প্রথম শতাব্দীর রাজকীয় নৌযান পাওয়া গেছে আলেকজান্দ্রিয়ার সমুদ্রতলে

মিশরে প্রথম শতাব্দীর রাজকীয় নৌযানগার্ডিয়ান থেকে নেওয়া

মিসরের বন্দর আলেকজান্দ্রিয়া। এর সমুদ্রতলে এবার খুঁজে পাওয়া গেছে প্রাচীন এক রাজকীয় নৌযান। প্রথম শতাব্দীর গ্রিক ইতিহাসবিদ স্ট্রাবো ‘প্লেজার বোট’-এর বর্ণনা দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে এটি। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এটিকে বলছেন ‘নতুন এক বিস্ময়’।

প্রাচীনকালে আলেকজান্দ্রিয়া ছিল রাজপ্রাসাদ, দালানকোঠা, মন্দির আর বাতিঘরের নগরী, যার খ্যাতি ছিল বিশ্বজুড়ে। প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম মহিমান্বিত নগরী হিসেবে নাম করেছিল আলেকজান্দ্রিয়া। প্রায় ১৩০ মিটার উঁচু বাতিঘর ছিল প্রাচীন বিশ্বের সাত আশ্চর্যের একটি।

এই বিলাসবহুল নৌকা সেই সময়ের অংশ। প্রথম শতকের প্রথমার্ধে নির্মিত প্রায় ৩৫ মিটার লম্বা এক রাজকীয় নৌযান, যার মাঝখানে ছিল বিলাসে সাজানো কক্ষসহ একটি প্যাভিলিয়ন

নৌকাটি পাওয়া গেছে অ্যান্টিরহোডোস নামে এক ডুবে যাওয়া দ্বীপের কাছে। দ্বীপটি ছিল প্রাচীন আলেকজান্দ্রিয়ার মহাবন্দর পর্তুস ম্যাগনাসের অংশ।

আরও পড়ুন

গ্রিক ইতিহাসবিদ স্ট্রাবো খ্রিষ্টপূর্ব ২৯ থেকে ২৫ সালের মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়া ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, রাজপরিবার উৎসব-অবসর যাত্রায় এমন সব চমৎকার নৌযান ব্যবহার করত। শহরের নানা উৎসবে যাওয়ার পথে খালে ভাসত নৌকা। গান, বাঁশি, নাচের উচ্ছ্বাসে ভরা মানুষের ভিড় লেগে থাকত।

ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট ফর আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজির নেতৃত্বে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সমুদ্র প্রত্নতত্ত্বের ভিজিটিং অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক গডিও এই অভিযান পরিচালনা করেছেন। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘এটা খুব রোমাঞ্চকর, কারণ মিসরে এ ধরনের নৌকা এই প্রথম পাওয়া গেল। স্ট্রাবোসহ বেশ কয়েকজন লেখক এসব নৌযানের কথা বলেছেন। কিন্তু আগে কখনো এমন নৌযান পাওয়া যায়নি।’

নৌকাটির কাঠের যেসব অংশ টিকে আছে, তা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, এর প্রস্থ ছিল প্রায় ৭ মিটার। এটি চালাতে অন্তত ২০ জন মাঝির প্রয়োজন হতো।

মাত্র ৭ মিটার পানির গভীরে ছিল এই নৌকা। দেড় মিটার পলির নিচে পড়ে ছিল এটি। এর কাঠামো এত অদ্ভুত যে প্রথমে গডিও ভেবেছিলেন, যেন দুটি নৌকা একটার ওপর আরেকটা রাখা আছে। এর সামনের অংশ সমতল। পেছনের অংশটি গোল। খুব অল্প পানিতে চলার মতো করে বানানো।

আরও পড়ুন
মিসরের উপকূলে অভিযান চলছে
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া

অধ্যাপক গডিও বহু অভিযান করেছেন মিসরের উপকূলে। আলেকজান্দ্রিয়ার পূর্ব বন্দর ও আবু কির উপসাগরে তিনি অনুসন্ধান করেছেন। ১৯৯২ সাল থেকে তিনি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হয়ে পানির নিচের বিশাল অঞ্চল ঘুরে দেখেছেন। ২০০০ সালে আবু কির উপসাগরে পাওয়া গিয়েছিল থোনিস-হেরাক্লিয়ন নামের হারানো নগরী এবং কানোপাস শহরের অংশ। এটি সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম বড় প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার। পটোলেমীয় যুগের রাজা-রানির দুই বিশাল ভাস্কর্যও উদ্ধার হয়েছিল সেখান থেকে।

২০১৯ সালে থোনিস-হেরাক্লিয়নের কাছে আরেকটি নৌকার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় অধ্যাপক গডিওর দল, যা গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়।

সর্বশেষ আবিষ্কারটি পাওয়া গেছে আইসিস মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মাত্র ৫০ মিটার দূরে। গডিও মনে করেন, খ্রিষ্টাব্দ ৫০-এর দিকে এই মন্দির ধ্বংস হওয়ার সময় নৌকাটি ডুবে গিয়েছিল। ধারাবাহিক ভূমিকম্প, সুনামি ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাচীন উপকূলরেখা ডুবে যায়। হারিয়ে যায় রাজমহল, প্রাসাদ ও বন্দরনগরীর বহু স্থাপনা।

আরও পড়ুন

আরেকটি ধারণা হচ্ছে, নৌকাটি হয়তো ছিল আইসিস দেবীর মন্দিরের পবিত্র রীতির অংশ। নাভিগিয়ুম ইসিদিস দেবীর সৌর নৌকার প্রতীক হিসেবে সাজানো এই নৌকা শোভাযাত্রায় অংশ নিত। নৌকার মূল কাঠামোর ওপর গ্রিক ভাষায় আঁকা গ্রাফিতিও পাওয়া গেছে। এখনো এর পাঠোদ্ধার শেষ হয়নি।

নৌকাটি নিয়ে গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। গডিও মনে করেন, এটি রোমান যুগের মিসরের জলপথে বিলাস, বিশ্বাস, দৈনন্দিন জীবন আর রাজকীয় আমোদের নতুন ছবি তুলে ধরবে। অক্সফোর্ড সেন্টার ফর মেরিটাইম আর্কিওলজির পরিচালক প্রফেসর ডেমিয়ান রবিনসন বলেছেন, ‘এ ধরনের নৌকা আগে কখনো পাওয়া যায়নি। লেখায় ও শিল্পকর্মে আমরা এর বর্ণনা দেখি বটে, কিন্তু প্রত্নতত্ত্বে এ যেন এক অসাধারণ মুহূর্ত।’

ইউনেস্কোর নির্দেশনা মেনে নৌকাটিকে সমুদ্রতলেই রেখে দেওয়া হবে। কারণ, পানির নিচের পরিবেশেই এর সংরক্ষণ সবচেয়ে নিরাপদ। এতে এখনো খুব অল্প অংশ খনন করা হয়েছে। শিগগিরই অনুসন্ধান আবার শুরু হবে।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন