মানুষ প্রথম আগুন জ্বালানো শিখেছিল কবে, নতুন তথ্য
মানুষের ইতিহাসে আগুন জ্বালানো সবচেয়ে বড় আবিষ্কারগুলোর একটি। এটি এমন এক সক্ষমতা, যা মানুষের সভ্যতা গড়ে দিয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রচলিত ধারণার বহু আগে মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। এমন তথ্য জানা গেছে ব্রিটেনের সাফোক কাউন্টির এক শান্ত গ্রাম বারনহামের মাটির নিচে পাওয়া নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে। এতদিন ধারণা করা হতো, মানুষ প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে আগুন তৈরি করতে শিখেছিল। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, এই দক্ষতা আসলে চার লাখ বছর আগেই অর্জিত হয়েছিল। অর্থাৎ আগের ধারণার চেয়ে প্রায় তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার বছর আগে মানুষের হাতে এই সক্ষমতা এসেছে।
প্রাচীন মানুষেরা বনের আগুন ব্যবহার করত, তা জানা ছিল বহুদিন ধরে। কিন্তু মানুষ নিজেরাই আগুন জ্বালাতে পারত, এমন সবচেয়ে পুরোনো ও নিশ্চিত প্রমাণ এতদিন মিলেছিল ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলে, মাত্র ৫০ হাজার বছরের পুরোনো এক স্থানে। সেই ধারণাকেই বদলে দিচ্ছে সাফোকের এই আবিষ্কার। আগুনে পোড়া মাটির দাগ ও আগুনে ফেটে যাওয়া হাতকুড়াল পাওয়া গেছে এখানে। এই থেকে জানা যাচ্ছে, মানুষ তখনই নিয়ন্ত্রিত আগুন ব্যবহার করতে পারত। যখন মানুষের মস্তিষ্কের আকার আধুনিক মানুষের কাছাকাছি ছিল। সে সময়ে উত্তরের ঠান্ডা অঞ্চলে সে সময়ের মানুষেরা নতুন বসতি গড়তে শুরু করেছিল।
এই আগুন জ্বালিয়েছিল কারা? বিজ্ঞানীদের ধারণা, বারনহামে আগুন জ্বালানো সেই দলটি ছিল প্রাচীন নিয়ান্ডারথালদের। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের পুরোনো সময় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রব ডেভিস বলছেন, ‘প্রভাবটা সত্যিই অসাধারণ। আগুন জ্বালানো ও আগুন নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মানুষের সবচেয়ে বড় ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তগুলোর একটি। এই আগুন মানুষকে শুধু উষ্ণতা, আলো বা নিরাপত্তা দেয়নি, পুরো জীবনযাপনের ধরন বদলে দিয়েছে।’
মানুষ আগুনকে আয়ত্ত করতে পারায় সমাজবদ্ধ জীবন শুরু হয়। অন্যকে গল্প বলা, ভাষার উদ্ভব, সবকিছু সম্ভব হয়। আগুন ছিল রাতের অন্ধকারে আলো, ঠান্ডার বিরুদ্ধে উষ্ণতা, আর খাদ্য রান্নার শক্তি। কাঁচা খাবারের বদলে সেদ্ধ বা ভাজা খাবার মানুষের শরীরে শক্তি জোগাতে শুরু করে। ফলে মানুষ বড় আকারে দলবদ্ধ হয়ে নিরাপদে বসবাস করতে শুরু করে।
সাফোকের বারনহামের পরিত্যক্ত কাদাখনিতে প্রথম পাথরে হাতিয়ার মিলেছিল ঊনিশ শতকের শুরুর দশকে। বিজ্ঞানীরা আবার এখানে ২০১৩ সালে অনুসন্ধান করেন। ‘পাথওয়েজ টু এনশিয়েন্ট ব্রিটেন’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে এখানে গবেষণা করা হয়। দীর্ঘ গবেষণায় ছোট ছোট সূত্র মিলতে থাকে। ২০১৪ সালে আগুনের দাগের প্রথম চিহ্ন দেখা গেলেও তখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি, এটা কি প্রাকৃতিক আগুনের ফল, নাকি মানুষের বানানো চুল্লি?
ঘটনার মোড় ঘুরে যায় যখন মেলে দুই টুকরো লোহার পাইরাইট, যেটিকে ফ্লিন্ট পাথরের সঙ্গে আঘাত করলে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বারনহামের স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডে ৩৩ হাজার নমুনা থাকার পরও কোথাও পাইরাইট পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, এই পাথরটি মানুষ দূরের কোনো উপকূলীয় অঞ্চল থেকে এনেছিল, বিশেষভাবে আগুন তৈরি করার জন্য।
এই প্রমাণের সঙ্গে মেলানো হয়েছে আগুনে তপ্ত হয়ে লাল হয়ে যাওয়া মাটির স্তরকে। ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপে বারবার পোড়ানো হয়েছিল মাটিকে। এটিই এক জায়গায় বহুবার আগুন জ্বালানোর নিশ্চিত প্রমাণ।
কানাডার কুইবেকের প্রত্নতত্ত্ববিদ সেগোলেন ভানদেভেলদে এই গবেষণাকে বলছেন, ‘এটাই এখন পর্যন্ত মানুষের আগুন তৈরি করার সবচেয়ে পুরোনো দৃষ্টান্ত।’
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান