যে কৌশলে ইন্টারকে উড়িয়ে দিল পিএসজি
২০১১ সালে প্যারিস সেন্ট জার্মেইকে কেনে কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট। তারপর থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল ফ্রান্সের ক্লাবটিকে ইউরোপের সেরা বানানো। সেজন্যে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতে বিন্দুমাত্র দ্বিধায় ভোগেনি তারা। ওই আমলের বেকহ্যাম, ইব্রাহিমোভিচ থেকে শুরু করে নেইমার, এমবাপ্পে, এমনকি মেসির মতো সুপারস্টারদের দলে ভিড়িয়েছে তারা, কিন্তু কোনো কিছুতেই সাফল্য মেলেনি। ধরে নেয়া হচ্ছিল, পিএসজি হচ্ছে ক্লাসের সেই ফার্স্ট বেঞ্চের ছেলেটি, যে ক্লাসের সব পড়া পারে, কিন্তু পরীক্ষায় বসলেই আর ভালো করতে পারে না। ২০২০ সালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল হেরে এ উপমাকে পোক্ত করেছিল লা পারিসিয়ানরা।
অবশেষে সেই তকমা ঝরে পড়ল প্যারিস সেন্ট জার্মেই’র গা থেকে। পিএসজি এখন ইউরোপ সেরা। ইউরোপিয়ান কাপ যেন ঘরেই ফিরল! সেই ১৯৫৪ সালে প্যারিসে ফ্রেঞ্চ ক্রীড়া পত্রিকা ‘এল’ ইকুইপে’-এর অফিসে বসেই জন্ম নিয়েছিল ইউরোপিয়ান কাপের আইডিয়া। পরে ১৯৯২ সালে এই টুর্নামেন্ট নাম বদলে হয় চ্যাম্পিয়নস লিগ। প্যারিসে জন্ম নেয়া সেই শিরোপা তাই অবশেষে প্যারিসে ফিরছে।
অবশ্য অন্যবারের তুলনায় এবারের পিএসজি একেবারে সাদামাটা। দলে মেসি, নেইমার, এমবাপ্পের মতো বড় কোনো নাম নেই। নেই আসরের ফেভারিট হওয়ার চাপও। কিন্তু এবারই পিএসজি খেলল নিজেদের ক্লাব ইতিহাসের সেরা ফুটবল। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে স্রেফ উড়িয়ে দিল টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা দল ইন্টার মিলানকে। ম্যাচটা যে এমন একপেশে হবে, সেটা কেউই ভাবেনি। অন্তত হলেও সেটা যে পিএসজির পক্ষে যাবে, এটা নিয়ে কোনো জুয়াড়িও বোধহয় বাজি ধরেননি। লুইস এনরিকের অনবদ্য ফুটবল দর্শনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রইলো স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক কিংবা ইন্টারের খেলোয়াড়েরাও, নইলে ফাইনালে এসে ৫ গোল হজম করে কোনো দল!
প্যারিস সেন্ট জার্মেই -এর দর্শনটাও এর কাছাকাছি। কিন্তু আরও আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে লুইস এনরিকের দল। শুধু যে আক্রমণ তাই নয়, বলের পজেশন দখলে রাখা, ফ্লুইডের মতো সব খেলোয়াড়ের জায়গা বদল করতে থাকাও তাদের খেলার অংশ।
পিএসজির ৪-৩-৩ ফরমেশনের বিপরীতে ইন্টারের ছিল চিরচেনা ৩-৫-২ ফরমেশন। ইন্টারের এই ফরমেশনে আটকে গেছে বায়ার্ন, বার্সেলোনার মতো বড় দলগুলো। স্ট্রাইকারে লাওতারো মার্তিনেজের সঙ্গে মার্কাস থুরাম, মিডফিল্ডে মিখিতারিয়ান-চালাহনলু-বারেল্লার দুই পাশে উইংব্যাক হিসেবে খেলেন ডামফ্রিস ও ডি মারকিও, আর ডিফেন্সে তাদের ত্রয়ীর নাম বাস্তোনি-আচেরবি-পাভার্ড। মোটা দাগে এই ফরমেশনে প্রতিপক্ষ বেগ পায় ইন্টারের দুই উইংব্যাক ডামফ্রিস ও ডি মারকিওকে আটকাতে। তাঁদের আক্রমণাত্মক মানসিকতার ওপর ভর করে ইন্টার খেলে কাউন্টার অ্যাটাকে। আক্রমণ শুরু হলে তাঁদের সঙ্গে দুই ফরোয়ার্ড এবং মিডফিল্ড থেকে দারুণভাবে দৌড় দিয়ে ডি-বক্সে পৌঁছে যান বারেল্লা-মিখিতারিয়ান। কাউন্টার অ্যাটাকের এই ধরনে হুট করেই প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা সংখ্যায় কমে যায়, আর এতেই গোল করার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি করে ইন্টার।
প্যারিস সেন্ট জার্মেই -এর দর্শনটাও এর কাছাকাছি। কিন্তু আরও আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে লুইস এনরিকের দল। শুধু যে আক্রমণ তাই নয়, বলের পজেশন দখলে রাখা, ফ্লুইডের মতো সব খেলোয়াড়ের জায়গা বদল করতে থাকাও তাদের খেলার অংশ। এটা সামলাতেই খাবি খেয়েছে ইন্টার। প্রথমত, সিমোনে ইনজাঘির দল নিজেদের স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ভঙ্গি থেকে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ম্যাচ শুরু করেছে। ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজার পর থেকেই পিএসজি তাই পালটা আক্রমণের ভয় না পেয়ে আক্রমণের পর আক্রমণ করে গেছে। দ্বিতীয়ত, পিএসজির ফ্লুইডিটির কাছে এলোমেলো হয়ে গেছে ইন্টারের রক্ষণ। কখনো স্ট্রাইকার হিসেবে শুরু করা দেম্বেলে চলে গেছেন রাইট উইংয়ে, কখনো রাইট উইঙ্গার থাকা দেজিরে দুয়ে পজিশন চেঞ্জ করে চলে আসছিলেন ফরোয়ার্ড হিসেবে, আবার কখনোবা বক্সের মধ্যে স্ট্রাইকারের পজিশনে চলে আসেন দুই ফুলব্যাক। ঠিক প্রথম গোলের সময় হাকিমি যেমন ছিলেন!
ইন্টার মিলান থেকে পিএসজিতে যোগ দেয়া মরোক্কের ফুটবলার হাকিমি যে কখন স্ট্রাইকারের জায়গায় চলে এসেছেন, সেটা বুঝতেই পারেনি ইনজাঘির শিষ্যরা। ফাঁকায় দাঁড়িয়ে একেবারে নিশ্চিন্তে গোল দিয়েছেন তিনি। শুধু যে ফ্লুইড ফুটবলের কাছেই হার মেনেছে ইন্টার তা না, দ্বিতীয় গোলে তারা পরাস্ত হয়েছে প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের করা কাউন্টার অ্যাটাকে। পিএসজির ডি-বক্সে লং থ্রো করতে গিয়ে বল হারিয়ে ফেলে ইন্টার, তারপর দুর্দান্ত গতিতে ইন্টারের অর্ধে ঢুকে সতীর্থ দুয়েকে বল পাস দেন ওসুমানে দেম্বেলে। দুয়ের নেয়া শট শেষ পর্যন্ত ইন্টারের উইংব্যাক ডি মারকিও-এর গায়ে লেগে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে জড়িয়ে যায় জালে।
দ্বিতীয়ার্ধের পিএসজি হয়ে উঠল আরও ভয়ানক। মুখ থুবড়ে পড়া ইন্টারকে ধাক্কা দিলেন ভিতিনহা। তাঁর চোখ ধাঁধানো পাসে নিজের দ্বিতীয় গোল করে ম্যাচের নায়ক হয়ে রইলেন দেজিরে দুয়ে। মাত্র ১৯ বছর বয়সী এই ফ্রেঞ্চ ফুটবলার যে প্যারিসের নতুন তারকা, এতে আর কোনো সন্দেহ নেই।
ম্যাচের ভাগ্য যেন সেখানেই নির্ধারিত হয়ে যায়। মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যে এই দুই গোল ইন্টারের মনোবল ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়। খেলা থেকে ছিটকে পড়ার পর শুরু হয় তাদের এলোমেলো ফুটবল। এতদিন যে লং বলের পাস প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপন ধরাতো, সেই লং বল এবার নখদন্তহীন। লাওতারো মার্তিনেজ কিংবা থুরাম, কেউই পারেননি প্যারিসের ডি-বক্সে ভয় ধরাতে। মিডফিল্ডে থাকা চালাহনোলু কিংবা বারেল্লা ছায়া হয়ে রইলেন পুরো ম্যাচে।
দ্বিতীয়ার্ধের পিএসজি হয়ে উঠল আরও ভয়ানক। মুখ থুবড়ে পড়া ইন্টারকে ধাক্কা দিলেন ভিতিনহা। তাঁর চোখ ধাঁধানো পাসে নিজের দ্বিতীয় গোল করে ম্যাচের নায়ক হয়ে রইলেন দেজিরে দুয়ে। মাত্র ১৯ বছর বয়সী এই ফ্রেঞ্চ ফুটবলার যে প্যারিসের নতুন তারকা, এতে আর কোনো সন্দেহ নেই। এরপর ম্যাচের চতুর্থ ও পঞ্চম গোল করে পিএসজিকে রেকর্ডবুকে তুলেছেন কাভারেস্কাইয়া ও মাইয়ুলু। কেননা ইউরোপিয়ান কাপ বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে ৫-০ গোলের ব্যবধানে জেতেনি কেউ!
কোনো বড় তারকা ছাড়া যে কেবল ফুটবল দর্শন দিয়েই ইউরোপ সেরা হওয়া যায়, তার প্রমাণ রাখলেন লুইস এনরিকে। নিজের আক্রমণাত্মক ও পজেশনভিত্তিক ফুটবল দর্শন প্যারিসে আনতে বেশ কাঠখড় পুড়িয়েছেন তিনি। এমবাপ্পে, নেইমারের চলে যাওয়ায় পিএসজির আক্রমণভাগে বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দলগত ফুটবলের সৌন্দর্যে সেসব ভুলেই গেছেন প্যারিসের ভক্তরা। তাই তো একক কোনো খেলোয়াড়কে নয়, বরং পুরো পিএসজি স্কোয়াডের প্রশংসায় মেতেছেন তারা।