লুইস এনরিকে যেভাবে বদলে দিলেন পিএসজিকে

লম্বা সময় ধরে যে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার জন্য পিএসজি অপেক্ষা করছিল, সেই ট্রফিটাই এবার এনে দিলেন এনরিকে। তাঁকে আকাশে ছুড়ে উদ্‌যাপনটাও হলো দেখার মতোরয়টার্স

১৯৫৬ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের প্রথম আসরের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হয় স্তাদে রেইমস। জমজমাট সেই ফাইনালে ৬৭ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থেকেও পরাজয় বরণ করতে হয় স্তাদে রেইমসকে। রিয়াল মাদ্রিদের সেই সুপার টিমের সঙ্গে হারলেও প্রশংসায় ভেসেছিল ফ্রান্সের ক্লাবটি। অনেকেই হয়তো তখন ভেবেছিলেন, ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় আধিপত্য বিস্তারের দাবিদার ফ্রান্স। কিন্তু সেই ফাইনালের প্রায় ছয় দশক পর মাত্র দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ গেল ফ্রান্সে। ১৯৯৩ সালে মার্শেইয়ের জয়ের পর অবসান হলো ফরাসিদের অপেক্ষার। তবে সে অবসান যে এ রকম তেড়েফুঁড়ে হবে, তা হয়তো পাঁড় পিএসজি–ভক্তরাও ভাবেননি।

পিএসজি ফ্রান্সের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব হলেও একসময় তারা ঋণের ভারে ছিল জর্জরিত। তাই কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট মাত্র ১০০ মিলিয়ন ইউরোতে মালিকানা পেয়ে যায় ক্লাবটির। মালিকানা পাওয়ার পর থেকেই তারার মেলা বসতে থাকে।

অথচ এবার গ্রুপ পর্ব থেকেই নিজেদের নিয়ে সংশয় ছিল পিএসজির। ৩৬ দলের মধ্যে ২৪ দলের দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও পিএসজির শুরুটা ছিল খুব বাজে। প্রথম পাঁচ ম্যাচে মাত্র এক জয় নিয়ে ত্রাহি অবস্থা তাদের। অপর দিকে ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ইন্টার মিলান তখনো অপরাজিত। খাদের কিনারা থেকে গ্রুপের শেষ তিন ম্যাচে পরপর জয় নিয়ে ১৫তম হয়ে গ্রুপ পর্ব শেষ করে তারা। অপর দিকে ইন্টার মিলান গ্রুপ পর্বে চতুর্থ হয়ে সরাসরি জায়গা করে শেষ ষোলোতে।

স্বপ্নের ট্রফি হাতে পিএসজি অধিনায়ক মার্কিনিওস
রয়টার্স

কোচ হিসেবে লুই এনরিকের এটি দ্বিতীয় ট্রেবল। ২০১৪-১৫ মৌসুমে বার্সার হয়ে প্রথম ট্রেবল জয়ের সঙ্গে এ মৌসুমের মিল একটাই—সেই বার্সাও মৌসুমের অর্ধেক সময় নিজেদের ছায়া হয়ে ছিল। প্লে–অফ রাউন্ডে নিজ দেশের ক্লাব ব্রেস্টের বিপক্ষে ৭-০ গোলের জয়ই হয়তো আত্মবিশ্বাস দিয়েছে পিএসজিকে। পরের রাউন্ডে স্কোরকার্ড দুই লেগ মিলিয়ে ১-১ ড্রয়ের পর পেনাল্টি পিএসজির জয়ের সাক্ষ্য দিলেও লিভারপুল ডিফেন্সকে কিন্তু একবিন্দুও শান্তিতে থাকতে দেননি দেম্বেলে, বারকোলারা। প্রথম লেগে পিএসজির ১০ শট অন টার্গেটের বিপরীতে লিভারপুলের একমাত্র শটই ছিল গোল!

পরের রাউন্ডে খেলা হলো আরও জমজমাট। প্রিমিয়ার লিগের মধ্যম সারির দল অ্যাস্টন ভিলা দুর্দান্ত খেলে জয়ও তুলে নিল এক ম্যাচে। তবে দুই লেগ মিলিয়ে পরের রাউন্ডে যেতে পারে এনরিকের দলই। সেমিতে রিয়াল মাদ্রিদকে হারানো আর্সেনালের বিপক্ষে অনেকটা আন্ডারডগ হয়েই মাঠে নেমেছিল তারা। তারপর দুই লেগেই জয় তুলে নিল। এরপরও এ ম্যাচ নিয়ে আলোচনা ছিল না তেমন, যতটা না ছিল দুই লেগেই মাস্টারপিস উপহার দেওয়া বার্সা বনাম ইন্টার। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো ম্যাচে শেষ পর্যন্ত পার্থক্য গড়ে দেয় ফ্রাত্তেসির অতিরিক্ত সময়ের গোল।

অবশেষে ফাইনালে পিএসজি। ২০২০ সালের পর আবার। সেবার দলে ছিলেন নেইমার, এমবাপ্পের মতো বিশ্বসেরা তারকারা। সে তুলনায় এবার দলে আশরাফ হাকিমি, উসমান দেম্বেলে আর জিয়ানলুইজি দনারুম্মা ছাড়া তেমন পরিচিত কোনো মুখ নেই। বাকি যাঁরা আছেন, প্রায় সবার বয়স খুব কম, এত বড় ম্যাচ খেলার জন্য প্রস্তুত কি না, সে প্রশ্নও তোলা যায়। ইন্টার মিলান বুঝি সহজেই এবার ফাইনালটা জিতে নিল। ২০১০ সালের পর আবারও ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় ট্রফি হয়তো যাবে মিলানের মাঠ, সান সিরোতে। কিন্তু পিএসজি ২০২০ সালের তুলনায় প্রায় নতুনদের নিয়ে গড়া একটা দল, ওরাও তো ফাইনালে। ওদের কি আসলেই এত হালকাভাবে নেওয়া যায়?

পিএসজি চেয়ারম্যান নাসের আল খেলাইফির সঙ্গে প্রেসনাল কিমপেম্বে
এএফপি

পিএসজি ফ্রান্সের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব হলেও একসময় তারা ঋণের ভারে ছিল জর্জরিত। তাই কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট মাত্র ১০০ মিলিয়ন ইউরোতে মালিকানা পেয়ে যায় ক্লাবটির। মালিকানা পাওয়ার পর থেকেই তারার মেলা বসতে থাকে। ২০১২ সালে ট্রান্সফারমার্কেটে তাণ্ডব চালিয়ে দলটি কিনে নেয় ইব্রাহিমোভিচ, থিয়াগো, সিলভা, লাভেজ্জি, ভেরাত্তিকে। কোচ হিসেবে দলে ভিড়ে আনচেলত্তি। পরের বছরগুলোতে মারকুইনোস, ডেভিড সিলভা, ডি মারিয়ার মতো তারকারাও ভিড় জমান ক্লাবটির ড্রেসিংরুমে। ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় সাফল্য রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়। তবে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব যাদের লক্ষ্য, তাদের কি আর এসবে মন ভরে? খরচ করার দিক দিয়ে কখনো কার্পণ্য করেননি দলটির মালিক নাসের আল খেলাইফি। ট্রান্সফারমার্কেটে বড় কোনো নাম শোনা গেলেই তার সঙ্গে যুক্ত হতো পিএসজির নাম।

তবে এরপরও ২০১৭ সালে নেইমারের ট্রান্সফার ছিল কল্পনাতীত। ২২২ মিলিয়ন ইউরো রিলিজ ক্লজ পরিশোধ করে নেইমারকে পিএসজিতে উড়িয়ে আনা ছিল একটি ‘পাওয়ার মুভ’। অনেকের ধারণা, মূলত বার্সেলোনার মার্কো ভেরাত্তিকে নিয়ে টানাটানির বদলা নিতেই পিএসজির এ ট্রান্সফার। একই ট্রান্সফার উইন্ডোতে এমবাপ্পেকে দলে ভেড়ায় তারা। খেলাইফি জানিয়ে দিলেন যেকোনো দলের যেকোনো খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ানোর সামর্থ্য আছে দলটির। তবে নেইমার–এমবাপ্পেকে দলে ভেড়ানোর পরও পরপর দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলো থেকেই বিদায় ঘটল তাদের। ২০১৯-২০ মৌসুমে ফাইনালে উঠেও রুপালি ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখা হলো না তাদের। এরপর যেন উন্মাদ হয়ে যান খেলাইফি, সবার চোখ কপালে তুলে ২০২১–এর ট্রান্সফার উইন্ডোতে লিওনেল মেসি, সার্জিও রামোসদের সঙ্গে দলে ভেড়ান ইউরোর সেরা খেলোয়াড় দনারুম্মা, আশরাফ হাকিমি, নুনো মেন্দেজদের। এরপরও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে তাদের সময় লাগল প্রায় চার বছর। কিন্তু কেন?

এই ট্রফিটি হাতে নেওয়ার জন্য কত–কী না করলেন! একসময় মনে হচ্ছিল, আর হয়তো চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বপ্ন পূরণ হবে না নাসের আল খেলাইফির। অবশেষে দূর হলো তাঁর সেই আক্ষেপ। ইতিহাস গড়ে চ্যাম্পিয়ন হলো পিএসজি
রয়টার্স

আধুনিক ফুটবলে ‘ট্র্যাক ব্যাক’ শব্দযুগল এখন বেশ পরিচিত। এর মানে হচ্ছে প্রতিপক্ষের সীমানায় কোনো খেলোয়াড় যদি বল হারায়, তাহলে তাঁকে নিজ দায়িত্বে ডিফেন্স লাইনে নেমে বলের পুনরুদ্ধারে দলকে সাহায্য করতে হবে। তৎকালীন পিএসজির আক্রমণের তিন তারকা—মেসি, নেইমার, এমবাপ্পে কারোরও নেই এ অভ্যাস। প্রত্যেকেই দলের মেইনম্যান হিসেবে খেলে অভ্যস্ত, নিচে নেমে এসে রক্ষণে সাহায্য করার আগ্রহ নেই কারোরই। আরেক দিকে রামোস, হাকিমি ডিফেন্ডার হলেও বারবার ওভারল্যাপ করে আক্রমণভাগে উঠে যাওয়ার অভ্যাসটা পুরোনো। তাই মাঠে প্রতিপক্ষ যখন পা থেকে বল কেড়ে নিত, হুট করে দেখা যেত পিএসজির ডিফেন্স একেবারে খালি। ফলে প্রায় প্রতিটা কাউন্টার অ্যাটাকের সামনে ফরাসি চ্যাম্পিয়নদের অসহায় মনে হতে লাগল। পাশাপাশি নেইমারের মতো তারকা খেলোয়াড়দের নিয়মিত চোটের সমস্যা তো ছিলই।

লুইস এনরিকে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাই বড় নামের পেছনে ছুটলেন না। বারবার নকআউট পর্ব থেকে হেরে যাওয়ার কারণ বের করলেন শুরুতে। এরপর কিছু নির্দিষ্ট খেলোয়াড় খোঁজার দিকে মনোযোগ দেন, যাঁরা খেলতে পারবেন তাঁর কৌশলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বার্সা থেকে এবার দলে ভেড়ান দেম্বেলেকে। না, রেকর্ড কোনো ট্রান্সফার ফিতে নয়, মাত্র ৫০ মিলিয়ন ইউরোতে। নেইমারের ট্রান্সফার ফির চার ভাগের এক ভাগ দিয়ে কেনা দেম্বেলে পরবর্তী সময়ে যে নেইমারের চেয়ে চার গুণ বেশি ফেরত দেবে ক্লাবটিকে—এ কথা এনরিকে বাদে কেউ বোধহয় ভাবেননি তখন। দেম্বেলে, মার্কিনিওস, হাকিমিদের মতো অভিজ্ঞদের পাশাপাশি দলে সুযোগ দেন বারকোলা, দেজিরে দুয়ের মতো তরুণদের, যাঁরা সমানতালে দৌড়াতে পারেন পুরো মাঠ। যার ফল সবাই দেখলেন এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে, বিশেষ করে ফাইনালে।

ম্যাচের ১২ মিনিটে যখন দেজিরে দুয়ের আলত করে বাড়ানো পাস আশরাফ হাকিমি ইন্টারের জালে জড়ান, তখনো হয়তোবা কেউ টের পাননি কী অপেক্ষা করছে ইন্টারের জন্য। নিজে ডিফেন্ডার হলেও পুরো ম্যাচেই ইন্টার ডিফেন্সকে নাচিয়েছেন তিনি। প্রথম গোলের সময়ই ইন্টারকে কেমন ছন্নছাড়া মনে হচ্ছিল, মৌসুমের শেষ মুহূর্তে এসে লিগ শিরোপা হারানো দলটাকে লাগছিল ক্লান্ত। তবে এদিন সবচেয়ে বেশি আলো ছড়িয়েছেন দেজিরে দুয়ে। এই টিনেজার প্রথম গোলে অ্যাসিস্টের পর দলের দ্বিতীয় গোল করেন বুলেট এক শটে। ৬৩ মিনিটে নিজের দ্বিতীয় গোলে ভিতিনহার বাড়িয়ে দেওয়া পাসটাও কিন্তু ছিল চোখে পড়ার মতো। ম্যাচ মূলত এখানেই শেষ। পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ খেলা ৩৬ বছর বয়সী ইয়ান সমার অথবা ৩৭ বছর বয়সী অ্যাচারবির বয়সটা এদিন খুব প্রকাশ পাচ্ছিল। গোলবন্যার ম্যাচের সেরা গোল কাভারস্থখেলিয়ার করা ম্যাচের চতুর্থ গোল। আর দেজিরে দুয়েকে দেখে উজ্জীবিত আরেক টিনেজার মায়ুলু ইন্টারের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকেন ম্যাচের ৮৬ মিনিটে। আর ওদিকে ইন্টার? গোল করা তো দূরের কথা, পুরো ম্যাচে উল্লেখযোগ্য কোনো আক্রমণই করতে পারেনি তারা। দুঃস্বপ্নের মতো একটি রাত কেটেছে তাদের।

এই ট্রফি ছুয়ে দেখার জন্য কত চেষ্টা নাসের আল খেলাইফির!

১৪ বছরে অনেক ভুলভাল সিদ্ধান্ত নেওয়া খেলাইফি ভাগ্যিস এনরিকেকে নিজের পছন্দমতো খেলোয়াড় কেনার অনুমতি দিয়েছিলেন। নইলে রুপালি ট্রফিটায় চুমু খেতে তাঁকে আরও কতকাল অপেক্ষা করতে হতো, কে জানে!

আরও পড়ুন