পৃথিবীতে প্রথম ছবি আঁকা শুরু হলো কীভাবে
শুরুতেই স্পষ্ট করে দিতে চাই, শিল্প আর চিত্রশিল্প এক জিনিস নয়। শিল্পের মধ্যে রয়েছে অনেক শাখা। নাচ, গান, গল্প, অভিনয়, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য—সবই শিল্পের অংশ। কিন্তু এখানে আমরা যে শিল্পের কথা বলছি, তা মূলত আর্ট বা চিত্রশিল্প। এই শিল্পের ধারণা কোথা থেকে এল কোথা থেকে? কে প্রথম ছবি আঁকা শুরু করল?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আগে ভাবতে হয়, চিত্রশিল্প আসলে কী? মানুষ যখন নিজের ভেতরের অনুভূতি বা ধারণা প্রকাশ করতে চেয়েছে, তখনই তারা জন্ম দিয়েছে চিত্রশিল্পের। তাই চিত্রশিল্প কোনো প্রাকৃতিক বস্তু নয়, এটি মানুষের তৈরি।
গুহার আঁকিবুঁকি থেকে প্রথম চিত্রশিল্প
বিশ্বের প্রথম চিত্রশিল্পী কারা ছিল, বলতে পারো? ইতিহাস বলছে, গুহার দেয়ালে আঁকা প্রাচীন ছবিগুলোই মানবজাতির প্রথম শিল্পকর্ম। তবে যাঁরা এই ছবি এঁকেছিলেন, তাঁরা হয়তো একে চিত্রশিল্প হিসেবে ভাবেননি। তাঁদের কাছে এগুলো ছিল রহস্যময়, শক্তিশালী, হয়তো কোনো জাদুকরি চিহ্ন।
ফ্রান্সের দক্ষিণে শভে নামে এক গুহায় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এমন কিছু ছবি খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলো আঁকা আছে বহু আগে। সেখানে আছে লোমশ গন্ডার ও ম্যামথের মতো বিলুপ্ত প্রাণীর ছবি। এই ছবিগুলো আঁকার সময় গুহাবাসীরা ব্যবহার করত কালো কয়লা আর লাল গিরিমাটি। সেই লাল রং তৈরি হতো পাথর গুঁড়া করে। তারপর মুখে সেগুলো চিবিয়ে থুতুর সঙ্গে মিশিয়ে গুহার দেয়ালে ফুঁ দিয়ে আঁকা হতো ছবি।
শুধু ফ্রান্স নয়, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও সোমালিল্যান্ডেও একই ধরনের গুহাচিত্র পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, এই চিত্রগুলো শুধু সাজানোর জন্য নয়, একধরনের জাদুর কাজ করত। শিকারিরা হয়তো হরিণ বা বাইসনের ছবি এঁকে ভাবত, এতে শিকারে সফল হওয়ার জাদুকরি শক্তি পাওয়া যাবে।
প্রাচীন যুগে শিল্প নিয়ে ভাবনা
শিল্প নিয়ে ভাবনা অবশ্য অনেক পুরোনো। গ্রিসের দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, শিল্পের উদ্দেশ্য হলো আমাদের চারপাশের জগৎকে অনুকরণ করা। তাঁর কাছে শিল্প মানে শুধু ছবি আঁকা ছিল না। অভিনয়, ভাষণ ও সংগীতকেও তিনি শিল্পই ভেবেছেন।
তখনকার সময়ে শিল্পীদের দেখা হতো কারিগর হিসেবে। কারণ, তাঁরা হাত দিয়ে কিছু তৈরি করতেন। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের ইউরোপে শিল্পকলা মূলত গির্জার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি জাগানোর জন্যই তখন শিল্পকর্ম তৈরি হতো। শিল্পীরা ছিলেন গিল্ড বা সংঘের সদস্য; তাঁদের বলা হতো দক্ষ কর্মী।
চিত্রশিল্পীরা যখন নির্মাতা হয়ে উঠলেন
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের ইউরোপে রেনেসাঁ যুগে এই ধারণার বড় পরিবর্তন ঘটে। তখন শিল্পীরা নিজেদের কারিগর নয়, বরং নির্মাতা হিসেবে ভাবতে শুরু করেন।
১৪৩৬ সালে ইতালির লেখক লিওন বাতিস্তা ‘আলবার্টি অন পেইন্টিং’ নামে একটি বিখ্যাত বই লেখেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, কবিতা বা বিজ্ঞানের মতোই চিত্রশিল্প গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর এই ভাবনা ফ্লোরেন্স শহরে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেই কাজ করতেন তিন মহান শিল্পী—লেওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলেঞ্জেলো ও রাফায়েল।
১৫৫০ সালে ইতালীয় লেখক জর্জিও ভাসারি লাইভস অব দ্য আর্টিস্টস নামে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন। এরপর থেকেই শিল্পীদের বিশেষ ব্যক্তি, অনন্য প্রতিভা হিসেবে দেখা শুরু হয়। তখন থেকেই শিল্পকলাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো ফাইন আর্টস, যা গভীর ধারণা বা ভাবনা প্রকাশ করে। যেমন চিত্রকলা বা ভাস্কর্য। অন্যটি ডেকোরেটিভ আর্টস, যা সাজানোর জন্য তৈরি করা হয়। যেমন কাঠ, ধাতু বা কাচের কাজ।
চিত্রশিল্পের সংজ্ঞা যেভাবে পাল্টে গেল
চিত্রশিল্প নিয়ে মানুষের ধারণা আবারও বদলে যায় ১৯১৪ সালে। ফরাসি শিল্পী মার্সেল ডুশাঁ তখন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন। তিনি দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ জিনিসকে শিল্পকর্মে রূপ দিতে শুরু করেন। কোনো বস্তু নির্বাচন করে তাতে নিজের সই করে দিতেন, আর নাম দিতেন ‘রেডিমেডস’।
তাঁর সবচেয়ে আলোচিত কাজ ছিল ফাউন্টেন। এটি একটি ইউরিনাল বা মূত্রপাত্র। সেই পাত্রে তিনি ‘R. Mutt’ নামে সই করেছিলেন। ১৯১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি শিল্প প্রদর্শনীতে এটি জমা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ডুশাঁ বলেছিলেন, ‘কোনো বস্তুকে শিল্প হিসেবে নির্বাচন করার মুহূর্তেই সেটি শিল্পে পরিণত হয়। কারণ শিল্পীর সেই বেছে নেওয়াটাই একধরনের শিল্প।’ তাঁর হাত ধরে শিল্পের অর্থ বদলে যায়। শিল্প মানে শুধু ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়া নয়, বরং এক গভীর ধারণা প্রকাশও হতে পারে।
তাহলে চিত্রশিল্পের আবিষ্কারক কে
বর্তমানের চিত্রশিল্পীরাও তাঁদের কাজের মাধ্যমে সমাজ, মানুষ ও জীবনের নানা প্রশ্ন তুলে ধরেন। তাঁরা আমাদের ভাবতে শেখান, নতুন চোখে দেখতে শেখান পৃথিবীকে। এই দিক থেকে তাঁরা অতীতের গুহাবাসী চিত্রশিল্পী কিংবা মার্সেল ডুশাঁর মতোই মানবচেতনার ধারাবাহিকতার অংশ।
তাহলে শিল্পের আবিষ্কারক কে? উত্তরটা সহজ। মানবজাতিই শিল্পের আবিষ্কারক। যে মুহূর্তে মানুষ বালুর ওপর কোনো নকশা এঁকেছিল, কিংবা গুহার দেয়ালে কোনো চিন্তা ফুটিয়ে তুলেছিল, সেই মুহূর্তেই জন্ম হয়েছিল শিল্পের।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন-এর ‘কিউরিয়াস কিডস’ অবলম্বনে