ওষুধ খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কেন

ওষুধ খেলে হতে পারে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াছবি: পেক্সেলস ডটকম

বয়সে টিংকু বেশ ছোট। এত ছোট যে মাঝেমধ্যে টিংকুর দাঁত পড়ে। একবার বিড়াল টিংকুকে আঁচড়ে দিল। চিকিৎসক বললেন যে র‌্যাবিসের ভ্যাকসিন দিতে হবে। ভ্যাকসিন দেওয়া হবে চার দিন। টিংকুকে সেটা জানানো হলো। প্রথম দিন টিকা দেওয়ার পর অভিযোগ করা শুরু করল টিংকু। টিকাকে ও বলে লাল পিঁপড়ার কামড়। লাল পিঁপড়ার কামড়ে ওর নাকি শরীর জ্বালাপোড়া করে। তাই ও টিকা দিতে চায় না। টিকার তারিখ এলেই না যাওয়ার জন্য নানা রকম টালবাহানা করে। কারণ, প্রথম দিন টিকা দেওয়ার পর টিংকুর জ্বর চলে এল।

চিকিৎসক বললেন, জ্বর আসা মানে হলো টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যাপারটা আবার কী? এ ব্যাপারে জানা না থাকলে তোমার ভ্রু কুঁচকে যেতেই পারে। আর জানা থাকলে তো হলোই। নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ তৈরি করা হয়। ওষুধ খেলে বা ব্যবহার করলে রোগ সেরে যায়। মানে ওষুধ খুব কার্যকর। তবে এই কাজের বাইরে কখনো কখনো অন্য ওষুধের অন্য রকম প্রভাবও দেখা যায়। এই অন্য প্রভাবই হলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

চেষ্টা করলে তুমিও মনে করতে পারবে। তোমার চারপাশের কারও কথা মাথায় এল? জটিল কোনো রোগের ওষুধ খেয়েছে। দেখা গেল র‌্যাশ উঠেছে শরীরে। লাল হয়ে গেছে। ওষুধ তৈরির সময় চেষ্টা করা হয়, যেন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যথাসম্ভব মৃদু হয়। ক্ষতি যেন কমিয়ে আনা যায়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে ‘বড় স্বার্থে ছোট ত্যাগ’ বলতে পারো। আমরা চাই, রোগ ভালো হোক। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হোক। তবু মৃদু কিছু প্রতিক্রিয়া আমাদের মেনে নিতে হয়।

আরও পড়ুন

সব মানুষের জন্য একই ওষুধে কি সমান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়? উত্তর হলো, না। তোমার জন্য এক রকম। অন্যজনের জন্য প্রতিক্রিয়া হবে অন্য রকম। সব সময়ই প্রতিক্রিয়া হবে মৃদু। কখনো কখনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এত মৃদু হয় যে তোমার চোখেই পড়বে না। তবে সবার মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। ওষুধ খাওয়া অল্প কিছু মানুষের ক্ষেত্রেই এটা ঘটে। মৃদু প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে গুরুতর প্রতিক্রিয়া খুবই বিরল। ধরো, কোনো ওষুধের প্যাকেটে লেখা থাকল, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বিরল কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এই ওষুধের প্রভাবে মারাতত্মক শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

উপসর্গ আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আলাদা। ডাক্তারই বলতে পারবে তোমার কী হয়েছে।
ফাইল ছবি

ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করা যাক। আমাদের শরীর খুব জটিল একটা যন্ত্র। শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় প্রদাহ বা অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য যে ওষুধ তৈরি করা হয়, সেটা শুধু ওই অংশে কাজ করে। অন্যান্য অঙ্গকে প্রভাবিত করে না। যেমন কিডনি জটিলতার ওষুধ হাঁটুর ব্যথায় কাজ করে না। আবার ওষুধ তৈরি করাও জটিল। কারণ, কোনো দুইজন মানুষ একই রকম নয়। তাই যে ওষুধের কার্যত কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, কিছু মানুষের জন্য সেটাও হতে পারে জটিল। বর্তমানে যেসব ওষুধ পাওয়া যায়, সেগুলো প্রায় নিখুঁত। ইতিহাসের যেকোনো সময়ের তুলনায় সেগুলো উন্নত। ভালো কাজ করে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব কম। আধুনিক ওষুধ খুব নিরাপদ ও কার্যকর।

আরও পড়ুন

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার কয়েকটি কারণ আছে। কখনো কখনো ওষুধ তৈরির সময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্দিষ্ট প্রভাব তৈরি হয়। যেমন রক্ত পাতলা করার জন্য বানানো ওষুধ হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। এতে রক্ত জমাট বাঁধার সম্ভাবনা কমে। তখন শরীরে কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত বন্ধ করতে বেশি সময় লাগে। এতে বেশ ক্ষতিও হতে পারে। এটাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

তোমার শরীরের প্রক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহৃত হয় এমন রাসায়নিককে লক্ষ্য করে কাজ করে অনেক ওষুধ। কখনো কখনো শরীরের একটি উপাদান বা একই রাসায়নিক একাধিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। একটি ওষুধ ওই উপাদানকে প্রভাবিত করলে দেখা দিতে পারে একাধিক প্রভাব। যেমন বিটা ব্লকার (কার্ডিওলজিস্টরা এই ওষুধ বেশি দেন) তোমার শরীরের বিভিন্ন অংশে স্ট্রেস হরমোন অ্যাড্রেনালিন ও নোরাড্রেনালিনের নিঃসরণকে বাধা দেয়। এটি হৃৎস্পন্দনকে ধীর করে, কমাতে পারে রক্তচাপও। এর মানে হলো, এটি রক্তচাপ কমানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। কিন্তু যদি তোমার রক্তচাপ স্বাভাবিকই থাকে এবং তুমি তোমার হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করতে এটি গ্রহণ করো, তাহলে রক্তচাপ কমানোর প্রভাবে মাথা ঘুরতে পারে।

আরও পড়ুন

টিংকুর ক্ষেত্রে প্রথম টিকা দেওয়ার পর হালকা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ব্যবহার শুরুর পর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার আর অসুবিধা হয়নি। কারণ, আমরা প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাই। কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আবার পুরোপুরি বোঝা যায় না। যেমন, সাম্প্রতিক কিছু ওষুধ ওজন বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু শুধু ওষুধটা সেবনের কারণেই ওজন বেড়েছে, তা বলা যায় না বা যাচাই করা যায় না।

উপসর্গ আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিন্তু আলাদা

ওষুধ সেবনের আগে রোগের যে লক্ষণ দেখা যায়, সেটা উপসর্গ। ওষুধ খাওয়ার পর রোগ সেরে যাওয়া অবধি উপসর্গ থাকতে পারে। আর ওষুধ সেবনের পর ওষুধের প্রভাবে যে লক্ষণ দেখা যায়, সেটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কোনটি উপসর্গ আর কোনটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, সেটা জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এই পার্থক্য চট করে ধরা যায় না সব সময়। তোমার কেমন লাগছে, সেটা চিকিৎসককে জানানো জরুরি। যেমন ক্লান্তি লাগা বা ডায়রিয়া হওয়া, উভয়ই উপসর্গ বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। অনেক উপসর্গ অন্য কোনো কারণেও তৈরি হতে পারে। যদিও তোমার মনে হতে পারে যে এটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এটি পরীক্ষা না করে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তাই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ।

একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যদি ১০ জনের মধ্যে ১ জনের ঘটে, তাহলে এটি ‘খুব সাধারণ’ ঘটনা।
ছবি: প্রথম আলো

অনেক সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার লক্ষণ অসুস্থতার লক্ষণের মতোই। চিকিত্সার কারণে এই প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আবার ভিন্ন কোনো অসুস্থতার কারণেও হতে পারে। তাই নিজের লক্ষণ গুগল করা যাবে না। চিকিৎসককে লক্ষণ জানাতে হবে। যদি উপসর্গ অসুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তখন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার নানা রকম হার থাকে। যদি ১০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তার মানে ১০ জনের ভেতর ১ জনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যদি ১০ জনের মধ্যে ১ জনের ঘটে, তাহলে এটি ‘খুব সাধারণ’ ঘটনা। প্রতি ১০ হাজার জনের মধ্যে ১ জনের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তাকে বলা হয় বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

আরও পড়ুন

খুব সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো ১০ জনের মধ্যে ১ থেকে ১০ জনকেই প্রভাবিত করে। সাধারণ ১০০ জনের মধ্যে ১ থেকে ১০ জনকে প্রভাবিত করে। ‘অস্বাভাবিক’ বলা হবে যদি ১ হাজার জনে ১ থেকে ১০ জনকে প্রভাবিত করে। বিরল ১০ হাজার জনের মধ্যে ১ থেকে ১০ জনকে প্রভাবিত করে। ‘খুব বিরল’ ১০ হাজার জনের মধ্যে ১ জনেরও কম প্রভাবিত করলে বলা হবে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তথ্য কোথায় পাওয়া যায়?

সাধারণত প্রতিটি ওষুধের প্যাকেটের ভেতর একটি ভাঁজ করা কাগজ থাকে। সেখানে লেখা থাকে, কীভাবে আর কখন ওষুধটি ব্যবহার করতে হবে। খাবারের আগে না পরে নিতে হবে। সাধারণ বা গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না। অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে কি না।

কখনো কখনো এই কাগজে অনেক বিস্তারিত লেখা হয়। ছোট ছোট অক্ষরে অনেক কথা লেখা থাকে। শুধু সেগুলো পড়েই সিদ্ধান্ত না নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া নিয়ম। নিজে নিজে ওষুধ সেবন করা যাবে না, চিকিৎসকের পরামর্শে সেবন করতে হবে, এ কথাও লেখা থাকে। ওষুধ খাওয়ার আগে কাগজটি ভালোমতো পড়বে। আর অবশ্যই কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করবে না।

আরও পড়ুন

সতর্কতা: এই লেখাটি চিকিৎসাবিষয়ক কিছু না