মাছের ডিম ক্যাভিয়ার কেন বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার
বাংলাদেশে এখন মা ইলিশ রক্ষায় মাছ ধরা বন্ধ। যে ডিম রক্ষার জন্য এত কিছু করা হয়, সেই মাছের ডিম নিয়েই আজকের লেখা। তবে আজকের লেখাটা বাঙালির প্রিয় ইলিশের ডিম নিয়ে নয়, বরং বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার নিয়ে। বেলুগা স্টারজন (Beluga Sturgeon) মাছ থেকে পাওয়া সেই বিখ্যাত ক্যাভিয়ার নিয়ে, যাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু ও বিলাসবহুল খাবার। এই মাছের ডিমগুলো দেখতে অনেকটা ছোট্ট পুঁতির মতো। কিন্তু এদের দাম সোনা বা হীরার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কীভাবে মাছের ডিম ক্যাভিয়ার বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার হয়ে উঠল?
বিশ্বে সুস্বাদু ও বিলাসবহুল খাবার হিসেবে পরিচিত ক্যাভিয়ার হলো নিষিক্ত না হওয়া মাছের ডিম, যার স্বাদ লবণাক্ত। তবে সব মাছের নিষিক্ত না হওয়া ডিম কিন্তু ক্যাভিয়ার নয়। মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (FDA) তথ্য অনুসারে, প্রকৃত ক্যাভিয়ার কেবল স্টার্জন (Sturgeon) মাছের ডিম থেকে আসে। এই মাছ সাধারণত রাশিয়া, ইউক্রেন ও উত্তর আমেরিকার কাছাকাছি পাওয়া যায়।
স্টার্জন মাছের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এদের ডিম উৎপাদনের ক্ষমতা। একটি স্টার্জন মাছ একসঙ্গে কয়েক মিলিয়ন ডিম ছাড়তে পারে। এরা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন জলাশয়ে বড় হয়। তবে বর্তমানে ডিমের চাহিদার কারণে এদের মাছের খামারেও বিশেষভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে। বেলুগা স্টার্জনের মতো কিছু প্রজাতি প্রায় ১৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বে প্রধানত চার ধরনের ক্যাভিয়ার পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো বেলুগা ক্যাভিয়ার, যা আসে কাস্পিয়ান সাগরের বেলুগা স্টার্জন থেকে। এটি সাধারণত ধূসর বা গাঢ় রঙের হয়। এর স্বাদ হয় তীব্র ও গাঢ়। এরপর রয়েছে ওসেট্রা ক্যাভিয়ার, যা বাদামি বা সোনালি রঙের হয় এবং এর মধ্যে একটি বিশেষ লবণাক্ত, যাতে সমুদ্রের স্বাদ পাওয়া যায়। তৃতীয়টি হলো সেভরুগা ক্যাভিয়ার, যা সেভরুগা, স্টারলেট ও সাইবেরিয়ান স্টার্জন মাছের ডিম থেকে আসে। এনব ডিম তুলনামূলক ছোট হলেও, এর স্বাদ হয় মাখনের মতো। সবশেষে লেক স্টার্জন। বন্য আটলান্টিক স্টার্জন ও সাদা স্টার্জন মাছ থেকে পাওয়া যায় আমেরিকান ক্যাভিয়ার, যার স্বাদ হয় তাজা ও লবণাক্ত।
ক্যাভিয়ার হলো একধরনের ফিশ রো বা মাছের ডিম। যদিও বিভিন্ন মাছের ডিমকে রো বলা হয়, কিন্তু প্রকৃত ক্যাভিয়ার আসে কেবল স্টার্জন (Sturgeon) মাছের ডিম থেকে। দাম কম হওয়ার কারণে বাজারে অন্যান্য মাছের ডিমও ক্যাভিয়ারের বিকল্প হিসেবে চলে। ফ্লাইং ফিস থেকে আসে টোবিকো রো। স্মেল্ট নামের ছোট মাছ থেকে আসে মাসাগো রো। আর স্যামন মাছের ডিমকে বলা হয় ইকুরা বা লাল ক্যাভিয়ার। এগুলো ক্যাভিয়ারের বিকল্প হিসেবে চললেও, দাম ও স্বাদের দিক থেকে স্টার্জন ক্যাভিয়ারই শ্রেষ্ঠ।
বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার হিসেবে ক্যাভিয়ারের স্থান পাওয়ার প্রধান কারণ হলো সীমিত জোগান ও দুষ্প্রাপ্যতা।। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ক্যাভিয়ার সংগ্রহ করা একটি মুক্ত বাজারে পরিণত হয়। ফলে অতিরিক্ত মাছ ধরা শুরু হয়। অতিরিক্ত মাছ ধরা, নদীর দূষণ ও বাঁধ নির্মাণের কারণে ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে স্টার্জন মাছ ধরার পরিমাণ ৭০ শতাংশ কমে যায়। পরিবেশগত ক্ষতি ও অবৈধ ব্যবসার ফলে স্টার্জন মাছ এখন বিপন্ন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্যমতে, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন প্রজাতিগুলোর অন্যতম। এই চরম দুর্লভতাই ক্যাভিয়ারের দাম আকাশছোঁয়া করে তুলেছে।
ক্যাভিয়ার উৎপাদনের প্রক্রিয়াও অত্যন্ত জটিল, যা এর দাম বাড়িয়ে দেওয়ার দ্বিতীয় প্রধান কারণ। স্টার্জন মাছের ডিম উৎপাদন শুরু করতে সর্বনিম্ন আট বছর থেকে কিছু ক্ষেত্রে ১৮ বছর পর্যন্ত সময় লাগে, যা প্রক্রিয়াটিকে খুবই সময়সাপেক্ষ করে তোলে। এ ছাড়াও এসব মাছ খুব সহজে সংক্রমণ বা রোগের শিকার হয়। আর ডিম সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম হতে হয়, কারণ ডিমগুলো খুব সহজে নষ্ট হয়ে যায়। ডিম উৎপাদনের সম্পূর্ণ কাজটি হাতে করা হয়। সব মিলিয়ে উৎপাদন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের এই সব জটিলতা ও ঝুঁকি মিলেই ক্যাভিয়ারকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবারে পরিণত করেছে।
ক্যাভিয়ার সাধারণত খুব ছোট, বায়ুরোধী কাচের পাত্র বা টিনের কৌটায় বিক্রি হয়। এর বিক্রয়প্রক্রিয়া খুবই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কারণ এর আকার, রং, দৃঢ়তা ও স্বাদের ওপর ভিত্তি করে এদের গ্রেড (Grade) ঠিক করা হয়, যা এর দাম নির্ধারণ করে। কাচের পাত্র বা টিনের কৌটায় পাওয়া ক্যাভিয়ারের দাম হয় ২ হাজার ডলারের কাছাকাছি যা প্রায় ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। আর টিনের কৌটায় থাকে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ গ্রাম। ক্যাভিয়ার শুধু পাঁচ তারকা রেস্তোরাঁ ও বিলাসবহুল হোটেলগুলোয় পরিবেশন করা হয়। সব মিলিয়ে উচ্চমূল্যের কারণে এবং সহজলভ্য না হওয়ায় ক্যাভিয়ার এখন বিলাসিতার প্রতীক হিসেবেই বিক্রি হয়ে থাকে।
সূত্র: ইউএসএ টুডে, সিএনবিসি, দ্য টেকআউট