গরমের দিনে ঠান্ডা পানীয় খেতে ইচ্ছা করে কেন
গরমের দিনে তীব্র রোদে বাইরে থেকে আসার পর যখন গলা শুকিয়ে যায়, তখন চোখের সামনে এক গ্লাস ঠান্ডা পানীয় দেখলেই যেন মন ভরে ওঠে। সেই ঠান্ডা পানির প্রথম চুমুকটা গলা দিয়ে নামার সময় মনে হয় মুহূর্তেই শরীর মন জুড়িয়ে গেল।
কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছ, এই প্রচণ্ড গরমে কেন আমাদের মন এত বেশি করে ঠান্ডা পানীয় চায়? কেন সাধারণ পানির চেয়ে বরফ ঠান্ডা পানীয় বা সোডা আমাদের কাছে এত সুস্বাদু ও লোভনীয় লাগে? এর পেছনে কি শুধু তৃষ্ণা মেটানোর সাধারণ কারণ লুকিয়ে আছে, নাকি অন্য কোনো কারণ?
মানুষের কার্বনেটেড বা ফিজি ড্রিংকস পান করা কিন্তু খুব পুরোনো অভ্যাস। প্রায় ১৭৬৭ সাল থেকেই এর চল শুরু হয়েছে, যা এখনো চলছে।
কোল্ডড্রিংক বা কার্বনেটেড পানীয় মুখে দেওয়ার পর ঠিক কী কারণে এত ভালো লাগে, সেটা এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। অনেকে মনে করে জিহ্বার ওপর বুদ্বুদগুলো ফাটার জন্যই এমন অনুভূতি হয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এমন একটি বিশেষ জায়গায় বা চেম্বারে পরীক্ষা করে দেখেছেন, যেখানে বুদ্বুদগুলো ফাটতে পারে না। তখনো মানুষ একই রকম স্বাদ ও অনুভূতির কথা বলেছেন। এর থেকে বোঝা যায় এই ব্যাপারটা শুধু বুদ্বুদ ফেটে যাওয়ার মতো সহজ কোনো কারণ নয়।
আসলে এই বিশেষ অনুভূতি হওয়ার মূল কারণ রাসায়নিক বিক্রিয়া। যখন পানির মধ্যে কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্যাস মেশানো হয় তখন এটি কার্বনিক অ্যাসিড তৈরি করে। আমাদের জিহ্বার যে কোষগুলো টক স্বাদ পায় এরা এই অ্যাসিডের স্বাদ পায়। সেই কোষগুলোর মধ্যেই কার্বনিক অ্যানহাইড্রেস নামে একটি বিশেষ এনজাইম থাকে। এই এনজাইমটি কার্বনিক অ্যাসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। যার ফলে আমরা সেই চেনা ঝাঁজালো অনুভূতি বা ‘পপ পপ’ করার মতো শব্দ অনুভব করি।
এই যে এনজাইমের বিক্রিয়া আর আমাদের ট্রাইজেমিনাল স্নায়ুর মিলেই কোল্ডড্রিংক বা কার্বনেটেড পানীয়তে এত দারুণ ও বিশেষ অনুভূতি তৈরি করে। ট্রাইজেমিনাল স্নায়ু মুখমণ্ডল ও মস্তিষ্কের সংযোগকারী বিশেষ স্নায়ু। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পানীয়তে থাকা কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্যাস আসলে আমাদের শরীরে ব্যথা অনুভব করার স্নায়ুগুলোকেও কিছুটা জাগিয়ে তোলে। তবুও এই ঝাঁজালো পানীয়কে মানুষ এত পছন্দ করে।
বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে পানীয় আমাদের অপছন্দ করার কথা, সেটাই আমরা ভালোবাসি। আসলে, কার্বনেটেড পানীয় বা ফিজি ড্রিংকসে যে কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্যাস থাকে তা মুখে একধরনের ঝাঁজালো বা জ্বালাভাব তৈরি করে। এই ঝাঁজালো ভাব আমাদের মস্তিষ্ককে হালকা ব্যথার সংকেত দেয়। এমন একটি স্বাদ আমাদের অপছন্দ করার কথা। তবে মজার বিষয় বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে পানীয়ের মধ্যে কার্বন ডাই–অক্সাইড যত বাড়ে সেই পানীয়টি তত বেশি ঠান্ডা বা শীতল বলে মনে হতে পারে। এই ঝাঁজালো ভাব ও শীতল অনুভূতির মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে। আর এই কারণেই এই পানীয় আমাদের কাছে এত জনপ্রিয়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো মানুষ ছাড়া অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সাধারণত এই ঝাঁজালো স্বাদ একেবারেই পছন্দ করে না। গবেষণায় দেখা গেছে, ইঁদুরকে কার্বনেটেড পানি পান করতে দিলেও এরা তা পান করে না বা পছন্দ করে না।
তাহলে মানুষ কেন এই নিয়মের ব্যতিক্রম? বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এর কারণ হলো কিছু মানুষ আছে যারা জীবনে রোমাঞ্চ বা উত্তেজনা উপভোগ করে। মনোবিজ্ঞানী পল রোজিনের ‘মশলাদার খাবারের তত্ত্ব’ও একই কথা বলে। মানুষ এমন পরিস্থিতি উপভোগ করে যেখানে তাদের শরীর সামান্য বিপদের বিষয়ে সতর্ক করে। কিন্তু তারা জানে যে এটি আসলে ক্ষতিকর নয়। কার্বনেটেড পানির ক্ষেত্রেও একই ধারণা কাজ করে। তবে মানুষ যখন এই পানীয়কে ‘সতেজ’ (রিফ্রেশিং) বলে, তখন তারা ঠিক কী বোঝাতে চায়, বিজ্ঞানীরা এখনো সেটি বোঝার চেষ্টা করছেন।
সূত্র: পপুলার সায়েন্স