ফুটবলের দলবদলের অদ্ভুত সব গল্প

দলবদলের মৌসুম ফুটবলপ্রেমীদের কাছে ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমার মতোই রোমাঞ্চকর। মুহূর্তেই পাল্টে যেতে পারে ঘটনা, হাসি-কান্না-আবেগ জড়িয়ে থাকে প্রতিটি হওয়া কিংবা না হওয়া দলবদলে। প্রতি দলবদলের মৌসুমেই রোমাঞ্চকর কিছু ঘটনা ঘটে, যা ভক্তদের মনে গেঁথে থাকে অনেক দিন। এই মৌসুমে ঘটে যাওয়া সেসব ঘটনা নিয়েই আজকের লেখা।

শূন্য থেকে শিখরে

নিউক্যাসলের ৬ ফুট ৬ ইঞ্চির স্ট্রাইকার নিক ভোল্টমাড। ছবি: এক্স

নিউক্যাসল থেকে লিভারপুলে যাওয়ার জন্য কম নাটক করেননি অ্যালেকজেন্দার ইসাক। কিন্তু একজন ব্যাকআপ খেলোয়াড় ছাড়া তাঁকে কোনোভাবেই ছাড়তে রাজি ছিল না নিউক্যাসল। শেষ দিন এসে যখন নিজেদের পছন্দমতো স্ট্রাইকার খুঁজে পেল নিউক্যাসল, তখনই নিশ্চিত হলো ইসাকের বিদায়। মজার ব্যাপার হলো ইসাকের পরিবর্তে আসা স্ট্রাইকার আগের মৌসুমেই ছিলেন ‘ফ্রি ট্রান্সফার’। এক মৌসুম আগে তাঁকে কিনতে একটা পয়সাও খরচ করতে হয়নি স্টুটগার্ডের। সেই ফ্রিতে কেনা খেলোয়াড় নিউক্যাসলে এসেছেন ক্লাবের সব রেকর্ড ভেঙে। বলছি জার্মান স্ট্রাইকার নিক ভোল্টমাডের কথা।

আরও পড়ুন

২৩ বছর বয়সী স্ট্রাইকারের উত্থান হয়েছে এই মৌসুমেই। একেবারে রাজকীয় উত্থান যাকে বলে। স্টুটগার্ডের ব্যাকআপ স্ট্রাইকার থেকে জার্মান দলে অভিষেক হয়ে গেছে তাঁর। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি দানবীয় এই স্ট্রাইকার ২৩-২৪ মৌসুমে খেলেছেন ভের্ডার ব্রেমেনের জার্সিতে। কিন্তু ৩০ ম্যাচে ২ গোল করা স্ট্রাইকারের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি তারা। তাই তো একেবারে ফ্রিতে তাঁকে ছেড়ে দেয় স্টুটগার্ডের কাছে। স্টুডগার্ডে এসে যেন প্রাণ ফিরে পান ভোল্টমাড। রীতিমতো পরিণত হন আগ্রাসী এক স্ট্রাইকারে। ৩৩ ম্যাচে ১৭ গোল করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেন বুন্দেসলিগায়। গোলমুখে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখে ডাক পড়ে জার্মান জাতীয় দলে। ২ ম্যাচে গোল না পেলেও পারফরম্যান্স খারাপ ছিল না।

নিউক্যাসল যখন ইসাকের পরিবর্তে কাকে দলে নেবে, সে নিয়ে চিন্তায় ব্যস্ত, তখনই চোখ পড়ে নিক ভোল্টমাডের ওপর। গত মৌসুমে ১৭ গোল করা স্ট্রাইকারের জন্য ব্যাংক ভাঙতেও দ্বিধা ছিল না তাদের। যদিও স্টুটগার্ড সুযোগটা নিয়েছে ভালোমতো। ইসাক চলে গেলে বেশ বিপদেই পড়ত নিউক্যাসল, তাই বাটে পেয়ে তাদের কাছ থেকে সুদে-আসলে টাকা তুলে নিয়েছে তারা। ভোল্টমাডকে কিনতে নিউক্যাসলের খরচ হয়েছে ৬৯ মিলিয়ন পাউন্ড। এর সঙ্গে রয়েছে বোনাস ও অ্যাড অন। সব মিলিয়ে খরচ পড়বে ৮৫ মিলিয়ন পাউন্ড।

তবে ভোল্টমাডকে ‘ওয়ান সিজন ওয়ান্ডার’ ভাবার কারণ নেই। এখন দেখা যাক এত টাকার মূল্য রাখতে পারেন কি না অনুর্ধ্ব-২১ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা।

আরও পড়ুন

যাঁদের হারালেন, তাঁদেরই হলেন

ফেরেনবাচের জার্সিতে কেরেম আকতরগ্লু। ছবি: এক্স

গোল করার পর হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাচ্ছেন গোলদাতা। এমন দৃশ্য ফুটবল মাঠে অনেক সময়ই চোখে পড়ে। সাধারণত সাবেক দলের বিপক্ষে গোল করলে এমনটা দেখা যায়। কিন্তু এবার ঘটনা ঘটেছে উল্টো, খেলোয়াড়ের একমাত্র গোলেই বিদায় নিয়েছে ‘ভবিষ্যৎ’ ফুটবল দল। এমনকি বরখাস্ত হয়েছেন কোচও।

ঘটনার সূত্রপাত বেনফিকা আর ফেরেনবাচের চ্যাম্পিয়নস লিগ বাছাইপর্বের ম্যাচে। জিতলেই চ্যাম্পিয়নস লিগ সমীকরণ যখন সামনে, তখন বেনফিকার নায়ক হয়ে উঠলেন কেরেম আকতরগ্লু। ৩৫ মিনিটে করা তাঁর একমাত্র গোলেই চ্যাম্পিয়নস লিগ নিশ্চিত করে বেনফিকা। মজার ব্যাপার হলো, এক মাস ধরে বেনফিকা আর ফেরেনবাচের মধ্যে কথাবার্তা চলছে এই আকতরগুলের ব্যাপারে। হোসে মোরিনহোর বিশেষ আগ্রহ ছিল তাঁর ব্যাপারে। মৌখিক কথাবার্তা যখন শেষ, বাকি শুধু কাগজে-কলমে আনুষ্ঠানিকতা, তখনই দুঃস্বপ্নের মতো এলেন আকতরগ্লু। ফেরেনবাচকে হারিয়ে বেনফিকাকে নিয়ে গেলেন চ্যাম্পিয়নস লিগে। আর তার পরদিনই স্বাক্ষর করলেন ফেরেনবাচে। যে দলকে হারিয়েছেন, সেই দলে যোগ দিলেন সপ্তাহ গড়াতে না গড়াতে। ২৪ মিলিয়ন ইউরোর বদলে স্বাক্ষর করে দেখলেন, না আছে সমর্থকদের উল্লাস, আর না আছে তাঁকে আনা কোচ। দোষটা যে দিন শেষে তাঁরই।

আরেকটা মজার ঘটনা কি জানো? কেরেম আকতরগ্লু বেনফিকার আগে ছিলেন ফেরেনবাচের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী গ্যালাতেসারের খেলোয়াড়। ২৬ বছর বয়সী এই উইঙ্গার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর হয়ে খেলা সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়ও বটে!

আরও পড়ুন

মারামারি থেকে মুখোমুখি

প্রথম ম্যাচেই মারামারিতে জড়িয়েছেন রো এবং রাবিও। ছবি: এক্স

মৌসুমের একদম প্রথম ম্যাচ, ফ্রেঞ্চ লিগে মার্শেই মুখোমুখি হয়েছে রেঁনের। কিন্তু ম্যাচ শেষ হতে না হতেই বিপত্তি, প্রথমে ঝগড়া এরপর রীতিমতো হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লেন দুই খেলোয়াড়। তা–ও ম্যাচের হাফ টাইমে। আন্দ্রে রাবিও আর জোনাথন রোকে ধরে আলাদা করতে হয়েছিল সতীর্থদের। গোল হজম করার পেছনে দুইজন দোষী করছিলেন দুইজনকে। যদিও সেই গোলেই হারতে হয়েছে মার্শেইকে। সেই ঘটনার রেশ ছিল পরদিন অনুশীলনেও।

মার্শেই বোর্ড এত ঝুট ঝামেলার মধ্যে যায়নি। পত্রপাথে বিদায় বলেছে দুইজনকেই। এক সপ্তাহের মধ্যে দুইজনই যোগ দিয়েছেন সিরি-আতে। জোনাথন রো যোগ দিয়েছেন বোলোনিয়াতে, আন্দ্রে রাবিও যোগ দিয়েছেন এসি মিলানে। একটু ভেবে বলো তো, পরবর্তী সিরি-আ ম্যাচ কোনটি?

ঠিকই ধরেছো, আন্তর্জাতিক বিরতির পর ইতালিয়ান লিগের প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি হবে বোলোনিয়া আর মিলান। সেখানে আবারও দেখা হবে দুই পক্ষের। দেখা যাক, মারামারির রেশ সেই পর্যন্ত যায় কি না?

আরও পড়ুন

যে দলবদল জানেনি কেউ

প্রেসিডেন্টের ইচ্ছাতেই গোপনে চুক্তি করা হয়েছে ডি জংয়ের।
ছবি: এক্স

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে এসে প্রতিটি মুহূর্ত বন্দী থাকে ক্যামেরার কোনায়। সবাইকে জানাতে ফাবরিজিও রোমানো, ডেভিড অর্নস্টেইনের মতো বাঘা বাঘা সাংবাদিকেরা খুঁজে খুঁজে হয়রান হন দলবদলের খোঁজখবর। যেখানে ক্লাবের মাঠ থেকে কাকপক্ষী বের হলেও খবর আসে, সেখানে আস্ত দলবদল হয়ে গেছে জানেনি কেউ। এমন ঘটনাই ঘটিয়েছে পর্তুগিজ লিগের ক্লাব পোর্তো।

মৌসুমের প্রথম ম্যাচের আগে খেলোয়াড়দের একে একে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষ। একে একে সব খেলোয়াড়কে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর একটু সময় নেন তাঁরা, এরপর ঘোষণা সারপ্রাইজের। ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসেন ডাচ স্ট্রাইকার লুক ডি জং। তাঁর এই দলবদলের ব্যাপারে জানা ছিল না কারোরই। হেভিওয়েট সাংবাদিক থেকে শুরু করে দলের সমর্থক এমনকি খেলোয়াড়েরা পর্যন্ত জানতেন না এই দলবদলের কথা। একেবারে গোপনীয়তা মেনে আনা হয়েছিল মাঠে, বানানো হয়েছিল জার্সি, এরপর চমক দেখা গেছে মাঠে।

এমন চমক যেন এক ধাক্কায় ১০-১৫ বছর আগে ফেরত নিয়ে গিয়েছিল ফুটবলপ্রেমীদের। দলবদল নিশ্চিত হওয়ার আগে জানা যেত না কোনো খবর। একমাত্র উপায় ছিল ক্লাবের নিজস্ব ঘোষণা। লুই ডি জংয়ের প্রেজেন্টেশন যেন সেখানেই ফেরত নিয়ে গেল সবাইকে।

আরও পড়ুন