম পানিতে ফের গোসল করে ঘুম দিল। এক ঘুমে বিকেল পার।

রাতে খাবার টেবিলে আরেক চমক। রুমালি রুটি আর গরুর চাপ। রুমালি রুটির সাইজও সে রকম, রাতে কাঁথা হিসেবে দিব্যি গায়ে দিয়ে ঘুমানো যাবে...এতই বড় সাইজ। আরও ছিল পরোটা আর বেগুনভাজি। আরাম করে খেল তানিম। এত কিছু মামা বানায় না। তার পরিচিত এক লোক আছে, সে নিয়মিত সাপ্লাই দেয়। খাওয়ার মধ্যেই তানিম জানতে চাইল—

মামা ফ্রিজের গল্পটা বললে না?

ও হ্যাঁ, বলব বলব, ভয় পাবি না তো?

না । কেন ভয়ের কিছু আছে নাকি?

থাকতেও পারে। আচ্ছা, আগে বল তো, এই বিশাল ফ্রিজটার দাম কত?

কত?

আহা, আন্দাজ করো না।

২০ হাজার?

হা হা...মাত্র ৩ হাজার।

কী বলো?

হ্যাঁ... তাহলে শোন কেন কম দাম।

বলো।

আরও পড়ুন

এই ফ্রিজটার বয়স ধর মিনিমাম ৪০-৫০ বছর হবে, ৬০-ও হতে পারে। পুরোনো ফ্রিজ বুঝতেই পারছিস। খেয়াল করেছিস, এই ফ্রিজের লক সিস্টেম আছে। মানে বাইরে থেকে তালা মারা যায়।

কিন্তু মামা, তোমার ফ্রিজে পানি ছাড়া তো কিছু নেই। তালা মারার দরকারও নেই।

হ্যাঁ তা নেই...তাহলে শোন মূল গল্পটা।

মামা কেশে গলা পরিষ্কার করে গল্প শুরু করলেন।

অবশ্য গল্প না এটা, সত্যি কাহিনি। এই ফ্রিজটা যাদের ছিল, তারা যথেষ্ট ধনী ছিল। তাদের কোনো ছেলে বা মেয়ে ছিল না। তবে স্বামী লোকটা ছিল বদ টাইপের। সে নাকি তার স্ত্রীকে অত্যাচার করত বলে শোনা যায়। তো একদিন স্ত্রী প্রতিশোধ নিল। স্বামীকে খাবারের সঙ্গে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলল।

বলো কী?

এখানেই শেষ না। স্ত্রী স্বামীর বডিটাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে লক করে চাবি ফেলে দিল।

কোথায় ফেলে দিল?

এমন কোথাও ফেলল যেন আর চাবি খুঁজে না পাওয়া যায়।

তারপর?

তারপর ওই অবস্থায় বাড়ির সবকিছু বিক্রি করা শুরু করল, ফ্রিজটাও ওই রকম বন্ধ অবস্থায় পানির দরে বিক্রি করে মহিলা উধাও হয়ে গেলেন। তাকে আর কেউ কখনো দেখেনি কোথাও!

তারপর?

তারপর আর কী, যে ফ্রিজটা কিনল, সে টের পেল তার ফ্রিজ থেকে পচা গন্ধ বের হচ্ছে। তখন ফ্রিজ ভেঙে দেখে মানুষের লাশ। ব্যস, তারপর তো হইচই। কত কাহিনি...

শেষ পর্যন্ত এই ভয়ংকর জিনিসটা তোমার কাছে এল কী করে?

আমি আসলে সস্তায় একটা ফ্রিজ খুঁজছিলাম। কীভাবে কীভাবে এই ফ্রিজটার খোঁজ পেলাম। এই ফ্রিজের পেছনের কাহিনি শুনে কেউ কেনে না বলে ফ্রিজটা পড়েই রইল একটা গোডাউনে বহুদিন। তারপর আর কী, একসময় আমি মাত্র তিন হাজার টাকায় কিনে ফেললাম। হা হা হা।

কিন্তু তোমার রাতে ভয় করে না?

ভয় করবে কেন? ফ্রিজের ভেতরে কি ওই বদ হাজব্যান্ডটা এখনো বসে আছে মনে করিস তুই?

তা নেই কিন্তু...

আরও পড়ুন

কেনার পর টানা এক মাস আমি ফ্রিজটা ধুয়েছি, সার্ফ এক্সেল, হুইল পাউডার, হারপিক যত রকম সাবান আছে, সব দিয়ে ধুয়েছি। তারপর ব্যবহার করা শুরু করেছি।

ফ্রিজটা তাহলে ঠিক ছিল?

হ্যাঁ কেনার পর এর পেছনে আমার ধোয়াধুয়ি ছাড়া কোনো খরচ করতে হয়নি। একদম ঠিক ছিল।

তারপর আরও অনেক গল্প হলো। ফাঁকে ফাঁকে আম খাওয়া হলো। তানিমের প্রিয় আম্রপালি আম। তবে মামা আরেক পদের আম খাওয়ালেন, সেটা হচ্ছে গৌড়মতি আম। অসাধারণ মিষ্টি। হলুদের ওপর বুটি বুটি আমটার মিষ্টির ধরনটাই অন্য রকম। মামা বললেন, ‘আরে আমের সিজন এখন শেষ, তোর আম্রপালি আম তো দূরে থাক, গাছও খুঁজে পাবি না কদিন পর। এখন কিছুদিন পাবি এই গৌড়মতি আম।’ আমটা সত্যি অসাধারণ।

রাতে শুতে গিয়ে বেশ ভয় ভয় করতে লাগল তানিমের। তার ঘর থেকে বের হলেই ফ্রিজটা দেখা যায়। মামা কেন যে গল্পটা বলল। মামা অবশ্য বলেছে তোর ঠান্ডা পানি খেতে ইচ্ছে হলে ফ্রিজ থেকে পানি খাস। তবে তোর ঘরের টেবিলের ওপরই পানির বোতল আছে। আর ঠান্ডা খেতে চাইলে ফ্রিজে বোতল আছে।

তানিম বাসা থেকে একটা বই এনেছিল। বইটা অবশ্য বেশ হাসির। লেখক শিবরাম চক্রবর্তী, তার প্রিয় লেখক। ‘হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন’ গল্পটা পড়তে শুরু করল তানিম। কিন্তু কেন যেন মোটেও হাসি আসছিল না। কেমন একটা ভয় ভয় ভাব ভেতরে থেকেই যাচ্ছে। মাথা থেকে ফ্রিজের ওই গল্পটা যাচ্ছেই না। অবশ্য ভয়ের কিছু নেই, ফ্রিজের পাশের ঘরটাই মামার ঘর। অর্থাৎ ফ্রিজের একদিকে ছটকু মামা আরেক দিকে তানিম।

কয়টা পর্যন্ত তানিম শিবরামের বই পড়েছে, সেটা তানিমও জানে না। একসময় চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল তানিমের। বই রেখে উঠে বসল, ঘুমানোর আগে এক গ্লাস পানি খাওয়া তানিমের অনেক দিনের অভ্যাস। বাসায় থাকলে মা বিছানার পাশের টেবিলে গ্লাস ভরে ঠান্ডা পানি রেখে দিতেন। এখানেও মামা পাশের টেবিলে বোতলে পানি ভরে রেখেছেন। কিন্তু পানিটা বেশ গরম, ছটকু মামার মতোই ঠান্ডা পানি খাওয়া তানিমের অভ্যাস। কাজেই গুটি গুটি পায়ে তানিম এসে ফ্রিজের সামনে দাঁড়াল। তখনই আবার ফ্রিজের গল্পটা মাথায় চলে এল। কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হলো তার।

ফ্রিজের দরজায় হাত দিতে যাবে, তখনই কট করে একটা শব্দ হলো। পুরোনো ফ্রিজ কত রকম শব্দ হতেই পারে। কট করে শব্দটা আবার হলো। শব্দটা ফ্রিজের ভেতর থেকেই আসছে সন্দেহ নেই...আর তখনই আস্তে করে ফ্রিজের দরজাটা খুলে গেল নিজে নিজে, যেন কেউ ভেতর থেকে দরজাটা খুলে দিয়েছে। তানিম লাফিয়ে সরে আসতে গিয়েও পারল না। মনে হলো, তার পা জোড়া কে যেন মেঝের সঙ্গে সুপার গ্লু দিয়ে আটকে দিয়েছে। অসম্ভব ভারী লাগছে পা দুটো। তানিমের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ নেই...ঠিক তখনই তানিম বিস্ফারিত চোখে দেখল ধবধবে সাদা একটা পা ফ্রিজের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে...প্রচণ্ড আতঙ্কে একটা আর্তচিত্কার দিল তানিম। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না। কেমন একটা ঘর্ঘর আওয়াজ হলো...তানিম টের পেল, আস্তে আস্তে পড়ে যাচ্ছে সে...পড়ে যাচ্ছে। হাঁটু ভাঁজ হয়ে সে পেছন দিকে পড়ে যাচ্ছে...আর সেই ধবধবে সাদা পা-টা তখনো ফ্রিজের ভেতর থেকে নামছে... নামছে... নেমে আসছে!

আরও পড়ুন

তানিমের যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখে তার মাথার ওপর ঝুঁকে আছে ছটকু মামা। তানিমের মাথা ভেজা। পানিতে জবজব করছে।

কিরে তানিম, ভয় পেয়েছিলি?

তানিম মাথা নাড়ে। মামা তখন একটা কাণ্ড করলেন। এক হাতে একটা সাদা পা দেখালেন। ‘এটা দেখে ভয় পেয়েছিস তাই না? গাধা, এটা পোরসিলিনের একটা নকল পা। ফ্রিজে রেখেছিলাম কারণ, জিনিসটা ডেলিভারি দিয়েছে যে গাড়িতে করে, সেটার ডিকিতে সমস্যা ছিল, আগুনের মতো গরম হয়েছিল ডিকিটা, পা-টাও গরম হয়েছিল। তাই ভেবেছিলাম, একটুক্ষণ ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করি। কিন্তু বের করতে ভুলেই গিয়েছিলাম। আর তুই রাতে পানি খেতে এসে ভয় পেয়েছিস। হি... হি...’। মামার হাসিটা মজার। বাচ্চাদের মতো। মামার কাণ্ডকারখানাই সব অদ্ভুত। পোরসিলিনের পা-টা ফ্রিজে রাখার দরকার কী ছিল? বাইরে থাকলে আপনা-আপনি কি ঠান্ডা হতো না?

আমার মাথা ভেজা...

ওহ, তোর জ্ঞান ফেরাতে একটা পানির ঝাপটা দিয়েছি, তাতেই...ওঠ, উঠে বস। তোকে এই ভয় পাওয়া পায়ের ইতিহাসটা বলি। এটা খুবই অ্যান্টিক জিনিস। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি।

তানিম উঠে বসল। এখন পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে বেশ হাসি পাচ্ছে। সামান্য একটা ব্যাপার আর সে কিনা ভেবেছিল ফ্রিজের ভেতর থেকে সেই লোকটা ভূত হয়ে নেমে আসছে।

মামা চমত্কার কফি বানায়। যদিও তানিম কফি বা চা খেতে তেমন পছন্দ করে না। তবে খাবার টেবিলে বসে গরম কফি খেতে এখন বেশ ভালো লাগছে। মামাও কফি নিয়ে বসেছে। কিছুক্ষণ কফি নিয়ে বক্তৃতা করলেন তারপর শুরু করলেন নকল পোরসিলিনের পায়ের কাহিনি।

এই পা-টা হচ্ছে রাজা শ্রী হরিশ্চন্দ্রের নকল পা। উনি ওডিশার শেষ রাজা ছিলেন। তার একটা পা ছিল না। কিন্তু সেটা কেউ জানত না। তার মৃত্যুর পর সেটা সবাই জানতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই পা পরে নিলামে ওঠে। আরেক রাজা কিনে নেয় চড়া দামে। তারপর সেই রাজার কোষাগার থেকে সেটা চুরি হয়ে যায়। তারপর বহু হাত ঘুরে... না না ভুল বললাম বহু পা ঘুরে... হা হা হা।

মানে বুঝলাম না, হাসছ যে?

হাসলাম, কারণ এই নকল পা-টা আরও অনেকে ব্যবহার করেছে। নকল পা হিসেবেই, এই জন্যই বললাম বহু পা ঘুরে...তবে শেষ পর্যন্ত এটা একটা ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ টাইপ প্রতিষ্ঠানে পড়ে ছিল দীর্ঘদিন। তারপর আরও কয়েক হাত ঘুরে এটা এখন আমার জিম্মায়।

তানিম ধবধবে সাদা পা–টার দিকে তাকায়; জিনিসটা এখন টেবিলের ওপর দিব্যি শোভা পাচ্ছে। কী ভয়টাই না পেয়েছিল তানিম। ভয় পাওয়ারই কথা।

বাকি রাতটা আরামেই ঘুমাল তানিম। একটা সুন্দর স্বপ্নও দেখে ফেলল... যেন সে চা–বাগানের মহিলাদের সঙ্গে চা–পাতা তুলছে। চা–বাগানের মহিলারা বলছে, ‘একি তুমি দেখছি সব পাতা তুলে ফেলছ, তাহলে আমরা তুলব কী?’

‘সব পাতা আপনাদের জন্যই তুলছি। দেখছেন না, আমার হাত দুটো সত্যি হাত না, আসলে মেশিন। মেশিনের হাত দিয়ে কী দ্রুত তুলছি।’ দেখতে দেখতে পুরো চা–বাগানের সব পাতা সে তুলে ফেলল একাই। তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘এবার আপনারা এগুলো নিয়ে নিন...’ মহিলারা সবাই খিলখিল করে হাসতে হাসতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবুজ কচি চা–পাতা তাদের ঝুড়িতে ভরতে লাগল। তখনই ঘুমটা ভাঙল। বেলা তখন ১১টা। উঠে দেখে তার হাত দুটো টনটন করছে, রাতজুড়ে চা–পাতা তোলার জন্য! আসলে বেকায়দায় শোয়ার জন্য হাত দুটো ব্যথা করছে আর সে কিনা স্বপ্ন দেখল চা–পাতা তুলছে তার মেশিনের হাত দিয়ে।

চলবে...