যখন কেউ ছিল না, তখন একজন জামাল ভূঁইয়া ছিলেন
ম্যাচের সবেমাত্র ৫ মিনিট, প্রথম কর্নার কিক। ডান প্রান্ত থেকে কর্নার নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়া। বক্সের ঠিক মাঝ বরাবর মাপা কর্নার। ডি-বক্সের বাইরে থেকে ছুটে এসে দূর্দান্ত এক হেড হামজা চৌধুরীর। বল জড়িয়ে গেল জালে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে গোলের খাতা খুললেন দ্বিতীয় ম্যাচেই। সেটাও আবার আর কেউ নন, স্বয়ং অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়ার বাড়ানো বল থেকে। হামজার গোল হয়ে রইল বাংলাদেশের নতুন যুগে প্রবেশের সাক্ষী। সাক্ষ্য দিলেন আর গত এক দশক ধরে বাংলাদেশকে টেনে নিয়ে যাওয়া অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়া।
গত দেড় দশকে বাংলাদেশের ফুটবল হেঁটেছে পেছনের দিকে। কোনো লক্ষ্য ছাড়া, উদ্দীপনা ছাড়া একের পর এক ম্যাচ শুধু খেলার জন্য খেলে গিয়েছে। বোর্ডের উদাসীনতা আর খামখেয়ালিতে না এগিয়েছে লিগ, না হয়েছে জাতীয় দলের কোনো উত্থান। বরং বাংলাদেশ এক বৃত্তের মাঝে ঘুরপাক খেয়েছে বছরের পর বছর। সেই ঘুরপাকে শক্ত হাতে বাংলাদেশের হাল ধরে রেখেছিলেন জামাল ভুঁইয়া। জামাল ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম বংশদ্ভুত খেলোয়াড়। ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন লাল-সবুজ জার্সি গায়ে চড়ানোর জন্য।
২০১১ সালে প্রথম ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে পা রাখেন জামাল। বয়স তখন তার সবে মাত্র ২১। ডেনমার্কে খেলার স্বপ্ন ততদিনে অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু চোখে মুখে স্বপ্ন লাল-সবুজ জার্সিটা গায়ে চড়ানোর। প্রথমবার এসে দেশের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল। দ্রুত হাঁপিয়ে ওঠা, গরমে নাভিশ্বাস তোলা, বাকিদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা। কোচেদের মনঃপুত না হওয়ায় শুরুতেই বিদায় নিতে হয় জামালকে। ২০১৩ সালে তাঁকে ডেকে পাঠান নতুন কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ। তাঁর অধীনে জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় জামালের জন্য। নেপালের বিপক্ষে সাফের ম্যাচ দিয়ে জাতীয় দলের পদার্পন করেন জামাল। বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেক হলো জামালের।
এরপর থেকে জামালকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ডেনমার্কের দল ছেড়ে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেছেন বাংলাদেশে। আস্তে আস্তে লাইমলাইটে আসতে শুরু করেন পারফরম্যান্স দিয়ে। বিশেষ করে ২০১৫ সালে গোল্ড কাপে হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। যদিও সতীর্থদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেক সময় লেগেছিল তাঁর। তবে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস জামালেট জীবনের শুরু থেকেই। ডেনমার্কের যে জায়গায় বেড়ে উঠেছেন, তা ছিল মাদক আর অপরাধের রাজ্য। কিশোর বয়সে গ্যাং অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন, চারটি গুলিও খেয়েছেন। ডেনিশদের হয়ে তাঁর ক্যারিয়ার থেমে গিয়েছিল সেখানেই। আর খুলে গিয়েছিল বাংলাদেশের ভাগ্য।
২০১৬ সালে ভুটানের কাছে হেরে দুই বছরের জন্য আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে নির্বাসিত হয় বাংলাদেশ। চোটের কারণে সেই ম্যাচে ছিলেন না জামাল। দুই বছর বপর যখন বাংলাদেশ মাঠে ফেরে তখন স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড়ের হাতে ওঠে অধিনায়কের দায়িত্ব। এরপর থেকে জাতীয় দলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মাঝমাঠে যেমন নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তেমনই দেশের ভেতরে-বাইরে ব্র্যান্ড হিসেবে বাংলাদেশের আছেন একজনই–জামাল ভুঁইয়া। তাঁর দেখানো পথ ধরে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে থিতু হয়েছেন তারিক কাজী, কাজেম শাহ। বাংলাদেশ থেকে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন তপু বর্মন, আনিসুর রহমান জিকো, সোহেল রানা, সাদ উদ্দিনরা। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে বাংলাদেশ পা দিয়েছেন নতুন এক যুগে।
জামাল ভুঁইয়া, তারিক কাজী বাংলাদেশের জার্সিতে যাত্রা শুরু করলেও বাকিদের জন্য সময়টা খুব একটা ভালো ছিল না। বিশেষ করে আগের বোর্ডের উদাসীনতায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত খেলোয়াড়দের দেশে আসার পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেককেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে পাকাপাকি ক্যারিয়ার গড়তে। জামাল-তারিক সেটা মেনে নিলেও বাংলাদেশে এসে খাপ খাওয়াতে পারেননি ইউসুফ জুলকারনাইন, রাহবার খানরা। তাঁদের ক্যারিয়ার লম্বা হয়নি বাংলাদেশে। আগের বোর্ড থাকাকালীন সময়ে হামজা চৌধুরীর আসা নিয়েও জল ঘোলা করেছিলেন অনেকে।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে সরকার পতনের পর বোর্ডেও আসে পরিবর্তন। নতুন প্রেসিডেন্ট তাবিথ আউয়াল এসে বদলে দেন বাংলাদেশ ফুটবলের চিত্র। দ্রুততম সময়ে আসে কিট স্পন্সর, তৈরি হয় হামজা চৌধুরী - ফাহমিদুল ইসলামের পাসপোর্ট। ফলাফল? বাংলাদেশের জার্সিতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত খেলোয়াড়দের ছড়াছড়ি। হামজাকে দেখে এসেছেন শমিত সোম, আসবেন কিউবা মিচেল। বয়সভিত্তিক দলেও খেলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন অনেকে। এর মধ্যে আবদুল কাদির নজর কেড়েছেন অনুর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে।
অরিজিন খেলোয়াড়দের লাল-সবুজ জার্সিতে খেলা বদলে দিয়েছে বাংলাদেশে ফুটবলের চিত্র। বছরের পর বছর পরে থাকা খালি মাঠে এখন টিকিটের সংকট। এক নজর দেখার জন্য দর্শকদের ভিড়। ক্যামেরার ঝলকানিতে ফুটবলারদের চোখ মুখ ঝলসে উঠছে। ভারতের বিপক্ষে ড্র নিয়ে হামজা চৌধুরী বদলে দিয়েছেন সব সমীকরণ। এতদিন টিভি পর্দায় পারফর্ম করা তারকা এখন বাংলাদেশের জার্সিতে। ঢাকার মাটিতে খেলছেন, মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন। লেস্টার সিটির জার্সিতে যাঁকে দেখে দূর আকাশে তারকা মনে হতো, তিনি আজ বাংলাদেশের জার্সিতে গোল করছেন। গর্বে বুক ফোলাচ্ছে বাংলাদেশের কোটি কোটি সমর্থকদের সঙ্গে। এই গণজোয়ার বাংলাদেশের নতুন উত্থানের গল্প বলছে নিজের মতো করে।
ভুটানের বিপক্ষে গোল যেন সেটার প্রতিরূপ। জামালের বয়স ছুঁয়েছে ৩৫। গত ১২ বছর ধরে বাংলাদেশের ফুটবলের ব্যাটন ছিল তাঁর হাতে। একের পর এক হার দেখেছেন। খালি মাঠে দুয়োধ্বনি, সবকিছুর সাক্ষী জামাল। র্যাংকিং ইতিহাসের সর্বনিম্নতে নেমেছে। দুই বছর নির্বাসিত ছিলেন আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে। তবুও আশা ছাড়েননি, বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করেছেন। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলা খেলোয়াড় জামাল পরিণত হয়েছে জাতীয় আইকনে। শুধু এই দিন দেখার অপেক্ষায়।
বাংলাদেশের খেলা দেখতে এখন টিকিটের হাহাকার। অনলাইনে টিকিট শেষ হয়ে যায় মুহূর্তেই। ভুটানের বিপক্ষে জামালের অ্যাসিস্ট যেন সেটারই রূপক। এক যুগ ধরে যে বাংলাদেশের ব্যাটন ছিল জামালের হাতে, সেটা সঁপে দিলেন হামজার হাতে। জামাল নিজেও জানেন, বয়সটা তাঁকে টেনে ধরছে। খুব বেশিদিন হয়তো লাল-সবুজ জার্সিতে পাওয়া যাবে না তাঁকে। দলে এখন তারকার ভিড়, বাংলাদেশের ফুটবল যাবে আরও অনেক দূর। কিন্তু দুঃসময়েও শক্ত হাতে দলের হাল ধরে রেখেছেন যে অধিনায়ক, সেই জামাল ভূঁইয়াকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতেই হয়।