তিনি শুধুই থাপড়ান

অলংকরণ: রাজীব

আধা মণ ওজনের থাপ্পড় খেয়ে লোকটা ঘুরে নালায় পড়ে গেছে। জিনসের ফিটফাট জামা–প্যান্ট। ইন করা। গলায় মোটা সোনার চেইন। হাতে ব্রেসলেট। চোখে সানগ্লাস। এই সাজসজ্জা নিয়ে সে পড়েছে নালায়। পচা কাদায় সারা গা লেপ্টালেপ্টি। বিতিকিচ্ছি অবস্থা। এক মিনিট আগে তার হম্বিতম্বি ছিল দেখার মতো। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী তাঁর কত কাছের খালুশ্বশুর, র‌্যাবের কোনো মেজরের সঙ্গে সে ন্যাংটাকালে খাল-বিলে খেলে বেড়িয়েছে, কোনো এলাকায় তাকে দেখামাত্র বাঘ আর ছাগল এক টিউবওয়েলে পানি খায়—এই ফিরিস্তি দিচ্ছিল সে। তার সেই আলেখ্যধর্মী বর্ণনার মধ্যেই ঠাস করে শব্দ হলো। দেখা গেল সে নর্দমায় পড়ে গেছে। তার এখনকার অবস্থা আরও বেশি দেখার মতো হয়েছে। অসহায় চোখ পিটপিট করছে। তাকে ধরাধরি করে ওপরে তোলা হয়েছে। মাটির ওপর বসে ঝিম মেরে গেছে সে। কানে সম্ভবত তালা লেগে গেছে।

অ্যাই তোর নাম কী?

মোজাম সরদারের রাশভারী গলায় যেন লোকটা সংবিৎ ফিরে পেল। ষাটোর্ধ্ব মোজামের কণ্ঠস্বর অতি বিখ্যাত রকমের কর্তৃত্বপরায়ণ। ভরাট। মোটা। ঠান্ডা। কিন্তু সেই কণ্ঠে কঠোর আদেশের সুর।

মারুফ।

লোকটা মাথা নিচু করেই জবাব দিল।

খালি মারুফ? পুরো নাম কী?

জি, মারুফ হায়দার।

পুরো নাম হয় নাই। কোন গোষ্ঠী? শেখ-সৈয়দ-চৌধুরী-মোল্লা—কোনটা?

মুনশি

তাহলে পুরো নাম কী দাঁড়াল?

জি, মারুফ হায়দার মুনশি।

বলতে বলতে লোকটা এক দলা থুতু ফেলল। থুতুর সঙ্গে রক্ত চলে এসেছে। দাঁত পড়েছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না। সে জিব গালের মধ্য নেড়েচেড়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

প্রায় দশ–বারোজনের জটলার মধ্যে লোকটা যেন চিড়িয়াখানার ওরাংওটাং। সবাই তার দিকে চেয়ে আছে। ঠোঁট বেয়ে রক্ত ঝরছে। জটলার মধ্যে যে লোকটা এক মিনিট আগে এসেছে, সে–ও বুঝে ফেলছে ঘটনা কী। মোজাম সরদার যখন উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন, তখন আর কারও বুঝতে বাকি নেই যে লোকটা তার হাতের থাপ্পড় খেয়েছে। কেন থাপ্পড় খেয়েছে, তা জিজ্ঞাসা করে দেখবে, সে সাহসও কারও হচ্ছে না।

‘জয়নাল, ওকে আমার বাসায় নিয়া যা, গোসল করায়ে গেস্টরুমে বিশ্রাম নিতে দে। এরপরে খেতে দিবি। খেয়াল রাখিস, অযত্ন না হয়!’

পাশে দাঁড়ানো জয়নাল লস্করের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন মোজাম সরদার।

লোকটা মিনমিন গলায় বলে, ‘তার দরকার নাই। আমারে যাইতে দ্যান।’

দরকার আছে। জয়নাল!

মোজাম সরদার পাশে দাঁড়ানো জয়নালের দিকে তাকালেন।

জয়নাল ঘাড় কাত করল। আস্তে লোকটার কানের কাছে এসে বলল, ‘চাচাজানের কথা না শুনলে আবার চড় খাবেন। এইবার হুঁশ ফিরব না।’

জয়নালের কথার পর এবার লোকটা ঝিম মারল। আবার মাথা নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে থাকল।

চাচাজান! ভাইসাবরে কি বাসায় যাওয়ার পথে রইস ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে নিয়ে যাব?

জয়নাল মোজাম সরদারের অনুমতি চাইল।

না। রইসরে বাসায় যেতে বলবা। ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট করতে বলবা।

অ্যার পরে ভাইসাহেবরে ছাইড়া দেব?

না, আমি না ফিরা পর্যন্ত বাসায় আটকে রাখবা। পালাইতে চাইলে বাইন্ধা রাখবা।

জি, কাছি দিয়া শক্ত গিঁট দিয়া বাইন্ধা রাখব।

মোজাম সরদার যখন উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন, তখন আর কারও বুঝতে বাকি নেই যে লোকটা তাঁর হাতের থাপ্পড় খেয়েছে।

জয়নাল আধা হিরো লোকটাকে বগলদাবা করে বাসার দিকে রওনা দিল। মোজাম সরদার মসজিদের পথে হাঁটা দিলেন। নামাজ কাজা হলে তাঁর আবার মাথার ঠিক থাকে না। ভিড় ভাঙা শুরু হলো। দুজন–তিনজন করে করে লোকজন সরে যেতে থাকল। একটু আগেকার কালজয়ী থাপ্পড় মারার দৃশ্য যার নসিবে ছিল, সে রসিয়ে রসিয়ে অন্যদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিতে থাকল।

হায়রে চড়! সরদার চাচার থাবড়ানি খায়া ব্যাডা ঘুল্লি দিয়া পড়ল। আমি দুই শ পার্সেন শিওর, অয় হাইগ্যা দিছে। উইঠ্যা আসার পর যহন বসল, তহন আমি গন্ধ পাইছি। ওয়াক থু!

মারল ক্যান ব্যাটাডারে?

আরে সরদার চাচা জিগাইছিল, বাড়ি কুনহানে? অয় মশকরা কইর৵া কয়, ‘বাড়ি বাংলাদেশে’। ব্যাদ্দপ একটা! পরে তর্কাতর্কি করল। তারপরই চড়! কে না জানে সরদার চাচার সঙ্গে ব্যাদ্দপি করলে চড় মাফ নাই!

লোকটার কথা মিথ্যা না। ত্যাড়ামি করেছে কিন্তু মোজাম সরদারের হাতে চড় খায় নাই, এমন লোক অত্র অঞ্চলে নাই। চড় মারার ব্যাপারে তাঁর বিরাট নাম। সময়-সুযোগ পেলেই তিনি যাকে–তাকে চড় মারেন। এই গুণটা তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।

মোজাম সরদারের দাদার নাম মোফাখ্খর সরদার। এলাকায় সাহেব ‘চড়ানো সরদার’ হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। তিনি যাকে–তাকে চড়াতেন। তাঁর ছেলে মোতালেব সরদারও চড়ানোর ওস্তাদ ছিলেন। বাপ-দাদার সেই সিলসিলা ধরে রেখেছেন মোজাম সরদার। বাবা বেঁচে থাকতেই হাত মকশ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখন অভিজ্ঞ হাতে ত্যাড়া লোকদের থাপড়ান।

তার মানে মোজাম সরদারের চড়ানোর অভ্যাস ঐতিহ্যগত। শান্তিপ্রিয় এলাকাবাসী তাঁর এই অভ্যাসকে অতি আদবের চোখে দেখে। আদরের চোখে দেখে। বলতে গেলে শ্রদ্ধা করে। কারণ, তিনি নিরপরাধ কিংবা নিরীহ লোকজনের গায়ে হাত তোলেন না। স্পষ্টতই যে লোক অন্যায় করেছে, তার গালে তিনি অবলীলায় চড় বসিয়ে দেন।

আরও পড়ুন

মোজাম সরদারের দাদার নাম কেন সাহেব চড়ানো সরদার হয়েছিল, তা নিয়ে এলাকায় একটা গল্প চালু আছে।

বহু বছর লোকের মুখে ঘুরে ঘুরে গল্পটার কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন এসেছে বটে, কিন্তু মূল ঘটনা বলা যায় অবিকৃতই আছে।

তখন ব্রিটিশের শাসন। মোফাখ্খর সরদারের তখন বিরাট তালুক। চার–পাঁচ শ বিঘে সম্পত্তি। পূর্বপুরুষ ডাকাতের সরদার ছিল। ডাকাতির পয়সা দিয়েই আসলে সেই তালুক কেনা। কিন্তু মোফাখ্খর ডাকাতি-ফাকাতির মধ্যে ছিলেন না। কলকাতায় মোটামুটি ধরনের পড়াশোনা করে এলাকায় চলে আসেন। বাপের তালুক বুঝে নেন। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি ছিল তাঁর। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর মতো ইয়া ভুঁড়ি। বাঁকা মোচ। সাধারণ মানুষ অসম্ভব ভয় পেত তাঁকে। একবার ব্রিটিশ সরকার খাল খনন শুরু করল। প্রকল্প পড়ল মোফাখ্খরের জায়গার ওপর। মানে খাল খনন হলে তাঁর প্রায় ৫০ বিঘা জমি ‘নাই’ হয়ে যাবে। মোফাখ্খর ঘোষণা দিলেন, তাঁর জমিতে খাল খুঁচতে এলে কেউ বেঁচে ফিরবে না। খাল কাটায় সরকারের বরাদ্দ মিলল। কিন্তু শ্রমিক মিলল না। কেউ খাল কাটতে যেতে রাজি না। খবর ওপরে গেল। বজরায় চেপে ইংরেজ অফিসার এলেন। সঙ্গে গাদাবন্দুকসহ জনা তিনেক সেপাই। সাহেব এসে মোফাখ্খরকে ইংরেজিতে ধমক দিলেন, ‘ইউ ইডিয়ট!’ গ্রামের মানুষ কথাটার মানে বুঝল না। কিন্তু মোফাখ্খর বুঝলেন। তিনি আর দেরি করেননি। ঠাস করে সাহেবের গালে চড় বসিয়ে দিলেন। সেপাইরা বন্দুক তাক করার পর চেয়ে দেখে, ৫০ জন চারদিক থেকে তাদের ঘিরে রেখেছে। সবার হাতে রামদা, বল্লম, সড়কি। সেই যে সাহেব পালাল, আর আসেনি। খালও আর হয়নি।

কদিন ধরে মোজাম খুব ব্যস্ত। তিন দিন পর কোরবানির ঈদ। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি বাড়ি এসেছে। তিনি আনন্দে–উত্তেজনায় আছেন। নাতি–নাতনির জন্য বাড়ির উঠোনের কোনায় নাগরদোলা বসানো হয়েছে।

সেই মোফাখ্খর সরদারের রক্ত মোজাম সরদারের গায়ে। সেই পাঁচ শ বিঘে জমি এখন নাই। শ দুয়েক বিঘে আছে। ছেলেরা পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় ব্যবসা করে। মেয়ে দুটোকে বিয়ে দিয়েছেন ধারেকাছেই। মোজাম সরদার জমিজমা দেখাশোনা করেন। এলাকায় বিচার–সালিস করে বেড়ান। কাকে ইউপি চেয়ারম্যান করলে সরকারি বরাদ্দে চুরিচামারি কম হবে, সেই ফয়সালা দেন।

কদিন ধরে মোজাম খুব ব্যস্ত। তিন দিন পর কোরবানির ঈদ। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি বাড়ি এসেছে। তিনি আনন্দে–উত্তেজনায় আছেন। নাতি–নাতনির জন্য বাড়ির উঠোনের কোনায় নাগরদোলা বসানো হয়েছে। মেলায় ঘুরে ঘুরে যারা নাগরদোলা বসায়, তাদের ধরে আনা হয়েছে। দুটো ঘোড়া আনা হয়েছে। বাচ্চারা যখন চাইছে, তখন তাদের ঘোরানো হচ্ছে। তারা ভয়ানক খুশি। তারা এখন বায়না ধরেছে হাতি এনে দিতে হবে। ছেলে ও ছেলের বউরা এ কথা শুনে ধমক দিয়েছিল তাদের। কিন্তু মোজাম সরদার কিছু বলেননি। কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। পরে বলেছেন, ব্যবস্থা হবে। তাঁর এই ঘোষণায় নাতি-পুতিরা তাৎক্ষণিকভাবে পিতামহের জয়ধ্বনিসূচক একটি সংক্ষিপ্ত আনন্দ মিছিল করেছে। ‘জনতার দাবি’ মেনে রাশভারী মোজাম সরদারকেও শেষ পর্যন্ত সেই মিছিলে শামিল হতে হয়েছে।

আরও পড়ুন

হাতি কোথায় ভাড়া পাওয়া যায়, সেই খোঁজে বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন মোজাম সরদার। বিকেলের রোদে গায়ে চাদর জড়িয়ে হাঁটছিলেন তিনি। পথে বছর তিরিশেক বয়সী ছেলেটা সামনে পড়ে গিয়েছিল। সালাম-কালাম দূরে থাক, ফিটফাট বাবুটি সিগারেটে টান মেরে মোজাম সরদারের মুখের ওপর ধোঁয়া ছুড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। এলাকার ছেলে হলে মোজামকে তার চেনার কথা। এমন আচরণ করার কথা না। এই কারণে ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করেছিলেন। ছেলেটার উল্টাপাল্টা কথাবার্তায় মেজাজ বিগড়ে গেল। হাতির চিন্তাটা বাধাগ্রস্ত হলো।

সবাই জানে, মোজাম সরদারের কথা নড়চড় হয় না। তিনি নিজের মুখে যখন নাতিদের কথা দিয়েছেন, তখন যেমন করেই হোক দু–এক দিনে হাতির জোগাড় হবে। বাড়ির সব কাজ দেখাশোনা করে জয়নাল। তার এখনকার বড় টেনশন হলো, হাতিটা বাড়িতে আনার পর তাকে রাখা হবে কোথায়। ইতিমধ্যেই বাড়িতে গরুর মতো দেখতে দুটি ‘হাতি’ আনা হয়েছে। কোরবানির জন্য বিশাল দুটি ষাঁড় কেনা হয়েছে আজ সকালেই। একটার নাম ‘কালা আজদাহা’, আরেকটার নাম ‘সাদা পাহাড়’। তাদের রাখা হয়েছে গোয়ালে। কিন্তু হাতি কোথায় রাখা হবে? কোনো ঝামেলা হলে শেষমেশ তো তাকেই চড় খেতে হবে—এই চিন্তা জয়নালকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। জয়নাল অবশ্য খুবই কাজের লোক। সে এই বাড়ির সবার মেজাজ বোঝে। সে সব ম্যানেজ করে ফেলতে পারবে।

দুই

মোজাম সরদারের বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেছে। হাতির সন্ধান করা সোজা কাজ না। গরু–গাধা হলে নাহয় ঠাস করে খুঁজে বের করা যায়। হাতি বলে কথা। বাজারে মঈনুদ্দিনের কাঠের আড়তে দবির খা নামের এক লোকের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। দবির একসময় রয়েল বেঙ্গল সার্কাসে খেলা দেখাত। আচমকা একদিন দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল। ৩০ ফুট ওপর থেকে পড়ে তার মরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মরে নাই। পা ভেঙেছে। তারপর চাকরি গেছে। সে এখন মঈনুদ্দিনের কাঠের আড়তে হিসাবপত্তর রাখার কাজ করে।

দবির ওই সার্কাস পার্টির মালিকের ঠিকানা দিয়েছিল। ৪০ কিলোমিটার দূরে মালিকের বাড়ি। মোজাম সরদার নিজেই সেখানে চলে গেছেন। মোজাম সরদার সার্কাস পার্টির মালিক অতুল বাবুকে নিজের পরিচয় দেওয়ার পর সহজেই তাঁকে চিনতে পারলেন। অতুল বাবু বললেন, মোজাম সরদারের নাম তিনি অনেক শুনেছেন। কিন্তু কোন কারণে অনেকবার তাঁর নাম শুনেছেন, তা অবশ্য তিনি বলতে পারেননি। সরদার সাহেব যে বহু প্রভাবশালী, লোকজনের মুখে অবলীলায় থাপ্পড় মেরে থাকেন, এই কথা যে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে, তা তিনি বলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন। অতুল বাবু জানালেন, এখন তাঁর সার্কাস পার্টির শো বন্ধ আছে। মোজাম সরদার চাইলে এক জোড়া হাতি ভাড়া নিতে পারেন। প্রতিদিনের জন্য তাঁকে দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। সঙ্গে মাহুতের খোরাকি দিতে হবে। মোজাম সরদার এককথায় রাজি হয়ে গেছেন। তিনি অতুল বাবুকে ঠিকানা দিয়ে এসেছেন। সব ঠিক থাকলে কাল সকালে মোজাম সরদারের বাড়িতে দুই–দুইটা হাতির পাড়া পড়তে যাচ্ছে।

রাত বাজে এগারোটা। গ্রামের পথে হেঁটে আসতে মোজাম সরদারকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। গ্রামটা দ্বীপের মতো। খেয়া পার হয়ে আসতে হয়। খেয়া বন্ধ হয়ে যায় রাত আটটার মধ্যে। মোজাম সরদার ঘাটে আসার পর সেখানকার লোকজন তাঁকে পার করে দিয়ে গেছে। বাড়ি পর্যন্ত তারা তাঁকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মোজাম সরদার রাজি হননি। তাদের চলে যেতে বলেছেন। তারা চলে গেছে। কিন্তু তারা চলে যাওয়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছেন, তাদের ছাড়া ঠিক হয়নি। তাঁর সঙ্গে কোনো টর্চলাইট বা হারিকেন নেই।

আরও পড়ুন

এখন কৃষ্ণপক্ষ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। পা ফেলতে হচ্ছে টিপে টিপে।

গ্রামের চারপাশে নদী থাকায় এখানে বিদ্যুৎ আসেনি। মোজাম সরদারের ছেলে তাঁর বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসিয়ে দিয়ে গেছে। তবে সপ্তাহখানেক প্যানেলটায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। কারেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না।

তবু আন্দাজের ওপর ভর করে মোজাম সরদার বাড়ির সামনের গেট পর্যন্ত চলে এসেছেন। সারা পথ বিকেলবেলায় থাপ্পড় খাওয়া ছেলেটার কথা ভাবছিলেন তিনি। অনেকক্ষণ ধরে তাঁর মনে হচ্ছিল, ছেলেটাকে জয়নালের জিম্মায় রাখা ঠিক হয়নি। জয়নালের মায়া–দয়া কম। ছেলেটা উল্টাপাল্টা কিছু করলে তাকে সে সত্যি সত্যি বেঁধে রাখতে পারে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মোজাম সরদার গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। বড় উঠোন পার হয়ে তাঁকে ঘরে যেতে হবে।

গ্রামের চারপাশে নদী থাকায় এখানে বিদ্যুৎ আসেনি। মোজাম সরদারের ছেলে তাঁর বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বসিয়ে দিয়ে গেছে।

একটু এগোতেই অন্ধকারের মধ্যে কী যেন চোখে পড়ল। মোজাম সরদার চোখ কচলালেন। সামনে এটা কী? অন্ধকারের মধ্যে সতর্কভাবে তাকালেন তিনি। উঠোনের মাঝখানে লম্বা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। মোজাম সরদার প্রায় ছয় ফুট উঁচু লোক। কিন্তু যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, সে মনে হচ্ছে তার চেয়ে আরও এক ফুট বেশি লম্বা। এত লম্বা মানুষ থাকার কোনো কারণ নেই। মোজাম সরদার একটু থতমত খেয়ে গেলেন।

অ্যাই, কে, কে দাঁড়ায়ে সামনে? কী ব্যাপার কথা কয় না ক্যান?

সামনের লোকটা কথা বলছে না। তার মুখ–চোখ কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু অন্ধকারের মধ্যে একটা অপচ্ছায়ার মধ্যে সে দাঁড়িয়ে আছে।

অ্যাই, তুই কে? কিডা? কথা কস না যে? মোজাম সরদারের সঙ্গে বেয়াদবি করিস?

সামনের লোকটা নির্বিকার। তিন হাত দূরে দাঁড়ানো মোজাম সরদারের হঠাৎ মনে হয়, সামনের লোকটা মানুষ না। জিন–ভূত কিছু হবে। পাশের চরে জিন দেখা গেছে বলে বহু আগে থেকে তিনি শুনে এসেছেন। সেসব জনশ্রুতি মোজাম সরদারের মনে পড়ে যায়। কিন্তু হোক জিন কিংবা ভূত। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে আর তাঁর কথার জবাব দেবে না, আর এই বেয়াদবি দেখেও তিনি ভয় পেয়ে চুপ করে থাকবেন, এটা কেমন কথা? ওটা এখনই যদি না থাপড়ানো হয়, তাহলে তো সেটা সরদার বাড়ির জন্য চরম অপমানের বিষয়। এই ভাবনা মাথায় আসতেই মোজাম সরদার আর দেরি করেননি। সামনে এগিয়ে গিয়ে গায়ে যত শক্তি ছিল, তাই দিয়ে লোকটাকে থাপ্পড় মেরে বসলেন। থাপ্পড়ের সঙ্গে বিকট আর্তচিৎকার শোনা গেল, ‘আ...আল্লারে!’

উঠোনে দশ–বারোজন লোক ছুটে এসেছে মোজাম সরদারের চিৎকার শুনে। হারিকেনের আলোয় উঠোন ভরে গেছে। মোজাম সরদার কথা বলতে পারছেন না। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছেন। তাঁর ডান হাতটা সম্ভবত ভেঙে গেছে। তিনি মাটিতে তখনো শোয়া। তিনি হারিকেনের আলোয় দেখলেন তাঁর সামনে বিশাল একটা মোটা খেজুরগাছের কাটা অংশ পুঁতে রাখা। এই খেজুরগাছের ‘গালেই তিনি কষে চড় বসিয়েছেন।

ছোট ছোট নাতি–পুতি মোজাম সরদারকে ঘিরে ধরেছে। জয়নাল তাঁকে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। তিনি জয়নালের দিকে চেয়ে বললেন, ‘এই জিনিস এখানে পুঁতছে কে?’

জয়নাল ঢোঁক গিলে বলল, ‘চাচাজান, আমিই পুঁতিছি। আপনি হাতি আনবেন। হাতি বান্ধার জন্য পুঁতিছি।’

মোজাম সরদার, জয়নালকে চড় দেওয়ার জন্য হাত তুলতে গেলেন। কিন্তু হাত উঠতে চাইছে না। তীব্র ব্যথা চেপে তিনি জয়নালের দিকে চাইলেন। জয়নালের পাশে দেখলেন সেই ছেলেটা হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছে। বিকেলে ওকেই তিনি চড় মেরে কাদার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন।

মোজাম সরদার স্বর নামিয়ে কঁকিয়ে কঁকিয়ে বললেন, ‘ও তুমি, এখনো আছ? কী নাম যেন বাবা তোমার?’

জি, মারুফ

খালি মারুফ? পুরো নাম কী?

জি, মারুফ হায়দার।

পুরো নাম হয় নাই। কোন গোষ্ঠী? শেখ-সৈয়দ-চৌধুরী-মোল্লা—কোনটা?

মোজাম সরদার গজর গজর করতে লাগলেন। তাঁর হাত তখন ফুলে উঠতে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন