পায়ের নখ যেভাবে বাঁচাতে পারে জীবন
তুমি হয়তো জানো, রক্তদান করলে জীবন বাঁচে। কিডনি দান করলেও অনেকের উপকার হয়। কিন্তু জানো কি, তোমার পায়ের নখও একদিন কারো জীবন বাঁচাতে পারে? শুনতে অবাক লাগলে এটাই সত্যি। কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালগেরির বিজ্ঞানীরা এখন মানুষের পায়ের নখ সংগ্রহ করছেন। আর এর পেছনে রয়েছে এক চমকপ্রদ কারণ।
গল্পটা শুরু হয় একজন আইনজীবীকে দিয়ে। তার নাম এমি বসিও। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। টানা কিছুদিন কাশি হওয়ায় চিকিৎসকের কাছে গেলেন। পরীক্ষা করে যা জানতে পারলেন, তাতে তাঁর পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছিল। তাঁর ফুসফুসের ক্যান্সার হয়েছে। তাও আবার রয়েছে শেষ পর্যায়ে।
এমি বাসিও কখনো সিগারেট খাননি। পুষ্টিকর খাবার খেতেন, নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। মনে করতেন, তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার হতেই পারে না। পুরো ব্যাপারটা ছিল একদম মাথায় বাজ পড়ার মতো।
এমির মতো অনেকেই আছেন যারা কখনো ধূমপান করেননি। তবুও ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। কেন এমন হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা একটা লুকানো শত্রুর সন্ধান পেয়েছেন। তার নাম রেডন।
রেডন হলো এক ধরনের গ্যাস যা প্রকৃতিতে নিজ থেকেই তৈরি হয়। এর কোনো গন্ধ নেই, রঙও নেই। চোখেও দেখা যায় না। কিন্তু এটা তেজস্ক্রিয়, মানে এর থেকে ক্ষতিকর রেডিয়েশন বের হয়। ধূমপানের পরে ফুসফুসের ক্যান্সারের দ্বিতীয় বড় কারণ এই রেডন গ্যাস। বাড়ির মাটি থেকে এটা বের হয়ে ঘরের ভেতরে জমা হতে পারে। কেউ বছরের পর বছর এই গ্যাসের সংস্পর্শে থাকলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
সমস্যা হলো, কেউ বলতে পারে না যে তারা জীবনে কতদিন রেডন গ্যাসের সংস্পর্শে ছিল। ধূমপান করলে মনে থাকে যে কত বছর সিগারেট খেয়েছে। কিন্তু রেডন তো দেখাই যায় না। তাহলে মনে রাখবে কীভাবে? এ কারণে কানাডায় ফুসফুসের ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য যখন মানুষ স্ক্রিনিং করাতে যায়, তখন রেডনের ব্যাপারটা বিবেচনা করা যায় না। শুধু ধূমপানের ইতিহাস দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখানেই বিজ্ঞানীরা একটা চমৎকার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। আর সেটা লুকিয়ে আছে আমাদের পায়ের নখে।
ডক্টর অ্যারন গুডারজি একজন বায়োকেমিস্ট। তিনি ও তাঁর দল আবিষ্কার করেছেন, আমাদের পায়ের নখে দীর্ঘদিনের তথ্য জমা থাকে। নখ যেন আমাদের শরীরের একটা ডায়েরি। সেখানে লেখা থাকে আমরা কী কী বিষাক্ত জিনিসের সংস্পর্শে এসেছি।
ব্যাপারটা কীভাবে কাজ করে সেটা একটু বোঝা যাক। তুমি যখন শ্বাসের সঙ্গে রেডন গ্যাস টেনে নাও, তখন সেটা খুব দ্রুত একধরনের তেজস্ক্রিয় সীসায় রূপান্তরিত হয়। তোমার শরীর এই সীসাকে অন্য সব সীসার মতোই মনে করে এবং তা চামড়া, চুল ও নখে জমা হয়। তাই নখ পরীক্ষা করলে বোঝা যায়, তুমি জীবনে কতটা রেডনের সংস্পর্শে এসেছ।
গবেষকেরা এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল নামে একটা বৈজ্ঞানিক জার্নালে সম্প্রতি তাঁদের প্রাথমিক গবেষণা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, পায়ের নখে তেজস্ক্রিয় সীসা মেপে দীর্ঘমেয়াদী রেডনের সংস্পর্শ নির্ণয় করা সম্ভব।
তাঁরা এই প্রাথমিক গবেষণার জন্য কানাডার ‘ইভিক্ট রেডন ন্যাশনাল স্টাডি’ নামে একটা বড় প্রকল্পে অংশ নেওয়া হাজার হাজার মানুষের মধ্য থেকে কিছু মানুষকে বেছে নিয়েছিলেন। স্বেচ্ছাসেবীদের পায়ের নখের কাটা অংশে সীসার আইসোটোপ মেপে দেখেছেন এবং প্রমাণ করেছেন, এটা সত্যিই কাজ করে।
এখন তাঁরা আরও বড় একটা গবেষণা করতে চান। এর জন্য পুরো কানাডা থেকে প্রায় দশ হাজার মানুষের পায়ের নখ সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করছেন। যারা এই গবেষণায় অংশ নেবেন, তাদের প্রথমে নিজেদের বাড়িতে রেডন গ্যাসের মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। তারপর তাদের পায়ের নখের কাটা অংশ সংগ্রহ করে পাঠাতে হবে বিশ্লেষণের জন্য।
এই গবেষণা সফল হলে কানাডায় ক্যান্সার প্রতিরোধের ভবিষ্যৎ ছবিটাই পাল্টে যেতে পারে। এই তথ্য থেকে এমন প্রমাণ পাওয়া যাবে যা আরও বেশি রোগীকে জীবন বাঁচানো প্রাথমিক স্ক্রিনিং এবং রোগনির্ণয়ের আওতায় আনতে পারবে। বিশেষ করে যাদের ফুসফুসের ক্যান্সার ধূমপানের কারণে হয়নি।
প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, কানাডায় যারা ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, তাদের পাঁচজনের মধ্যে দুইজন বর্তমান স্ক্রিনিং পদ্ধতির আওতায় আসেন না। আর অর্ধেক রোগী তো কখনো সিগারেটই খাননি। বাকি অর্ধেক হয়তো খুব কম খেয়েছেন বা অনেক আগে খেয়েছেন। তাই শুধু ধূমপানকে ক্যানসারের কারণ বলা যায় না।
ভাবো তো, তোমার পায়ের নখের কাটা অংশ, যেটা তুমি নিয়মিত ফেলে দাও, সেটা একদিন কারো জীবন বাঁচাতে পারে। বিজ্ঞান কত আশ্চর্য, তাই না? এই গবেষণা সফল হলে অনেক মানুষ আগে থেকে সতর্ক হতে পারবেন। তাঁরা হয়তো জানতেনই না যে তাঁরা ঝুঁকিতে আছেন। আর প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পড়লে সারিয়ে তোলার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যাবে।
এমির মতো মানুষদের জন্য এটা আশার আলো। যারা কোনো বদাভ্যাস ছাড়াই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাদের জন্য এই গবেষণা নতুন পথ খুলে দিতে পারে। আর তোমার মতো সাধারণ মানুষদের ছোট্ট একটা অবদান, অর্থাৎ পায়ের নখের কাটা অংশ সেই পথ তৈরিতে সাহায্য করতে পারে।
সূত্র: পপুলার সায়েন্স