মিষ্টিজাতীয় খাবার সবার খেতে ভালো লাগে কেন
চকলেট, কেক, আইসক্রিমের মতো মিষ্টিজাতীয় খাবার দেখলেই আমাদের জিবে পানি আসে। মিষ্টি খাবারের প্রতি অনেকেরই অদ্ভুত দুর্বলতা আছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে আমরা এসব লোভনীয় খাবারের প্রতি টান অনুভব করি। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছ, যে জিনিসটা আমাদের শরীরের জন্য অতটা ভালো না, সেটার প্রতি কেন আমাদের এত তীব্র আকর্ষণ? অন্যদিকে ভিটামিন, আয়রন ও পটাশিয়ামের মতো উপকারী পুষ্টিতে ভরপুর সবজির জন্য আমাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। কেন এমনটা হয়? কেন চিনি আমাদের কাছে এত বেশি প্রিয়?
আমাদের এই মিষ্টির প্রতি ভালো লাগার রহস্য জানতে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে গবেষণা করছেন। শত শত গবেষণার পর তাঁরা এমন কিছু তথ্য জেনেছেন, যা জানলে তুমিও অবাক হবে। অনেকের ধারণা, ছোটবেলা থেকে অভ্যাসের কারণে আমরা মিষ্টি পছন্দ করি। কিন্তু গবেষণা বলছে, চিনির প্রতি আমাদের ভালোবাসা আসলে সহজাত বা জন্মগত। অর্থাৎ মিষ্টির প্রতি আকর্ষণ নিয়ে আমরা জন্মাই।
নবজাতকদের মধ্যেই এই প্রবণতা বিশেষভাবে দেখা যায়। শিশুরা সাধারণ ফর্মুলার চেয়ে মিষ্টি ফর্মুলা বেশি পছন্দ করে। এটি এমন এক বিশেষ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, যা মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে তৈরি করা হয়। এই ফর্মুলাগুলো তৈরি করা হয় গরু দুধের সঙ্গে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের সঠিক মিশ্রণে। মজার ব্যাপার হলো, এটি কেবল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের শিশুদের মধ্যে দেখা যায় এমন না। সারা বিশ্বের শিশুদের মধ্যেই দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এর একটি কারণ হতে পারে শিশুদের টেস্ট বাড বা স্বাদ নেওয়ার গ্রন্থি তেতো বা কড়া স্বাদের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। ফলে তাদের মস্তিষ্ক সহজাতভাবেই মিষ্টি খাবারের দিকে বেশি আগ্রহী হয়। কারণ, মিষ্টি স্বাদ কোনো বিপদ বা বিষের সংকেত দেয় না। ফলে মস্তিষ্ক এটিকে নিরাপদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্করা যখন সোডার ক্যানে নির্দিষ্ট পরিমাণ মিষ্টি পছন্দ করেন, তখন শিশুরা এর দ্বিগুণ বা তারও বেশি মিষ্টি পানীয় পছন্দ করে। অর্থাৎ মিষ্টির প্রতি শিশুদের এই ঝোঁক প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, ছোট শিশুদের পছন্দের চিনির ঘনত্বের যেন কোনো শেষ নেই। অবাক করার মতো বিষয় হলো, বাচ্চারা এমন পানিও পছন্দ করেছে, যা যেখানে পানিতে এত বেশি চিনি মেশানো হয়েছে যে চিনি আর দ্রবীভূত হচ্ছে না।
শিশুদের এই অস্বাভাবিক মিষ্টি পছন্দ করার রহস্য জানতে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে গবেষণা করছেন। সেখান থেকে শত শত গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য। আমাদের সহজাত এই মিষ্টির প্রতি টান কেন এত তীব্র, চলো জেনে নিই বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে কী বলছেন।
আমরা সাধারণত চিনিকে খারাপ হিসেবে দেখি। কিন্তু এর কিছু ভালো দিকও আছে। চিনি আমাদের শরীরকে ক্যালরি সরবরাহ করে, যা পরে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। দ্রুত বেড়ে ওঠার জন্য শিশুদের এই শক্তির খুব প্রয়োজন। এ ছাড়া চিনি আমাদের শরীরে চর্বি জমা করতে সাহায্য করে, যা জরুরি সময়ে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
প্রাচীনকালে মানুষের জন্য বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। সেই সময় যারা বেশি চিনিযুক্ত ফল খেত, তাদের বেঁচে থাকার ও বংশবিস্তার করার সম্ভাবনা বেশি ছিল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেই সব মানুষের জিন পরবর্তী প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এভাবেই মিষ্টির প্রতি আমাদের ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ মিষ্টি খাবার পছন্দ করা আমাদের টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর তাই আমাদের মস্তিষ্কে এই অস্বাভাবিক চাহিদা তৈরি হয়েছে মিষ্টির প্রতি।
সমস্যা হলো, বর্তমান সময়ে চিনির কোনো অভাব নেই। আমরা এখন প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত চিনি গ্রহণ করি, যা একসময় খুব বিরল ছিল। ফল থেকে পাওয়া চিনিতে ফাইবার থাকে, যা আমাদের শরীরের জন্য ভালো। কিন্তু জুস বা ক্যান্ডির মতো প্রক্রিয়াজাত খাবারে সেই ফাইবার থাকে না। ফলে আমরা সহজে অনেক বেশি চিনি খেয়ে ফেলি, যা শরীরের জন্য খারাপ। ফলে আমাদের শরীর যতটা শক্তি পায়, তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না এবং নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হয়।
মূলত আমাদের জিহ্বায় আছে টেস্ট বাড বা স্বাদ গ্রন্থি। এতে বিভিন্ন স্বাদ গ্রহণের রিসেপ্টর আছে। চিনিতে যে হাইড্রোক্সিল গ্রুপ (OH-) থাকে, তা মিষ্টি স্বাদ নেওয়ার রিসেপ্টরের সঙ্গে জুড়ে যায়। এই যুক্ত হওয়ার পদ্ধতির নাম ‘হাইড্রোজেন বন্ধন’। এই বন্ধন গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্নায়বিক সংকেত চলে যায় আমাদের মস্তিষ্কে। ফলে আমরা মিষ্টি স্বাদ পাই।
আর মিষ্টি খাবার খাওয়ার পর মস্তিষ্কে যে আনন্দের অনুভূতি তৈরি হয়, তার পেছনে রয়েছে আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্রের নিবিড় সম্পর্ক। অবাক করা বিষয় হলো, আমাদের জিহ্বার মতোই অন্ত্রেও কিছু স্বাদ গ্রহণকারী কোষ থাকে। এই কোষগুলোর কাজ হলো হজমপ্রক্রিয়া চলাকালীন চিনির আগমন সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা এবং তৎক্ষণাৎ মস্তিষ্ককে তথ্য জানানো। যখন মিষ্টি খাবার খাওয়ার পর রক্তে শর্করার পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যায়, তখন অন্ত্রের কোষগুলো সক্রিয় হয়ে মস্তিষ্কের সংকেত পাঠায়।
এই সংকেত পাওয়ামাত্রই মস্তিষ্ক ডোপামিনের মতো আনন্দের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে। ডোপামিন নিঃসরণের ফলেই আমাদের মধ্যে তীব্র ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়। মস্তিষ্ক তখন এই ভালো লাগাকে একটি ‘পুরস্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করে। আর বারবার সংকেত পাঠাতে থাকে, ‘এই কাজটি আবার করো, আমি এই অনুভূতি চাই।’ এই কারণেই আমরা আরও মিষ্টি খাবার খাওয়ার জন্য এক তীব্র অনুভূতি অনুভব করি প্রতিদিন। কেননা, আমাদের এই মিষ্টির প্রতি ভালো লাগা আরও দৃঢ় হয় অভ্যাসের মাধ্যমে। মস্তিষ্ক খুব দ্রুত খাবারকে বিভিন্ন পরিবেশ বা রুটিনের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলে।
সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান, কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি