বিশ্বের বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর খুলছে, কী আছে এখানে
গত ১ অক্টোবর ২০২৫ (শনিবার) রাতটা ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো একটা রাত ছিল। কারণ, সেই রাতে গিজার পিরামিডের ঠিক পাশেই উদ্বোধন হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর—গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম (জিইএম)। এই জাদুঘর তৈরি করতে খরচ হয়েছে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। আর এই প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের জন্য মিসরীয়দের অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় দুই দশকের বেশি সময়।
এক পাশে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম পিরামিডগুলো আর অন্য পাশে নতুন জাদুঘরের বিশাল ভবন। শনিবার রাতের অন্ধকার নামতেই এই দুটি স্থাপনা যেন একসঙ্গে আলোয় ঝলমল করে উঠল। এরপর ফারাওদের পোশাক পরা শিল্পীরা মঞ্চে এলেন। তাঁরা হাজার বছর আগের মিসরের ঐতিহ্যবাহী গান ও সুরে মঞ্চ মাতিয়ে দিলেন। সেই সুর ছিল অদ্ভুত ও খুবই মনোমুগ্ধকর।
এরপর আকাশে শুরু হলো বিশাল আতশবাজি ও ড্রোন লাইট শো। ড্রোন শোতে আইসিস ও ওসিরিসের মতো দেব–দেবীর ছবি তৈরি হলো আকাশে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি জাদুঘরের ফলক উন্মোচন করে গোটা বিশ্বকে দেখালেন মিসরের হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসকে নতুনভাবে।
কিন্তু মিসর কেন এত জোর দিয়ে এই জাদুঘরকে বিশ্বের বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর বলছে? আর সেখানে এমন কী কী জিনিস রাখা হয়েছে, যা ইতিহাসপ্রেমী মানুষের অন্তত একবার হলেও দেখা উচিত? কারণটা হলো, এই জাদুঘর তৈরি হয়েছে গিজার পিরামিড থেকে মাত্র এক মাইলের মধ্যে। এটিকে বলা হচ্ছে, একমাত্র সভ্যতার জন্য তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থাপনা। এটি প্রায় ৪ লাখ ৭০ হাজার বর্গমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত।
অবশ্য এই জাদুঘর তৈরি করা মোটেই সহজ ছিল না। ১৯৯২ সালে এই জাদুঘর তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু নির্মাণকাজ শুরু হতে লেগে যায় ২০০৫ সাল। দুই দশকের বেশি সময় ধরে নির্মাণকাজে অসংখ্য বিলম্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অন্যান্য বাধার কারণে এর সম্পূর্ণ উদ্বোধন পিছিয়ে যাচ্ছিল। তবে সেই অপেক্ষার পালা এবার শেষ।
জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করলে প্রধান কক্ষেই তোমাকে স্বাগত জানাবে ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের একটি বিশাল ভাস্কর্য। এর বয়স প্রায় ৩ হাজার ২০০ বছর। আর ওজন ৮৩ টন। এখানে ৫০ হাজারের বেশি প্রাচীন প্রত্নবস্তু প্রদর্শন করা হচ্ছে। জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে খুফুর, সেই ৪ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো সূর্য নৌকাটি, যা পিরামিড নির্মাণকারী ফারাওয়ের পরকালের যাত্রার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ২০২৪ সালে সীমিত পরিসরে এর কিছু অংশ খোলা হলেও এখন এটি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
বিশাল এই জাদুঘরের ভেতরে শুধু পুরোনো জিনিস আছে, এমনটা নয়। এটি একটি পুরো কমপ্লেক্স। এখানে ২৪ হাজার বর্গমিটার জায়গাজুড়ে রয়েছে প্রদর্শনী কক্ষ। এর সঙ্গে রয়েছে বাচ্চাদের জন্য বিশেষ মজার জাদুঘর, পড়াশোনা ও বিভিন্ন আলোচনার জন্য আধুনিক সুবিধা। কেনাকাটার জন্য দোকানপাট ও প্রাচীন জিনিসগুলোকে ভালো রাখার জন্য বিশাল একটি সংরক্ষণ কেন্দ্র। ১২টি প্রধান প্রদর্শনী গ্যালারি প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে গ্রিক, রোমান যুগ পর্যন্ত পাওয়া সব মূল্যবান জিনিসপত্র সময় ও বিষয় ধরে সাজানো আছে সেখানে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো মিসরীয় ইতিহাস চোখের সামনে দেখা যাবে এখানে।
মিসর নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা বলছেন, এই বিশাল জাদুঘরটি তৈরি হওয়ার ফলে অন্য দেশগুলোর কাছে থাকা মিসরীয় পুরাকীর্তিগুলো ফেরত চাওয়ার দাবি আরও শক্তিশালী হবে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শিত সেই বিখ্যাত রোসেটা পাথরের (Rosetta Stone) মতো জিনিসগুলো মিসর ফেরত চাইছে।
গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের প্রধান আকর্ষণ বালক রাজা তুতানখামুনের সমাধির সব জিনিসপত্র। ব্রিটিশ মিসরবিদ হাওয়ার্ড কার্টার সমাধিটি আবিষ্কার করার পর থেকে এই অমূল্য জিনিসগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু এই জাদুঘরে সেসব জিনিস, যার মধ্যে তুতানখামুনের দর্শনীয় সোনার মুখোশ, তাঁর রাজসিংহাসন, রথসহ পাঁচ হাজারের বেশি সামগ্রী তা প্রথমবারের মতো এক জায়গায় একসঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে। এর ফলে তুতানখামুনের পুরো গুপ্তধন এখন সবার চোখের সামনে।
মূলত একসময় মিসর ছিল আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। কিন্তু ২০১১ সালের ‘আরব বসন্তের’ বিদ্রোহ এবং পরে করোনাভাইরাস মহামারির সময় মিসরে পর্যটকের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল। তাই এত বড় একটি জাদুঘর তৈরি করে মিসর সরকার আসলে পর্যটনশিল্পে কৌশলগত বিনিয়োগ করছে। তারা আশা করছে, এই জাদুঘরের মাধ্যমে অর্থনীতি আবার চাঙা হবে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে রেকর্ড ১ কোটি ৫৭ লাখ মানুষ মিসর ভ্রমণ করেছেন। আর সরকারের লক্ষ্য ২০৩২ সালের মধ্যে এই পর্যটকের সংখ্যা দ্বিগুণ করে ফেলা। জাদুঘরটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে হাসান আল্লাম হোল্ডিং নামের প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার দর্শনার্থীর আগমন আশা করছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য টিকিটের দাম প্রায় ৭৩০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ মিসরীয় পাউন্ড।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, সিএনএন