টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে পাঁচ প্রশ্ন

বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে এবার মুখোমুখি হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া। ১১ জুন ইংল্যান্ডের লর্ডসে শুরু হবে টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই লড়াই। ইতিমধ্যে ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই দলে যেমন পুরোনো তারকারা আছেন, তেমনি দেখা যাচ্ছে কিছু নতুন মুখও।

দক্ষিণ আফ্রিকার দল

টেম্বা বাভুমা (অধিনায়ক), টনি ডি জর্জি, এইডেন মার্করাম, উইয়ান মুলডার, মার্কো ইয়ানসেন, কাগিসো রাবাদা, কেশব মহারাজ, লুঙ্গি এনগিডি, করবিন বশ, কাইল ভেরেইনা, ডেভিড বেডিংহাম, ত্রিস্তান স্টাবস, রায়ান রিকেলটন, সেনুরান মুথুসামি ও ডেইন প্যাটারসন।

চোট থেকে ফিরে এসেছেন লুঙ্গি এনগিডি। তাঁকে ফিরে পাওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার পেস আক্রমণ আরও শক্তিশালী হয়েছে। তবে প্রোটিয়াদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে ফাইনালের মতো মঞ্চে অভিজ্ঞতার ঘাটতি। লর্ডসের উইকেট সাধারণত পেসাররা সুবিধা পান। তাই একাদশ নির্বাচনেও দিতে হবে বাড়তি গুরুত্ব। সব মিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে এমন পাঁচটি সমস্যা আছে, যা নিয়ে আগেভাগে ভাবতে হবে। তবে সব সমস্যা যে বিরক্তকর তা কিন্তু নয়। কিছু মধুর সমস্যও আছে।

১. ওপেন করবে কারা?

দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ওপেনিং জুটিতে এখন মূলত দুজনের নামই ঘুরেফিরে আসছে। এইডেন মার্করাম ও টনি ডি জর্জি। গত বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ থেকে শুরু করে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টেও ছিল এই জুটি। সেই ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছিল ২ উইকেটে। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে হঠাৎই ওপেন করতে নামেন রায়ান রিকেলটন। সে সুযোগ রিকেলটন ভালোই কাজে লাগিয়েছেন। ৩৪৩ বলে ২৫৯ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে হয়েছিলেন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়। দল জিতেছিল ১০ উইকেটে। আইপিএলেও ভালো ফর্মে আছেন বাঁহাতি এই কিপার ব্যাটার। তাহলে রিকেলটনকে জায়গা ছাড়বেন কে? মার্করাম নাকি ডি জর্জি?

মার্করাম অবশ্য অনেক দিন ধরেই দলের নিয়মিত ওপেনার। তাঁর টেস্ট রান ইতিমধ্যেই ২৫০০ ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে বাভুমা সাধারণত টেস্টে চার, পাঁচ কিংবা ছয়ে ব্যাট করেন। তবে ওয়ানডেতে তিনি খেলেন ওপেনার হিসেবে। তাহলে কি বাভুমা টেস্টেও ওপেন করবেন? নাকি রিকেলটন বা ডি জর্জির মধ্যে কাউকে মার্করামের সঙ্গে বেছে নেওয়া হবে?

দক্ষিণ আফ্রিকা যদি ওপেনিংয়ে একজন বাঁহাতি ও একজন ডানহাতির মিশ্রণ রাখতে চায়, তবে দল নির্বাচন কঠিন হয়ে পড়বে। সব মিলিয়ে ওপেনিং জায়গাটা নিয়েই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা শিবির। একে মধুর সমস্যা না বলে উপায় আছে!

২. মিডল অর্ডারে দক্ষিণ আফ্রিকার ভরসা কে?

গত কয়েকটি সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার মিডল অর্ডারে সবচেয়ে বড় ভরসার নাম—টেম্বা বাভুমা আর কাইল ভেরেইনা। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বিপক্ষে দুজনই ছিলেন দারুণ ফর্মে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে ভেরেইনা খেলেন অপরাজিত ১০৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। পাকিস্তানের বিপক্ষেও কেপটাউনে দ্বিতীয় টেস্টে তিনি সেঞ্চুরি করেছেন। আর অধিনায়ক বাভুমা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে করেছিলেন ১১৩, পাকিস্তানের বিপক্ষে কেপটাউনে খেলেছেন ১০৬ রানের ইনিংস। কিন্তু বাভুমাকে যদি ওপেন করানো হয়, তাহলে মিডল অর্ডার সামলাবেন কে?

তা ছাড়া টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের মতো বড় আসরে শুধু দুজনের ওপর ভরসা রাখা যায় না। মিডল অর্ডারে অন্য কাউকে এই চাপ সামলাতে হবে। কিন্তু সেই ক্রিকেটার কে? ত্রিস্তান স্টাবস নাকি ডেভিড বেডিংহাম?

স্টাবসকে অনেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যৎ তারকা হিসেবে দেখছেন। তবে টেস্টে তাঁর অভিজ্ঞতা এখনো খুব সীমিত—মাত্র ৯টি ম্যাচ খেলেছেন। অস্ট্রেলিয়ার মতো বোলিং আক্রমণের সামনে স্টাবস কি ফাইনালের চাপ সামলাতে পারবেন?

ডেভিড বেডিংহামের ক্ষেত্রেও প্রায় একই কথা প্রযোজ্য। তাঁর টেস্ট অভিজ্ঞতা ১২ ম্যাচের। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি শতাধিক ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছেন। সেই অভিজ্ঞতাই এবার বড় মঞ্চে কাজে লাগাতে পারেন তিনি।

এই দুই তরুণ ব্যাটার যদি নিজেদের সেরা খেলাটা খেলতে পারেন, তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে ধরা দিতে পারে বহু প্রতীক্ষিত আইসিসি ট্রফি। এখন দেখার বিষয়, কে কতটা চাপ সামলাতে পারেন।

৩. ফাইনালে করবিন বশ নাকি উইয়ান মুলডার?

দক্ষিণ আফ্রিকার দলে এই মুহূর্তে দুজন তরুণ অলরাউন্ডার আছেন—করবিন বশ ও উইয়ান মুলডার। ব্যাটে–বলে তাঁরা দারুণ অবদান রাখতে পারেন। সাম্প্রতিক আইপিএল আর এসএ টি-টোয়েন্টি লিগে দুজনই ভালো খেলেছেন। তবে টেস্ট ক্রিকেটের ফাইনালে লাল বলের অভিজ্ঞতাই আসল চাবিকাঠি। আর সেদিক দিয়ে এগিয়ে আছেন উইয়ান মুলডার। বয়স ২৭ হলেও তিনি ইতোমধ্যেই ১৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। ২২.৬৫ গড়ে করেছেন ৫৮৯ রান এবং নিয়েছেন ৩০ উইকেট।

অন্যদিকে করবিন বশ এখনো নতুন। একমাত্র টেস্টটি খেলেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। কিন্তু সেই ম্যাচেই তিনি আলো ছড়িয়েছেন। প্রথম ইনিংসে বল হাতে ৪ উইকেটের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে করেছেন অপরাজিত ৮১ রান। এই দুজনের মধ্যে একজনই মার্কো ইয়ানসেনের সঙ্গে মূল দলে জায়গা পাবেন হয়তো। তবে ঠিক কে মাঠে নামবেন ফাইনালে, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন। দক্ষিণ আফ্রিকা হয়তো শেষ মুহূর্তে দলের কন্ডিশন আর প্রয়োজন বুঝেই সিদ্ধান্ত নেবে।

৪. আনরিখ নরকিয়াকে না পাওয়া হতে পারে বড় ক্ষতি

দক্ষিণ আফ্রিকার এই দলটায় পেস বোলারদের ভিড়। লুঙ্গি এনগিডি, কাগিসো রাবাদা, ডেন প্যাটারসনদের সঙ্গে আছেন অলরাউন্ডার মার্কো ইয়ানসেন, উইয়ান মুলডার আর করবিন বশ।

শুনতে ভালো লাগলেও এই দলটায় একটা বড় সমস্যা আছে—ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে খেলার অভিজ্ঞতা। রাবাদা ছাড়া বাকিদের ইংলিশ কন্ডিশনে খেলার অভিজ্ঞতা তেমন নেই। কিন্তু আনরিখ নরকিয়া দলে থাকলে এই ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হতো।

মার্কো ইয়ানসেন অবশ্য ইংল্যান্ডে দুটি টেস্ট খেলে ৯ উইকেট নিয়েছেন। কিন্তু এনগিডির পারফরম্যান্স আহামরি নয়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই টেস্টে নিয়েছেন মাত্র ২ উইকেট। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে নরকিয়ার না থাকাটা নিশ্চিতভাবেই প্রোটিয়াদের জন্য বড় ক্ষতি।

৫. কেশব মহারাজ কি ভিন্নমাত্রা যোগ করতে পারবেন?

দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং লাইনআপ পেসারে ঠাসা। বিপরীতে স্পিনার মাত্র একজন—কেশব মহারাজ। গত এক বছরে টেস্টে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন। মাত্র ১৩ ইনিংসেই ৪০ উইকেট! আর মাত্র ২ উইকেট পেলেই তাঁর নামের পাশে ২০০ উইকেটের মাইলফলক যোগ হবে। অভিজ্ঞ এই স্লো লেফট আর্ম বোলার যেকোনো সময় ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। ইংল্যান্ডেও তাঁর রেকর্ড খারাপ নয়। সাত টেস্টে নিয়েছেন ২১ উইকেট।

তবে এই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা চাইলে একেবারে পেস আক্রমণ নিয়েও নামতে পারেন। মার্কো ইয়ানসেন, রাবাদা, এনগিডির সঙ্গে ডেন প্যাটারসন, অলরাউন্ডার মালডার বা বশকে নিয়ে। সে ক্ষেত্রে তারা হয়তো অস্থায়ী স্পিনার হিসেবে মার্করামের ওপর ভরসা রাখবেন। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত কি নেবে প্রোটিয়ারা? সম্ভবত না। কারণ, দলে একজন পূর্ণাঙ্গ স্পিনার থাকা মানেই একটা বাড়তি অস্ত্র। বলের পাশাপাশি ভালোই ব্যাট করতে পারেন মহারাজ। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ গড়ে হাজারের বেশি রান করেছেন মহারাজ, সর্বোচ্চ ৮৪।

আরও পড়ুন