পৃথিবীর একমাত্র খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ কোনটি
বর্তমানে পৃথিবীতে মোট ১৯৫টি দেশ আছে। এতগুলো দেশের মধ্যে পৃথিবীতে একটি মাত্র দেশ আছে, যেখানে বাইরে থেকে কোনো খাবার বা সবজি আমদানি করতে হয় না। দেশটি নাম গায়ানা। আজকাল বেশির ভাগ দেশকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য অন্য দেশ থেকে নিয়ে আসতে হয়। তখন গায়ানা সম্পূর্ণভাবে নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করে চলেছে।
দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে আমাজনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ছোট দেশ গায়ানা। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডের ‘নেচার ফুড’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে এই অবাক করা তথ্য উঠে আসে। গবেষণায় জানানো হয়, বাইরের কোনো আমদানি ছাড়াই গায়ানাই একমাত্র দেশ যারা তার সব নাগরিকের জন্য ফলমূল, শাকসবজি, দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ, মাংস, উদ্ভিদভিত্তিক প্রোটিন ও স্টার্চিযুক্ত খাবারসহ পর্যাপ্ত খাদ্য সম্পূর্ণভাবে উৎপাদন করতে এবং নিজেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে সক্ষম।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬৫ শতাংশ দেশই এমন আছে, যারা তাদের জনসংখ্যার খাদ্যতালিকার চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করছে। কিন্তু কীভাবে গায়ানা একমাত্র এমন অবিশ্বাস্য সক্ষমতা অর্জন করল, যা অন্য কোনো দেশ পারল না?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জার্মানির গোটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয় ও এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বিশ্বের ১৮৬টি দেশের খাদ্য উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, গায়ানাই একমাত্র দেশ যা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সাতটি প্রধান খাদ্যগোষ্ঠীর সবকটির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অর্থাৎ, এই সাতটি খাবারের কোনোটির জন্যই তাদের বাইরের দেশের ওপর নির্ভর করতে হয় না। এই খাদ্যগোষ্ঠীগুলো হলো ফলমূল, শাকসবজি, দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ, মাংস, উদ্ভিদভিত্তিক প্রোটিন এবং স্টার্চিযুক্ত প্রধান খাবার।
মূলত আমদানি হলো বাইরে থেকে জিনিস আনা, আর রপ্তানি মানে অন্য দেশে পাঠানো। বেশির ভাগ দেশ খাদ্যের জন্য আমদানির ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশও করে। কিন্তু গায়ানা প্রকৃতির সহায়তায় এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই নির্ভরতা কাটিয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে এমনভাবে উৎপাদন করে যে তাদের জনগণের প্রয়োজনীয় সাতটি প্রধান খাদ্যগোষ্ঠীর সব চাহিদা পূরণ হয়। এভাবেই গায়ানা বিশ্বের সামনে এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
তবে এই গবেষণায় গায়ানার পরে রয়েছে চীন ও ভিয়েতনাম। তারা সাতটি প্রধান খাদ্যগোষ্ঠীর মধ্যে ছয়টিতেই নিজেদের জনগণের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে পারে। অন্যদিকে সাতটি খাদ্যগোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচটি বা তার বেশিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে মাত্র নিউজিল্যান্ড।
সবচেয়ে হতাশার খবর বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশের বেশি দেশ দুটি বা তার কম খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, আফগানিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, ম্যাকাও, কাতার ও ইয়েমেন এই ছয়টি দেশ কোনো খাদ্যগোষ্ঠীতেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি।
গবেষকদের মতে, খাদ্যের দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা কম থাকাটা কিন্তু স্বভাবতই খারাপ নয়। এই গবেষণার প্রধান লেখক ড. জোনাস স্টেহল বলেন, ‘আমার মনে হয়, কোনো দেশের তার প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ খাদ্য উৎপাদন না করার পেছনে যৌক্তিক এবং উপকারী কারণ থাকতে পারে।’
একটি দেশের হয়তো পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, ভালো মানের মাটি বা স্থিতিশীল তাপমাত্রা নেই। যা তার জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনে বাধা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে, খাদ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত অঞ্চলগুলো থেকে আমদানি করা বরং সাশ্রয়ী হতে পারে। তবে এর একটা বিপদও আছে। খাদ্যের দিক থেকে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণতা কম থাকে, তাহলে খরা, যুদ্ধ অথবা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার মতো হঠাৎ আসা বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সমস্যা সামলানোর ক্ষমতা দেশের কমে যেতে পারে।
এই সক্ষমতা মাপার জন্য জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের গবেষকেরা প্রথমে প্রতিটি দেশ কতটা খাদ্য তৈরি করে, তা মেপে দেখেন। এরপর তাঁরা সেই উৎপাদনের পরিমাণকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের (ডব্লিউডব্লিউএফ) তৈরি করা ‘লাইভওয়েল ডায়েট’–এর সঙ্গে জনগণের পুষ্টির চাহিদার তুলনা করেন। ‘লাইভওয়েল ডায়েট’ হলো এমন একটি স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকা, যা বলে বেশি করে শাকসবজি, ডাল ও উদ্ভিদভিত্তিক প্রোটিন খেতে এবং চর্বি, লবণ ও চিনি কম খেতে।
কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সুবিধা নিয়ে বিতর্ক আরও বেড়ে যায়। কারণ, এ ধরনের অস্থিরতাই প্রমাণ করে দিয়েছে, আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা কতটা সহজে ভেঙে পড়তে পারে। এ ছাড়া এটা বেড়ে যাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। কারণ, মানুষ এখন অন্য দেশের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে। তবে জনস্বাস্থ্য ঠিক রাখতে চাইলে একটি স্থিতিশীল খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করা খুবই জরুরি প্রতিটি দেশের জন্য।
সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, সায়েন্স অ্যালার্ট