যে বনসাইয়ের দাম ১৬ কোটি টাকা
একটা বিশাল বটগাছকে ছোট্ট একটা টবে ঘরের ভেতর বামন বানিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যাপারটা আসলে অবিশ্বাস্য। বামন আকৃতির এই গাছের জন্ম কোথায়? বন-জঙ্গলে কি এরা এমন করে জন্মায়? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, কেন একটা বনসাইয়ের দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়?
বনসাই হলো গাছকে ছোট করে রাখার এক বিশেষ শিল্প। এটি জাপানি শব্দ, যেখানে ‘বন’ (Bon) মানে ‘পাত্র’ আর ‘সাই’ (Sai) মানে ‘বোনা’ বা ‘রোপণ করা’। অর্থাৎ, পাত্রে গাছ রোপণ করে তাকে ছোট আকৃতিতে রাখা হলো বনসাই।
বনসাই আসলে ছোট কোনো সাধারণ গাছ নয়। এটি দেখতে বড় গাছের মতোই, তবে আকারে অনেক ছোট। শিল্পীরা কিছু বিশেষ পদ্ধতি মেনে গাছগুলোকে এমন ছোট করে রাখে। এর জন্য তারা গাছের ডালপালা ছাঁটেন, শেকড় কাটেন, তার দিয়ে ডালকে সুন্দর আকার দেন। বিশেষ ধরনের পাত্রে রোপণ করেন।
এখন পর্যন্ত বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি বনসাই গাছটি হলো একটি ৮০০ বছরের পুরোনো জাপানি সাদা পাইন। ২০১১ সালে এশিয়া-প্যাসিফিক বনসাই ও সুইসেকি কনভেনশন ও প্রদর্শনীতে ওই গাছটি বিক্রি হয় ১০ কোটি জাপানি ইয়েনে। যার মূল্য ডলারে ১.৩ মিলিয়ন এবং টাকায় প্রায় ১৬ কোটি। গাছটি দেখতে বেশ বড়, এর কাণ্ডগুলো খুব সুন্দর এবং গাছটাও বেশ তরতাজা।
বনসাই শিল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো একটি সম্পূর্ণ গাছকে প্রকৃতির মতো করে একটি ছোট স্থানে জন্য বড় করে তোলা। যেখানে গাছের বয়স বাড়লেও আকার থাকবে ছোট। বনসাই শিল্পীরা বলেন, ‘বনসাই হলো ধৈর্য, শিল্পকলা ও প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রতীক। এটি শুধু একটি গাছ নয়, এটি একটি জীবন্ত ভাস্কর্য।’
নামটা জাপানি হলেও বনসাই শিল্পের শুরুটা কিন্তু জাপানে নয়। এটা শুরু হয় প্রাচীন চীনে। প্রায় ২ হাজার বছর আগে চীনে ‘পেনজিং’ (Penjing) নামে এক ধরনের শিল্পকলা প্রচলিত ছিল। এই পেনজিং-এর মাধ্যমে ছোট পাত্রে প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হতো। যার মধ্যে গাছ, পাথর ও মাটি থাকত। চীনের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এই শিল্পকে আধ্যাত্মিক ও প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মাধ্যম হিসেবে দেখতেন।
নবম শতাব্দীর দিকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হাত ধরে এই পেনজিং শিল্প চীন থেকে জাপানে আসে। জাপানে এসে এটি ‘বনসাই’ নামে নতুন রূপ নেয়। পরে এটিই একটি স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে বিকশিত হয়। জাপানিরা পেনজিং থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গাছকে আরও সহজ করে বানানো শুরু হয়। জাপানিদের কাছে বনসাই হলো ধৈর্য ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাপানে বনসাই এক অভিজাত শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তখন থেকে বনসাই জাপানের সামুরাই যোদ্ধা ও সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বনসাই তৈরি করা কোনো জাদু নয়। এটা একটা বৈজ্ঞানিক ও লম্বা সময়ের প্রক্রিয়া। একটা সাধারণ ছোট গাছকে বনসাই বানাতে কিছু বিশেষ টেকনিক ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে আছে নিয়মিত গাছের ডালপালা ছাঁটা। যাতে গাছ লম্বা না হয়ে ছোট থাকে। এতে শিল্পী পছন্দের আকার দিতে পারে। একই কারণে শেকড়ও কাটা হয়। যেন পাত্রের ভেতর বেশি বড় না হয়। এভাবে গাছের বেড়ে ওঠা বন্ধ থাকে এবং পাতা ছোট থাকে। গাছের ডালপালাকে তার দিয়ে বেঁধে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হয় যেন দেখতে প্রাকৃতিক গাছের মতো লাগে। বনসাইকে বিশেষ ধরনের অগভীর আর চ্যাপ্টা পাত্রে লাগানো হয়। এতে শেকড় বেশি বাড়তে পারে না। আর মাটি ও সারও খুব কম পরিমাণ করে ব্যবহার করা হয়। এভাবে গাছ যতটুকু দরকার ততটুকু পুষ্টি পায়, বেশি বড় না হয়।
একটি বনসাইয়ের দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। গাছ যত পুরোনো আর বিরল জাতের হবে, এর দাম তত বেশি হবে। শত শত বছরের পুরোনো বনসাইগুলোকে সাধারণ গাছ না বলে এক একটা শিল্পকর্ম হিসেবে দেখা হয়। একটা সুন্দর বনসাই তৈরি করতে একজন শিল্পীর অনেক বছরের দক্ষতা ও প্রচুর পরিশ্রম লাগে। তাই, যিনি যত দক্ষ, তার তৈরি বনসাইয়ের চাহিদা ও দাম তত বেশি হয়।
বনসাইয়ের আকার, ডালপালার সাজানো ধরন, কাণ্ডের গঠন এবং সম্পূর্ণ গাছটি দেখতে কতটা প্রাকৃতিক ও সুন্দর লাগছে—এগুলোও দামের ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে জাপানের ঐতিহ্যবাহী স্টাইলে তৈরি বনসাইগুলো খুব মূল্যবান হয়। কিছু গাছের প্রজাতি এমনিতেই বিরল ও এদের যত্ন নেওয়া কঠিন। এমন গাছের বনসাইয়ের দাম স্বাভাবিকভাবেই বেশি হয়। কিছু বনসাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসে, যার একটা ঐতিহাসিক মূল্য থাকে। এই ঐতিহাসিক গুরুত্ব এদের দাম অনেক বাড়িয়ে দেয়।
হাজার বছর বেঁচে থাকা এমনই একটি বিখ্যাত বনসাই হলো ইতালির ক্রিসপি বনসাই মিউজিয়ামে থাকা ‘ফিকাস রেটুসা লিন’ (Ficus Retusa Linn)। এই বনসাইটি পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক গাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি মিউজিয়ামের প্রধান আকর্ষণ। এছাড়া জাপানেও ‘সর্জেন্ট জুনিপার বনসাই’ নামে আরেকটি হাজার বছরের পুরোনো বনসাই গাছ রয়েছে। যেটা কাটো পরিবারের মালিকানাধীন মানসেই-এন বনসাই নার্সারিতে রাখা আছে। এগুলো আসলে অমূল্য।
বাংলাদেশেও বিভিন্ন বৃক্ষমেলায় বনসাই বিক্রি হয়। যেগুলোর দামও আসলে লাখ টাকা।
সূত্র: বনসাই সেন্টার, বিজনেস ইনসাইডার এবং ইয়াহু লাইফস্টাইল