নদী কেন সোজা পথে না গিয়ে এঁকেবেঁকে চলে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো তাঁর গানেই লিখে গেছেন, ‘ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা/ পথে পথে বাহির হয়ে আপন-হারা’। সত্যি, নদীকে দেখলে এমন পাগলামির কথাই মনে আসে। খেয়াল করে দেখবে, পৃথিবীর কোনো নদীই কিন্তু সরলরেখায় চলে না। সব নদীই সর্পিল অর্থাৎ আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলে। তোমার মনে হতেই পারে নদীর চলার পথে নিশ্চয়ই কোনো পাহাড় বা বড় বাধা এসে পড়েছে। তাই সে দিক পরিবর্তন করেছে। কিন্তু সমতল ভূমিতে যেখানে কোনো দৃশ্যমান বাধাই নেই, সেখানেও নদী কেন এমন সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে?
নদীর ধার ধরে হাঁটতে গেলে দেখা যায়, নদীটি এঁকেবেঁকে চলেছে। আর সাগরের দিকে যাওয়ার পথে এটি বারবার বাঁক নিচ্ছে। এ ধরনের বাঁকানো পথ নদীর একটি খুবই আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। আসলে একটি নদীর জন্ম হয় যখন উঁচু পাহাড় বা বরফের চূড়ায় জমা হওয়া বৃষ্টির পানি বা বরফগলা পানি ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে এবং একসঙ্গে জমা হয়। এই মিলিত ধারাগুলো যখন একটি নির্দিষ্ট পথে চলতে শুরু করে, তখনই তাকে আমরা নদী বলি।
অনেক নদীতেই বিশাল আকারের, গোল ঘূর্ণায়মান বাঁক দেখা যায়। এই বাঁকগুলো নিজে থেকেই তৈরি হয়। যখন নদী সমতল ভূমির ওপর দিয়ে বয়ে চলে। বাঁকগুলো আকারে ছোট হতে পারে। আবার অনেক বড় এলাকাজুড়েও থাকতে পারে। নদীর এই এঁকেবেঁকে চলার স্বভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সমতল জায়গায় বা যেখানে খুব সামান্য ঢাল আছে। এর কারণ হলো, যদি খাড়া ঢাল থাকত, তবে পানি সোজা নিচের দিকে খুব দ্রুত ছুটত; কিন্তু ঢাল কম থাকায় পানি সোজা না গিয়ে আঁকাবাঁকা পথে চলতে বাধ্য হয়।
সহজভাবে বললে, নদীর এই বাঁকগুলো তৈরি হয়; কারণ পানি কখনোই এক জায়গায় স্থির থাকে না। এটি সব সময় ছুটে চলে এবং নদীর তলদেশ ও পাড়ের মাটির সঙ্গে প্রতিনিয়ত ধাক্কা খায়। নদীর তলার গঠন কেমন এবং পানির স্রোতে কতটা জোর আছে—এই দুটি জিনিসের কারণেই নদীতে এই আঁকাবাঁকা বাঁকগুলো তৈরি হয়।
নদী কেন সোজা পথে না গিয়ে এঁকেবেঁকে চলে, এর পেছনে রয়েছে দুটি প্রক্রিয়া। ক্ষয় ও জমাট বাঁধা। নদীর বাঁকের বাইরের দিকে পানির স্রোত থাকে খুব তীব্র। এই তীব্র স্রোতের ধাক্কায় নদীর পাড় থেকে মাটি ও পাথর ক্ষয় হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে এই ক্রমাগত ক্ষয়ের কারণে নদীর বাঁকটি আরও চওড়া ও বড় হতে থাকে।
অন্যদিকে নদীর বাঁকের ভেতরের দিকে পানির স্রোত থাকে অনেক শান্ত ও ধীরগতির। স্রোত দুর্বল হওয়ায় নদী উজান থেকে বয়ে আনা পলি, বালু ও কাদা এই অংশে জমা হয়। ফলে পলি জমে জমে বাঁকের ভেতরে একটি মৃদু ঢাল তৈরি হয়। বাঁকের একদিকে এই ক্ষয় ও অন্যদিকে এই জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াটি একসঙ্গে চলতে থাকে। যার ফলে নদীর বাঁকগুলো আরও স্পষ্ট হয়। নদী সব সময় এর জন্য সহজ রাস্তা খোঁজে; কিন্তু এই ক্ষয় ও জমার চক্রাকার খেলার কারণেই নদী সর্পিল বা আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলে।
নদীর গতিপথ মূলত দুটি জিনিসের ওপর নির্ভর করে। পানির বেগ এবং মাটির ঢাল। যখন নদী সমতল বা সামান্য ঢালু অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে চলে, তখন পানি ধীরে চলে এবং বাঁক তৈরি করার মতো যথেষ্ট সময় পায়; কিন্তু যদি ঢাল খুব খাড়া হয়, তবে পানি তীব্র বেগে সোজা নিচে দিকে ছুটে যায়। এতে বাঁক তৈরি হয় না। সবচেয়ে বেশি বাঁক দেখা যায় যেখানে সামান্য ঢাল থাকে। এই ঢালে পানির যথেষ্ট জোর থাকে। যা বাঁকের বাইরের দিকের মাটি কাটতে এবং ভেতরের দিকে পলি জমাতে সাহায্য করে। পানির এই ক্রমাগত ক্ষয় ও জমার প্রক্রিয়াই নদীকে একটি স্থায়ী, আঁকাবাঁকা পথে চলতে বাধ্য করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদী নিজেই নিজের পথ তৈরি করতে থাকে। আর এই বাঁকগুলো আরও বড় হয়ে ওঠে।
নদীতে একবার বাঁক তৈরি হলে কিন্তু প্রক্রিয়াটি থামে না। এই ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে নদী একসময় এর চলার পথ পুরোপুরি পাল্টে ফেলতে পারে। এই পথ পরিবর্তনের কারণে তৈরি হয় ‘অক্সবো হ্রদ’। যখন একটি বাঁকের বাইরের অংশ এত বেশি ভেঙে যায় যে নদীটি আর বাঁক না নিয়ে সোজা পথ ধরে বয়ে যায়। তখন নদীর সেই পুরোনো অর্ধচন্দ্রাকার বাঁকটি মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি হ্রদে পরিণত হয়। যা অক্সবো হ্রদ নামে পরিচিত।
সারা বিশ্বে নদীগুলো এঁকেবেঁকে বয়ে চলে। যা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই বাড়ায় না সঙ্গে পরিবেশের জন্যেও অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি নদীকে আমেরিকান জীবনধারার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। আফ্রিকার জাম্বেজি নদীও এর আঁকাবাঁকা চলার কারণে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের মতো বিশাল প্রাকৃতিক দৃশ্য তৈরি করেছে। ইউরোপের দানিউব ও মিসরের নীলনদের মতো বিখ্যাত নদীগুলোও এর আঁকাবাঁকা গতিপথের জন্য পরিচিত। এই নদীগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানবসভ্যতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যা কৃষি ও বাণিজ্যের জন্য অপরিহার্য পানির জোগান দিয়ে আসছে।
সূত্র: টিএম পার্কস ফাউন্ডেশন, ইন্ডিয়ানা পাবলিক মিডিয়া