১৭ বছর পর শিরোপা জিতল ‘ট্রফিহীন ক্লাব’

‘খুব একটা ট্রফি জিতি না আমি, তবে দ্বিতীয় বছর আমি সবসময় ট্রফি জিতি।’। কথাটা টটেনহামের অজি কোচ অ্যাঞ্জি পোস্তেকোগলুর। এক বছর আগে বলা তাঁর কথায় ছিল না কোনো ঔদ্ধত্য, চোখে-মুখে ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। পোস্তেকোগলুর সেই কনফিডেন্স পুরো ফুটবল দুনিয়ার সামনে তাঁকে বানিয়েছিল হাসির খোরাক। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছুই না।

পোস্তেকোগলু ফুটবল দুনিয়ার খুব একটা পরিচিত নাম নন। কয়েক বছর আগেও তিনি ছিলেন নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। হুট করেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লিগে তাঁর পদচারণা। যেখানে পদে পদে তাঁকে ধরাশায়ী করতে প্রস্তুত পেপ গার্দিওলা, আর্নে স্লট, এনজো মারেসকারা। অন্য কোনো দল হলেও হয়তো আমলে নেওয়া যেত। কিন্তু পোস্তেকোগলুর অধীনে যে দল, তারা শেষ কবে শিরোপা জিতেছে তা গুনতে হাতের কড় শেষ হয়ে যাওয়ার দশা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের পরিচয় ‘ট্রফিহীন সেই দলটা’ হিসেবে।

বছরের হিসেব করলে টটেনহাম নামের পাশে শিরোপা নেই ১৭ বছর। দিনের হিসেবে ৬২৯৪ দিন। বিশাল লম্বা পথচলায় কত রথী-মহারথী নাম লিখিয়েছেন টটেনহামে। গ্যারেথ বেল, লুকা মদ্রিচ থেকে শুরু করে হ্যারি কেইন। তারকাখ্যাতি তাদের নামের সঙ্গে শোভা পেয়েছে, পায়নি শুধু শিরোপার ছোঁয়া। শুধু কি খেলোয়াড়? তারকা কোচদের মিলনমেলা ছিল হোয়াইট হার্ট লেন। মাউরিসিও পচেত্তিনো নামযশ কামিয়েছেন টটেনহামের সাদা জার্সিতে। যোগ দিয়েছিলেন হ্যারি রেডন্যাপ, হোসে মোরিনহো, অ্যান্তোনিও কন্তের মতো নামিদামি কোচেরা। জীবনে ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি না দেখা কোচেরা মুখ থুবড়ে পরতেন টটেনহামের সান্নিধ্যে এসে।

টটেনহাম তাই ক্রমেই হয়ে উঠেছিল ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। এর পেছনে খেলোয়াড় কিংবা কোচের যতটা না দোষ, তার সমান দোষ বর্তায় টটেনহাম চেয়ারম্যান ডনিয়েল লেভির ওপর। লেভিকে ধরা হয় ফুটবল দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ চেয়ারম্যান হিসেবে। তাঁর টেবিল থেকে ডিল সম্পন্ন করে ফেরা যেন বাঘের মুখ থেকে মাংস ছিনিয়ে আনা। অন্যান্য দল দূরে থাক, নিজ দলের ম্যানেজাররা পর্যন্ত মাথা খুড়ে মরতেন নতুন দলবদলের জন্য। কিন্তু নতুন খেলোয়াড়ের খোঁজ পেতেন না। এ নিয়ে মরিনহো, কন্তের অভিযোগের অন্ত ছিল না। অ্যাঞ্জি পোস্তকোগলু যখন টটেনহামের দায়িত্ব পান, তখন তাঁর মাথার ওপর দলবদলের খড়্গ একটা ছিলই। এতদিন এক হ্যারি কেইনের ওপর ভর করা স্পার্স কেইনকে হারিয়ে হয়ে পড়ে দিশেহারা। কেইনের অভাব পূরণ করতেই দরকার ছিল বিশাল দলবদল। বড় অঙ্কের খরচ শেষে অ্যাঞ্জি পোস্তকোগলু নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন ইউরোপা লিগের স্পট। মৌসুমের শেষদিন কোচের মুখ থেকে নিশ্রিত হয় সেই অমোঘ বাণী। দ্বিতীয় মৌসুম আমি শিরোপাবিহীন থাকি না।

দ্বিতীয় মৌসুমে শিরোপা জিতে খরা কাটালেন কোচ অ্যাঞ্জি পোস্তকোগলু।
ছবি: এক্স

মৌসুমের শুরু থেকেই টটেনহাম ঘুরপাক খেয়েছে হারের বৃত্তে। তৃতীয় ম্যাচে প্রথম হারের মুখ দেখে টটেনহাম। এরপর থেকে শুধু ইহারের বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে তারা। প্রথমবারের মতো বড়োদিন পালন করেছে লিগের দ্বিতীয় হাফে থেকে। লিগ টেবিলে তাদের অবস্থানই যথেষ্ট ছিল কোচকে বরখাস্ত করার জন্য। কিন্তু অ্যাঞ্জি পোস্তকোগলুর যেভাবে দল সামলাচ্ছেন, তাতে বাকিদের কিছু বলার ছিল না। পুরো দলে এমন একজন খেলোয়াড়ও নেই, যিনি লিগে ৩০ ম্যাচের প্রথম একাদশে ছিলেন। প্রতিদিনই নিত্যনতুন খেলোয়াড় পড়তেন চোটের কবলে। পুরো মৌসুমে এক ম্যাচের জন্যও নিজের পুরো স্কোয়াডকে ফিট পাননি তিনি। ডিফেন্ডার আর্চি গ্রে আর পেদ্রো পোরো ছাড়া প্রত্যেকেই অন্তত কয়েক ম্যাচের জন্য ছিলেন মাঠের বাইরে। ফলে কেউই একাদশে জায়গা পাকাপোক্ত করতে পারেননি। কারণ সেই একটাই, চোটের ওপর চোট।

এক মৌসুমে এত চোটের শিকার হলে তার দায় কিছুটা হলেও কোচের ওপর বর্তায়। কিন্তু এতে যতটা না কোচের দোষ, তার থেকে বেশি দুর্ভাগ্য। বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই চোটে পড়েছেন প্রতিপক্ষের ট্যাকেলে। এমনও সময় গিয়েছে যেখানে দলের ১০ জন খেলোয়াড় চোটের কারণে মাঠের বাইরে।

খেলোয়াড়দের ক্রমাগত চোটের কারণে নিজের ট্যাকটিস পর্যন্ত ঠিকঠাক গুছিয়ে উঠতে পারেনি পোস্তেকোগলু। ফলে যতই মৌসুম এগিয়েছে, শোচনীয় হয়েছে টটেনহামের অবস্থা। বড়দিনের মাঝামাঝি এসে কোচ নিজেও বুঝে গিয়েছিলেন, এই মৌসুম বাঁচানোর আর কোনো সম্ভাবনা নেই তাঁর। ফলে একমাত্র শিরোপার সম্ভাবনা বেঁচে আছে ইএফএল কাপ আর ইউরোপা লিগে। ফলে লিগ ম্যাচের ভাবনা বাদ দিয়ে সকল মনোযোগ দিলেন কাপের ম্যাচে।

ইএফএল কাপের সেমি ফাইনালে প্রথম লেগ পর্যন্ত এগিয়ে ছিল টটেনহাম। কিন্তু সবটা মাটি করে দ্বিতীয় লেগ। অল রেডদের কাছে চার গোল হজম করে লিগ কাপ হাতছাড়া হয় স্পার্সের। অন্যদিকে লিগে অবস্থান অবনমনের কাছাকাছি। শেষ ভরসা হিসেবে বাকি থাকে ইউরোপা লিগ। সেখানেই পড়ে সবার নজর।

ইউরোপা লিগের গ্রুপ পর্ব শেষে চতুর্থ অবস্থানে ছিল টটেনহাম। এরপর শেষ ষোলোতে এজেড, কোয়ার্টারে ফ্র্যাংকফ্রুট, সেমিতে বোদো/গ্লিমটকে হারিয়ে পৌঁছে যায় ফাইনালে। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ বহু পরিচিত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তাদের অবস্থাও যে খুব একটা ভালো, তা নয়। আয়নায় তাকালে একে অপরের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারবে যেন। লিগে শোচনীয় অবস্থা, আছে ১৬তম অবস্থানে। মাঝপথে বরখাস্ত হয়েছেন কোচ। চ্যাম্পিয়নস লিগে সরাসরি সুযোগ পেতে চাইলে একমাত্র পথ ইউরোপা লিগ। ইউনাইটেডের জন্য লড়াইটা টটেনহামের মতোই করুন। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে চাইলে ফাইনাল জেতা ছাড়া কোনো উপায় খোলা নেই তাদের সামনে।

সনের মুখে হাসি, হাতে শিরোপা।
ছবি: এক্স

ডু অর ডাই লড়াইয়ে বিলবাওতে নামল ইউনাইটেড আর স্পার্স। ইউনাইটেডের ইউরোপিয়ান শিরোপা নেই প্রায় ৮ বছর। অন্যদিকে টটেনহামের ক্যাবিনেটে শিরোপা নেই ১৭ বছর। দুইদলের লড়াইটা নিজেদের সমর্থকদের মুখে শেষ হাসি ফিরিয়ে আনার। দুই দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ব্রেনান জনসনের একমাত্র গোলে । নিশ্চিত হলো টটেনহামের শিরোপা। তবে গোলের চেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে রইল মিকি ভ্যান দি ভেনের দুর্দান্ত গোল লাইন সেভ। গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে রসমস হুইল্যান্ডের হেড জালে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল। উড়ে এসে জুড়ে বসে সেই গোল থামিয়ে হিরো বনে গেছেন দি ভেন। আর শেষ বাঁশি বাজতেই ফুরালো সতেরো বছরের অপেক্ষা। সোশ্যাল মিডিয়ায় টটেনহামকে কেন্দ্র করে করা ‘নো ট্রফি’ জোকের অবসান ঘটল অবশেষে।

এক সেভ দিয়ে হিরো বনে গেছেন ডি ভেন।
ছবি: এক্স

টটেনহামের শিরোপা জয়ের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন গ্যারেথ বেল। সেই বেল, যিনি টটেনহামকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ইউরোপের মঞ্চে। লেফট ব্যাক থেকে লেফট উইঙ্গার হয়েছেন; বিশ্বসেরাদের মঞ্চে তুলে নিয়ে গিয়েছেন স্পার্সকে। টটেনহাম ছেড়েছেন, খেলা ছেড়েছেন। কিন্তু আবেগটা রয়ে গেছে। তার সামনেই শিরোপার উল্লাস করেছেন হিউয়েন মিন সন। বছর খানেক আগেও যিনি দাবি করেছিলেন, তিনি টটেনহামের কিংবদন্তি নন। শিরোপা জিততে না পারলে কীসের কিংবদন্তি? সন ইতিহাস গড়েছেন। ১৭ বছর পর শুধু শিরোপাই জেতেননি, অধিনায়ক হিসেবে পূরণ করেছেন স্পার্সের স্বপ্ন। বছরের পর বছর ধরে যে আক্ষেপ পুষে রেখেছিলেন মনে, সেই আক্ষেপ স্পার্স মিটিয়েছে লন্ডনের রাস্তায়, ট্রফি প্যারেডে শামিল হয়েছে লাখ লাখ স্পার্স সমর্থক। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন সন, বেন ডেভিসরা। এত বছর ধরে যে ক্লাবকে অন্তরে ধারণ করেছেন, শত দুর্যোগেও হাল ছাড়েননি। তাদের নিয়ে শীর্ষ পৌঁছানোর আনন্দই তো আলাদা। ১৭ বছর পর স্পার্সের শিরোপা জয় যেন সেটাই জানান দিয়ে গেল আরেকবার।

আরও পড়ুন