বাংলাদেশ এখন সহযোগী দেশগুলোর সহজ প্রতিপক্ষ
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় দুঃসময় কোনটি? ক্রিকেটের পথচলা থেকে দেখে আসা যে কারও মতে, সময়টা ১৯৯৯ থেকে ২০০৩। চার বছরে টানা ৫৩ ম্যাচে হারের দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশ। জয় শব্দটা যেন নিজেদের অভিধানে তুলতেই পারছিল না টাইগাররা। তবে সে অনেক আগের কথা। তখনও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ছিল সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু। এখনকার বাংলাদেশের সঙ্গে সেই বাংলাদেশের তুলনা হয় না। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ যেন সেই পুরোনো জায়গাতেই ফিরে গেছে। আইসিসির সহযোগী দলগুলোর জয়ের খাতা খোলা হয় বাংলাদেশকে দিয়েই।
ক্রিকেট দুনিয়ায় বাংলাদেশ এখন বড় নাম। সামর্থ্যে না হলেও কাগজে-কলমে তো বটেই। ২৫ বছর ধরে টেস্ট খেলছে বাংলাদেশ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল, বিশ্বকাপের কোয়ার্টার খেলার রেকর্ড আছে দলটির নামের পাশে। আর কেউ না হোক, সহযোগী দেশগুলোর সামনে বাংলাদেশ বড় নামই বটে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগী দেশগুলোর সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে। কেবল বড় দল নয়, বরং সহযোগী দেশগুলোর কাছেও বাংলাদেশ এখন ‘টার্গেট প্র্যাক্টিস’। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যেন, ‘টেস্টখেলুড়ে দলকে হারাতে চান? বাংলাদেশকে ডাকুন।’ বিশেষ করে ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাট টি-টোয়ান্টিতে।
২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়ালো, বাংলাদেশকে নিয়ে আশা দেখেছিলেন অনেকে। দেখবেন না-ই বা কেন? নতুন একটা দল, মাত্র আন্তর্জাতিক ফরম্যাটে খেলতে শুরু করেছে। নতুন একটা ফরম্যাট যেখানে ধুমধারাক্কা চার-ছয়ের খেলা, টেস্ট-ওয়ানডেতে থিতু হওয়া দলগুলোর তুলনায় এই ফরম্যাটে তরুণদের আধিপত্যই তো বেশি হওয়ার কথা। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছিল সুপার এইটে। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, অধরা সাফল্য ধরা দেবে এই ফরম্যাটের হাত ধরে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এই ফরম্যাটে লজ্জায় ডুবেছে বাংলাদেশ।
সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে প্রথম হারের স্বাদ দিয়েছিল স্কটল্যান্ড। ২০১২ সালে নেদারল্যান্ডসের মাটিতে স্কটল্যান্ড বাংলাদেশকে হারায় ৩৪ রানে। সে ম্যাচে ১০০ করে রিচি বেরিংটন হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। আইসিসির পূর্ণ সদস্যদের বিপক্ষে সেটাই ছিল স্কটল্যান্ডের প্রথম জয়।
তার ঠিক দুদিন পর নেদারল্যান্ডসের কাছে ১ উইকেটে হারের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে লজ্জাটা একটু কমই ছিল। কারণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে ইংল্যান্ডকে ধরাশায়ী করার রেকর্ড আছে ডাচদের। তাদের জন্য বাংলাদেশকে হারানো তেমন বড় কোনো ব্যাপার ছিল না।
বছর দুই পর, ঘরের মাটিতে ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে হারায় হংকং। একে তো নিজেদের মাটিতে বিশ্বকাপ, সেখানেও বাংলাদেশকে খেলতে হয়েছে বাছাইপর্ব। সেখানে হংকংয়ের বিপক্ষে হার যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। ভাগ্যিস নেপাল, আফগানিস্তানের বিপক্ষে জিতেছিল বাংলাদেশ। নইলে সেবার ঘরের মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দর্শক হয়ে থাকতে হতো স্বাগতিকদের। শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে ২ বল হাতে রেখে ২ উইকেটের জয় পায় হংকং। তাদের ক্রিকেট ইতিহাসে এত বড় জয় আসেনি আর কখনও।
এরপর আসে ২০১৮ সাল, এতদিন পর্যন্ত এক দুই ম্যাচে হেরে অন্তত শিরোপা নিয়ে ঘরে ফিরেছিল টাইগাররা। কিন্তু বাংলাদেশের আফগানিস্তান সফর বদলে দেয় সকল হিসেব নিকেশ। কাগজে-কলমে সফরটা আফগানিস্তানে হলেও খেলা হয়েছিল ভারতের দেহরাদুনে। সেখানে ৩ ম্যাচে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইট ওয়াশ হয় বাংলাদেশ। জেতা দূরে থাক, লড়াই করার মতো অবস্থাই তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিপিএল থেকে নাম কামানো রশিদ খান বাংলাদেশকে সেবার ধরাশায়ী করেছিলেন একাই। আফগানদের অবশ্য এই তালিকায় রাখা যায় না। কারণ ২০১৭ সালেই আইসিসির ১২তম পূর্ণ সদস্য হিসেবে নাম লেখায় আফগানরা। তবুও সদ্য নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল খেলে আসা বাংলাদেশ আফগানদের কাছে হোয়াইটওয়াশ হওয়া, আলাদা করে লেখায় স্থান পাওয়ার মতো।
২০১৯ সালে আবারও যম হয়ে এল আফগানিস্তান। ততদিনে অবশ্য আফগানরা বড় দল হওয়ার স্বাদ পেয়ে গিয়েছে। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ তখনও ধুঁকছে।
করোনার কারণে ক্রিকেটে একপ্রকার স্থবিরতা নেমে এসেছিল ২০২০ সালে, ২০২১ সালে সেই জট খুলতে না খুলতেই সহযোগী দেশগুলোর দরজায় কড়া নাড়ে বাংলাদেশ। এবার একেবারে বিশ্বকাপের মঞ্চে। স্কটল্যান্ডের কাছে ৬ রানে হেরে ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের। ব্যর্থতার ইতিহাসে যুক্ত হয় আরেকটি পালক। সহযোগী দেশগুলোর কাছে হারের পালক।
২০২৩ সালে এসে সেই তালিকায় যুক্ত হয় আয়ারল্যান্ড। যদিও কাগজে-কলমে আয়ারল্যান্ড আর সহযোগী দেশ নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে এসে বাংলাদেশকে টি-টোয়েন্টিতে হারানোর কথা হয়তো আইরিশরাও নিশ্চিত করে ভাবেনি। চট্টগ্রামে ৭ উইকেটের জয় তুলে নিয়ে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে হারানোর স্বাদ পায় আয়ারল্যান্ড।
২০২৪ বিশ্বকাপের আগে বিশাল তালিকায় নতুন নাম হিসেবে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যে দেশের বিশ্বকাপ খেলা দূরে থাক, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট চলছেই ধার দেনা করা খেলোয়াড় দিয়ে, বাংলাদেশকে হারতে হয়েছে সেই দেশের কাছেও। ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সিরিজ খেলতে যায় বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে উলটো ধরাশায়ী হয়ে আসতে হয় স্বাগতিকদের কাছে হেরে। প্রথম দুই ম্যাচে হেরে শুরুতেই সিরিজ হাতছাড়া করে টাইগাররা। শেষ ম্যাচ জিতলেও, সেটা হয়ে থাকে সান্ত্বনা পুরস্কার।
অতঃপর ২০২৫ সাল। পাকিস্তান সিরিজের আগে আগে প্রস্তুতি হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে প্রত্যাশিত জয় দেখে সবাই ভেবেছিল, বাকি ম্যাচগুলোতেও জয় তুলে আনবে বাংলাদেশ। যে কারণে দুই ম্যাচের সিরিজ টেনে করা হয়েছিল তিন। কিন্তু পরের দুই ম্যাচে ঘুরে গেল পাশার দান। দ্বিতীয় ম্যাচে ২০৫ করেও হারতে হলো ২ উইকেটে। আর তৃতীয় ম্যাচে ৭ উইকেটে হেরে ফসকে গেল সিরিজটাও।
ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে বাংলাদেশ আছে একেবারে শুরু থেকেই। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশ যেন পরিণত হচ্ছে দুর্বল দেশগুলোর সহজ টার্গেটে। বড় দলগুলো লড়ছে না পূর্ণ শক্তির দল নিয়ে, ছোট দলগুলো বাংলাদেশকে হারাচ্ছে বলে কয়ে। ঘুরে ফিরে একই বৃত্তে আটকা পরে গিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। সে বৃত্ত থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না।