১২ হাজার কোটি টাকার বিশ্বকাপে থাকছেন কারা?
বিশ্বকাপ মানেই অন্য রকম উত্তেজনা। বিশ্বকাপের জন্য বছরের পর বছর ধরে চলে অপেক্ষা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আসরে জায়গা করে নিতে চার বছর ধরে লড়াই করে দলগুলো। অতঃপর বিশ্ববাসীর সামনে আসে নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ। কিন্তু বিশ্বকাপের সব আয়োজন তো জাতীয় দলকেন্দ্রিক। যদিও ফুটবল ক্লাবকেন্দ্রিক খেলা। সারা বছর ক্লাবেই ব্যস্ত থাকেন খেলোয়াড়েরা। নিজেদের ক্লাবের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তর্কে মাতেন সমর্থকেরা। বিশ্বেরা সেরা ক্লাব কোনটা, এ প্রশ্ন আসতেই পারে। তা যাচাইয়ের উপায় কী? সদ্য সমাপ্ত উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জেতা পিএসজি না হয় ইউরোপ–সেরা। কিন্তু ইউরোপ ছাড়াও তো আরও মহাদেশ আছে। সেসব মহাদেশে আছে শক্তিশালী ক্লাবও। বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোকে নিয়ে তাই ফিফা আয়োজন করেছে ক্লাব বিশ্বকাপ। সব মহাদেশের সেরা ক্লাবগুলো খেলবে এই টুর্নামেন্টে।
ক্লাব বিশ্বকাপ বলে যে কোনো কিছু ছিল না, তা নয়। প্রতিবছরই ঘটা করে আয়োজন করা হতো ক্লাব বিশ্বকাপ। সেটিকে অবশ্য বিশ্বকাপ না বলে কনফেডারেশনস কাপ বললেই ভালো শোনায়। প্রতিবছর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে সুযোগ পেত মোট ৭টি দল। ৬টি মহাদেশের মহাদেশীয় টুর্নামেন্টজয়ী দল ও স্বাগতিক দেশের লিগজয়ী দল। সাধারণত ডিসেম্বরের শেষ দিকে বড়দিনের ছুটির আগে অনুষ্ঠিত হতো ক্লাব বিশ্বকাপ। ফরম্যাটটাও ছিল বেশ অদ্ভুত—তিন রাউন্ডে ৭ দল মুখোমুখি হতো একে অপরের। প্রথম পর্বে স্বাগতিক দলের মুখোমুখি হয় ওশেনিয়া চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী দল। দ্বিতীয় পর্বে যুক্ত হয় এশিয়ান, আফ্রিকান ও উত্তর আমেরিকার সেরা দল। সেমিফাইনালে এসে যুক্ত হয় ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার সেরা দল। তারপর সেমিফাইনাল জিতে নিশ্চিত হয় ফাইনালের টিকিট। ফাইনাল জিতে এক বছরের জন্য মেলে বিশ্বের সেরা ক্লাবের খেতাব। গত ১১ মৌসুম ধরে চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী দলের হাতে উঠছে ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা। শেষ ২০১২ সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব করিন্থিয়ানস চেলসিকে হারিয়ে বিশ্বের সেরা ক্লাবের খেতাব পেয়েছিল।
পুরোনো ক্লাব বিশ্বকাপ নিয়ে ক্লাব সমর্থকদের মধ্যে তেমন আগ্রহ ছিল না। বাজে ফরম্যাটের কারণে সাধারণ দর্শকেরাও খুব একটা গা করতেন না। ক্লাবের সমর্থকেরা টিভি পর্দার সামনে বসতেন নিজের ক্লাবকে খেলতে দেখার জন্য। কিন্তু দর্শক আগ্রহ, চমক কোনোটাই টানতে পারত না ক্লাব বিশ্বকাপ। ফলে ক্লাব বিশ্বকাপ ছিল ফিফার কাছে অনেকটা ‘আনট্যাপড মার্কেট’। মহাদেশীয় টুর্নামেন্টগুলো থেকে ফেডারেশনগুলোর আয় চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সেই টাকার কোনো ভাগ ফিফা পর্যন্ত এসে পৌঁছাত না। যে ফরম্যাটে আয়োজন চলছিল, তাতে বিশ্বকাপ আয়োজন করেও খুব একটা লাভের মুখ দেখছিল না ফিফা। টাকার ভাগ পেতে নতুন কোনো ভাবনা দরকার ছিল ফিফার। আর সেটা এলো পুরোনো ফরম্যাটে নতুন টুর্নামেন্ট আয়োজনের মাধ্যমে।
ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের ফরম্যাট পুরোটাই নিয়ে আসা হয়েছে ফিফা বিশ্বকাপ থেকে। ৩২ দলের টুর্নামেন্ট, ৪টি দল নিয়ে ৮টি গ্রুপ। রাউন্ড-রবিন পদ্ধতিতে খেলে প্রতিটি গ্রুপ থেকে শীর্ষ দুই দল সুযোগ পাবে রাউন্ড অব সিক্সটিনে। এর পর থেকে শুরু নকআউট পর্ব, ১৬ দল থেকে বেরিয়ে আসবে একজন চ্যাম্পিয়ন। সাজানো–গোছানো এই ফরম্যাটে এত দিন ধরে চলে এসেছে চ্যাম্পিয়নস লিগও। ফলে ফরম্যাট নিয়ে অভিযোগ নেই কারও। হেভিওয়েট দলদের মেলা বসেছে বিশ্বকাপে। রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যান সিটি, চেলসি, পিএসজি, বায়ার্ন থেকে শুরু করে আল হিলাল, রিভার প্লেট, পালমেইরাস —মহাদেশের সেরা দলগুলো নামবে শিরোপার লড়াইয়ে। তবে ৩২ দল নির্বাচন নিয়ে রয়েছে বেশ মারপ্যাঁচ।
ফিফার মতে ক্লাব বিশ্বকাপের ৩২ দল বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের মহাদেশীয় পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে। ৬টি মহাদেশীয় টুর্নামেন্টে গত চার বছরে যারা রাজত্ব করেছে, ভালো পারফরম্যান্স করেছে, তাদের জায়গা মিলেছে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় যারা মহাদেশীয় ক্লাব প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ২০২৫ ক্লাব বিশ্বকাপে তারাই শুধু জায়গা পাবে। সর্বোচ্চ ১২টি দল অংশ নেবে ইউরোপ থেকে, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ৬টি। এশিয়া, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা থেকে অংশ নেবে চারটি করে দল। আর একটি ক্লাব সুযোগ পাবে ওশেনিয়া থেকে। বলা বাহুল্য, স্বাগতিক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পাচ্ছে আরেকটি সিট। স্বাগতিক দেশ হিসেবে এই সুযোগটি পাচ্ছে লিওনেল মেসির দল ইন্টার মায়ামি। যারা এই বছর সাপোর্টার্স শিল্ড জিতে সুযোগ পেয়েছে বিশ্বকাপে। কিন্তু এমএলএস কাপজয়ী এলএ গ্যালাক্সিকে ফিরতে হয়েছে ব্যর্থ মনোরথে। গত চার বছরে ইউরোপে কোনো সাফল্য না পাওয়ায় নেই বার্সেলোনা, লিভারপুল, নাপোলির মতো দলগুলো। এ মৌসুমে লিগ জিতেও তাই তাদের টুর্নামেন্ট দেখতে হচ্ছে বাড়ি বসে।
৬ মহাদেশের মোট ২০টি ক্লাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে বসতে চলেছে নতুন ক্লাব বিশ্বকাপের প্রথম আসর। প্রথম আসরের শিরোপা যার ঝুলিতে উঠবে, চার বছরের জন্য তারাই পাবে বিশ্বের সেরা ক্লাবের খেতাব। জার্সিতে জ্বলজ্বল করবে ক্লাব বিশ্বকাপের ব্যাচ। ক্লাব বিশ্বকাপ তাই শুধু একটা টুর্নামেন্ট নয়, হয়ে উঠেছে মর্যাদার লড়াইও। কিন্তু মৌসুমের মাঝখানে প্রায় মাসব্যাপী এই টুর্নামেন্ট নিয়ে ভিন্নমতও কিন্তু কম নেই।
খেলোয়াড়দের জন্য এমনিতেই বড় হচ্ছে ফুটবল উইন্ডো। চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা বেড়েছে, খেলার গতি, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। ১০ বছর আগের ফুটবল আর এখনকার ফুটবলে পার্থক্য অনেক বেশি। ফুটবল এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। খেলোয়াড়দের প্রতিটি নড়াচড়া থাকে আতশি কাচের নিচে। শীর্ষ লিগে খেলা একজন খেলোয়াড় সর্বোচ্চ দুই মাস ছুটি পান নিজের জন্য। সেই সময়টাও যদি কেড়ে নেয় একটি টুর্নামেন্ট, সেখানে খেলোয়াড়দের বিশ্রামের সময়টা কোথায়? ক্রোয়েশিয়ান তারকা লুকা মদরিচের কথাই ধরা যাক। ২০২৩-২৪ মৌসুম থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্রামের সুযোগ পাননি তিনি। ২০২৪ চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেই চলে গেছেন ইউরো খেলতে, সেখান থেকে ফিরে আবার নিয়মিত মৌসুম। মৌসুম শেষে আবার ক্লাব বিশ্বকাপ। ক্লাব বিশ্বকাপ শেষে চুক্তি স্বাক্ষর করবেন এসি মিলানের সঙ্গে। তারপর লম্বা এক মৌসুম শেষে ফিফা বিশ্বকাপ। সব মিলিয়ে খেলোয়াড়দের ওপর খেলার চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। সেখানে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ বাড়তি এক টুর্নামেন্ট হয়ে সেই চাপকে করেছে দ্বিগুণ।
এ ছাড়া বেশির ভাগ দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয় জুনের ৩০ তারিখ। মাঝপথে টুর্নামেন্ট হওয়ায় বিপত্তিতে পড়েছে অনেক দল। কেউ কেউ চুক্তি বাড়িয়ে খেলোয়াড়কে রেখে দিচ্ছে কয়েক দিনের জন্য। কেউ নতুন দলের সঙ্গে চুক্তি করলেও আগ বাড়িয়ে যোগ দিতে পারছেন না। রিয়াল মাদ্রিদের নতুন সাইনিং ফ্রাঙ্কো মাস্তানতুয়োনো রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিলেও ক্লাব বিশ্বকাপে খেলবেন রিভার প্লেটের হয়ে। ক্লাব বিশ্বকাপ তাই বাড়তি ঝামেলা যোগ করেছে ক্লাবগুলোর মাথায়।
তৃতীয়ত, যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন সমস্যা নিয়ে চলমান বিক্ষোভ। ‘অবৈধ’ অভিবাসনবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে পুরো যুক্তরাষ্ট্র ফেটে পড়েছে বিক্ষোভে। সেই বিক্ষোভ দমনে হয়েছে পুলিশ মোতায়েন, কোথাও কোথাও চলছে কারফিউ। এ নিয়ে চিন্তায় আছে ফিফাও। কারণ, বিক্ষোভের প্রভাব সরাসরি পড়ছে ক্লাব বিশ্বকাপের টিকিট বিক্রির ওপর। যে মেসিকে ক্লাব বিশ্বকাপের পোস্টার বয় বানিয়েছে ফিফা, সেই মেসির ম্যাচের টিকিট বিক্রি করতেই হিমশিম খাচ্ছে তারা। বিশাল মূল্যছাড় দিয়েও মিলছে না দর্শক। সব মিলিয়ে ভেন্যু নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ফিফা।
তবে এত কিছুর মধ্যেও প্রাইজমানির ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফুটবল টুর্নামেন্টে সর্বকালের সবচেয়ে বড় পুরস্কার দেওয়া হবে এই টুর্নামেন্টে। আসরে মোট ১০০ কোটি মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১২ হাজার ১৫৭ কোটি ২৬ লাখ টাকার সমান। ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো তাই তাঁর নতুন টুর্নামেন্ট নিয়ে যারপরনাই খুশি। শিরোপাতেও খোদাই করে রাখা আছে তাঁর নাম। এখন দেখার বিষয়, ফিফার ‘মাস্টারমাইন্ড প্রজেক্ট’ আলোর মুখ দেখে নাকি মুখ থুবড়ে পড়ে আরেকবার।