যে টুর্নামেন্টে ব্যবহার করা হয় প্রায় ৫৫ হাজার বল
‘উইম্বলডন’ নামটার মধ্যেই জড়িয়ে আছে আভিজাত্য। বছরে টেনিসের চারটি গ্র্যান্ড স্লাম। প্রতিটির নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের দেশের নাম, যুক্ত আছে ওপেন। যেমন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ইউএস ওপেন ও ফ্রেঞ্চ ওপেন। কিন্তু উইম্বলডন স্বতন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টেনিস ইতিহাসে। এ শুধু র্যাকেট আর বলের লড়াই নয়—বরং ঐতিহ্যের মিলনমেলা। কিন্তু কেন উইম্বলডনকে এত উঁচুতে রাখা হয়? উইম্বলডন ফাইনালের আগে সেই রহস্য আর মজার কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক একনজরে।
সাদা পোশাকে কড়াকড়ি
গ্র্যান্ড স্লাম এলেই ভক্তদের নজর থাকে প্রিয় খেলোয়াড়ের পোশাকের দিকে। উইম্বলডন সেদিক থেকে একেবারে ব্যতিক্রম। উইম্বলডনে খেলতে হবে সাদা পোশাক পরেই। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে টেনিসের আভিজাত্য। ঠিক টেস্ট ক্রিকেটের মতো। একসময় ধনী লোকেদের খেলা ছিল টেনিস। নিয়মিত ধবধবে সাদা পোশাক পরতে পারতেন তাঁরা। ধনীদের খেলায় যাতে অন্য কেউ প্রবেশ করতে না পারে, তাই নিয়ম করে দেওয়া হয় ধবধবে সাদা পোশাক পরার। যে নিয়ম এখনো ধরে রেখেছে উইম্বলডন। টুর্নামেন্টের আগে প্রতিটি খেলোয়াড়ের পোশাক পর্যবেক্ষণ করা হয়, পাস মার্ক পেলেই তবে সেই পোশাক পরতে দেওয়া হয় তাঁদের।
প্রতি উইম্বলডনে ব্যবহার করা হয় প্রায় ৫৫ হাজার বল
একটা টুর্নামেন্ট খেলতে সর্বোচ্চ কয়টা বল লাগতে পারে? ১৫, ২০? প্রতি ম্যাচের জন্য উইম্বলডনের বরাদ্দ থাকে ৩০ থেকে ৪০টি বল। ম্যাচের দৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে বলের সংখ্যা কম–বেশি হয়। আর পুরো টুর্নামেন্টের জন্য? ৫৪,২৫০টি! এই বলগুলো শুধু ম্যাচের জন্য নয়, ব্যবহার করা অনুশীলনের জন্যও। মজার ব্যাপার হলো, বলগুলো যাতে ঠিকঠাক থাকে তাই সেগুলোকে ঠিক ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। ম্যাচ শুরু হলে প্রথম সাত গেমের পর বলগুলো বদলে ফেলা হয়, তারপর প্রতি নয় গেম পরপর নতুন বল আসে। খেলা শেষে এই বলগুলো আবার ব্যবহার করা হয়। আবার চাইলে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কিনেও নিতে পারবে।
২৫০ জন বল বয়
প্রতিটি কোর্টের দুই পাশে দুজন বল বয় দাঁড়িয়ে থাকেন ঠায়। বেশির ভাগ বল বয়ই আসে আশপাশের টেনিস একাডেমি থেকে, খেলার পাশাপাশি খেলোয়াড়দের কাছ থেকে দেখতে। কিন্তু উইম্বলডন এর ব্যতিক্রম। প্রায় ২৫০ জন ছেলে-মেয়েকে উইম্বলডনের বল বয় ও গার্লস হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কয়েক মাসের ট্রেনিং শেষে তাদের পাঠানো হয় কোর্টে।
ঘাসের প্রতি ভালোবাসা
টেনিস–দুনিয়ায় একমাত্র উইম্বলডনই খেলা হয় প্রাকৃতিক ঘাসের মাঠে। আর এই ঘাসের যত্নআত্তিও হয় বিশাল আয়োজন করে। শীতকালে এর পুরোটাই ঢাকা থাকে তুষারে। আস্তে আস্তে জন্মায় ঘাস। টুর্নামেন্ট চলাকালীন প্রতিদিন ঘাসগুলোকে মেপে ঠিক ৮ মিলিমিটার উচ্চতায় কাটা হয়। প্রাকৃতিক ঘাসে খেলা হয় বলেই ২০২০ উইম্বলডন কোভিড শেষ হওয়ার পর খেলানো সম্ভব হয়নি।
বাজপাখির নিরাপত্তা
প্রাকৃতিক ঘাসে খেলা, আর পাখি আসবে না এমনটা কি হয়? উইম্বলডনের সবুজ মাঠে পায়রাদের উৎপাত একেবারে শুরু থেকেই। আর জানোই তো, টেনিস ম্যাচে একটা শব্দও খেলোয়াড়দের মনোযোগ ছিটকে দিতে পারে। যে কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত পাখির ব্যাঘাত থেকে বাঁচতে রয়েছে এক বিশেষ কর্মী—তার নাম রুফাস, একটি হ্যারিস বাজপাখি! টুর্নামেন্টের প্রতিদিন সকালে রুফাস মাঠের ওপর দিয়ে চক্কর কেটে পায়রাদের দূরে রাখে। উইম্বলডন মাঠে গড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রুফাসের।
ইতিহাসের দীর্ঘতম ম্যাচ
টেনিস ইতিহাসের দীর্ঘতম ম্যাচের সাক্ষী হয়েছিল এই উইম্বলডন। ২০১০ সালের উইম্বলডনে প্রথম পর্বের একটি ম্যাচ চলেছিল টানা তিন দিন। মার্কিন জন ইসনার আর ফরাসি নিকোলাস মাহুত টানা ১১ ঘণ্টা ৫ মিনিট ধরে ছিলেন মাঠে। উইম্বলডনে তখন বেশ অদ্ভুত একটা নিয়ম ছিল। শেষ সেটের টাইব্রেকারে যতক্ষণ না ২ গেমের ব্যবধান হবে, ম্যাচ চলতেই থাকবে। ফলে টাইব্রেক না হওয়া পর্যন্ত চলছিল খেলা। শেষ পর্যন্ত ইসনার ৭০-৬৮ গেমে জিতেছিলেন টাইব্রেকার। শেষ হয়েছিল ১৮৩ গেমের টেনিস ম্যারাথন। সেই ম্যাচে কয়টি বল ব্যবহৃত হয়েছিল জানো? ১২৩টি!
স্ট্রবেরি আর ক্রিমের স্বর্গ
স্ট্রবেরি-ক্রিম খাওয়া উইম্বলডনের অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রতিবছর এখানে ২০ লাখেরও বেশি স্ট্রবেরি আর ৭ হাজার লিটার ক্রিম খাওয়া হয়। ব্রিটিশ আভিজাত্য আর স্বাদের চমৎকাল মিশেল মিস করতে চান না কেউ।
রাজকীয় আসন
উইম্বলডনের সেন্টার কোর্টে ৭৪টি বিশেষ আসন আছে, যা শুধু রাজপরিবারের সদস্য, সেলিব্রিটি আর বিশেষ অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত। একটা সময় ছিল যখন রাজপরিবারের কেউ এলে খেলোয়াড়দের ম্যাচ থামিয়ে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাতে হতো। এখন আর সেই সময় নেই। তবুও ম্যাচে বিরতি চললে বড় বড় তারকাদের দিকে ক্যামেরা তাক করা হয়, করতালির মাধ্যমে তাঁদের স্বাগত জানায় দর্শকেরা।
বিজ্ঞাপনবিহীন এই টুর্নামেন্ট
খেলা মানেই যেন বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। টেনিসও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু অন্য বড় টুর্নামেন্টগুলোতে যেমন চারপাশে বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি দেখা যায়, উইম্বলডন সেখানে একেবারেই নিপাট ভদ্রলোক। কোর্টের ভেতরে একেবারেই যৎসামান্য বিজ্ঞাপন থাকে, বহু বছর ধরেই এই নিয়ম মেনে আসছে উলম্বলডন। যে কারণে দেখতেও উইম্বলডনকে বিশেষ কিছু লাগে।
সেন্টার কোর্টে ছাদ
বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ হওয়া উইম্বলডনের এক পুরোনো ঐতিহ্য! কিন্তু ২০০৯ সালে সেন্টার কোর্টে একটি অত্যাধুনিক ছাদ বসানো হয়, যা প্রয়োজন অনুযায়ী খোলা ও বন্ধ করা যায়। এখন আর বৃষ্টির জন্য খেলার মজা মাটি হয় না, খেলা চলে অবিরাম! তবে সেন্টার কোর্টের বাইরে সমস্যাটা রয়েই গেছে।
মাঝের রোববার বিশ্রাম
অতীতে উইম্বলডনে একটা মজার নিয়ম ছিল। মাঝের রোববার খেলা বন্ধ রাখা হতো। মূলত দর্শকেরা যাতে একঘেয়ে হয়ে না পড়েন, সে জন্যই এই নিয়ম ছিল। এ ছাড়া মাঠের ঘাসকে একটু সময় দিতে মাঝের রোববার বন্ধ রাখা হতো খেলা। ২০২২ সালে পর্যন্ত এই নিয়ম বলবৎ ছিল, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া (বৃষ্টি বা খেলা পিছিয়ে যাওয়া) মাঝের রোববারে খেলা হতো না। কিন্তু এই ঐতিহ্যটা এখন নেই! ২০২২ সাল থেকে অল ইংল্যান্ড ক্লাব ঘোষণা করেছে যে মাঝের রোববার আর বিশ্রামের দিন নয়, এখন থেকে প্রতিদিনই খেলা চলবে। এতে দর্শকদের আনন্দ আরও বাড়বে, আর খেলার গতিও থাকবে নিরবচ্ছিন্ন।