মায়ের জন্য আলাদা উপহার কেনা হয়ে ওঠেনি
মাকে নিয়ে ভাবার মতো বা লেখার মতো ইচ্ছা বছরে একবারই আসে। যখন চারপাশে মা দিবসের উদ্যাপন শুরু হয়, ছোট থেকে বড় সব বাচ্চাই মায়ের জন্য কিছু না কিছু উপহার নিয়ে আসে। কেউ ফুল কেনে, কেউ কার্ড বানায়, কেউ আবার মায়ের পছন্দের খাবার তৈরি করে। কিন্তু আমার জীবনে এমন কোনো বিশেষ আয়োজনের সুযোগ আসেনি। মনের কথাগুলোও মাকে বলতে পারিনি—কখনো নার্ভাসনেস, কখনো–বা অপ্রকাশিত অনুভূতির কারণে।
প্রথমবার মা দিবসের কথা জানতে পারি ক্লাস ফোরে পড়ার সময়। এক বান্ধবী বলেছিল, ‘এই দিনে মাকে উপহার দিতে হয়।’ সেই ছোট্ট মনে ততটাই ধারণা হয়েছিল যে মাকে খুশি করতে হলে এই বিশেষ দিনেই কিছু দিতে হবে। সেদিন নিজের জমানো টাকায় মায়ের জন্য ছোট্ট একটা উপহার নিয়ে যাই। আম্মু উপহারটা খুশিমনে নিলেও বলেছিল, ‘মায়ের কথা সারা বছরে এক দিনই তোর মনে পড়ল?’ খুব ছোট হলেও তার এ কথাটা আমার হৃদয়ে গেঁথে যায়। আসলেই তো, কেন আমরা মা দিবসে মাকে নিয়ে এত মাতামাতি করি? কেন সারা বছর ধরে মায়ের ভালোবাসা উদ্যাপন করতে পারি না?
এর পর থেকে আর কোনো বিশেষ দিনে মায়ের জন্য আলাদা উপহার কেনা হয়ে ওঠেনি। তবে প্রতিদিনই মায়ের কাজে একটু সাহায্য করে, কলেজ থেকে ফেরার পথে তার পছন্দের ফুল বা ছোলা মাখা নিয়ে এসে গোপনে বলি, ‘আম্মু, মা দিবসের শুভেচ্ছা।’ জানি না, আম্মু টের পায় কি না। হয়তো বুঝেও না বোঝার ভান করে।
আমারও মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হয় মাঝেমধ্যে। মায়ের মুখে তখনই শোনা যায় সেই বাঙালি মায়েদের জাতীয় সংলাপ—‘মা যখন থাকবে না, তখন বুঝবি।’ কথাটা শুনে রাগে বুকটা ফেটে যায়। কারণ, আমি কখনোই ভাবতে পারি না আমার জীবনে মায়ের না থাকার কথা। আম্মু হয়তো ভাবে, আমি তাকে ভালোবাসি না। কিন্তু কীভাবে বলি, তুমি তো আমার একমাত্র অনুপ্রেরণা! সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোতে তুমিই ছিলে পাশে, পরীক্ষার রেজাল্ট একটু খারাপ হলে তুমিই বলেছিলে, ‘পরেরবার ভালো করবি।’
বাবার কাছে কিছু চেয়েও না পেলে তুমিই হাসিমুখে আমার জন্য সেটা এনে দাও। কখনো কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দাওনি—যা চেয়েছি, তাই দিয়েছ। আজ পর্যন্ত দেশ-বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাজ করতে পেরেছি শুধু তোমার নিঃস্বার্থ সমর্থনে। প্রতিযোগিতার প্রস্তাব এলেই তুমি তোমার অল্প অল্প করে জমিয়ে রাখা টাকা দিয়ে আমাকে ওয়ার্কশপে পাঠাও। তখন আমার একটাই লক্ষ্য থাকে—ভালো কিছু করা, যেন তুমি গর্ব করতে পারো।
তুমি আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছ। বলেছিলাম, ভালোমতো পড়াশোনা করব, তোমার সব কথা শুনব। কিন্তু কথা রাখতে পারিনি। জানি, তুমি হয়তো মনে মনে কষ্ট পাও, তবু আমার পছন্দের রান্না ঠিকই করে রাখো। সৃষ্টিকর্তার পর যদি কারও ধৈর্যশীলতার উদাহরণ দেওয়া যায়, তবে তা সন্তানের প্রতি একজন মায়ের ভালোবাসা।
মাঝে মাঝে ভাবি, যদি তুমি না থাকো—কী হবে আমার? আম্মু, তুমি আমার সাহস, আমার শক্তি। তোমার জন্যই আমি সবকিছু করার সাহস পাই। কারণ, জানি তুমি আমার পাশে আছো। জানি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমাকে তুমি মাফ করে দিয়ো। দোয়া কোরো, যেন একদিন সত্যিই সাফল্য অর্জন করে তোমার কথা সবার সামনে বলতে পারি।
তোমাকে অনেক কিছুই বলতে চেয়েছি, কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি। আমি খুবই ভাগ্যবান, তোমার মতো আম্মু পেয়েছি। আজ হয়তো সব বলে শেষ হবে না। কিন্তু আম্মু, তোমাকে আসলেই আমি অনেক ভালোবাসি।
তোমার আয়ু আরও হাজার বছর বাড়ুক। তোমাকে নিয়ে যে দেশ-বিদেশ ঘোরা এখনো বাকি। তোমাকে নিয়ে যে আমার অনেক স্বপ্ন ।
সামিরা জাহান
সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, ঢাকা