নেদারল্যান্ডস কীভাবে সাইকেলের দেশ হয়ে উঠল

সাইকেলের দেশ নেদারল্যান্ডসএক্সপ্যাটিসিয়া ইন্টারন্যাশনাল

পৃথিবীতে এমন এক দেশ আছে, যেখানে শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই সাইকেল ব্যবহার করতে পছন্দ করে। এমনকি দেশটির জনসংখ্যার তুলনায় সাইকেলের সংখ্যা বেশি। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭৮ লাখ, আর সাইকেলের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ। মানে, এই দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক সাইকেল আছে।

দেশটির নাম নেদারল্যান্ডস। নেদারল্যান্ডসে সাইকেলের দেখা বেশি পাওয়া যায় রাজধানী আমস্টারডামে। এটি ‘সাইকেলের শহর’ বা ‘বিশ্বের বাইসাইকেলের রাজধানী’ নামেও পরিচিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে গাড়ির পাশাপাশি সাইকেল ব্যবহার করা হতো। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখা যায় ভিন্ন পরিস্থিতি। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ তখন নিজেদের পুর্নগঠনে ব্যস্ত ছিল। নেদারল্যান্ডসও নিজেদের আর্থিক ও দেশের কাঠামোর উন্নয়নে কাজ করেছে।

অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির পাশাপাশি মানুষের রুচির পরিবর্তন হতে থাকে। সাইকেল বাদ দিয়ে মানুষ বেছে নিতে শুরু করে মোটরগাড়ি। ফলে বাড়তে থাকে গাড়ির সংখ্যা। তবে ১৯৬০–এর দশকের শেষের দিকে গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে সড়ক দুর্ঘটনা। তারপর এই দেশে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিলে মানুষ ধীরে ধীরে গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে শুরু করে। এরপর পরিস্থিতি বদলে যায়। আবারও গাড়ির জায়গা দখল করতে শুরু করে সাইকেল।

আরও পড়ুন

১৯৬০-এর দশকে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির ফলে শুরু হয় ‘স্টপ দ্য চাইল্ড মার্ডার’ বা শিশুহত্যাবিরোধী আন্দোলন। পাশাপাশি ১৯৭৩ সালের তেলসংকট ডাচদের আবার সাইকেলমুখী হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এভাবে নেদারল্যান্ডসে সবাই সাইকেলমুখী হতে শুরু করে। তৈরি হয় সাইকেলবান্ধব পরিবেশ। নগর প্রশাসন সাইকেলের জন্য আলাদা লেন তৈরিতে মনযোগ দেয়। চলার সুবিধার জন্য মানুষ সাইকেলকে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।

১৯৭০–এর দশকে এসে দেশের সরকার দেশটিকে সাইকেল বান্ধব করার পরিকল্পনা শুরু করে। অবকাঠামো আর রাস্তাগুলো হতে শুরু করে সাইকেল উপযোগী। যা ধীরে ধীরে পুরো দেশকে সাইকেল উপযোগী করে তোলে।

সবখানেই যেন সাইকেলে চড়ে যাওয়া যায়, সে কথা মাথায় রেখে কমিয়ে আনা হয় দূরত্ব। আবাসিক এলাকা থেকে স্কুল, হাসপাতাল, শপিংমল, অফিসগুলো এমন দূরত্বে বানানো হয়, যেন সহজেই সেখানে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া যায়। দূরবর্তী যাত্রার জন্য বাস ও ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত যাওয়া যায় সাইকেলে। এতে করে সাইকেল ব্যবহার হয়ে ওঠে সহজ। সড়ক দুর্ঘটনার হারও কমতে থাকে।

আরও পড়ুন

নেদারল্যান্ডসে সাইকেল দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত পরিবহন মাধ্যম। যেখানে প্রায় ৩৬ শতাংশ ডাচ মানুষ প্রতিদিন ভ্রমণের মাধ্যম হিসেবে সাইকেল ব্যবহার করে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার হয় ৪৫ শতাংশ। গণপরিবহন ১১ শতাংশ। দেশব্যাপী সব ভ্রমণের (শহর ও গ্রামে) ২৭ শতাংশ সাইক্লিং করে এ দেশের মানুষ।

দূরত্বের ওপর নির্ভর করে ডাচরা বিভিন্ন ধরনের সাইকেল ব্যবহার করে। ছোটদের জন্য আলাদা সাইকেল, তরুণ-তরুণীদের জন্য আলাদা সাইকেল। প্রবীণদের জন্য আছে বিশেষ আরামদায়ক সাইকেল। সাইকেলের বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে সবাইকে হার মানিয়েছে এই দেশটি।

নেদারল্যান্ডসের ইউট্রেখট সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে অবস্থিত ‘স্টেশনসপ্লেইন’ সাইকেল গ্যারেজটি হলো বিশ্বের বৃহত্তম সাইকেল পার্কিং লট। যেখানে প্রায় ১২ হাজার সাইকেল রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া আমস্টারডাম সেন্ট্রাল স্টেশনের ঠিক সামনে দুটি বিশাল আকারের আন্ডারওয়াটার বাইসাইকেল গ্যারেজ রয়েছে।

স্টেশনসপ্লেইন বাইসাইকেল গ্যারেজ বিশ্বের প্রথম পানির নিচে তৈরি সাইকেল পার্কিং সুবিধা, যা ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চালু হয়। এটিতে প্রায় ৭ হাজার সাইকেল রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এটি খালের নিচে পানির পৃষ্ঠ থেকে নয় মিটারের বেশি গভীরে অবস্থিত।

আরও পড়ুন

আরেকটি আন্ডারওয়াটার গ্যারেজ হলো আইজেবুলেভার্ড। এটি আইজে নদীর পাশে সেন্ট্রাল স্টেশনের অন্য দিকে অবস্থিত। এটিতে প্রায় ৪ হাজার সাইকেল রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এটি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হয়।

সাইকেলবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা ও সাইকেল চালানোর উৎসাহ বাড়ানোর জন্য আমস্টারডামে ‘বাইসাইকেল মেয়র’ নামে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আছেন। বেসরকারি সংস্থা বিওয়াইসিএস এই পদ তৈরি করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর আমস্টারডামে। ২০১৬ সালে আমস্টারডামের প্রথম বাইসাইকেল মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন আন্না লুটেন। এই ‘বাইসাইকেল মেয়র’-এর কাজ হলো সাইকেল চালাতে উৎসাহিত করা, এর সুবিধাগুলো তুলে ধরা এবং শহরে সাইক্লিং-সম্পর্কিত সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করা।

আরও পড়ুন