বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত ১০ দেশ

একটি দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে অনেক সময় বৈদেশিক ঋণ নেওয়া জরুরি হয়ে পরে। কিন্তু এই ঋণের বোঝা যখন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়, তখন তা অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে।

যুদ্ধের কারণে, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কিংবা বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন দেশ ঋণ নিতে বাধ্য হয় অনেক দেশ। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের ঋণ পরিমাপ করা হয় জিডিপির শতাংশ হিসাবে। এই ঋণের পরিমাণ যখন জিডিপির তুলনায় অতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন সেই দেশগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

বিশ্বে এমন কিছু দেশ আছে যারা ঋণের ভারে জর্জরিত। এর মধ্যে কিছু শক্তিশালী দেশের নামও রয়েছে। চলো জেনে নেওয়া যাক, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত ১০ দেশ কোনগুলো ও এই দেশগুলোর পরিস্থিতি কেমন। এই তালিকাটি ফোকাস ইকোনমিক্সের থেকে প্রকাশিত। বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের থেকে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

১. জাপান

বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশের তালিকায় সবার ওপরে আছে জাপান
ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশের তালিকায় সবার ওপরে আছে জাপান। দেশটির ঋণ জিডিপির প্রায় ২৪২ শতাংশের বেশি। ১৯৯০ সালের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে জাপানের সরকার ব্যাপকভাবে খরচ করতে শুরু করে। যা এই বিশাল ঋণের মূল কারণ। পাশাপাশি, বয়স্ক জনসংখ্যার কারণে স্বাস্থ্যসেবা ও পেনশনের খরচও অনেক বেড়েছে।

এত বিশাল ঋণ থাকা সত্ত্বেও জাপানের অর্থনীতিতে এটি বড় কোনো সমস্যা তৈরি করছে না। কারণ বেশিরভাগ ঋণই দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া। তবে যদি ভবিষ্যতে সুদের হার বেড়ে যায়, তাহলে এই ঋণ শোধ করার খরচ বেড়ে যাবে। যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

আরও পড়ুন

২. সিঙ্গাপুর

২০২৫ সালে সিঙ্গাপুরের সরকারি ঋণ জিডিপির প্রায় ১৭৩ শতাংশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এটি কোনো অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে হয়নি। এমনটা হয়েছে সরকারের একটি পরিকল্পিত নীতির কারণে। আর্থিক বাজারকে উন্নত করতে ও বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পে সহায়তা করার জন্য সিঙ্গাপুর কৌশলগতভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ইস্যু করে। অন্যান্য ঋণগ্রস্ত দেশের মতো এই ঋণ না। সিঙ্গাপুরের বিশাল বাজেট ও বৈদেশিক রিজার্ভ বজায় রাখে এই ঋণ। তাই এই উচ্চ ঋণ এই দেশে কোনো আর্থিক চাপ তৈরি করে না।

৩. ইরিত্রিয়া

পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটির সরকারি ঋণের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ২১০ শতাংশ। দীর্ঘস্থায়ী সামরিক সংঘাত, বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা ও কঠোর অর্থনৈতিক নীতির কারণে এই বিশাল ঋণ তৈরি হয়েছে। এসব কারণে উৎপাদনশীল খাত থেকে শ্রম ও বিনিয়োগ কমেছে এবং চীনসহ অন্যান্য ঋণদাতার ওপর দেশটির নির্ভরতা বেড়েছে। এসব কারণেই দেশটির উচ্চ ঋণ একটি বড় অর্থনৈতিক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে বাধা দিচ্ছে ও দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে তুলছে সেখানে।

আরও পড়ুন

৪. গ্রিস

২০০৯ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর গ্রিস বিশাল ঋণের জালে জড়িয়ে পরে। তাদের ঋণ জিডিপির প্রায় ১৪৯ শতাংশ। অর্থনৈতিক সংস্কারের পরও দেশটি এখনো এই সংকট থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। তবে দেশটির সরকারের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিচক্ষণ নীতির কারণে ঋণের বোঝা ৫০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে।

৫. ইতালি

দেশটির ঋণ জিডিপির ১৩৮ শতাংশের বেশি
ছবি: এএফপি

ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইতালির ঋণ অনেক বেশি। দেশটির ঋণ জিডিপির ১৩৮ শতাংশের বেশি। সরকারের ধারাবাহিক বাজেট ঘাটতি ও ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই ঋণের প্রধান কারণ। দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ ব্যয়ের কারণে আগামী বছরগুলোতেও ইতালির সরকারি ঋণ বেশি থাকবে।

আরও পড়ুন

৬. সুদান

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গৃহযুদ্ধের কারণে সুদানের অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। দেশটির ঋণ জিডিপির প্রায় ১২৮ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ সংঘাত এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা দেশটির ঋণ পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। এই ঋণের বোঝা দেশের অবকাঠামো ও জনসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগকে সীমিত করেছে।

৭. বাহরাইন

২০২৫ সালে বাহরাইনের সরকারি ঋণ জিডিপির প্রায় ১৩১ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০১৪-২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমে যাওয়ায় দেশটির রাজস্ব কমে যায়, যা এই বিশাল ঋণের মূল কারণ। পাশাপাশি আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার কারণে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধিও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

আরও পড়ুন

৮. মালদ্বীপ

বর্তমানে দেশটির আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় আছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

মালদ্বীপের সরকারি ঋণ জিডিপির প্রায় ১২৫ শতাংশ। এই ঋণের মূল কারণ হলো চীন-মালদ্বীপ মৈত্রী সেতুর মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী অবকাঠামো প্রকল্প ও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পর্যটন খাতে বড় ধরনের ধস। এই মহামারির ধাক্কা সামলাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ খরচ করতে হয়েছিল। তবে বর্তমানে শক্তিশালী পর্যটন রাজস্ব ও ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে পাওয়া আর্থিক সহায়তা দেশটির আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করছে।

৯. যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ জিডিপির ১২৪ শতাংশেরও বেশি। সামরিক খাতে বিশাল ব্যয়, সরকারি বাজেট ঘাটতি ও মহামারির সময় অর্থনৈতিক প্রণোদনা এই ঋণের প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী বছরগুলোতে জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি থাকবে ও তাদের সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।

আরও পড়ুন

১০. ফ্রান্স

প্যারিস, ফ্রান্স
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউরোপের আরেকটি শক্তিশালী দেশ ফ্রান্সের ঋণও বেশ বেশি। দেশটির ঋণ জিডিপির প্রায় ১১৬ শতাংশ। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ও বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের জন্য এই ঋণ বেড়েছে। এই বিশাল ঋণের বোঝা সরকারের আর্থিক ক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। যা নতুন বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজে বাধা তৈরি করছে।

বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়

এখন আসা যাক বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ঋণের দিকে। ২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের সরকারি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ ট্রিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ১১.৫৮ ট্রিলিয়ন টাকা হলো দেশের অভ্যন্তর থেকে নেওয়া ঋণ। বাকি ৮.৪২ ট্রিলিয়ন টাকা হলো বৈদেশিক ঋণ। এই ঋণের ফলে দেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৩৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সিইআইসি ডেটার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ১০৩.৭৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সূত্র: ফোকাস ইকোনমিক্স, ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ

আরও পড়ুন