রোনালদোকে ‘বিদায় করা’ কোচ টিকলেন মাত্র তিন ম্যাচ

‘এবার আমি একটু শান্তিতে ঘুমাব’—ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দল থেকে ছাঁটাই করার পর এমনই এক মন্তব্য করেছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তৎকালীন কোচ এরিক টেন হাগ। রোনালদোর বিশাল ক্যারিয়ারে দাগ ফেলার মতো ঘটনা ছিল সেই একটাই। হেভিওয়েট কোচদের অধীন থেকেও রোনালদোকে বসতে হয়নি বেঞ্চে। যেখানে এরিক টেন হাগ রোনালদোকে নিয়ে করেছিলেন নতুন ‘এক্সপেরিমেন্ট’। সেই কোচই কিনা নতুন দলে গিয়ে বরখাস্ত হলেন মাত্র তিন ম্যাচের মাথায়। সেটাও আবার লিগের রেকর্ড গড়ে।

ডাচ কোচ এরিক টেন হাগের সামনে দায়িত্বটা ছিল বিশাল। শাবি আলোনসো রীতিমতো ইতিহাস গড়েছিলেন বায়ার লেভারকুসেন দলকে নিয়ে। বায়ার্ন মিউনিখের রাজত্ব ভেঙে জিতেছিলেন বুন্দেসলিগা, সেটাও আবার অপরাজিত থেকে। রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব নিতে আলোনসো যখন লেভারকুসেন ছাড়লেন, তখন তথৈবচ অবস্থা হয়েছিল লেভারকুসেন বোর্ডে। যোগ্য কোচ খুঁজে পাওয়ার লড়াইয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন টেন হাগ। আয়াক্সের ‘ড্রিম টিম’ নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনাল খেলা কোচের ওপর ভরসা রেখেছিল লেভারকুসেন। কিন্তু সেই আশা উবে গেছে লিগ শুরু হতে না হতেই।

আরও পড়ুন
ইউনাইটেডে থাকাকালীন রোনালদোকে বাদ দিয়ে দল গড়তে চেয়েছিলেন টেন হাগ।
ছবি: এক্স

টেন হাগের অধীন মাঠের লেভারকুসেন যেন হারিয়েই গিয়েছিল। মাঝমাঠ ধরে রেখে যে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিয়েছিলেন শাবি আলোনসো, টেন হাগ তার ছিটেফোঁটাও দিতে পারেননি। বরং নিজের দর্শন চাপাতে চেয়েছেন দলের ওপর। সেটাও কাজে দেয়নি। এর প্রমাণ প্রথম ম্যাচটাই। ব্রাজিলিয়ান দল ফ্ল্যামেঙ্গোর অনূর্ধ্ব-২০ দলের কাছে ৫-১ গোলে হেরে শুরু হয়েছিল তাঁর লেভারকুসেন ক্যারিয়ার। অনেকেই আন্দাজ করেছিলেন, টেন হাগের কপালে শনি লেখা আছে।

টেন হাগের ভাগ্যও যে খুব একটা প্রসন্ন ছিল, তা–ও নয়। তিনি এসেছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন লেভারকুসেনের ড্রিম টিম ভাঙতে শুরু করেছে। শাবি আলোনসো যে দলটাকে একত্র করে রেখেছিলেন, স্বপ্নজয় করেছিলেন যাঁদের নিয়ে, তাঁদের কেউই আর বর্তমান দলে নেই। মাঝমাঠের তারকা ফ্লোরিয়ান রিৎজ পাড়ি দিয়েছেন লিভারপুলে। তাঁকে সঙ্গে গেছেন রাইটব্যাক জেরেমি ফ্রিমপং। গ্রানিত শাক যোগ দিয়েছেন সান্ডারল্যান্ডে, আমিন আদলি যোগ দিয়েছেন বোর্নমাউথে। এমনকি মূল গোলরক্ষক লুকাস রাদেস্কিও যোগ দিয়েছেন মোনাকোতে। জোনাথন টাহ, ওদিলন কসুনু পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছেন ভিন্ন দলে। স্ট্রাইকার ভিক্টর বনিফেসের সঙ্গে মিলানের চুক্তিও হয়ে গিয়েছিল, মেডিকেলে ফেল করায় ভেস্তে গেছে সেই দলবদল। এককথায় শাবি আলোনসোর স্বপ্নের দল শাবির সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে গেছে।

আরও পড়ুন
শাবি আলোনসোর স্বপ্নের দল ভেঙে গেছে এক মৌসুমেই।
ছবি: এক্স

এই ভঙ্গুর দলকে জোড়া লাগানোর দায়িত্ব ছিল টেন হাগের কাঁধে। একেবারে গোড়া থেকে সবটা শুরু করার দায়িত্ব বোর্ড তুলে দিয়েছিল তাঁর কাঁধে। আয়াক্সেও একই কাজ করেছেন, সফলও হয়েছিলেন। লেভারকুসেন ভেবেছিল, আয়াক্সের সেই টেন হাগকে আবারও ফর্মে পাবে তারা। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। লেভারকুসেন পেল ইউনাইটেডের অফ-ফর্মে থাকা টেন হাগকে। যে টেন হাগ দল গড়তেই ভুলে গেছেন। নইলে বিশাল বাজেট নিয়ে দলবদলের বাজারে নেমে এমন খেলোয়াড়দের কেউ দলে ভেড়ান?

টেন হাগের অধীন তাদের সবচেয়ে বড় ট্রান্সফার ছিলেন লিভারপুলের জ্যারেল কুইনসা। ২২ বছর বয়সী সেন্টার ব্যাককে ৩৫ মিলিয়ন ইউরোতে কিনেছে তারা। অন্যদিকে পিএসভি থেকে কিনেছে মার্কিন মিডফিল্ডার মালিক টিলম্যানকে। তাঁকে কিনতেও লেগেছে ৩৫ মিলিয়ন ইউরো। দুটি দলবদল আপাতদৃষ্টে ভালো মনে হলেও আহামরি কেউ নন। ফেলে যাওয়া শূন্যস্থানগুলো পূরণে দরকার ছিল যোগ্য এবং পরিচিত নাম। যাঁদের যেমন অভিজ্ঞতা আছে, তেমনি তরুণ দলকে সামনে থেকে নেতৃত্বও দিতে পারবেন। কিন্তু এর কোনোটাই হয়নি। বরং তরুণ খেলোয়াড়েরা ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছেন টেন হাগের অধীনে এসে।

আরও পড়ুন
লিভারপুল থেকে রেকর্ড মূল্যে জ্যারেল কুইনসাকে কিনেছে লেভারকুসেন।
ছবি: এক্স

যার প্রমাণ মিলেছে প্রথম তিন ম্যাচেই। শাবির সাজানো বাগান যেন ছন্নছাড়া টেন হাগের অধীন। তাঁর অধীন তিন ম্যাচ খেলেছে লেভারকুসেন। প্রথম ম্যাচে চতুর্থ ডিভিশনের একটি দলের সঙ্গে জিতেছে ৪-০ গোলে। দ্বিতীয় ম্যাচে ১-২ গোলে হেরেছে হফেনহেইমের কাছে। আর তৃতীয় ম্যাচে এগিয়ে থেকেও ১০ জনের ভেরডার ব্রেমেনের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে ২ গোল হজম করে করেছে ৩-৩ গোলে ড্র। খেলার ধরন দেখে আর দেরি করেনি লেভারকুসেন বোর্ড। বরখাস্ত করেছে টেন হাগকে।

দিনের হিসাবে মাত্র ৬২ দিন লেভারকুসেনের দায়িত্ব পালন করেছেন টেন হাগ, ম্যাচের হিসাবে মাত্র তিনটি। জার্মান লিগের ইতিহাসে এটা এক নতুন রেকর্ড। এর আগে এত কম সময়ে বরখাস্তের চিঠি জমা পড়েনি কারও নামে। দলবদলের শেষ দিনে খেলোয়াড়দের বিদায় ঘণ্টা বাজে, সেখানে কোচ হিসেবে বিদায় নিয়ে যেন নতুন এক ইতিহাস গড়লেন এরিক টেন হাগ।

আরও পড়ুন