বেজির নাম বেজিও

অলংকরণ: তীর্থ

ভাইয়া ঘোষণা দিল, এই বেজির নাম বেজিও। রবার্তো বেজিও।

ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই বেজিটা লাফিয়ে উঠল। আমিও লাফিয়ে উঠলাম। বেজি সাপ খায়। মুখে তার বিষও তো থাকতে পারে?

আমার কথা শুনে ভাইয়া হেসে খুন। কিন্তু আমার ভেতর ধুকপুকি। সেটা অবশ্য শুধু বিষ–সংক্রান্ত না। এই বেজি যদি মা দেখে, মায়ের কী প্রতিক্রিয়া হবে, সেটা ভেবেই আমার ঘাম ছুটে গেল।

: ভাইয়া, বেজিও হোক কি রোনালদো, এটাকে নিয়ে বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না!

: হবে না মানে। এক শ বার ঠিক হবে। নগদ এক শ টাকা দিয়ে কিনেছি না?

: তোকে এই জিনিস কিনতে কে বলল, বল?

: শোন রুনু…তোর না সবকিছুতেই নাক সিটকানোর স্বভাব হয়ে যাচ্ছে। মহল্লার ছেলেমেয়েরা এটার গলায় দড়ি লাগিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল…আমি ওদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য এক শ টাকা দিয়ে কিনেছি…

: ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য কিনেছিস তো ভালো কথা…ছাড়িয়ে তো নিয়েছিস…এবার ছেড়ে দে…

: মাথা খারাপ! দেখছিস না কেমন রোগা-পটকা হয়ে আছে? একে আগে খাইয়ে চাঙা করতে হবে। তাহলে না জঙ্গলে গিয়ে সারভাইভ করতে পারবে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ভাইয়া বলল, শোন, মায়ের কপি করে কথায় কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলবি না। মেয়েরা ১৫ বছর পর্যন্ত মায়েদের কপি করে, তারপর তারা কপি করে বাবার…তুই বাবার না কর, অন্তত আমার তো করবি?

: তোর কপি করে কী করব, বেজি পুষব?

: না। কিন্তু বেজি পোষায় সাহায্য তো করবি!

: তা কী সাহায্য লাগবে তোমার?

: বেজিটা আমি ঘরে রাখব। কিন্তু মাকে কিছু বলবি না!

: মাথা খারাপ! মায়ের নাক তুই জানিস না! বাসায় ঢুকলেই বুঝে ফেলবে ঘরে কিছু একটা আছে!

 ভাইয়া ফিক করে হেসে দিল। তারপর বের করল একটা সেন্টের বোতল। আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে আবার হেসে পুরো সেন্টের বোতল স্প্রে করে উড়িয়ে দিল বেজির গায়ে। আমি বললাম, এই বোতল তুই কোথায় পেলি?

: বাবার। বাবার বন্ধু এল না গত সপ্তাহে…কানাডা থেকে…বাবাকে গিফট দিল না!

: ভাইয়া, তুই বাবার সেন্ট…তুই জানিস বাবা জানলে কী করবে?

: জানবে কী করে…তুই না বললেই হয়!

 আমার গলা যেন কেউ চেপে ধরল। একটা না, দুই দুইটা সিক্রেট পেটে চেপে চলতে হবে আমাকে?

বিকেলে মা এবং সন্ধ্যায় বাবা অফিস থেকে ফিরলেন। বাবাকে নিয়ে অবশ্য আমার তেমন কোনো ভয় ছিল না। বাবা দেশের কী অবস্থা, জ্যামের কী অবস্থা, রাস্তার কী অবস্থা ইত্যাদি নিজে নিজে বর্ণনা করেন, নিজেই বিরক্ত হয়ে টিভি দেখতে বসে গেলেন। সমস্যা হলো মাকে নিয়ে। মা সেই বিকেল থেকে বাসায় ঢুকে কিছুক্ষণ পরপর নাক কুঁচকাচ্ছেন আর আমাকে ডাকছেন, রুনু, এদিকে আয় তো…

: পড়তে বসেছি মা…পরে আসি?

: আচ্ছা, তোর না পরীক্ষা হয়ে গেল…আবার কিসের পড়া?

: কী বলো, মা? ভর্তি পরীক্ষায় তো আসল পরীক্ষা মা…বাবা কী বলে শোনো না…বাবা বলে পরীক্ষা হোক যথা তথা ভর্তি হোক ভালো…

: তোর বাবা মাঝেমধ্যেই উল্টাপাল্টা কথা বলে, তার সব কথা কানে নিবি না!

: আচ্ছা, ঠিক আছে।

: তুই কি কোনো গন্ধ পাচ্ছিস?

আরও পড়ুন

আমি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে জোরে জোরে পড়তে শুরু করে দিই। মা বিড়বিড় করতে থাকে। আবার ডাক দেয়—রুনু…

: মা, বলো…

: তুই কি কোনো গন্ধ পাচ্ছিস?

: আমার তো তিন দিন থেকে ঠান্ডা লেগেছে, মা। নাক বন্ধ। হ্যাঁচ্চো!

: আচ্ছা, রাতে কিন্তু গরম দুধ খাবি!

আমি মনে মনে ভাইয়াকে শাপশাপান্ত করি। তার জন্য অভিনয় করতে গিয়ে রাতের ভাগে পড়ল গরম দুধ। ভাইয়া তখন টুক করে আমার ঘরে ঢুকে বলল, চিন্তা করিস না। দুধ আমাকে দিয়ে দিবি!

: তুই খাবি?

: উঁহু! রবার্তো বেজিও খাবে। গুগল করে বের করেছি বেজিওরা স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরা দুধ খায়…

: সাপ খায় না?

: খায়। ইঁদুর, তেলাপোকা সব খায়…এই ঘরের সব পোকা সাফা করে দেবে…

: ইশশশশ! ছি ছি ছি!

: ছি ছি ছি বলার কী আছে! আমরাও তো মাংস খাই! খাই না?

: চুপ থাক, ভাইয়া!

মা ঘরের দরজা খুলতে যাবে এমন সময় বাবা বলল, চিকাটিকা বোধ হয়! দেখছ না কেমন চিকচিক করছে! মা থমকে গেল। বলল, কালকে বিষ এনো তো…

রাতে খেতে বসেছি সবাই মিলে। ভাইয়া খাচ্ছে ঝড়ের বেগে। বাবা তাকে দেখে বলল, আজ কি প্রিমিয়ার লিগ শুরু হয়েছে?

ভাইয়া বলল, না তো, বাবা।

: তাহলে আস্তে খা। তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই বেয়ার গ্রিলস…অনেক দিন কিছু খেতে পাসনি!

: কাজ আছে, বাবা…

: কাজ আর তুই? ভালো…

অন্যদিন হলে ভাইয়া বিতং করে কাজের বর্ণনা দিত, কিন্তু আজকে খাওয়াতেই মন দিল। এমন সময় ভাইয়ার ঘর থেকে কিচকিচ শব্দ আসতে থাকল। আমি আর ভাইয়া বুঝলাম বেজিও আওয়াজ দিচ্ছে—হয়তো খিদে পেয়েছে। মা বলল, কিসের আওয়াজ?

ভাইয়া আমার দিকে তাকাতেই মুখে জোর করে ফোটাতে হলো কিছু না জানার একটা ভঙ্গি। বললাম, আমি কী জানি!

সবাই থমকে থাকল কিছুক্ষণ। কিচকিচ আওয়াজটা আবারও এল। মা উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল ভাইয়ার রুমের দিকে। শ্বাসরোধ হয়ে এল আমাদের। এবারই ধরা পড়ে যাবে আমাদের বেজিও। মা ভাইয়ার, আমার এবং বেজিওর পিঠের চামড়া উঠিয়ে নেবে। আমাদের চামড়া দিয়ে তেমন কিছু হবে না। বেজির চামড়া দিয়ে হয়তো বেল্ট হবে। বাবা সেই বেল্ট পরে অফিস যাবে। বলবে, বুঝলেন রহমান সাহেব, বেজির চামড়ার বেল্ট হলো মাস্টারপিস। দেশে যদি আরও বেজি বাড়ত…! এটা একটা প্রকল্পের ভেতর নিয়ে আসতে হবে। বেজিচাষ প্রকল্প!

 মা ঘরের দরজা খুলতে যাবে এমন সময় বাবা বলল, চিকাটিকা বোধ হয়! দেখছ না কেমন চিকচিক করছে! মা থমকে গেল। বলল, কালকে বিষ এনো তো…

 আমি আর ভাইয়া হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

রাতে আমার আর ভাইয়ার জন্য রাখা দুধ খেয়ে বেজিও শরীরটা এলিয়ে দিল। ভাইয়া তার মাথায় হাত বোলাতেই ঘাগু বেড়ালের মতো চোখ আরামে বুজে ফেলল বেজিও। তার আদর খাওয়া দেখে আমারও ইচ্ছা করল তাকে আদর করতে। কিন্তু হাত উঠিয়েও থেকে গেল আমার। বেজির শরীরটা যেন কেমন, ইশ্‌! কী লোমভর্তি চারপাশ! উফ! ভাইয়া ঘোষণা দিল আগামীকাল সে মাছ ধরতে লেকে বসবে…এক হাতে মাছ ধরবে অন্য হাতে বেজিকে খাওয়াবে। আমি বললাম, আমিও যাব। লেকটা তো আর বেশি দূর না! আমাদের দোতলার বাড়ি থেকে বিশটা হাত দূরে। ভাইয়া আমাকে চোখ টিপ দিয়ে একটা ইশারা করল। আর এরই মধ্যে বেজিও দেখি ঘুমিয়ে পড়ল। ভাইয়ার কোলে মাথা দিয়ে বেশ আয়েশি একটা ঘুম। ঘুমালে বোধ হয় সবাইকে সুন্দর লাগে দেখতে। বেজিওর দিকে তাকিয়ে কেমন একটা মায়া চলে এল। আহা রে!

ভাইয়া কিছুক্ষণ কী বলবে ভেবে পেল না। তারপর বলল, মেয়ে হলেই মেয়েদের মতো কাঁদতে হবে নাকি!

ভোরের দিকে শুনলাম বাবা আর মায়ের বিকট চিৎকার। ছুটে তাদের ঘরে গিয়ে যা দেখলাম, তা অবিশ্বাস্য। বেজিও বাবার বুকের ওপর মাথা চাগিয়ে বসে আছে। বাবার চোখ বিস্ফারিত। একেবারে গোল গোল আলু। বেজিও অবশ্য নির্বিকার। বাবার গোল চোখ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে তাকিয়ে আছে বাবার গোঁফের দিকে। আমার কেন যেন মনে হলো বেজিও বাবার ঝাঁকড়া গোঁফটাকে ছোটখাটো কোনো বেজি মনে করছে। কিন্তু মা? মা পাশে বসে আছে রুদ্রমূর্তিতে—এটা কে এনেছে? এটাকে কে এনেছে? রুনু…রুনু…তুই এনেছিস? কার সাহস এ বাড়িতে এটাকে নিয়ে আসার?

ভাইয়া চুপচাপ গিয়ে বেজিওকে উঠিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি এনেছি।’

ভাইয়ার এ গুণটা অবশ্য ভালো। সত্য স্বীকার করে নিতে পারে। মা বলল, কাল সকালে আমি এটাকে এ বাড়িতে দেখতে চাই না! এটাকে এক্ষুনি ফেলে আয় বাইরে!

ভাইয়া বলল, ও খুব দুর্বল। আরও কয়েকটা দিন থাক। তারপর আমি রেখে আসব! এখন না!

ভাইয়া খুব শক্ত কণ্ঠে এসব বলে বেজিওকে নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে।

ভাইয়ার এই গুণটা অবশ্য খুব খারাপ—ঘাড়ত্যাড়ামি।

আরও পড়ুন

পরের দিন ভাইয়া বেজিওকে নিয়ে নিজের ঘর থেকে বের হলো না। সকালের নাশতার রুটি, দুপুরের ভাত কোনোটাই ঠিকমতো নাকি খেল না বেজিও। আমারও মনটা খারাপ হলো। মাকে বললাম, মা ঠান্ডা তো ভালো হচ্ছে না। এক গ্লাস গরম দুধ দাও, খাই!

: আমার সাথে চালাকি হচ্ছে দুই ভাইবোনের? খুব চালাক তোরা? তোরা চলিস পাতায় পাতায়, আমি চলি পাতার শিরায়…কোনো দুধ হবে না ওই বেজিটার জন্য! আমি আজ অফিসও যাব না। দেখি এ বাড়ি থেকে ওটা কীভাবে না বের করে তোরা থাকিস!

আমার কান্না এল। ভাইয়া বলল, মেয়েদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবি না!

আমি বললাম, আমি তো মেয়েই!

ভাইয়া কিছুক্ষণ কী বলবে ভেবে পেল না। তারপর বলল, মেয়ে হলেই মেয়েদের মতো কাঁদতে হবে নাকি!

দেখলাম ভাইয়ার চোখও চিকচিক করছে। ভারি সে ছেলে!

ভাইয়া চোখ কচলে বলল, বিকেলে মাছ ধরতে যাব লেকে। চিন্তা করিস না। গুগল করে দেখেছি…বেজিও ছোট ছোট সব মাছ খেতে পারবে!

আমি বেজিওকে মুরগির মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম। বেজিও একটু শুঁকে কিচকিচ করে সরে গেল। ভাইয়া বেজিওকে ধরে আদর করতে থাকল। কিন্তু বেজিওর চোখে যে খিদা, সেটা আমাদের চোখ এড়াল না।

বিকেলে ভাইয়া গেল মাছ ধরতে। একটা ছিপ আর কিছু আটার গুলি নিয়ে। আমি যেতে চাইলাম। ভাইয়া নিষেধ করে বলল, বেজিওর দিকে খেয়াল রাখতে। কিন্তু ভাইয়া যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মা আমাকে ডাকল। বলল, ওটা কোথায়?

আমি চুপ থাকলাম।

মা এবার একটু ধমক দিয়ে বলল, কোথায় ওটা?

নিজেকে মিরজাফরের মতো লাগছিল। কিন্তু মাকে ঠিকই দেখিয়ে দিলাম ভাইয়ার জুতার বাক্সে লুকিয়ে রাখা বেজিওকে। মা বেজিওকে একটা কাপড়ে লেপ্টে এক হাতে ধরে নিচে নিয়ে গেল। তারপর ছুড়ে দিল জংলার দিকে। শূন্যে উড়ন্ত বেজিও একবার যেন আমার দিকে তাকাল। তার চোখে কেবলই অবিশ্বাস! সে হয়তো ভাবতেই পারছে না মানুষেরা এত নিষ্ঠুর হতে পারে!

আমি কাঁদতেও পারলাম না। মা তার আগে বলল, তোর ভাইয়া কোথায়?

আমি বললাম, লেকে।

মা বেরিয়ে গেল। আমিও মায়ের সঙ্গে। মা লেকের ধার থেকে ভাইয়ার কান ধরে ছিপ তুলে নিয়ে আসতে শুরু করল। আমি এমন একটা ভাব করলাম যেন এসবের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। যেন আমি লেকে এসেছি হাওয়া খেতে।

মা ভাইয়াকে নিয়ে আগে আগে আর পিছে পিছে…হঠাৎই দেখলাম থমকে গেছে মা আর ভাইয়া। আমি পেছন থেকে এগিয়ে দেখলাম লেকের ধার থেকে যেখানে ঢালটা হঠাৎই খাদ হয়ে গেছে, একটা বনলতার গাছ যেখানে লেপ্টে আছে কড়ইগাছের শিকড়কে, সেখান থেকে একটা কালো রঙের সাপ বেরিয়ে এসেছে। একেবারে মা আর ভাইয়ার পায়ের কাছে। ফণাও তুলেছে। খুব মৃদু, প্রথমে দেখলে বোঝা যায় না, কিন্তু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায় যে সাপটা মাথাও নাড়াচ্ছে। মায়ের শরীরটা একেবারে থমকে গেছে। এ এলাকায় সাপ যে একেবারে নেই, তা না, কিন্তু এভাবে সাপের মুখোমুখি হওয়া একেবারেই নতুন একটা ব্যাপার। ভাইয়া কোনোমতে মুখে বলল, হুসসস…হুসসস…যা যা! সাপ তাতে তেমন বিচলিত হলো না। তার ফণাটা যেন আরও মেলে ধরল। মা কী করবে, ভেবে পেল না। সাপটা তার ছোবলটা মারতে যাবে এমন সময় একটা বেজি লাফিয়ে পড়ল সাপটার ওপর। সাপটাও বেজিটাকে পেঁচিয়ে ধরল। বেজি আর সাপ মিলে গড়াগড়ি খেয়ে সড়সড় করে গড়িয়ে পড়ল জংলা খাদের ভেতরে। চকিতে কী হয়ে গেল আমরা কেউ যেন বুঝে উঠতে পারলাম না। ভাইয়া শুধু বলল, বেজিও!

ওটা হয়তো বেজিও ছিল কিংবা বেজিও ছিল না…অন্য কোনো বেজি ছিল…কিন্তু মায়ের কান্নার অন্ত থাকল না। মা সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত চার্জার লাইট নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে বেজিওকে খুঁজে বেড়াল। বারবার ডাকতে থাকল—বেজিও বেজিও…বেজিও…

বেজিও ফিরল না। হয়তো ফেরার মতো অবস্থায় সে ছিল না।

আরও পড়ুন