ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নরাই ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে
‘বিশ্বকাপ’ নামটার মধ্যেই জড়িয়ে আছে আভিজাত্য আর গৌরব। হোক সেটা ক্রিকেট, ফুটবল কিংবা অন্য যেকোনো খেলা। বিশ্বসেরা হওয়ার বাসনা কার মধ্যে না থাকে? এত দিন ধরে ফুটবল পায়ে যে লড়াই হয়ে এসেছে দেশগুলোর মাঝে, সেই ফরম্যাটটাকে নতুন মোড়কে নিয়ে এসেছিল ফিফা। তবে সেটা ক্লাবগুলোর জন্য। ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে দামি শিরোপার পর্দা নামতে যাচ্ছে আজ। প্রথম মৌসুমের ফাইনালে ঘুরেফিরে জায়গা করে নিল এই মৌসুমের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন দুই দল!
ক্লাব বিশ্বকাপকে শুরু থেকেই ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছিল বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট হিসেবে। ইউরোপিয়ান ফুটবলের ভক্তদের মধ্যে ইউরোপের দিলগুলো নিয়ে যে পরিমাণ আগ্রহ ও উত্তেজনা, ইউরোপের বাইরের দলগুলো সে তুলনায় কিছুটা আড়ালেই থেকে যায়। ফিফার উদ্দেশ্য ছিল সেই দলগুলোকেও সামনের সারিতে নিয়ে আসা। নিয়মিত ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখা দর্শকদের জানাও হয় না, ইউরোপের বাইরের ফুটবল ঠিক কতটা রোমাঞ্চকর। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের পুরোনো ফরম্যাট সে লড়াই হওয়ার সুযোগই দিত না। নতুন টুর্নামেন্ট কতটা সফল, সে প্রশ্ন না হয় আরেক দিনের জন্য থাকল। আজকের লেখাটা এই বিশ্বকাপের দুই ফাইনালিস্টকে নিয়ে। চেলসি আর পিএসজি। মজার ব্যাপার হলো, এই মৌসুমে ইউরোপিয়ান দুই টুর্নামেন্টের শিরোপা ঠাঁই পেয়েছে তাদের ক্যাবিনেটে।
পিএসজির কথা দিয়েই শুরু করা যাক। লুইস এনরিকের অধীনে পিএসজি নতুন করে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে। আর এর সম্পূর্ণ অবদান যেন কিলিয়ান এমবাপ্পের! এমবাপ্পের বিদায়ের পর দলকে পুরোপুরি ঢেলে সাজিয়েছেন এনরিকে। আর তার প্রমাণ মিলছে প্রতি ম্যাচে। প্রতিটি খেলোয়াড় যেন এনরিকের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। গত মৌসুমে ঠিক যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন দলকে নিয়ে, সেটাই সত্যিতে পরিণত হয়েছে। লিগ জিতেছেন, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন এই দল নিয়ে। বিশাল লম্বা একটা মৌসুম শেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখলেন, স্বাভাবিকভাবেই খেলোয়াড়দের ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এনরিকের পরিকল্পনা ছিল অন্য। নিজের খেলোয়াড়দের কীভাবে ফিট আর এনার্জেটিক রাখতে হয়, কখন কাকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা খুব ভালোভাবেই জানা আছে তার। তাই তো ক্লাব বিশ্বকাপে তাদের যাত্রা হয়ে রইল অবিস্মরণীয়।
প্রথম ম্যাচেই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদকে উড়িয়ে দিলেন ৪-০ গোলে। পরের ম্যাচে রীতিমতো চূড়া থেকে পতন। ব্রাজিলিয়ান ক্লাব বোতাফোগোর কাছে ১-০ গোলে হার। দীর্ঘ মৌসুম কাটিয়ে ছন্দপতন হয়েছে, এমনটাই ভাবনা ছিল অনেকের। কিন্তু সিয়াটেল সোন্ডার্সকে হারিয়ে শীর্ষে থেকেই গ্রুপ পর্ব শেষ করল পিএসজি। শেষ ষোলোতে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ালেন তাদেরই সাবেক খেলোয়াড় লিওনেল মেসি। স্বাগতিক ইন্টার মায়ামিকে কোনো পাত্তাই দিল না পিএসজি। ৪-০ গোলের বিশাল জয় এল তাদের বিপক্ষেও।
কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা বায়ার্নের সঙ্গে। এই বায়ার্নের কাছেই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হারের স্বাদ পেয়েছিল পিএসজি। প্রতিশোধের একটা সুবর্ণ সুযোগ আছে এবার, একেবারে বিশ্বের সেরা মঞ্চে। ২-০ গোলে জিতে নিজেদের নামটা উজ্জ্বল করল এনরিকের শিষ্যরা। যদিও ম্যাচের শুরুতেই জামাল মুসিয়ালার চোট বদলে দিয়েছিল অনেকগুলো সমীকরণ। গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি ডোনারোমা রীতিমতো নিজেকে সামলেছেন চোটের ভয়াবহতা দেখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়-পরাজয়ের লড়াইয়ে মাথা উঁচু করে মাঠ ছেড়েছে পিএসজি।
সেমিফাইনালে দেখা হলো আরেক প্রাক্তনের সঙ্গে। এই প্রাক্তনের সঙ্গে অবশ্য বনিবনা হয়নি, রীতিমতো কোর্ট–কাছারি করতে হয়েছে পিছু ছাড়তে। সেই কিলিয়ান এমবাপ্পেকে যেন দেখিয়ে দেওয়ার ছিল পিএসজির। প্যারিসের খেলোয়াড় থেকে কোচ, প্রতিটি দর্শক তৈরি ছিল প্রতিশোধের জন্য। আর সেই সুযোগ করে দিয়েছে স্বয়ং রিয়াল মাদ্রিদই। নখদন্তহীন আক্রমণের সঙ্গে ডিফেন্সের বিশাল ভুল। পিএসজি সহজেই পেরিয়ে গেল রিয়াল মাদ্রিদ বাধা। পুরো ফাইনাল পর্যন্ত একটা দলই ছিল যারা পিএসজির পথের কাঁটা হতে পারত। তাদের অনায়াসে উড়িয়ে দিয়ে পিএসজি প্রমাণ করল; বিশ্বজয়ের লক্ষ্যেই এসেছে তারা। নইলে এক টুর্নামেন্টে তিনটি ভিন্ন দলকে ৪ গোল দেওয়া কি মুখের কথা?
পিএসজি যেভাবে ইউরোপিয়ান রথী-মহারথীদের ঘোল খাইয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে এসেছে, চেলসির গল্পটা তার ঠিক উল্টো। ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনাল পর্যন্ত বড় কোনো প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে হয়নি বললেই চলে ব্লুজদের। উল্টো সংবাদ সম্মেলনে মুখ খুলে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরেছেন কোচ এনজো মারেসকা। গ্রুপ পর্বে চেলসি শুরু করেছিল এলএএফসির বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতে। কিন্তু পরের ম্যাচেই তাদের ধাক্কা দেয় ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লামেঙ্গো। ৩-১ গোলে হেরে গ্রুপ পর্বে ধাক্কা খায় ইংলিশ ক্লাবটি। পরের ম্যাচে তিউনিসিয়ান ক্লাব তুনিসের বিপক্ষে ৩-০ গোল জিতে ট্র্যাকে ফেরে তারা। রাউন্ড অব সিক্সটিনে ৪-১ গোলে হারায় বেনিফিকাকে। কোয়ার্টার ফাইনালে আবারও ব্রাজিলিয়ান প্রতিপক্ষ। তাদের সামনে আর হোঁচট খায়নি চেলসি। ২-১ গোলে হারিয়ে নিশ্চিত করে সেমির পথ।
সেমিফাইনালের আগে নিজেদের লম্বা শিডিউল নিয়ে কথা বলছিলেন কোচ মারেসকা। কীভাবে এই মৌসুমে খেলা ৬৩ ম্যাচ তাদের দলও খেলোয়াড়দের ফিটনেসের ওপর বাজে প্রভাব ফেলছে। বিপরীতে তাঁকে এক সাংবাদিক জানান, সেমির প্রতিপক্ষ ফ্লুমিনেন্স এই মৌসুমে খেলেছে ৭০ ম্যাচ। মারেসকার মুখে তখন আর কোনো শব্দ ছিল না। ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। চেলসি খেলোয়াড়েরা ভুল করেনি। ফ্লুমিনেন্সকে ২-০ গোলে হারিয়ে উঠে এসেছে ফাইনালে এই মৌসুমের কনফারেন্স কাপজয়ী চেলসি।
ক্লাব বিশ্বকাপের প্রথম আসর নিয়ে অনেক আশা ছিল ভক্তদের মধ্যে। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন এখানে হয়তো ইউরোপিয়ান আধিপত্য দেখা যাবে না। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই মৌসুমে ইউরোপিয়ান মঞ্চে ট্রফি জেতা দুই ক্লাবকেই লড়তে দেখা যাবে স্বর্ণালি শিরোপার জন্য। নতুন হোক আর পুরোনো, বিশ্বকাপ নামের তো একটা মর্যাদা আছে। সেই মর্যাদার লড়াইয়ে কে জেতে, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে আজ রাতেই।