ভবিষ্যতের চাকরির বাজারে টিকে থাকতে কী পড়বে
আজ থেকে মাত্র দশ বছর আগে ‘ইউটিউবার’ বা ‘অ্যাপ ডেভেলপার’ বলে কোনো পেশা ছিল না। কিন্তু এখন লাখো মানুষ এই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। ভবিষ্যতে কোন পেশায় সবচেয়ে বেশি যাবে মানুষ?
আগে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শেষে চিন্তা হতো, এরপর কী পড়ব? কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়লে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। প্রশ্নের উত্তর খোঁজা তুলনামূলক সহজ ছিল। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বা শিক্ষক—এগুলোই ছিল সবচেয়ে পরিচিত পেশা। কিন্তু এখন যুগ পাল্টেছে। পৃথিবী এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে আজ থেকে দশ বছর পর কী ধরনের নতুন চাকরি তৈরি হবে, তা আমরা কেউ জানি না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সালের বেশিরভাগ চাকরি নাকি এখনো তৈরিই হয়নি! তাহলে উপায়? এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা কোন বিষয় নিয়ে পড়ব? এই লেখায় সেসব বিষয় নিয়েই জানাব।
পরিবেশ রক্ষার বিপ্লব
চারদিকে তাপমাত্রা বাড়ছে। গরম হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। গলছে বরফ। বাড়ছে সমুদ্রের পানি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আগামী দিনে অনেক মানুষের দরকার হবে। অনেক দেশের সরকার আর বড় বড় কোম্পানিগুলো পরিবেশ বাঁচানোর জন্য অনেক টাকা খরচ করছে। তারা নতুন নতুন প্রযুক্তি আনছে। তাই বোঝাই যাচ্ছে, এই দিকে আগামী দিনে অনেক নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে।
তাই এখন যদি তুমি এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স নিয়ে পড়ো, তাহলে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংকে বলা যায় পৃথিবীর ডাক্তার। পরিবেশের সমস্যাগুলো খুঁজে বের করা আর তার সমাধান করাই এদের কাজ। এ বিষয়ে পড়লে তুমি এমন যন্ত্র বানাতে পারবে যা হয়তো বাতাস থেকে কার্বন শুষে নেবে। অথবা এমন সোলার প্যানেল ডিজাইন করতে পারবে যা রাতেও বিদ্যুৎ দিতে পারবে।
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সে পড়লে তুমি পরিবেশের সবকিছু নিয়ে জানতে পারবে। পরিবেশ নিয়ে যত ধরনের কাজ আছে, প্রায় সবকিছুর জন্যই তুমি তৈরি থাকবে। এর পাশাপাশি পাবলিক হেলথ নিয়ে পড়লে জানতে পারবে কীভাবে দূষণের কারণে মানুষের অসুখ প্রতিরোধ করা যায়। পরিবেশ খারাপ হলে মানুষের শরীরও খারাপ হবে। তাই ভবিষ্যতে পাবলিক হেলথের চাহিদাও বাড়বে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় স্বাগতম
তুমি কি কখনো গুগল অ্যাসিস্টেন্ট বা সিরির সঙ্গে কথা বলেছ? ওগুলোই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের প্রাথমিক রূপ। কিন্তু ওগুলো ভবিষ্যতে আরও অনেক শক্তিশালী হবে। এখনই মানুষের অনেক কাজ করে দিচ্ছে এআই। চীনে একটি হাসপাতালে রোবট ডাক্তার আছে। ভবিষ্যতে রোবট শিক্ষক হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। আর ভিডিও বানানো, লেখালেখি করা কিংবা আর্টের কাজ তো এখনই করছে! তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের কী হবে? তখন এআই বানানোর লোক লাগবে। এমনকি এআই নিয়ন্ত্রণ করার মানুষও দরকার হবে। তাই রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে তুমি হয়তো এমন রোবট বানাতে পারবে, যেটা বৃদ্ধদের যত্ন নেবে বা বিপজ্জনক কাজ করে দেবে। পাশাপাশি এআই যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেদিকেও যেতে পারো।
ডিজিটাল জাদুর জগৎ
এখন প্রায় সবাই গেম খেলে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি আসছে। সোশ্যাল মিডিয়ার রাজত্ব চলছে। কিন্তু মাত্র ১৫ বছর আগে ফেসবুক ছিল না, ইউটিউব ছিল না। এখন এগুলো আমাদের জীবনের অংশ। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ছাড়া একদিন কাটানোর কথাও অনেকে ভাবতে পারে না। আবার এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নতুন এক জগৎ। তাই ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো বিষয়ে পড়লে তুমি ভবিষ্যতে টিকে থাকতে পারবে।
ভিডিও গেমস এখন আর শুধু ছোটদের খেলার জিনিস নয়। এটা এখন হাজার হাজার কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি। সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলে। তাই গেম ডেভেলপমেন্ট বা গেম ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করলে তুমি এই মজার আর লাভজনক পেশায় ঢুকতে পারবে।
আমরা সারাদিন ইন্টারনেটে কি করি, কোথায় ঘুরছি, কী কিনছি, কী দেখছি, তার সবকিছুই কোথাও না কোথাও জমা হচ্ছে। এই বিশাল পরিমাণ তথ্যকেই বলে ‘বিগ ডেটা’। যারা এই বিগ ডেটা বিশ্লেষণ করে মানুষের পছন্দ-অপছন্দ বুঝতে পারে, তাদের চাহিদা এখন তুঙ্গে। খেয়াল করলে দেখবে, ফেসবুকে তোমার পছন্দের জিনিসই তোমার সামনে আসে। ইউটিউবে নিয়মিত খেলা দেখলে তোমার হোমে সবসময় খেলার খবর বা হাইলাইটস আসবে। এগুলো সবই ডেটার কাজ। তাই বিগ ডেটার কাজও শিখতে পারো।
বিশেষজ্ঞ হবে, নাকি সব কিছু একটু করে জানব
এতক্ষণের আলোচনার পরে তোমার মনে হতে পারে, আমি কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হব, নাকি সব বিষয়ে অল্প অল্প করে জানব? এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। কেউ কেউ বলেন, যেকোনো একটি বিষয়ে খুব গভীর জ্ঞান অর্জন করো। মানে বিশেষজ্ঞ হয়ে যাও। যেমন, এআই এক্সপার্ট হয়ে যেতে পারো কিংবা শিখতে পারো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। আবার কেউ কেউ বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান রাখা ভালো। কখন কোনটা কাজে লেগে যাবে, বলা তো যায় না!
তাই ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে না চাইলে এসব বিষয়ে ডিগ্রির পাশাপাশি সাধারণ কিছু দক্ষতা অর্জন করে রাখতে পারো। যেমন, সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা বা প্রবলেম সলভিং, গভীরভাবে ভাবার অভ্যাস বা ক্রিটিকাল থিংকিং এবং নতুন কিছু তৈরি করার বুদ্ধি বা ক্রিয়েটিভিটি। এই গুণগুলো যন্ত্র বা রোবটের পক্ষে নকল করা প্রায় অসম্ভব। তাই যে মানুষের মধ্যে এই দক্ষতাগুলো থাকবে, তাদের চাহিদা কখনো কমবে না।
শেখার কোনো শেষ নেই
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে হয়তো একবার গ্র্যাজুয়েশন করেই বসে থাকা যাবে না। আজীবন শিখতে হতে পারে। কারণ, তুমি শিখতে শিখতে হয়তো সেই বিষয়টা পুরাতন হয়ে যাবে। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও এটাই সত্যি। ধরো, তুমি কম্পিউটার সায়েন্স পড়ে একটা কোম্পানিতে চাকরি নিলে। পাঁচ বছর পর নতুন প্রযুক্তি এল। তাহলে তোমাকে টিকে থাকতে হলে আবার শিখতে হবে। এটা ভয়ের কিছু না। বরং রোমাঞ্চকর! তুমি সারাজীবন নতুন কিছু শিখতে পারবে। নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। প্রতিনিয়ত একই কাজ করলে একঘেয়েমি চলে আসে। কোনো কাজের প্রতি উত্তেজনা থাকে না। তাই নতুন জিনিস শিখলে কাজে আনন্দ পাবে।
এখন কী করব
এখন বেশি চিন্তা না করে যা পড়তে ভালো লাগে, সেটা পড়ো। আগ্রহ থাকলে যেকোনো বিষয়ে সফল হওয়া সম্ভব। তবে এখানে আলোচ্য ট্রেন্ডগুলোর কথা মাথায় রেখো। পরিবেশ, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য—এই ক্ষেত্রগুলোতে সুযোগ সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি সব সময় শেখার মানসিকতা রেখো। একবার ডিগ্রি নেওয়াই শেষ কথা নয়। শুধু চাকরির জন্য পড়াশোনা বা করে জানার জন্যও পড়া উচিৎ। শেখার মধ্যেও আনন্দ আছে। কিন্তু সেই আনন্দ খুঁজে নিতে জানতে হয়। একবার সেই আনন্দ খুঁজে নিতে পারলে, তোমার জন্যই ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করবে!
সূত্র:
১. কাপলান ইন্টারন্যাশনাল পাথওয়ে
২. ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম
৩. ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম
৪. এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ