সাত সাগর পাড়ি দিয়ে সৈকত যেভাবে আইসিসির এলিট প্যানেলের আম্পায়ার
বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নাম ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল, সংক্ষেপে আইসিসি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব আইন ও নিয়ম ঠিক করে আইসিসি। আবার কোন দেশ কার সঙ্গে ম্যাচ খেলবে, সেটাও আইসিসির এখতিয়ারে। এমনকি আন্তর্জাতিক টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে কে আম্পায়ার হবেন, সেটিও নির্ধারণ করে আইসিসি।
আইসিসি সারা বিশ্ব থেকে বেছে বেছে আম্পায়ারদের একটা তালিকা তৈরি করেন। এটাকে বলা হয় আইসিসির আম্পায়ারদের এলিট প্যানেল। আর এই প্যানেলে থাকা আম্পায়াররাই আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো পরিচালনা করে থাকেন।
আইসিসির এই এলিট প্যানেলে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র আম্পায়ার হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছেন শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ ওরফে সৈকত। আজকে বলব শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ সৈকতের আইসিসির প্যানেল আম্পায়ার হওয়ার গল্প।
ময়মনসিংহের ছেলে সৈকতের বেড়ে ওঠা কিন্তু রাজশাহীতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বল ও ব্যাট হাতে ক্রিকেট খেলতে খেলতে একদিন জাতীয় দলের খেলোয়াড় হয়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু চোটের কারণ দলে নিয়মিত হতে পারেননি। পড়ালেখায় অত্যন্ত মেধাবী সৈকত শুধু ক্রিকেট নয়, ক্রিকেটের আইনকানুনের প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন শুরু থেকেই। এর একটা কারণ স্কুল, কলেজ কিংবা বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া।
বারবার চোটের কারণে যখন জাতীয় দলের দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, তখন সৈকত উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাজ্যে গেলেন।
শিক্ষা লাভের মাঝপথে অনেক শিক্ষার্থী যখন লন্ডনে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, তখন সৈকত আবার দেশে ফিরে এলেন ক্রিকেটের টানে।
এখনকার রবি আর তখনকার মোবাইল কোম্পানি একটেল একবার করপোরেট লিগে দল গঠন করে। সেই দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় ছিলেন সৈকত।
সৈকতের শিক্ষা ও আচরণ দেখে একটেল তাঁকে কোম্পানিতে এক্সিকিউটিভ হিসেবে নিয়োগ দেয়। আকর্ষণীয় বেতন আর করপোরেট জীবনের ভবিষ্যৎ তখন তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, কিন্তু সৈকত বুঝলেন যে এখানে থাকতে হলে তাঁকে ক্রিকেট ছাড়তে হবে।
ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসায় সৈকত একসময় চাকরিই ছেড়ে দিলেন। যোগ দিলেন বিসিবিতে। মনোযোগ দিলেন আম্পায়ারিংয়ে।
সে সময় ক্রিকেটে ঠিক করপোরেটজগতের মতো অর্থের ঝনঝনানি ছিল না, কিন্তু খেলার মাঠে থাকার আনন্দটাই তাঁকে এক অন্য রকম তৃপ্তি এনে দিল। মনোযোগ আর সততার সঙ্গে আম্পায়ারিং শুরু করলেন তিনি। যদিও এতে অন্য এক সমস্যার মুখোমুখি হতে হলো সৈকতকে।
যেহেতু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন রাজনীতিমুক্ত নয়, সে কারণে অনেকেই চাইতেন সৈকত যেন বিশেষ বিশেষ ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে না থাকেন। কারণ, সৈকত কোনো দল বা কারও পছন্দের খেলোয়াড়ের পক্ষে বা বিপক্ষে আম্পায়ারিং করতেন না। তিনি শুধু তখনই আঙুল তুলতেন, যখন সেটি তাঁর কাছে সত্যিকারের আউট বলে মনে হতো।
সৈকতের সততা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আসা বিদেশি আম্পায়ারদের নজর এড়ায়নি, তার চেয়ে যেটা বেশি তাঁদের নজর কেড়েছিল, সেটা হচ্ছে আম্পায়ার হিসেবে সৈকতের দক্ষতা।
আইসিসির আম্পায়ার্স প্যানেলের সঙ্গে কাজ করতেন—এমন এক অস্ট্রেলীয় বিষয়টি খেয়াল করে আম্পায়ার সৈকতের কথা আইসিসিকে জানালেন।
এরপর আইসিসির বিশ্বমানের বিভিন্ন টুর্নামেন্ট, যেমন ওমেন্স ওয়ার্ল্ড কাপ, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ পরিচালনা করার সুযোগ দেয় সৈকতকে। আর প্রতিটি টুর্নামেন্টে সৈকত প্রমাণ করেন, তিনি দক্ষ আম্পায়ার হিসেবে অনেক দূর পাড়ি দিতে সক্ষম।
২৮ মার্চ ২০২৪ আইসিসি ঘোষণা করে, বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ ওরফে সৈকতকে আইসিসির আম্পায়ারদের এলিট প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার আম্পায়ার মারাইস এরাসমাসের অবসরে আইসিসির এলিট আম্পায়ার্স প্যানেলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেটি পূরণ করতে আইসিসি সৈকতকে এলিট প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করে।
সৈকতের জন্য এটা ছিল অর্জনের শেষ নয়, কেবল শুরু। এরপর সৈকত আইসিসির তরফ থেকে খেলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রতিবার প্রতিটি ম্যাচে প্রমাণ করেছেন, তিনি একজন টাইগার আম্পায়ার। তিনি এমন সব আউট দিয়েছেন, যা দিতে সাহসের প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত যতবার তিনি আঙুল তুলেছেন অথবা কোনো জটিল পরিস্থিতিতে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, অধিকাংশই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের কাছে কুড়িয়েছে প্রশংসা। কয়েক মাস আগে ভারত-ইংল্যান্ডের হাই ভোল্টেজ ম্যাচে দুর্দান্ত আম্পায়ারিং করেছিলেন সৈকত। চলতি অ্যাশেজেও তাঁর আম্পায়ারিং নজর কেড়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের।
ভবিষ্যতেও সৈকত যে তাঁর আম্পায়ারিংয়ের এই সুনাম ধরে রাখতে পারবেন, সেটা আমরা বলতে পারি। কারণ, তিনি আউটের আপিল করা দলের অধিনায়ককে বলতে পারেন, ‘তাঁদের রিভিউ নিতে দাও, কিন্তু আমি বলছি, যেটাকে আমি আউট দিয়েছি, সেটা আউটই হবে।’