নেকড়ে যেভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছিল ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক
১৮৭২ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো ও মনটানা অঙ্গরাজ্যের মাঝামাঝি একটা বনাঞ্চলকে ন্যাশান্যাল পার্কে রূপ দেওয়া হয়। নাম রাখা হয় ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। জাতীয় উদ্যান মানেই সেখানে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এজন্য দরকার পর্যটকদের নিরপত্তা। এই বন পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চল। এখানে ঘুরে বেড়ায় এল্ক নামের হরিণের দল। আরও আছে ভালুক, কোয়েট, পাহাড়ী সিংহসহ অসংখ্য মাংশাসী প্রাণী। এছাড়া কাঠবিড়ালী, নানারকম পাখি, ব্যাঙ, ইঁদুর, খরগোস ও বিবরের মতো ছোট ছোট প্রাণীতো আছেই। আর আছে এল্কের মতো অতিকায় হরিণ।
বেজির মতো ছোট ছোট বিবরগুলো পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আসলেন জীববৈচিত্রে কোনো প্রাণীর অবদানকেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। কিন্তু ইয়োলোস্টন ন্যাশনাল পার্কের কর্তব্যক্তিরা এই বিষয়টা জানতেন কিনা কে জানে। তারা মনে করেন, নেকড়ে, কোয়েট, ভালুক আর পাহাড়ী সিংহরা দর্শণার্থীদের জন্য বিপজ্জনক। এছাড়া আশপাশের যেসব মানব বসতি ছিল, তাদের গবাদি পশুগুলোও ধরে খেয়ে ফেলে নেকড়ের পাল।
এজন্য তাঁরা বন থেকে এসব প্রাণী শিকারের জন্য অন্য অনুমতি দেয়। শিকারিরাও মনের আনন্দে নেকড়ে নিধনে মেতে ওঠে। এমনকী সাধারণ মানুষও স্রেফ শখের বসে ইয়োলোস্টন পার্কে গিয়ে নেকড় শিকার শুরু করে। ফল হয় মারাত্মক, অচীরেই, অর্থাৎ ১৯২০ এর দশকেই ন্যাশনাল পার্ক থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায় ধূসর নেকড়ে।
নেকড়ে বিলুপ্তির পর বনে রাজত্ব শুরু হয় এল্কদের রাজত্ব। এদের মূল শিকারি হারিয়ে গিয়েছে। তাই প্রজননে বাঁধা নেই। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে এল্কের সংখ্যা। ফল হয় ভয়ংকর। বনের সুবজ ঝোপঝাড়, তৃণলতা খেয়ে শেষ করে ফেলে এল্করা। ফলে ব্যাঙ, কাঠবিড়ালি, ইদুরের মতো প্রাণীরা আগেই বন থেকে উজাড় হয়ে গিয়েছে। এরপর উজাড় হতে শুরু করে বনের বড় বৃক্ষরাও। কারণ, এসব বৃক্ষের যেসব নতুন চারা জন্ম নেয় সেগুলো বাড়তে পারে না এল্কের কারণে। বড় কিছু বৃক্ষ ছাড়া পুরো বন থেকে হারিয়ে যায় সবুজ ঝোপঝাড়, তৃণলতা। এদের ওপর নির্ভরশীল শত শত প্রাণীও তাই বিলুপ্ত হতে শুরু করে। এমনকী নদীর তীরবর্তী তৃণভূমিও এল্কেরা সাবাড় করে দেয়। ফলে নদী থেকে বিবরের দলও অন্য কোথাও চলে যায়। এমনকী বনে বাস করা ভালুকও বিলুপ্তের পথে। কেন? সে কথায় পরে আসছি।
এভাবে চলতে থাকলে এল্ক হরিণের দলও বেশিদিন টিকতে পারবে না। খাবারের অভাবে খুব শগগিরই তারা এ বন ছেড়ে পাশের কোনো বনে আশ্রয় নেবে। তখন সেসব বনের দশাও হবে ইয়োলোস্টোনের মতো। বিজ্ঞানীরা আশংকা করেন, এভাবে চলতে থাকলে পুরো যুক্তরাষ্ট্রই এক সময় মরুভূমিতে পরিণত হবে। এখন বনকে বাঁচানোর একটাই উপায়—এল্কের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। শিকারি বা সাধারণ মানুষকে লেলিয়ে দিলেই তারা ব্যবস্থা করে ফেলত। কিন্তু একই ভুল দুবার করতে চাননি বিজ্ঞানীরা। তাঁরা। মানুষের ওপর প্রকৃতির ভার ছেড়ে দিলে কী হয়, তা তো দেখেছেনই।
ইয়োলোস্টনকে রক্ষা করতে ১৯৯৫ সালে বিজ্ঞানীরা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পদ্ধতিই অনুসরণ করেন। যে প্রাণীটির বিলুপ্তির কারণে এ বনের এই দশা। সেই প্রাণীটিকেই ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা ভাবেন তাঁরা। কিন্তু বাঁধসাধে স্থানীয় লোকজন। নেকড়েরা ফিরে এলে গবাদিপশু এমনকী মানুষের জীবনও হুমকিতে পড়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন—এমন প্রজাতির নেকড়ে আনতে হবে, যারা এই বনের পরিবেশের সঙ্গে খাপা খাইয়ে নিতে পারবে সহজেই এবং লোকালয়েও যাবে না। অনেক ভেবে তারা পাশের দেশে কানাডার দিকে নজর দেন। সেখান থেকে নিয়ে আসেন ১৪টি কানাডিয়ান নেকড়ে, ছেড়ে দেন ইয়োলোস্টোনে। অবিশ্বাস্য ফল আসে এতে।
নেকড়ের দল ইয়োলোস্টনে ফিরে আসার পর পরই বদলে যায় এল্কদের আচরণ। প্রকৃতির আরেক বিস্ময়কর ব্যাপার এটা—শিকারি ও শিকারের সম্পর্ক। শিকারিরা শুধু শিকারকে হত্যা করে না, বরং এদের আচরণেও পরিবর্তন আনে। নেকড়ের অনুপস্থিতিতে এল্কের দল নির্বিঘ্নে খাবার খেত। এক জায়গায় টানা কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে দিতেও ওদের অসুবিধা হতো না। শিকারের ভয় নেই, তাই। যতক্ষণ কোনো এক জায়গার সবুজ গাছপালা আর তৃণভূমি সম্পূর্ণ শেষ না হচ্ছে, এল্কের দল সেই স্থানেই থেকে যায়। তারপর যখন সব শেষ হয়, সেখান থেকে চলে যায় অন্য কোনো এলাকায়। সেখানকার সবুজ ধ্বংসে মনোনিবেশ করে। কিন্তু নেকড়েরা ফিরে আসার পর এই আচরণ বদলে যায়। এল্করা তখন সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে—কখন না আবারে নেকড়ের দল এসে আক্রমণ করে। এর আগে নেকড়ের অনুপস্থিতেতে আরাম-আয়েশ করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার খেয়েছে। নেকড়ে ফিরে আসার পর সেই সুযোগ আর থাকে না। কোনোরকম পেটে কিছু পড়লেই সেই স্থান ত্যাগ করে পালিয়ে যায় এল্কের দল। ফলে সবুজ উদ্ভিদ বা ঘাসলতা আবার সজীব হয়ে ওঠার সুযোগ পায়।
ওদিকে নেকড়ের দলের খাবারের অভাব নেই। প্রচুর এল্ক রয়েছে। সুতরাং, দ্রুতই এদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বেশি বেশি নেকড়ে বেশি বেশি এল্ক শিকার করে—আনুপাতিক হারে কমতে থাকে এল্কের সংখ্যা। ফলে গাছপালা বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়। বনের চেহারা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করে।
নেকড়ে নিধন যখন শুরু হয়, তখন কোয়েটও শিকার করতে শুরু করেন শিকারিরাা। কোয়েট হলো এক ধরনের হিংস্র বন্য কুকুর। প্রচুর কোয়োট শিকার করলেও এদের সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে পারেননি শিকারিরা। ফলে নেকড়ে বিলুপ্ত হওয়ার পরও বেশ কিছু কোয়েট রয়ে যায়। বনে কোয়েটের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল নেকড়রা। এদের একেবারে সহ্য করতে পারে না, সুযোগ মতো পেলেই নেকড়ের দল কোয়েটদের মেরে ফেলে। তাই যখন নেকড়ে বিলুপ্ত, তখন কেয়োটরাও দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এল্ক এদের খাদ্যতালিকায় প্রথম স্থানে ছিল না কখনোই। কারণ এল্কের আকার। বরং কোয়েটের প্রধান শিকার ছোট প্রাণী—খরগোশ, পাখি, বুনোহাঁস ইত্যাদি। ফলে নেকড়ে বিলুপ্ত হওয়ার পর এসব ছোটপ্রাণীরাও কোয়েটদের অবাধ শিকারে পরিণত হয়। নেকেড়র সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে কোয়েটের সংখ্যাও কমে অর্ধেক হয়ে যায়। ফলে ইঁদুর, কাঠবিড়ালির, পাখি ও হাঁসপাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর এসব প্রাণীর সংখ্যা বাড়ার সংঙ্গে বাড়তে থাকে ছোট ছোট প্রাণীদের শিকার করে বেঁচে থাকা শিকারি পাখির সংখ্যাও—কাক, চিল, ঈগল।
এল্করা নদীর কিনারের উদ্ভিদগুলো খেয়ে শেষ করে ফেলেছিল। ফলে নদীতীরের বাস্তুতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীর পাড় ভাঙে। নদী আর নদীর কিনারের ওপর বড় বড় গাছের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে বিবর নামের নামের একটা প্রাণী। ছোট্ট বেজির মতো এই প্রাণীটাকে বলা হয় প্রকৃতির ইঞ্জিনিয়ার। এরা তাদের ধারালো দাঁত দিয়ে গাছ কেটে নদীর বুকে বাঁধ বানায়। তারপর সেই বাঁধের নিচে তারা বাসা বানায়। বাঁধ পানির গতিপথ বদলে দেয়। বনের ভেতর তৈরি হয় স্থায়ী লেক। বিবর নদী ও লেকের পানি পরিষ্কার রাখতেও ভূমিকা রাখে। ফলে সেই লেক বা নদীকে ঘিরে তৈরি হয় একটা ইকোলজিক্যাল চেইন। সেখানে ব্যাঙেরা ফিরে আসে, মাছের সংখ্যা বেড়ে যায়, জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীরা ফিরে আসে। এগুলো ফিরে আসার পরে এদের শিকার করে খায় এমন প্রাণীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
নেকড়ে বিলুপ্তির পর ইয়োলোস্টন বনের ভালুকের সংখ্যাও কমে গিয়েছিল। কারণ ভালুক যেমন ফলভোজী, একই সঙ্গে মাংসভোজীও। কিন্তু অন্য মাংশাসী প্রাণীদের মতো ভালুকের শিকারের দক্ষতা নেই। সম্ভবত তাদের ধীর গতির কারণে। নেকড়েরা শিকারের পর সবুটুক মাংস চেঁছেপুঁছে খায় না। উচ্ছিষ্ট দিয়ে ভালুকেরা উদরপূর্তি করত। ভালুকের আরেকটা প্রিয় খাবার বেরি। কিন্তু এল্করা বেরি গাছ খেয়ে শেষ করে ফেলে। তাই উভয়সংকটে পড়ে ভালুকেরা। খাবারের অভাবে কমতে থাকে তাদের সংখ্যা। শুধু ভালুকই নয়, নেকড়েদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে কিছু ছোট মাংসাশী প্রাণী ও পাখিরা টিকে থাকত। তারার সংকটে পড়ে যায় নেকড়ে বিলুপ্তির পর। নেকড়েরা ফিরে আসার পর, এসব প্রাণীও ফিরে আসে।
শুধু তাই নয়, নেকড়েরা হারিয়ে যাওয়ার পর বন যখন মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার দশায় পৌঁছে যায়, তখন পর্যটকেরাও মুখ ফিরিয়ে নেয় ইয়োলোস্টন ন্যাশনাল পার্ক থেকে। কিন্তু আবার যখন বন আগের রূপে ফিরে আসে, জীববৈচিত্র্যে ভরপুর হয়ে ওঠে, তখন আবার পর্যটকরা ফিরতে শুরু করেন। প্রতিবছর কোটি কোটি লাখ লাখ পর্যটক ইয়োলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক ঘুরতে আসেন। সেখান থেকে বছরে ৩৫ মিলিয় ডলার আয় করে পার্কটি।