যে শিল্পী অস্ত্রকে বদলে দেন শিল্পে
অনেক সময় জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা মানুষকে পুরোপুরি বদলে দেয়। তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল শিল্পী রাল্ফ জিমানের জীবনে। ১৯৭০-এর দশক। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে এক শপিং মলের বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি তুচ্ছ কারণে এক অপরিচিত ব্যক্তি তাঁদের দিকে বন্দুক তাক করে ধরে। কী নিয়ে সেই ঝগড়া হয়েছিল তা তাঁর মনে নেই। কিন্তু সেই ভয়ংকর মুহূর্তটা তিনি আজও স্পষ্ট মনে করতে পারেন।
সৌভাগ্যক্রমে, পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত হয়ে আসে। সেদিন কোনো অঘটন না ঘটলেও সেটিই ছিল শুরু। ৫০ বছর বয়সী জিমান একটু ভেবে বলেন, তাঁর জীবনে অন্তত ১৫ থেকে ২০ বার তাঁর দিকে বন্দুক তাক করা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে তিনি একজন বন্দুকবিরোধী শিল্পী।
জনগণের হাতে অস্ত্রের সহজলভ্যতা ও এর সহিংসতা বিচলিত করে রাল্ফ জিমানকে। সে কারণে তিনি আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা থেকে শিল্পী হয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত নেন। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি অস্ত্রকে তাঁর শিল্পের মাধ্যম করে তুলেছেন। লাখ লাখ হাতে তৈরি সুতার পুঁতি ব্যবহার করে তিনি বন্দুক, রাইফেল ও অন্যান্য অস্ত্রকে শিল্পে রূপ দিয়েছেন। যার মাধ্যমে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ফলাফলকে শিল্পের ভাষায় তুলে ধরেন। তাঁর শিল্পকর্মগুলো যেন নীরব প্রতিবাদ। যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সহিংসতা দিয়ে নয়, বরং শিল্প ও শান্তির পথেই আমাদের ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব।
শিল্পী রাল্ফ জিমান তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে অস্ত্রের বিস্তার ও পুলিশ বাহিনীর সামরিকীকরণ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন। এই চিন্তা থেকেই তিনি ‘ওয়েপন্স অব ম্যাস প্রোডাকশন’ নামের একটি সিরিজ তৈরি করেন। এই সিরিজের প্রতিটি শিল্পকর্ম দক্ষিণ আফ্রিকার সাম্প্রতিক অতীতের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা দিক তুলে ধরেন।
জিমান তাঁর এই সিরিজটি শুরু করেছিলেন পুঁতি দিয়ে তৈরি ডজনখানেক নকল একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে। তিনি বলেন, বর্ণবাদের দিনগুলোতে একে-৪৭ ছিল মুক্তির অস্ত্র। কিন্তু বর্ণবাদ-পরবর্তী যুগে এটি ব্যাংক ডাকাতি, গাড়ি চুরি ও অন্যান্য সহিংস অপরাধের প্রতীক হয়ে ওঠে। তারের ফ্রেম এবং লাখ লাখ পুঁতি দিয়ে তৈরি এই রাইফেলগুলো ছিল জিমানের প্রতিবাদের প্রথম শিল্প।
এরপর, ২০১৬ সালে তিনি সিরিজটি আরও বড় করতে কাজ শুরু করেন। তিনি তারের ফ্রেম এবং লাখ লাখ পুঁতি দিয়ে বানাতে শুরু করেন মিগ-২১ ফাইটার জেট। এই মডেলের জেট বেছে নেওয়ার কারণ ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অ্যাঙ্গোলার গৃহযুদ্ধ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত যুদ্ধে এর ব্যবহার। সেই সময়ে কিউবার সেনারা দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানবাহিনীর বিরুদ্ধে মিগ-২১ ব্যবহার করত, যা দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়।
মিগ-২১ ফাইটার জেট তৈরিতে জিমানের সঙ্গে কাজ করে ১০০ জনেরও বেশি শিল্পীর একটি দল। শিল্পকর্মটি সম্পূর্ণ করতে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় নিয়েছিল তারা। রাল্ফ জিমান যখন একটি পূর্ণ আকৃতির মিগ-২১ ফাইটার জেটকে পুঁতি দিয়ে সাজানোর চ্যালেঞ্জ নেন, তখন প্রথম কাজ ছিল একটি বিমান খুঁজে বের করা। তিনি ফ্লোরিডার লেকল্যান্ডের একজন সামরিক ঠিকাদারের কাছ থেকে একটি অব্যবহৃত জেট কেনেন। যদিও সেটি খুব ভালো অবস্থায় ছিল না। তবু জিমানের কাছে সেটিই ছিল নিখুঁত। তাঁর দল বিমানের ইঞ্জিন খুলে ফেলে এবং বাকি অংশ একটি ফ্ল্যাটবেড ট্রাকে করে লস অ্যাঞ্জেলেসে তাঁর স্টুডিওতে নিয়ে যায়।
এই শিল্পকর্মের নকশার বেশির ভাগ কাজ বিমানেই মূল ফ্রেমে করা হয়েছে। জিমান বিমানের অ্যালুমিনিয়াম প্যানেলে কাগজের শিট আটকে এর ওপর রঙিন টেপ ব্যবহার করে নকশা তৈরি করেন। এরপর সেই অ্যালুমিনিয়াম প্যানেলেগুলো খুলে সাবধানে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হতো। সেখানে জোহানেসবার্গ, কোয়াজুলু-নাটাল এবং এমপুমালাঙ্গা প্রদেশের জিম্বাবুইয়ান এবং এনদেবেলে সম্প্রদায়ের ১০০ জনেরও বেশি কারিগর পুঁতি ব্যবহার করে সেই নকশাগুলো হাতে তৈরি করতে শুরু করেন। এভাবেই লাখ লাখ পুঁতির মাধ্যমে একটি পুরো যুদ্ধবিমানকে শৈল্পিক রূপ দেওয়া হয়।
রাল্ফ জিমানের এই শিল্পকর্মের আকার ছিল অবিশ্বাস্য। সবচেয়ে বড় প্যানেলগুলোর দৈর্ঘ্য ২০ ফুটের বেশি এবং ওজন ৩০-৪০ পাউন্ড পর্যন্ত ছিল। পুরো ৫১ ফুট লম্বা এবং ২৪ ফুট চওড়া এই জেটটি প্রায় ৩.৫ কোটি পুঁতি দিয়ে ঢাকা। জিমান বলেন, এই কাজটি করার কোনো যান্ত্রিক উপায় নেই। বিমানের প্রতিটি অংশ শতভাগ হাতে তৈরি করা হয়েছে। এতে কত শত ঘণ্টা সময় লেগেছে তা কল্পনা করাও কঠিন।
তবে জিমান কেন সহজ রঙের বদলে এই কষ্টসাধ্য পুঁতি বেছে নিলেন? জিমান জানান, ‘পুঁতি পছন্দের কারণটি ব্যক্তিগত। আমি সব সময় পুঁতির কাজ পছন্দ করতাম। আমি এর সঙ্গেই বড় হয়েছি। আমার ছোটবেলার আয়া সব সময় আমাদের জন্য পুঁতির জিনিসপত্র নিয়ে আসতেন।’
জিমান আরও বলেন, ‘পুঁতির কাজ করতে প্রচুর দক্ষতা এবং শ্রমের প্রয়োজন হলেও এটিকে প্রায়ই তুচ্ছ মনে করা হয়। তাই তিনি সব সময় এই শিল্পকে নিয়ে কাজ করতে চাইতেন। পুঁতির মাধ্যমে শুধু শিল্প নয়, বরং একটি সংস্কৃতির গল্পও বলা সম্ভব।’
সিরিজের সবচেয়ে বড় শিল্পকর্ম মিগ-২১ ফাইটার জেট, বর্তমানে সিয়াটলের ফ্লাইট মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে। এই প্রদর্শনীর পর এটি বিক্রির জন্য রাখা হবে। সেই বিক্রি করা অর্থ শিক্ষা কর্মসূচির পাশাপাশি ইউক্রেনের শিশুদের জন্য আর্ট থেরাপির কাজে ব্যবহার করা হবে।
সূত্র: সিএনএন