মানুষ কেন পুরোনো জিনিস রেখে দিতে ভালোবাসে
তোমার বাসাতে নিশ্চয়ই এমন কিছু জিনিস আছে, যা বছরের পর বছর ধরে ঘরের এক কোণে পড়ে আছে? হয়তো সেটা তোমার ছোটবেলার ভাঙা খেলনা, পুরোনো স্কুলব্যাগ কিংবা এমন জিনিস, যা আজ আর কাজে লাগে না। মাঝেমধ্যে মনে হয় এসব ফেলে দিলেই তো ঘরের অনেকটা জায়গা ফাঁকা হয়। কিন্তু যেই ফেলতে যাবে, তখনই মনে হয় ‘থাকুক, পরে কাজে আসতেও তো পারে’। কেন এমন হয়? কেন আমরা খুব সহজে আমাদের প্রিয় জিনিস বা পুরোনো স্মৃতি জড়ানো জিনিসপত্র ফেলে দিতে পারি না? এর পেছনে কি শুধু মায়া কাজ করে, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
আমাদের মধ্যে অনেকেই কিছু প্রিয় জিনিস জমিয়ে রাখি, যা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু মানুষের মধ্যে এমন একটি অভ্যাস দেখা যায়, যেখানে তাঁরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি জিনিসপত্র জমিয়ে ফেলেন। এই অতি জমিয়ে রাখার প্রবণতাকেই বিজ্ঞানীরা বলছেন ‘মজুতদারি’ (Hoarding)। এ অভ্যাস ঠিক কী এবং কেন মানুষের মধ্যে দেখা যায়, তা নিয়ে গবেষকেরা গবেষণা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা মায়ো ক্লিনিক জানিয়েছে, যাঁদের মধ্যে এমন অভ্যাস আছে, তাঁরা প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত জিনিসপত্র সংগ্রহ করেন এবং সেই জিনিসগুলো ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। যাঁরা এ সমস্যায় ভোগেন, তাঁরা পুরোনো খবরের কাগজ থেকে শুরু করে পোশাক, আসবাব—সবকিছুই জমিয়ে রাখতে পারেন।
কিন্তু কেন কিছু মানুষ এত অপ্রয়োজনীয় জিনিস জমান? আসলে অতিরিক্ত জিনিস জমানোর এ অভ্যাসের পেছনে গভীর কিছু মানসিক কারণ থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প্রথমত, যাঁরা জীবনে বড় কোনো মানসিক কষ্ট বা আঘাতের (ট্রমা) শিকার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এ অভ্যাস বেশি দেখা যায়। কানাডার সমাজকর্মী এলেন বার্চাল জানিয়েছেন, যাঁরা এমন আঘাত পেয়েছেন, তাঁদের জিনিস জমানোর প্রবণতা অন্যদের চেয়ে বেশি হয়।
দ্বিতীয়ত, এটি অনেক সময় মানসিক চাপ কাটানোর একটি উপায় হিসেবে কাজ করে। এ প্রবণতার শিকার কিছু মানুষ মনে করেন, বেশি জিনিস থাকলে তাঁরা নিরাপদ ও সুখী বোধ করবেন, যা মূলত চাপের প্রতি তাঁদের একধরনের প্রতিক্রিয়া।
এ ছাড়া অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি), উদ্বেগ বা বিষণ্নতার মতো কিছু মানসিক সমস্যার সঙ্গেও এর সম্পর্ক আছে। এই রোগগুলো সরাসরি এ অভ্যাস তৈরি না করলেও এ প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে।
অনেকে আবার খুব খুঁতখুঁতে হন। তাঁরা প্রতিটি জিনিস নিয়ে এটি রাখবেন না ফেলে দেবেন, এ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভোগেন। এ সিদ্ধান্তের চাপ যখন খুব বেশি হয়ে যায়, তখন তাঁরা কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং সবকিছু জমিয়ে রাখার সহজ পথটিই বেছে নেন। এ ছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, প্রিয়জনের মৃত্যু, বিবাহবিচ্ছেদ বা সম্পত্তি হারানোর মতো বড় কোনো ঘটনার পরও এ অভ্যাস শুরু হতে পারে।
আবার অনেকের কাছে জিনিসপত্র জমিয়ে রাখার অভ্যাসটি অনেক ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি করে। এর একটি ভালো উদাহরণ দেখা যায় বিখ্যাত ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’ সিরিজের সেল্ডন কুপার চরিত্রের মধ্যে। সিরিজের নবম সিজনের ১৯ নম্বর পর্বে দেখা যায়, সেল্ডন কুপার একটি ভাড়া করা স্টোরে নিজের জীবনে ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিস জমিয়ে রেখেছে। সে এই গুদামকে ‘Fortress of Shame’ বা ‘লজ্জার দুর্গ’ বলে ডাকে। এখানে সে তাঁর অতীতের পুরোনো স্মৃতি ও আবেগ জড়ানো সব জিনিসপত্র যত্ন করে রেখেছে। সেল্ডন কুপারের মতো অনেক মানুষই মনে করেন, জিনিসপত্র জমিয়ে রাখাটা খুবই দরকারি। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ জমানো জিনিসগুলো আসলে খুব কমই কোনো কাজে আসে।
এ ছাড়া মানুষের মনে আরেকটি ভাবনা কাজ করে—হয়তো পুরোনো জিনিস একদিন অনেক দামি হয়ে যাবে। কিছু টিভি অনুষ্ঠানে দেখা যায়, সাধারণ স্টোররুম থেকে বের হওয়া জিনিসের দাম হাজার হাজার ডলার হয়ে গেছে। তখন এ ধারণা আরও শক্তিশালী হয় মানুষের মনে।
গবেষকেরা মনে করেন, এই শোগুলো দর্শকদের বোঝায় যে তাঁদের সাধারণ জিনিসগুলোরও মূল্য আছে। এতে জিনিস জমানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। যদিও পরে কাজে লাগবে ভেবে জিনিস জমিয়ে রাখার এ অভ্যাস বেশির ভাগ মানুষের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক হন না। কিন্তু এ মানসিকতা সেলফ স্টোরেজ ইন্ডাস্ট্রির জন্য খুবই লাভজনক। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ৫০ হাজারের বেশি ভাড়ার স্টোররুম আছে, যা সেসব যাওয়া জিনিসপত্রে ভরা, যা মালিকেরা ব্যবহার করেন না। আবার ফেলে দিতেও পারেন না।
এ অতিরিক্ত জিনিস জমানোর অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমে ধীরে ধীরে শুরু করা খুব জরুরি। পুরো ঘর একসঙ্গে পরিষ্কার করার চেষ্টা না করে শুরুতে একটি ছোট জায়গা যেমন একটি ড্রয়ার বা একটি তাক বাছাই করো।
একটি সহজ বুদ্ধি হলো যদি কোনো জিনিস ছয় মাস বা এক বছর ধরে একেবারেই ব্যবহার না করো, তবে সেটিকে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নাও। মনে রাখবে, জিনিস ফেলার সময় হয়তো তোমার একটু মানসিক চাপ হতে পারে।
তবে যদি দেখো যে এ জমানোর অভ্যাস তোমার জীবনকে অস্বাস্থ্যকর বা বিপজ্জনক করে তুলছে, তাহলে অবশ্যই একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শদাতার সাহায্য নেওয়া উচিত। কারণ, তখন এ অভ্যাস মনের গভীরে থাকা কোনো অন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। যার জন্য পেশাদার সাহায্য দরকার।
সূত্র: লাইভসায়েন্স, ডিসকভার ম্যাগাজিন, সাইকোলজি টুডে