রামেন যেভাবে সারা বিশ্বে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল
এক বাটি গরম রামেন। এতে থাকে নরম নুডুলস, সুস্বাদু ঝোল আর ওপরে সাজানো মাংস ও ডিম। রামেনের কথা শুনলেই অনেকের জিভে জল চলে আসে। জাপানের এই সাধারণ খাবারটি এখন আর শুধু জাপানিদের প্রিয় নেই। বরং সারা বিশ্বের ভোজন রসিকদের কাছে এটি এক দারুণ খাবার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু কীভাবে এই সহজ সরল খাবারটি এত দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল? প্রতিটি শহরে, এমনকি ঢাকাতেও এখন এর দেখা মেলে। রামেনের এই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার পেছনের গল্পটি বেশ মজার।
রামেন মূলত এক ধরনের জাপানি নুডুলস স্যুপ। এর মূল উপাদানগুলো হলো গমের তৈরি নুডুলসের সঙ্গে বিভিন্ন স্বাদের ঝোল। যেটা সাধারণত মাংস বা মাছের স্টেক দিয়ে তৈরি করা হয়। সঙ্গে টপিংস হিসেবে মাংস, ডিম, সি-উইড ও সবুজ পেঁয়াজ থাকে। রামেনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর বৈচিত্র্য। জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলে রামেনের স্বাদ ও পরিবেশনে ভিন্নতা দেখা যায়। সেটা একে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
রামেনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এর জন্ম চীনে। ধারণা করা হয়, ১৯ শতকের শেষের দিকে বা ২০ শতকের শুরুর দিকে চীনা অভিবাসীরা তাদের নুডুলস স্যুপ জাপানে নিয়ে আসে। জাপানে এটি ‘চুকা সোবা’ (Chuka Soba) নামে পরিচিতি পায়। এই নামের মানে চীনা নুডুলস ইন স্যুপ। বাংলায় যাকে আমরা বলি স্যুপ নুডলস। জাপানিরা ধীরে ধীরে এই খাবারটিকে নিজেদের মতো করে নিতে শুরু করে। তাঁদের স্থানীয় উপাদান ও স্বাদের সঙ্গে মিশিয়ে নতুন স্বাদ যুক্ত হয় এতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের অর্থনীতি হয়ে পরে বিধ্বস্ত। তখন সস্তা ও পুষ্টিকর খাবার হিসেবে রামেন সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সহজলভ্য ময়দা ও স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে তৈরি এই খাবারটি দ্রুত ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
তবে, চীনাদের আনা নুডলস আর এখনকার জাপানি রামেন এই দুটো কিন্তু একেবারেই আলাদা জিনিস। প্রায় ১০০ বছর আগে যখন জাপানে প্রথম চীনা রামেন আসে তখন জাপানিদের কাছে উডন (Udon) ও সোবা (Soba) নামের নুডলস বেশ পুরোনো ছিল। জাপানে এই দুই ধরনের নুডলসের প্রায় ৪৫০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। অর্থাৎ, রামেন আসার শতবছর আগে থেকেই জাপানে নুডলস খাওয়ার একটা নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল। আর এই কারণেই জাপানে এমন এক ধরনের রামেন তৈরি হলো, যেখানে জাপানের নিজস্ব নুডলস ঐতিহ্যের প্রভাব দেখা যায়। আর এভাবেই এটি চীনা নুডলস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা পরিচয় পেল।
রামেনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এর অসংখ্য ধরনের স্বাদ। এত ধরনের স্বাদ পেতে একজন বারবার রামেন খেয়ে থাকে। মূলত এর জন্যেই সবাই এর প্রতি এত আকৃষ্ট। রামেনের জগতে রয়েছে নানা প্রকার ও ধরনের রামেন। যা থেকে গড়ে উঠেছে বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত অনেক রেস্তোরাঁ।
বিশ্বের জনপ্রিয় রামেনের মধ্যে সবার আগে আসে সাপ্পোরো রামেন (Sapporo ramen) , টোনকোটসু রামেন (Tonkotsu ramen), মিসো রামেন (Miso Ramen), শিয়ো রামেন (Shio Ramen), শোয়ু রামেন (Shoyu ramen) ইত্যাদি।
১৯৫৮ সালে নিসিন ফুডসের প্রতিষ্ঠাতা মোমোফুকু আন্দো ‘চিকেন রামেন’ নামে প্রথম ইনস্ট্যান্ট রামেন বাজারে আনেন। তখন এটি রামেনকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এক বিরাট কাজ করে। খুব কম দামে, সহজে ও দ্রুত তৈরি করা যায় বলে ইনস্ট্যান্ট রামেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে কলেজ শিক্ষার্থী ও ব্যস্ত চাকরিজীবীদের কাছে। ধারণা করা হয় এখান থেকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রামেনকে আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাত করা শুরু করে। এখন বাংলাদেশেও বিভিন্ন বড় বড় শপিং মলে বিভিন্ন ধরন ও স্বাদের ইনস্ট্যান্ট রামেন, প্যাকেট রামেন পাওয়া যায়।
২০০০ সালের পর থেকে জাপানি অ্যানিমে, মাঙ্গা, ভিডিও গেমস ও পপ কালচার বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পায়। মনে করা হয় এটা থেকেও রামেন বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। অনেক জনপ্রিয় অ্যানিমে বা কার্টুনে রামেন খাওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। যেমন, নারুতোর প্রিয় খাবার ইচিরাকুর রামেন।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ইয়ামোতো নুডলস, ওটাকু রামেন এবং উইকিপিডিয়া